চাষাবাদের সাথে যুক্ত একটা বড় অংশের মানুষের ভরসা এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলোই। কম সুদে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে পারেন চাষিরা। তবে বেসরকারি হলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমস্ত সুযোগ সুবিধার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হবেন। তখন তাঁদের আশ্রয় হবে একমাত্র মহাজন। পীযূষ দত্তের প্রতিবেদন।
রেল, বীমা, বিএসএনএলের পর এবার নজর ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের দিকে। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি, ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ জানান যে এই বছরের শেষে, শীতকালীন অধিবেশনে ব্যাঙ্কিং অ্যামেন্ডমেন্ট বিল (২০২১) পাশ করানো হবে। যার লক্ষ্য আপাতত দেশের দু’টি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্ককে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া। এবং তারই বিরুদ্ধে, গত ১৬ এবং ১৭ তারিখে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক ফোরামের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক কর্মীরা দু’দিন ব্যাপী ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ডাক দেন। এই দু’দিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বহু ব্যাঙ্ক কর্মীকে এই ধর্মঘটে সামিল হতে দেখা যায়। মোদী সরকারের আমলে, বেসরকারিকরণ যে একটা অন্যমাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যেই রেলে বেসরকারি ট্রেন চালানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র, তা স্পষ্ট করে দেয় যে রেলকে বেসরকারিকরণের দিকে ইতিমধ্যেই কয়েক পা এগিয়ে ফেলেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে, ট্রেন চলে ৬৪,০০০টি রুটে। জানা যায়, ২ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ গোটা ভারতে প্রতিদিন চলাচলের জন্য ট্রেন ব্যবহার করেন। সেখানে এই সরকারের ভাবনা, তারা সিমেনস লিমিটেড, অ্যালস্টম ট্রান্সপোর্ট ইন্ডিয়া লিমিটেডের মতো আরো ২৩টি কোম্পানিকে ট্রেন চালু করবার সুযোগ দেবে।
ইতিমধ্যেই এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার গল্প অজানা নয়। এবং এই তালিকায় দীর্ঘদিনের উজ্জ্বল নাম বিএসএনএল, জিও ফোর-জি-র মার্কেটে, এই সরকারি সংস্থাকে রুগ্ন করে কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোদী সরকারের মরিয়া চেষ্টা খালি চোখেই নজরে আসে। তবে বেসরকারিকরণের এই কোপ এবার সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে ছাড় দিতে রাজি নয় কেন্দ্রীয় সরকার। যেমনটা উপরেই বললাম। ব্যাঙ্কিং অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২১। ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ অ্যাক্ট ১৯৭০ এবং ১৯৮০ আরেকদিকে ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৯-কে পরিবর্তনের মাধ্যমে এই নতুন অ্যামেন্ডমেন্ট বিল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। সরকারের হাতে থাকা পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের দখল সরকার ৫১ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা করে এই বিলের মাধ্যমে।
এই প্রসঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে আরো ক’টি তথ্য। ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি হলে, কী কী সমস্যার সম্মুখীন হবে মানুষ? জানা যায়, বেসরকারি হলে, ভোক্তাকে সর্বনিম্ন ব্যালেন্স ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা বজায় রাখতে হবে, অন্যদিকে সরকারি ব্যাঙ্কে ব্যালেন্স রাখতে হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। এছাড়া ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ হলে অতিরিক্ত এটিএম চার্জ, এসএমএস চার্জ, সার্ভিস চার্জ বইতে হবে ভোক্তাকে। সরকারি ব্যাঙ্কে কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, বার্ধক্য ভাতা, স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট, জনধন অ্যাকাউন্ট এইসব অলাভজনক অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, অন্যদিকে বেসরকারি কোনও ব্যাঙ্ক কোনোভাবেই ভোক্তাদের এই সুযোগ দেয় না। কারণ এই সমস্ত অলাভজনক অ্যাকাউন্টে সেই অর্থে ব্যাঙ্কের কোনও লাভ থাকে না। ফলত, মুনাফা মাথায় রেখে চলা বেসরকারি ব্যাঙ্কের পক্ষে, দেশের গরিব মানুষকে ব্যাঙ্কিং সহায়তা দেওয়ার কোনও উপায় থাকে না।
কলকাতা স্টেট ব্যাঙ্কের সদর দপ্তরের সামনে এই দু’দিন দেখা যায় শয়ে শয়ে ব্যাঙ্কের কর্মী এসে উপস্থিত হয়েছেন। বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃত্বের পাশাপাশি মঞ্চে বামফ্রন্টের একাধিক নেতা এবং আইএসএফের মতো সংগঠনকেও উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। এসবিআই -এর প্রধান দপ্তরের কর্মী এবং এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, সুদীপ দত্তর সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে একাধিক বিষয়, “এই শীতকালীন অধিবেশনে সরকার ব্যাঙ্কিং অ্যামেন্ডমেন্ট বিল আনতে চাইছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ জানিয়েছেন যে তাঁরা দু’টি পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ককে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেবেন। যদিও এখনও ব্যাঙ্কগুলির নাম ঘোষণা করেননি। এবং এখানে আমাদের মত হল, যেহেতু প্রতিটা পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক আমাদের প্রফিট দেয়, অপারেটিং প্রফিট এবং নেট প্রফিট, তাই আমরা মনে করি সরকার এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কেটে ফেলতে চাইছে। আমরা এটা হতে দেব না, তাই আমরা আন্দোলনে নেমেছি।” তিনি আরো জানান, “যদি এই ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি সংস্থার হাতে চলে যায় তবে সাধারণ গরিব মানুষ এতদিন যা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছিলেন তা দেওয়া আর সম্ভব হবে না। সরকার যখন ডিমনেটাইজেশন করল তখন এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলিই সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো, কোনও বেসরকারি ব্যাঙ্ক আসেনি।” সুদীপ দত্তর মতে, কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক জনবিরোধী বিল নিয়ে আসবার চেষ্টা করে যাচ্ছে, শ্রমকোড থেকে এই ব্যাঙ্কিং অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, তাই আগামিদিনে বৃহত্তর আন্দোলন ছাড়া কোনও সমাধানের পথ অর্থমন্ত্রীর নজরে আসছে না।
এইদিন পুরুষ ব্যাঙ্ক কর্মীদের পাশাপাশি নজরে আসে বিপুল পরিমাণ মহিলা কর্মীদের অংশগ্রহণও, স্টেট ব্যাঙ্ক গোলপার্ক ব্র্যাঞ্চের কর্মী সুচরিতা চট্টোপাধ্যায় এ বিষয় জানান, “এটা তো সবার আন্দোলন, এখানে সবার থাকাটা জরুরি। আমাদের এখানে পুরুষদের পাশাপাশি বিশাল পরিমাণে মহিলা কর্মীরাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। এমনকি ভোক্তাদের একটা অংশকেও এই আন্দোলনে পাশে পাওয়া যাচ্ছে।”
কৃষক আন্দোলনের পর ‘মোদী বিরোধী আন্দোলন’ যে আরো ক’ধাপ এগিয়েছে এ বিষয় কোনও সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাওয়ায় ব্যাঙ্ককর্মী রুপম জানান, “কৃষক আন্দোলন আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যে অদম্য তাগিদের সাথে কৃষকরা দিনের পর দিন মাটি আঁকড়ে লড়াই করে গেল তার থেকে শিখতে আমরা বাধ্য।” এই আন্দোলনে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা বিষয় জানতে চাইলে, উনি জানান, “মুখ্যমন্ত্রীকে আমাদের তরফ থেকে আমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয়েছিল, উনি আমাদের চিঠির জবাব দিয়েছেন, জানিয়েছেন, কর্মব্যস্ততার কারণে উনি আসতে পারছেন না তবে উনি আমাদের আন্দোলনের পাশে আছেন।”
ফেব্রুয়ারি মাসের একটি ভাষণে মোদী তাঁর বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানান, ‘মনিটাইজ এবং মর্ডানাইজ’ এই স্লোগানকে সামনে রেখেই, তিনি নজর দিচ্ছেন আরো বেসরকারিকরণের দিকে। তাঁর মতে, কেন্দ্রের লক্ষ্য বেসরকারি সংস্থার থেকে ২.৫ ট্রিলিয়ান বিনিয়োগ আদায় করা। তাঁর মতে, বেসরকারি সংস্থার হস্তক্ষেপ দেশের পরিকাঠামোগত উন্নতিতেও সাহায্য করবে।
মোদী সরকারের এই ‘বেচে দেওয়া’র খেলা যে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উপর কোপ তা বুঝতে বাকি থাকে না। সরকারি ব্যাঙ্কই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে নির্দ্বিধায় সাধারণ মানুষ নিজের সঞ্চয় রাখেন, ঋণ নেন। চাষাবাদের সাথে যুক্ত একটা বড় অংশের মানুষের ভরসা এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলোই। কম সুদে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে পারেন চাষিরা। তবে বেসরকারি হলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমস্ত সুযোগ সুবিধার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হবেন। তখন তাঁদের একমাত্র আশ্রয় হবে সেই মহাজন।
পীযূষ দত্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।