একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।
গত ১২ তারিখ রাত ১১:৩০ টা নাগাদ, বকুলতলা থানার অন্তর্গত জীবন মণ্ডলের হাটের কাছে একটি বাড়ি থেকে তিন জন গণআন্দোলন ও সমাজকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই তিন জনের একজন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র তীর্থরাজ ত্রিবেদী, আরেকজন পলিটেকনিক ইন্জিনিয়ার আলফ্রেড ডিক্রুজ। তাদের সাথে থাকা আরেকজনও পলিটেকনিকের ছাত্র রাকেশ আলি। পরেরদিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ দুপুর ১টা নাগাদ পুলিশ, এলাকার বাসিন্দা বাবলু হালদার নামক আরেক যুবককে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য গ্রেফতারির সময় অভিযুক্তদের বাড়ির লোককে কোনোরকম অ্যারেস্ট মেমো বা কিছুই দেওয়া হয়নি।
পরেরদিন থানায় গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)-র জয়নগর শাখার দু’জন প্রতিনিধি গেলে তাঁদেরকে পুলিশের তরফ থেকে কোনোরকম তথ্য তো দেওয়াই হয় না, উপরন্তু ২-৩ ঘন্টা ধরে বিভিন্নরকম প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করা হয়। গ্রাউন্ডজিরোর পক্ষ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এপিডিআরের সম্পাদক আলতাফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “ওই তিন যুবক এলাকায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারের কাজ করছিল। পরেরদিন আমাদের দুই সদস্য অ্যারেস্টের বিষয় জানতে থানায় গেলে, তাঁদের দীর্ঘক্ষণ জেরা করে পুলিশ। তবে সেই সময় যে সামান্য কথা তারা সেই যুবকদের সঙ্গে বলতে পেরেছে তার থেকে জানা গেছে, গ্রেফতারির সময় সেই তিন যুবকের গায়ে হাত তোলে পুলিশ।”
জানা যায় সেই তিন যুবক ‘শ্রমিক কৃষক একতা মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের একটি লিফলেট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এলাকায় মায়াহাউরি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাঠামোগত অবস্থা বেহাল। তাই করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কথা মাথায় রেখে, তাঁরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চব্বিশ ঘণ্টা ডাক্তার, পর্যাপ্ত বেডের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থার মতো বিষয়কে সামনে রেখে প্রচারের কাজ চালাচ্ছিল। জানা যায়, এর আগে এই সংগঠনের নেতৃত্বে প্রায় ৭, ৫০০ মানুষের সাক্ষর সংগ্রহ করে বিএমওএইচ-এর কাছে ডেপুটেশন দেয়। আগেও এই সংগঠন ওই সমস্ত এলাকায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারের কাজ চালিয়েছে।
গেল দু-বছরের কোভিড সংক্রমণের কথা মনে করলে আমরা দেখব কী ব্যাপক পরিমাণ বেড এবং অক্সিজেনের অভাব দেখা গিয়েছিল। দ্য প্রিন্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে মোট ৫০৭টা কোভিড হাসপাতাল (সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে), তার মধ্যে অধিকাংশ হাসপাতালে ‘বেড অ্যাভেলেভেল’ বললেও দেখা গেছে তথ্য সঠিক নয়, বহু রোগীকে বেড না পেয়েই সেই সমস্ত হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছিল অক্সিজেনের কালোবাজারি। সেই সময় রাজ্য সরকারকে এই সমস্যার সমাধানের জন্য হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। যদিও, এখনও বিভিন্ন বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে দেখা যায়, পশ্চিমবাংলার স্বাস্থ্য কাঠামো দেশের মধ্যে সবথেকে এগিয়ে। কলকাতা শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবার দৃশ্য যদি এই হয়ে থাকে তবে জেলা স্তরে স্বাস্থ্য কাঠামোর দশা সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন পরে না।
এবার আসা যাক এই চার যুবকের গ্রেফতারির প্রসঙ্গে। ১৯৯৬ সালে, ডি.কে. বসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে মামলাটি হয়েছিল, তাতে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়তে স্পষ্ট বলা হয়, অভিযুক্তকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে তুলতে হবে। গ্রেফতারির সময় উপস্থিত ঘরের লোককে অ্যারেস্ট মেমো দিতে হবে। বাড়ির লোককে স্পষ্ট জানাতে হবে কোথায় এবং কিসের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে দেখা যায় এই রায়কে সম্পূর্ণ লঙ্ঘণ করে রাজ্য পুলিশ। প্রায় দু’দিন বেআইনি ভাবে পুলিশি হেফাজতে রাখার পর, ১৪ তারিখে এই চার যুবককে কোর্টে তোলা হয়।
এপিডিআরের আরেক সদস্যা সঞ্চিতা আলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “এপিডিআরের পক্ষ থেকে পুলিশ সুপারকে ডেপুটেশন দেওয়ার কথা ছিল। পুলিশ সুপার দেখা করেনি। তার বদলে ডিআইবির কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।” তিনি আরো জানান যে, ১৪ তারিখ দুপুর দুটো নাগাদ, এপিডিআর-এর সদস্যরা ডেপুটেশন দিতে গেলে তাঁরা দেখেন গোটা এলাকা র্যাফ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তাদের প্রথমে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। পুলিশের সঙ্গে বচসার পর তাদের মধ্যে চার জনকে ভিতরে গিয়ে ডেপুটেশন জমা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পরে বিকেল ৪টে নাগাদ ওই চার যুবককে বারুইপুর এসডিজেএম কোর্টে তোলা হলে জানা যায় তাঁদের বিরুদ্ধে সিআরপিসি ১০৮ ধারায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। তবে কোর্টে তাঁদের শর্ত সাপেক্ষ জামিন মঞ্জুর করা হয়। বলা হয় জামিনের শর্ত হিসেবে জন প্রতি ২৫,০০০ টাকা — যা চার জনের জন্য গিয়ে দাঁড়ায় মোট ১ লক্ষ টাকা — এবং বকুলতলা থানার অধীনে চারটি জমির দলিল দিতে হবে। সময়ের অভাবে তা জোগাড় করতে না পারায়, ওই চার যুবকের ১৪ তারিখ জামিন করানো যায় না। তাঁদের বারুইপুর জেলে রাখা হয়।
তবে সন্ত্রাসের কাহিনি এখানেই শেষ হয় না। ১৫ তারিখ জানা যায়, সকালবেলা বকুলতলা থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ (মহিলা পুলিশ ছাড়া) বাবলু হালদারের বাড়িতে পৌঁছায় এবং জোর জবরদস্তি তাঁদের ঘরে ঢুকে তল্লাসি চালায়। এর আগে ১৩ তারিখ যখন বাবলু হালদারকে গ্রেফতার করে সেদিন রাতেও ৯টা নাগাদ ওসি, ডিএসপি এবং এই কেসের আইও বাবলু হালদারের বাড়িতে ঢুকে তল্লাসি করে। তবে এদিন পুলিশবাহিনী তল্লাসির পর ঘরের মহিলা এবং বাচ্চাদের বের করে দিয়ে ঘরে তালা মেরে দেয়।
১৫ তারিখ সকালের এই ঘটনার পর, দুপুর-বিকেল নাগাদ বকুলতলা থানা উত্তর পদুয়া গ্রাম থেকে জিয়াউল মণ্ডল নামে শ্রমিক কৃষক একতা মঞ্চের আরেক সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিস। শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বকুলতলা থানার ওসির নেতৃত্বে, পুলিশবাহিনী গোটা এলাকায় ব্যাপক সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।
প্রতিবেদক পীযূষ দত্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।