৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতি বছরের মতো এই দিনটির জন্য একটি ‘থিম’ ঠিক করেছে রাষ্ট্রসংঘ। অবশ্যই অতিমারীর পৃথিবীতে তাতে উঠে এসেছে ‘কোভিডোত্তর’ সময়ের কথা। কিন্তু ভারতে কিছু রাজ্যে ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবন্ধী মানুষদের পরিস্থিতি আশাপ্রদ নয় মোটেই। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষদের অতিমারীকালীন অবস্থা একেবারেই কোনও সদর্থক ছবি দেখাচ্ছে না। রাজ্যের সরকার এই বিষয় নিয়ে নিশ্চুপ, যেন বেছে নিয়েছে উপেক্ষার রাস্তা। প্রতিবন্ধী মানুষেরা ও প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা নিজেরাই তাই খুঁজে নিচ্ছেন এগিয়ে চলার পথ, একজোট হয়ে। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে নানা হতাশা আর চ্যালেঞ্জের মাঝে সেই আশার আলোর কথাই লিখলেন দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত।
প্রতি বছরের মতো এ বছরেও ডিসেম্বর-এর তিন তারিখ পালিত হবে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। রাষ্ট্রসংঘ এ বছরের ‘থিম’ বা বিষয় হিসাবে বেছেছেন “কোভিড-উত্তর পৃথিবীতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সব কাজে যোগদান এবং নেতৃত্বদান”।
আমরা অবশ্য কলকাতায় বসে ঠিক বুঝতে পারছি না ২০২১-এর ডিসেম্বর মাসকে ‘কোভিডোত্তর’ সময় হিসাবে ধরা যায় কি না। আমরা এখনও পুরোপুরি ‘আনলক’ হয়ে উঠতে পারিনি যদিও লকডাউন-এর মধ্যেও নেই। এরমধ্যে কোভিড-এর নতুন রূপ ওমিক্রন-এর খবর পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতায় বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের সবচেয়ে বড় যে জমায়েত হয়, রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী রাণী রাসমণি রোডে আয়োজন করে আসছে অনেক বছর ধরে, শোনা যাচ্ছে কলকাতা পুলিশ অনুরোধ করেছে এই বছরের অনুষ্ঠান ‘ছোট’ করে করতে। কারণ একটাই – কোভিড। কলকাতায় ভোট উৎসব বা দুর্গা পুজোয় না কি খুব বেশি সংক্রমণ ছড়ায়নি, তবে প্রতিবন্ধীরা একত্রিত হলে সংক্রমণ হু হু করে ছড়াবে এ কথা বোধহয় আমাদের রাজ্যের সরকার বিশ্বাস করে। স্কুল, কলেজ ইত্যাদি ধাপে ধাপে খুললেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও স্পেশাল স্কুলগুলো খোলার কথা পরিষ্কার করে বলেনি, কাজেই এই শিশুদের শিক্ষা এখনও অনলাইন-এর ওপারে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি মেনে নিয়ে থাকে যে প্রতিবন্ধী মানুষেরা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কারণ কোভিড স্পর্শ থেকে ছড়ায় আর স্পর্শ ছাড়া এদের চলাফেরা মুশকিল, তাহলে এদের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা সরকারের করা উচিৎ ছিল। ভ্যাকসিন-এ অগ্রাধিকার প্রতিবন্ধী মানুষেরা পশ্চিমবঙ্গে পাননি এবং এই অগ্রাধিকার পাওয়ার এবং প্রয়োজনে বাড়ি এসে টিকাকরণের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে কেস করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। তা সত্ত্বেও দুয়ারে ভ্যাকসিন প্রকল্পের কোনও খবর নেই।
এরমধ্যে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা হয়ে গেছে। ভোটপ্রার্থী কারা হবেন তাও ঘোষণা করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। কর্পোরেশনের নির্বাচনে কোনও প্রতিবন্ধী প্রার্থী আছেন কি না সে খবর আমরা এখনও পাইনি। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের যে কোনও লোকাল বডি ইলেকশন-এ প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সংরক্ষণ থাকতে হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য তার মধ্যে পড়ে না। সংরক্ষণ না থাকলে প্রতিবন্ধীদের ভোটে দাঁড় করানো যাবে না এমনটাও তো কোথাও বলা নেই। বিভিন্ন দল তারা কর্পোরেশন ভোটে জয়ী হলে কী কী সুব্যবস্থা নেবে নাগরিকদের জন্য তা বলতে শুরু করেছে, ভোটের প্রচার শুরু হয়েছে। নগর উন্নয়নে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য বিশেষ সুবিধা কী কী থাকবে সে কথা এখনও অব্দি কোনও রাজনৈতিক দল বলেনি। নানা ধরনের প্রান্তিক মানুষের কথা উঠে এলেও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য কিছু ব্যবস্থা যা কর্পোরেশনের সরাসরি কাজের তালিকাভুক্ত তা নিয়ে কোনও কথাবার্তা এখনও চোখে পড়ছে না।
ইতিমধ্যে বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম পাতায় খবর করে জানিয়েছে মধ্য কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে এক মূক বধির মহিলার গণধর্ষণের খবর। কিন্তু থানা থেকে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ সহায়ক না দিতে পারার জন্য ঘটনার চার মাস পর রেপ কেস নথিভূক্ত হয়। কোর্ট অর্ডার না আসা অব্দি কলকাতা পুলিশ কেন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদক আনতে পারল না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে এমনকি নারী আন্দোলনের কর্মীদেরও সোচ্চার হতে দেখা গেল না।
তবে কি ২০২১-এর ৩ ডিসেম্বর আমরা শুধু হতাশ হয়ে বসে থাকব? অপেক্ষা করব কবে কোন রাজনৈতিক দল বা অন্যান্য আন্দোলনের কর্মীরা আমাদের কথাও ভাববে – তার জন্য? তা কেন হবে? এই অতিমারীর সময়ই আমাদের কিছু আশার ঝলক তো দেখিয়েছে। কোভিড অতিমারী চলাকালীন কেন্দ্র সরকার দেশের প্রতিবন্ধীদের জন্য তিনটি আইন পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। দেশের অন্যান্য প্রান্তের আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে এই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবন্ধী মানুষেরা একযোগে আন্দোলন করে সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। ২০২১-এর সবচেয়ে বড় জয় মনে করা হচ্ছে যে কৃষক আন্দোলনের জয়কে – সেই লড়াইয়ে যোগদান করতে অনেক প্রতিবন্ধী কৃষককে আমরা দেখেছি। কোনও বিশেষ দলের মুখাপেক্ষী না থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিজেদের দল তৈরি করতে আমরা দেখছি। নিজেদের ক্ষেত্রে আন্দোলন করে তারা বিভিন্ন জয় ছিনিয়ে আনছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছে তাদের জন্য পৃথক ভ্যাকসিন ক্যাম্প করতে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিহীন ছাত্ররা একজোট হয় অনলাইন পরীক্ষার বিরুদ্ধে। মানসম্পদ দপ্তরকে বাধ্য করে নতুন নির্দেশিকা জারি করতে। স্পেশাল স্কুল হোক না প্রতিবন্ধী মঞ্চ, একত্রিত হলেই “একদিন সূর্যের ভোর, একদিন স্বপ্নের ভোর আসবেই” গান যে মানুষেরা গেয়ে থাকেন, হয়তো এইসব ছোট ছোট সাফল্যের গল্পই তাদের জীবনে নতুন ভোর আনবে। রাষ্ট্রসংঘ কী ‘থিম’ ঠিক করেছে তা জানেন ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের খুব অল্প সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষ। অতিমারী পেরিয়ে, বাইরে নতুন নেতৃত্ব না খুঁজে, নিজেরা নেতৃত্ব দিয়ে নতুন করে সমাজে অংশগ্রহণ করার শপথ তারা নেবেন ৩ ডিসেম্বর।
(শম্পা সেনগুপ্ত প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কর্মী ও ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড-এর যুগ্ম সম্পাদক। )