কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম পাঞ্জাবের কীর্তি কিসান ইউনিয়ন-এর কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য রামিন্দর সিং পাটিয়ালার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় গ্রাউন্ডজিরো-র পক্ষে সুদর্শনা চক্রবর্তী।
প্র: এই কৃষক আন্দোলনের যে ধারা বা সাফল্য আগামী দিনে এ দেশের নাগরিকদের আন্দোলনে তার কোনও প্রভাব পড়বে কি? পড়লেও কীভাবে?
উঃ দেখুন, এই আন্দোলন এ দেশের মানুষদের অন্তত এটুকু উদ্ধুদ্ধ করবে যে তারা ভুল কোনও কথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিখুন। এটা একটা প্রভাব নিশ্চয়ই পড়বে। কারণ যবে থেকে মোদি জমানা শুরু হয়েছে উনি যেন মুখ বন্ধ করিয়ে রাখতে শুরু করেছিলেন। এক এক করে বহু প্রতিষ্ঠান (ইনস্টিটিউশন) যেন নতজানু হয়ে পড়ছিল। তো এই আন্দোলন তাদের আবার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়া করাবে। আপনাকে একটা উদাহরণ দিতে চাইব। গত কয়েক বছরে মনে হচ্ছিল দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্ট যেন কোনও নির্দেশের উপর কাজ করছে। চার জন বিচারক প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন এই বিষয়ে। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে আমাদের এমনটা উপলব্ধি হল যে, সুপ্রিম কোর্টেও যেন নতুন করে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। বিশেষ করে লখিমপুর খেরি ও অন্যান্য মামলায় যেভাবে দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় নিরপেক্ষতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেখে আমাদের মনে হচ্ছে এই সাহস বা এরকম প্রভাব যা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা কৃষক আন্দোলনের জন্যই সম্ভব হচ্ছে। দ্বিতীয় যে উদাহরণটি দিতে পারি যে, দিল্লির যন্তর-মন্তর যেখানে প্রতিবাদ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল, এই কৃষক আন্দোলনের ফলে যন্তর-মন্তরে প্রতিবাদ আন্দোলনের যে ধারা তা যেন আবার বেঁচে উঠেছে। গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রগুলি (ডেমোক্রেটিক স্পেস) যা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, এই আন্দোলন তা ফেরত পেতে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে এবং এ দেশের যে জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন তার উপর এর প্রভাব পড়তে চলেছে ও মানুষ আবার রুখে দাঁড়াবেন এবং নিশ্চিতভাবেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে চলেছে।
প্র: এক বছর – দীর্ঘ একটা সময়। এত লম্বা সময় ধরে কোনও একটা আন্দোলন এ দেশে গত কয়েক বছরে টানা চলেনি। একটু যদি বলেন, কীভাবে এই সময় ধরে কৃষক আন্দোলনের অভিমুখ বিভিন্ন সময়ে বদলেছে, নতুন নতুন জিনিস গ্রহণ করেছেন আপনারা, সরকারের সঙ্গে আলোচনার দিশা ঠিক করেছেন ইত্যাদি।
উঃ একটা জিনিস আমি প্রথমেই বলতে পারি দিল্লির সীমান্তে এই আন্দোলন আসে ২০২০-এর নভেম্বরের ২৬/২৭ নাগাদ। তার আগে এই আন্দোলন পাঞ্জাবে প্রায় তিন, সাড়ে তিন মাস চলেছে। জুনে অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার পর থেকেই প্রতিবাদ শুরু হয়ে গিয়েছিল। জুলাই থেকে তা আরও জোরদার হতে শুরু করে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় চার-সাড়ে চার মাস সময়ে এই আন্দোলন পাঞ্জাবে গড়ে উঠেছিল। যখন গড়ে উঠছিল, তখনও আমরা ভাবছিলাম যে যদি পাঞ্জাব থেকে বেরোতে না পারে, কারণ সারা দেশে তখনও সেভাবে কোনও আওয়াজ ওঠেনি – তাহলে আমাদেরও কাশ্মীরের মতো অবস্থা করা হবে। আমরা তখন ভাবছিলাম – ‘পাঞ্জাব আফটার কাশ্মীর’ – এমনটা হতে পারে। সেই হিসাবেও আমাদের কাছে রণনীতি ছিল। আমরা মাথা খাটিয়ে নানা কিছু বের করছিলাম। আবার পাঞ্জাব থেকে বের করার কথা যে ভাবছিলাম, পাঞ্জাবে এমন একটা আন্ডার কারেন্ট ছিল যে, এটা কেন্দ্রের আইন, আর এর বিরুদ্ধে দিল্লিতে গিয়েই আমাদের ‘মোর্চা’ লাগানো উচিত। তারপর আন্দোলন যখন একটা নির্দিষ্ট রূপ পেতে শুরু করেছে এবং যখন আমরা এলাম তত দিনে কিন্তু এই যে তার আগের চার, সাড়ে চার মাসের একটা ওয়েভ লেন্থ সেটা কাছাকাছি রাজ্যগুলোতে যেতে শুরু করে দিয়েছিল। আমরা এই আন্দোলনকে পাঞ্জাবের বাইরে নিয়ে গেলাম ও তারপর রণনীতি বদলাতে শুরু করে দিল। এরকম নয় যে আমরা খুব ‘ক্যালকুলেটেড’ ভাবে কোনও প্রক্রিয়া বেছে নিচ্ছিলাম। যেরকম যেরকম বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে আসতে শুরু করেছিল, নানান সমস্যা আসতে শুরু করেছিল, আমরা সেই অনুযায়ী পথ তৈরি করতে করতে এগিয়েছি।
ঠিক সেইভাবেই ২০২১-এর ২৬ জানুয়ারি যখন একটা চক্রান্ত হল ও আমাদের আন্দোলনের গতি কিছুটা নিম্নমুখী হল তখন তাকে সামাল দিতে আমরা খুবই স্পষ্ট পন্থা নিয়েছিলাম, সবাইকে জানিয়েছিলাম যে আমরা একটা চক্রান্তের শিকার হয়েছি এবং আন্দোলনের ভেতরে যে শক্তিগুলো ছিল যারা একে দিগভ্রান্ত করতে চাইছিল তাদের বিরুদ্ধেও খুব স্পষ্ট ‘পলিসি’ ও ‘স্ট্যান্ড’ নেওয়া হয়েছিল। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে টানা দু-আড়াই মাস আন্দোলনের ভেতরেই নৈতিক দ্বন্দ্বও চলেছে, ‘জটঠেবন্দী’-দের মধ্যে। একটা লম্বা দ্বন্দ্ব, তর্ক সেসবের পরেই কোনও একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। যখন যখনই মনে হয়েছে যে, আন্দোলনের গতি কোনওভাবে বাধা পাচ্ছে বা নিম্নমুখী হচ্ছে, তখনই তাকে আরও জাগিয়ে তুলতে, তার দিশা ঠিক রাখতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত বলা যেতে পারে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ের কথা। আমাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা এই সময়ে কী করা হবে সে বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন। আমরা অন্যদিকে ভাবছিলাম যে লকডাউন কখনোই কোভিড মোকাবিলার উপায় হতে পারে না এবং আন্দোলনের উপরেও এর প্রভাব পড়লে চলবে না। টিকাকরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর সরকার যাতে কাজ করে সে নিয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করাই আমাদের কাজ ছিল। প্রেশার গ্রুপ হিসাবে আমাদের কাজ করার ফলেই হরিয়াণার সরকার লকডাউন জনিত রেস্ট্রিকশন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আমাদের এই নিয়ে আন্দোলনের ভেতরেও টানা আলোচনা চলেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা একটা যুক্তিযুক্ত জায়গায় পৌঁছাই এবং করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সরকারকে তার জন্য চাপ দিয়ে তাদের থেকে টিকাকরণ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করতে পেরেছি এবং আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে গেছি। অন্যান্য রাজ্যও আমাদের থেকে নিশ্চিতভাবেই কিছু শিখতে পেরেছিল। তাছাড়া যখন কৃষক সংসদ হল, তখন আমরা অপোজিশন পার্টিদের জন্য পিপল হুইপ জারি করলাম। যাতে বর্ষাকালীন সংসদ অধিবেশনের অ্যাজেন্ডা আর টোন-ও যেন সেট হয়ে গেল। এই সময়েই বাধ্য হয়ে সরকার যন্তর-মন্তরে যে প্রতিবাদ-আন্দোলন নিষিদ্ধ করেছিল, তা সংশোধন করতে বাধ্য হল, ফলে যন্তর-মন্তরে আরও প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু হল। দিল্লির নাগরিকদের অনেকেই আমাদের বলেছিলেন, “আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিসর কৃষক আন্দোলন বাঁচিয়ে দিল।” এইভাবেই আন্দোলন চলছিল। নেগোশিয়েট আমরা করিনি। সরকার অনেক ষড়যন্ত্র করেছে আমাদের আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করতে, অনেক প্রোপাগ্যান্ডা চালিয়েছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল, কৃষকদের মধ্যে যে নিজেদের মধ্যের মেলবন্ধন ছিল, তাতে আমরা নিজেদের আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে দিশা ঠিক করে নিয়ে, নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে এগোতে পেরেছি। তাছাড়া এটা একদিক দিয়ে কৃষকদের অস্তিত্বের প্রশ্ন ছিল। এই তিনটি আইন তাদের জমিছাড়া করার আর শস্যের বাজারে কর্পোরেটের একচেটিয়া কারবার করার ব্যবস্থা পাকা করছিল। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে পাঞ্জাবে কৃষকদের সমাজে এটা জাতীয় আন্দোলন ছিল। এর মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন ছিল। পাঞ্জাবে এটা জাতীয় আন্দোলন ছিল, হরিয়াণায় কৃষকদের রাগ প্রকট হয়ে উঠেছিল এবং উত্তরপ্রদেশে এক গভীর অসন্তোষ ছিল। এইজন্য এর চেহারা তিনটি রাজ্যে একটু আলাদা হয়ে চোখে পড়ে। পাঞ্জাবে জাতীয় আন্দোলন হওয়ার কারণে পাঞ্জাবি সম্প্রদায়ের যে কেউ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাঞ্জাবি গোষ্ঠীর মানুষেরা জানেন যে বিষয়টা যখন অস্তিত্বের তখন তার সঙ্গে একটা ইমোশনাল বন্ডিং, আবেগের জোট তৈরি হয়ে যায়, তাই ‘বাঙ্গাল’ হোক বা ‘সাউথ’ বা বিদেশ, যেখানেই পাঞ্জাবি ছিলেন, তাদের মধ্যে একটা আবেগের যোগসূত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল আর তারা এই লড়াইটা জিততে চেয়েছিলেন। সেইজন্যই কখনও বিশ্বাসে চিড় ধরেনি, কখনও মনে হয়নি যে আমরা হেরে যেতে পারি – লড়াই যতই দীর্ঘ হোক, চলবে, জিতে ফিরব, আইন প্রত্যাহার করিয়েই ফিরব। শেষ আরেকটা কথা বলব, এত লম্বা লড়াই চালিয়ে যেতে আমাদের যে ‘লঙ্গর’-এর ভাবনা, গুরু নানকজি যার সূচনা করেছিলেন, ‘কমিউনিটি কিচেন’ বলা যেতে পারে, তা আমাদের ভীষণ সাহায্য করেছে। পাঁচ শতাব্দীর লঙ্গর চালানোর অভিজ্ঞতা, সেইসঙ্গে এখনও আমাদের গ্রামগুলোতে বছরে দু-তিন বার তো লঙ্গর হয়ই – তাই কমিউনিটি কিচেন কীভাবে চালাতে হবে, মানুষকে খাওয়াতে হবে সে বিষয়ে আমাদের মানুষদের একটা দীর্ঘ প্রশিক্ষণ আছে। এই ঐতিহ্য আমাদের অবস্থান আন্দোলনে ১৫/১৬ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা জুড়ে আন্দোলনরত কৃষকদের কীভাবে খাওয়াতে হবে তাতে দারুণ সাহায্য করেছে, যা এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ছয় মাস ছয় মাস করে আমরা আমাদের বন্দোবস্ত করে এগিয়েছি, কোনও অসুবিধা হয়নি – হেরে ফিরবো না, এটুকু নিশ্চিত ছিল। সরকার বুঝে গেছিল যে আমরা পিছু হঠবো না, আর এর যে রাজনৈতিক প্রভাব, তা তারা দেখতে পেয়েছিল হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনে। আপেল চাষীদের যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি আদানি গোষ্ঠী করেছিল আর প্রো-বিজেপি সমর্থকেরাও যেভাবে সরে আসছিল আর নির্বাচনে জামিন জব্দ হল তাতে কোন্ দিকে হাওয়া বইতে পারে, তারা বুঝতে পেরেছিল। এইসব কারণ মিলেই আইন প্রত্যাহার হল আর এই ঐতিহাসিক জয় এল।
প্র: আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন যে আলাদা আলাদা ‘জাঠটেবন্দী’দের মধ্যে বিভিন্ন কারণে মতানৈক্য থাকলেও এই একটি বিষয়ে তারা সহমত হয়েছিলেন এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনগুলি যে কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিষয়ে একজোট হয়ে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, সেই ছবি কি দেশের বৃহত্তর রাজনীতির আঙিনায় ভবিষ্যতে দেখা সম্ভব বলে মনে করেন?
উঃ অবশ্যই। যদি আমরা একটা সাধারণ লক্ষ্য স্থির করে নিতে পারি, যেমন এক্ষেত্রে ছিল তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হবে, এটি কৃষক আন্দোলন হবে এবং এতে কোনও ‘রাইট’, ‘লেফট’ হবে না। ফোকাস থাকবে একটিই বিষয়ের উপরে। যদি কেউ কখনও দিক বদলানোর চেষ্টা করেছেন, সবাই তাকে আবার বুঝিয়ে একই দিশায় নিয়ে এসেছে। সাধারণভাবে আমরা একটা কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম বানিয়েছিলাম এবং তার উপরেই সব কিছু স্থির হচ্ছিল। কেউ যদি কখনও এদিক-ওদিক করার চেষ্টা করেছে তো সেগুলিকে ঠিক করা হয়েছে। এভাবেই যদি জোটবদ্ধ কোনও লড়াইয়ের পরিকল্পনা করা হয়, যেটা ‘কমন’ হবে, যেখানে কেউ নিজেদের অ্যাজেন্ডা জোর করে ঢোকাবে না, নিশ্চয়ই নিজেদের চিন্তা-ভাবনার একটা প্রভাব তো থাকবেই, কিন্তু কমন মিনিমাম প্রোগ্রামে নিজের ভাবনাকেই একমাত্র সঠিক বলে চালানো চলবে না। যা আন্দোলনের জন্য সঠিক তাকেই সফল করার লক্ষ্য নিয়ে যদি এগোনো হয়, তবেই তা জোটবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঠিক হবে, কৃষক আন্দোলন থেকে অন্তত এই শিক্ষাটা নেওয়া যেতে পারে।
প্র: আপনার মনে হয় আগামী দিনে বামপন্থী দলগুলি এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃহত্তর রাজনীতির পরিসরে নিজেদের জোটবদ্ধ করতে পারবে?
উঃ আমি একটাই কথা বলব যে কোনও সংগঠনই হোক না কেন তারা যদি মানুষের আন্দোলন করতে চায়, মানুষের ইস্যু নিয়ে লড়াই করতে চায়, তাহলে আন্দোলনের স্বার্থে কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম নিয়েই এগোতে হবে। এবং বামপন্থী দলগুলি যদি আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোটবদ্ধ হতে চায়, সংসদীয় রাজনীতির জন্য শুধু নয়, তাহলে তা বামপন্থীদের জন্যও লাভজনক হবে।
প্র: সারা দেশের কৃষকদেরই এই আন্দোলনে সমর্থন ছিল। কিন্তু আমাদের যেন মনে হচ্ছিল পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ ভারতের যে প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের কৃষকেরা তাদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে একটু হলেও কম ছিল। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
উ: শুরুতেই একটা কথা বলতে চাই এই আন্দোলনে পাঞ্জাব নেতৃত্বের জায়গায় ছিল, কারণ যা বারবার বলছি সেখানে এটি একটি জাতীয় আন্দোলনের চেহারা পেয়ে গেছিল। অন্যান্য রাজ্যে এর মাত্রা যেমন ছিল তেমনি সেইসব রাজ্যে এর গভীরতা ও অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছিল। একে তো পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল থেকে অনেকটাই দূরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানকার বিভিন্ন রাজ্যে তারা নিজেদের মতো করে আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন কিছু সংগঠিত করেছিলেন। আমাদের পক্ষে এখান থেকে তার গভীরতা বোঝা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আরেকটা বিষয় হল অনেকেই বোধহয় শুরুতে এমনটা ভাবছিলেন যে এই তিনটি আইন শুধুমাত্র পাঞ্জাব ও হরিয়াণায় চালু হবে আর এমএসপি-ও আমাদের জন্য। সত্যিটা ছিল যে এই আইন বলবৎ করে সারা দেশের কৃষকদের জমিচ্যূত করার প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা করা হয়েছিল, বিশেষ করে ‘সারপ্লাস প্রডিউস’ হয় এমন জায়গায়। আসলে এমএসপি তো সারা দেশের কৃষকদের জন্যই জরুরি। এমএসপি নিয়ে দেশের কৃষকদের মধ্যে যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার ছিল, তা এই আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা করতে পেরেছি। এই যে সচেতনতা তৈরি হল, তার উপর নির্ভর করে এই রাজ্যগুলি তাদের নিজেদের কৃষক আন্দোলনকে কোন্ দিকে নিয়ে যেতে পারবে তা তো আগামী দিনেই বোঝা যাবে। এই আন্দোলনকে অবশ্যই বাড়াতে হবে। এ কথা ঠিক যে কৃষকদের মধ্যে অনেকগুলি স্তর আছে – ধনী, মধ্য আয়, প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের কৃষক। আমি পাঞ্জাবের একটা ছোট্ট সমীক্ষার কথা বলতে চাই – একজন অধ্যাপক এই আন্দোলন কেন্দ্রীক একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে ৭০০ জন কৃষক আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই হলেন প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের কৃষকেরা, অর্থাৎ এই অংশের কৃষকেরা অনেক বেশি ‘কমিটমেন্ট’ নিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পাঞ্জাবের এই ট্রেন্ড মনে রাখা দরকার যে অন্যান্য রাজ্যেরও।
প্র: পূর্ব ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের যে সরকার তাদের কী এক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে করছেন?
উঃ দেখুন, পাঞ্জাবেও যখন এই অর্ডিন্যান্স এসে পৌঁছায় সেখানকার সরকার ফুল নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল না। করোনা লকডাউনের সময় ছিল, শ’য়ে শ’য়ে কেস আমাদের বিরুদ্ধে জারি হয়েছে। অনেকেকেই জেলেও যেতে হয়েছে। কিন্তু যখন আন্দোলন ধীরে ধীরে গড়ে উঠল, পাঞ্জাব নির্বাচন কাছে এসে যাচ্ছিল, তখন তারা বুঝতে পারল যে এতে তাদের রাজনৈতিক ক্ষতি হতে চলেছে। আকালি-রাও প্রথমে আমাদের সঙ্গে ছিল না, কিন্তু যখন তাদের পায়ের তলা থেকেও সামাজিক ক্ষেত্রের জমি সরে যেতে থাকল, তখন তারাও অবস্থান বদলাল। বলা যায়, আমরা তাদের ফুল দিতে বাধ্য করেছি। আমি আগেই বলেছি যে আন্দোলন কীভাবে তৈরি হবে, কীভাবে এগোবে তা নিয়ে অন্য রাজ্যের নেতৃত্বকে ভাবতে হবে, সংসদীয় রাজনীতিতে লাভের কথা ভাবলে হবে না।
প্র: আন্দোলন চলেছে, কিন্তু পাশাপাশি কৃষক আত্মহত্যা, প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের কৃষকদের শোষন চলছেই। কৃষক আন্দোলনের জয় কী ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি কোনওভাবে পরিবর্তন করতে পারবে?
উঃ এই আন্দোলন ছিল যা ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছিল তাকে রক্ষা করার। এই আন্দোলন সম্পূর্ণ কৃষি সমস্যার (ক্রাইসিস) সমাধান নিয়ে আসার জন্য হয়নি, তার বাই-প্রোডাক্ট বলা যেতে পারে। এবার দেশের কৃষি মডেল কী হবে তা পাঞ্জাব সহ সারা দেশের আলোচনায় আসা দরকার। আত্মহত্যা আছে, কৃষিঋণের মারাত্মক চাপ রয়েছে। বুঝতে হবে গ্রিণ রেভোলিউশন-এর যে সাম্রাজ্যবাদী চেহারা তার ফলাফল এটা। এ দেশে প্রাকৃতিক, দীর্ঘমেয়াদী কৃষি মডেল কীভাবে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে এবার আলোচনা শুরু করতে হবে। কৃষি আন্দোলন থেকে ফেরার পরেই আমরা এ বিষয়ে মিডিয়ায় কথা বলেছিলাম। এমএসপি-কে এর সঙ্গে জুড়ে কীভাবে এগোতে হবে এবার কৃষক আন্দোলনের যে বুদ্ধিজীবী অংশ রয়েছেন তাঁরা এ নিয়ে চর্চা শুরু করবেন।
প্র: এই একই সময়ে এ দেশে লেবার কোড পাশ হয়ে গেল। শ্রমিকেরা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন দেশের নানা প্রান্তে চালালেও দেশ জুড়ে কোনও জোটবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। শ্রমিক ইউনিয়নগুলির ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। যদিও শ্রমিকেরা কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন, যোগ দিয়েছেন। কিন্তু জোরদার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে না ওঠার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন?
উঃ দেখুন, সত্যি কথা কথা হল কৃষক আন্দোলনের কারণে এখনও লেবার কোড চালু হয়নি। এই আন্দোলনের একটা ইতিবাচক প্রভাব এভাবেই সরাসরি শ্রমিকদের আন্দোলনের উপরে পড়েছে। এক্ষেত্রে এবারে ট্রেড ইউনিয়নদের স্পষ্ট ভূমিকা নিতে হবে। যেমন কৃষক আন্দোলনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত ছিল যে কৃষি আইন প্রত্যাহার মানে প্রত্যাহারই, কোনও সংশোধন নয়, সাময়িকভাবে ফিরিয়ে নেওয়া নয়। যদি ট্রেড ইউনিয়নদের মাথায় থাকে যে লেবার কোড শ্রমিকদের পক্ষে কিছুটা সংশোধন করে নেওয়া যাবে, তাহলে শ্রমিক আন্দোলন কোনও মজবুত জায়গায় পৌঁছাবে না। লেবার কোড চাই না বলে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে তাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর এই আন্দোলন গড়ে তুলতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট-বড়-মাঝারি যে কোনও ইউনিয়ন যদি এগিয়ে আসে তাহলে তাদের একটা যৌথ মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। এমনটা যেন না হয় যে দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব রইল ও বাকিদের স্রেফ সাথে নিল। কারণ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত শ্রমিক আন্দোলন কোনও কিছু আদায় করতে পারবে না। কৃষক আন্দোলন থেকে এটাই শিখতে হবে।
প্র: কৃষক আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা অভাবনীয় ছিল। তাঁরা শিখিয়ে দিয়ে গেলেন একটি পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর ভেতর থেকে উঠে এসেও তাঁরা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকতে পারেন। মনে করছেন যে সামাজিক কাঠামোয় এর কোনও প্রভাব পড়তে চলেছে? বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়াণা, উত্তরপ্রদেশের যে চরম পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সেখান থেকে আসা মহিলারা, নির্দিষ্টভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের এই যে আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান যা সমাজে বদল আনবে?
উঃ এ কথা সম্পূর্ণ সত্যি, মহিলারা সমাজের অর্ধেক ও তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আন্দোলনে সাফল্য আসত না। তারা এই আন্দোলনে একটা অন্য আবেগ যুক্ত করেছিলেন, তাদের যুক্ত হওয়ার ফলেই আন্দোলন অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল। সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনে এর নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু কত দিনে, কতটা, কীভাবে তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। এই তিন রাজ্যের কথা যে আপনি বললেন, অবশ্যই বদল আসবে। প্রশ্ন উঠবে। তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করা যাবে তা ভাবতে হবে। সংগঠন করে যারা আন্দোলন করে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। মহিলাদের অংশগ্রহণ তাদেরও অনেক কিছু নতুন শিখিয়েছে। নিজেদের ও অন্যান্য মহিলাদের জীবনে তারা কীভাবে এর প্রয়োগ করবেন তা দেখতে হবে। তবে নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।