কৃষক আন্দোলনকে কাছ থেকে চাক্ষুষ দেখবেন বলে টিক্রি বর্ডার-সিংঘু বর্ডারে পৌঁছে গেছেন কোয়েল সাহা ও সন্দীপ সাহা। এই আন্দোলন তাঁদের কাছে ‘হট্টমেলার দেশ’ হয়ে ধরা দিয়েছে। সরকার ও পুঁজির মিলিত শোষণ, জাত-ধর্ম-লিঙ্গের নানা অসাম্যের বিপরীতে এক সমতার দুনিয়া যেন। আন্দোলনের নানা চরিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁরা আন্দোলনকারী কয়েকজন মানুষের কথা বিশেষ ভাবে বলেছেন – কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র – এই মানুষগুলির মনের জোর ও রাজনৈতিক বোধই এই আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সাথে সাথে উঠে এসেছে এই আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষক একতার সূচনার প্রশ্নটিও।
কড়াই বসিয়ে আগুনে জ্বাল দেওয়ার মতো পরিস্থিতিকে উসকে দিচ্ছে – খবরের কাগজ, টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে এমন ধারণাই আমার মতো ছাপোষা বাঙালির মনে হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি বিল বলবৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পাঞ্জাব হরিয়ানা,উত্তর প্রদেশ, রাজস্থানের কৃষকেরা রাজধানী শহরকে কেন্দ্র করে চারিদিক থেকে ট্রাক্টরে চড়ে কৃষি-অধিকার-সংবিধানকে রক্ষা করার তাগিদে স্থির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে আসছেন। নভেম্বরের প্রবল শীতে জল কামান, টিয়ার শেলকে উপেক্ষা করার মতো হাড় হিম করা ছবি তামাম ভারতবাসীর মতো আমাদেরও তীব্র গতিতে ধাক্কা দিয়েছিল।
নারী-পুরুষ-শিশু যখন তাদের দাবিতে অনড় থেকে দিল্লির সীমান্তে, তাদের অবস্থাকে তীব্র ভাবে ঘোষণা করতে চাইছেন অহিংসাকে মত ও পথ করে, তখন সংবাদপত্রের অন্য একটি খবর খুবই বিচলিত করল।
২০২০, ১৬ ডিসেম্বর ‘এই সময়’ খবরের কাগজ: নতুন ভবন ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নতুন সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কর্ণাটক শ্রীঙ্গেরি মঠের পুরোহিতদের মন্ত্র উচ্চারণ এবং মোদীর ভূমি পুজো। উপস্থিত ২০০ বিশিষ্ট মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী প্রজন্ম গর্ববোধ করবে কারণ এই সংসদ ভবন তৈরী হয়েছে স্বাধীন দেশে। (পৃষ্ঠা-৪)
মঠ ভবন হিন্দু ধর্মের পুরোহিতদের সন্মিলিত মন্ত্র উচ্চারণ আগামী প্রজন্মকে গর্ববোধ করার উপাদানের যোগান দেবে। আর করোনা পরিস্থিতিতে বিরোধীশূন্য লোকসভা রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যাওয়া জনবিরোধী বিল ও কোডের বিরোধিতা করলে সরকার দেশদ্রোহিতার তকমা সেঁটে দিতে কসুর করবে না। কোন্ ভারতবাসীর হিত কামনা করে এই সরকার, সেই প্রশ্ন লাট্টুর মত পাক খেতে থাকে।
২৬ জানুয়ারি ২০২১। প্রজাতন্ত্র দিবসে তামাম ভারতবাসী লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ আর ভারতীয় ফৌজের নানা রকম ইভেন্ট দেখায় অভ্যস্ত। দেশের সরকার দেশের প্রতি জনগণের ভক্তি অনুসারে স্কেল বেঁধে দিয়ে থাকেন। যে স্কেল অনুসারে কৃষি আন্দোলন দেশবিরোধী তকমা আগেই কুড়িয়েছে। হাড় কাঁপানো শীত, খোলা আকাশের নীচে কৃষি আন্দোলন তার আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে গুরুত্ব দিতেই ২৬ জানুয়ারির মহান প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। অগুন্তি ট্রাক্টরে চড়ে সীমানা পার করে দিল্লি, লালকেল্লার দিকে আসা কৃষকেরা তামাম ভারতবাসীর কাছে গ্রাম ভারতের কৃষি অর্থনীতি ও সংস্কৃতি দুই-ই স্পষ্ট চরিত্রে প্রকাশ করলেন। আর উল্টোদিকে সরকারের অভিসন্ধমূলক ষড়যন্ত্র আবারও প্রকাশ পেল নগ্নভাবে।
২৭ জানুয়ারি ২০২১। স্তুপ করা বোল্ডারের পাঁচিল, লোহার ব্যরিকেড, পরিখা এবং অগুন্তি পুলিশ, আধা জওয়ানদের কড়া নজরদারি। আন্দোলনের পরিসরকে ঘিরে ফেলার তোড়জোড় চলছে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অগত্যা হাইওয়ে থেকে পায়ে হেঁটে কিছু দূর পৌঁছে অটো রিক্সা করে ঘুরপথে হরিয়ানার নারিলা পথ হয়ে কিষাণদের প্রতিবাদ অবস্থান সিংঘু বর্ডারে পৌঁছানো গেল। নানা বয়স নানা রঙে অজস্র মানুষের ঢল, বাহারি পতাকা, পোস্টারে সেজে সিংঘু বর্ডারের প্রধান প্রতিবাদ অবস্থান মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছে। থেকে থেকেই ধ্বনি উঠছে ‘কিষাণ একতা জিন্দাবাদ, জয় জওয়ান জয় কিষাণ, মজদুর কিষাণ একতা জিন্দাবাদ’।
প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর সেবাধর্ম মিলেমিশে একাকার দিল্লির কৃষক আন্দোলন। সিংঘুর গোটা অঞ্চলের প্রায় ১০কিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র ট্রলি এবং তাঁবু। ছোট বড় মাঝারি তাদের নানা বর্ণ ও আকৃতি। জায়গাটা যেন তাঁবু নগরী। অজস্র মানুষকে ঠাণ্ডার হাত থেকে শরীরকে গরম রাখতে দেওয়া হচ্ছে সকালে চা, রাতে খিরা (দুধের সুস্বাদু মিষ্টান্ন)। যত দেখছি ততই আশ্চর্য হচ্ছি যেন ‘হট্টমেলার ওপারে’। সকাল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যে নেমে এল বোঝার উপায় নেই। সর্বত্র প্রতিবাদের চলন। ‘নয়া কৃষি আইন’ উৎখাত করার দাবিতে মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ থেকে আসা নারী-পুরুষ-শিশুর মিলিত উচ্চারণ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আছে মূল প্রতিবাদ মঞ্চ। যে মঞ্চ সংলগ্ন লঙ্গরখানা থেকে সন্ধ্যের পকোড়া আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের আছে ঢালাও বন্দোবস্ত। কলকাতা থেকে কৃষক আন্দোলন চাক্ষুষ দর্শন করতে আসা অবাক আমাদের জনাকয়েককেও সেই খাবার ও আতিথেয়তার মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের শরিক করে নেওয়া হল। সেই সূত্রেই ভিন রাজ্যের আন্দোলনে প্রথম মানুষটির সাথে আলাপ। নাম গুরপাল সিং, বয়স বছর ৪০, এসেছেন পাঞ্জাবের ভাতিন্ডা থেকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে ছুটি নিয়ে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে। গুরপাল নিজের উদ্যোগে আমাদের জনাকয়েকের তাঁবুতে থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। তাঁবুর ভিতরে মাথা গলাতেই আবারও অবাক হওয়ার পালা। না হলেও ৪০০ থেকে ৫০০ জনার থাকার সুবন্দোবস্ত এই তাঁবুতে। কম্বল-তোষক, মোবাইল-চার্জার বোর্ড, পানীয় জলের পাউচ, রাত পাহারায় সদাসতর্ক হয়ে সবাইকে দেখে শুনে রাখা বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠর ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিবর্গ যাকে কী আর বলি – বড়দাই বলতে পারি! ভারতবর্ষ তার জাতীয় রাজনীতিতে পেয়েছে গান্ধী পরিবার, সংঘ পরিবারের ধারাবাহিকতা। সেই ধারাবাহিকতার উল্টোপিঠে একই দেশ একই মাটিতে কৃষি বিলের বিরোধিতা, আন্দোলনের সক্রিয়তা তামাম ভারতবাসীকে পথের ধারে এক সমতার পরিবারে বেঁধে দিল।
দেওয়া-নেওয়ার সংস্কৃতি তথা বিনিময় প্রথার ওপারে দাঁড়িয়ে যেন বাদলবাবুর সমতার দুনিয়াকে স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা। এরকম এক দুনিয়ার স্বপ্নই তো বুনেছিলেন নাট্যকার বাদল সরকার তাঁর ‘হট্টমেলার ওপারে’ নাটকে। ২০২১ সালের ভরা শীতের নতুন বছরে সেই স্বপ্ন দেখা মুহূর্তরা দিল্লি বর্ডারের সীমানায় ধরা দিল। তবে অঙ্গনমঞ্চের পরিসর অতিক্রম করা অন্য এক হট্টমেলা।
২৮ জানুয়ারি ২০২১। রাতের আশ্রয়স্থল ছেড়ে এগোতে থাকলাম টিডিআই মল লাগোয়া কুন্ডলী শিল্পাঞ্চলের দিকে। অবশ্যই যার অক্ষে রয়েছে পরের পর তাঁবু আর ট্রলি। মূল মঞ্চ থেকে যার দূরত্ব ৪ কিমি। এ পথের শুরুতেই যিনি বসে আছেন সর্দার গুরমিক সিং, সাথে তাঁর ছোট্ট ট্রলি। কাজ গা হাত পায়ের ব্যথা মালিশ করে সারিয়ে তোলা। তাই দূরদূরান্ত থেকে ট্রলি চেপে আন্দোলনে সামিল হতে আসা মানুষেরা ক্লান্তি তাড়াতে মালিশ ট্রলির সামনে বসে পড়ছেন।
সেবার এরকম হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে পরিধিতে। প্রতিটি লঙ্গরখানায় সকাল হতেই মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে হরিয়ানা পাঞ্জাবের কৃষাণ-কৃষাণীরা লেগে পড়েন নাস্তা তৈরিতে। কৃষাণ-কৃষাণীদের এই যৌথ শ্রম আমাদের মনোযোগী করে। যদিও এই ঘটনা একমাত্র বা ব্যতিক্রম তা কিন্তু একেবারেই নয়। বরং নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ আন্দোলনের অন্যতম চরিত্র।
সিংঘু বর্ডারের ‘বুক ঠেক’ এ আলাপ আমানদীপ কৌর-এর সঙ্গে, বয়স ২৩, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা যুবতী। সিংঘু অঞ্চল সংলগ্ন বাচ্চাদের অবৈতনিক ভাবে লেখাপড়ার দায়িত্বে আছেন তিনি। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা উচিত। হরিয়ানা কিংবা পাঞ্জাবের দারু ঠেক তথা মদ্যপানের আসরের বিপরীতমুখী চেতনাকে উস্কে দেওয়ার জন্যই সচেতন ভাবে গড়ে তোলা এই ‘বুক ঠেক’ জাতির জীবনে নেশার গেড়ে বসা চরিত্রকে অঙ্গুলি নির্দেশ সহ নেশাবিরোধী অবস্থান নেওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। গড়ে উঠেছে অস্থায়ী লাইব্রেরি। বই পড়া। পড়ার ফলে গড়ে ওঠা মত এবং মতের আদানপ্রদান। প্রতিটি তাঁবু সৃজনশীলতার আতুঁড় ঘর হয়ে উঠেছে। শুধু প্রতিবাদ নয় পাশাপাশি গঠনও চলছে সমান তালে। দু’হাতের তালুতে জীবন বেঁধে মানুষই সব করে। দিল্লির কঠিন ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে উপযোগী তাঁবু তৈরি করা আবার গরম শুরু হতেই মার্চ মাসের গোড়াতেই গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে গড়েপিটে নেওয়া হয়েছে খড়ের চালা সহ অন্যান্য ঘর ঠান্ডা রাখার উপাদান। সবই করছেন আন্দোলনে থাকা কৃষক-ছাত্র-যুবরা। গড়ে উঠছে এক বৃহত্তর মৈত্রীর বন্ধন। এই মৈত্রীভাব সর্বত্র।
৩০ জানুয়ারি ২০২১। গান্ধীজির সাহাদাত দিবস পালন হচ্ছে গাজিপুর সীমান্তে। বক্তব্য রেখেছেন রাকেশ টিকায়েত। আর পাশেই মুসলিম ‘ভাইজান’ লঙ্গরখানা। পরিবেশিত হয় মিষ্টি ভাত। যাকে বলা হয় জর্দা। সুস্বাদু এই মিষ্টান্ন পরম তৃপ্তিতে গ্রহণ করেছেন উত্তর প্রদেশ-হরিয়ানা থেকে আসা জাঠ কৃষকেরা। সেই সময় আমার মনে হচ্ছে কবির স্বপ্ন সার্থক হতে পারে একমাত্র সংগ্রামের পবিত্র জমিতেই।
‘সকালের কীর্তনের সুরে একদিন মিশে যাবে ভোরের আজান’।[i] (কবি সব্যসাচী গোস্বামী)
‘সাঁঝি সাথ’ তাঁবুতে চলছিল পোস্টার প্রদর্শনী। যে প্রদর্শনীতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সমর্থকেরা নানা ভাষা নানা বর্ণে, কৃষক আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাক্ষর রেখে যান। সন্ধ্যেয় একই সাথে চলে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ক মত আদানপ্রদান। যে রাজনৈতিক মত আদানপ্রদানে মহিলাদের মতামত অন্যতম। জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে সংবাদমাধ্যম যখন বিকিয়ে যাওয়া চরিত্র নিয়ে কদর্য ভাবে প্রকাশিত, তখন কৃষক আন্দোলন ‘গোদী মিডিয়া’ নামকরণের মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমের দালালসর্বস্ব চতুর্থ স্তম্ভের বিরোধিতা করেই নীরব হল না, আন্দোলনের খবর নিয়ে প্রকাশ পেল ‘ট্রলি টাইমস’। অনলাইন ও প্রিন্টিং দুই মাধ্যমেই। গুরমুখ, হিন্দি ও ইংরেজীতে প্রকাশিত যে পত্রিকা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চাইছে আন্দেলনের দিশা ও অভিমুখ। এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে ছাত্র-যুবক-ডাক্তার-শিক্ষক-বিজ্ঞানী-ডকুমেন্টরি ফিল্ম মেকার-নাট্যকার-মানবাধিকার কর্মীরা ও আশপাশের কারখানায় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের আছে অনায়াস যাতায়াত। আন্দোলনের অভিজ্ঞতা পরখ করতে আসা আমাদের কয়েকজনার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলাপ হয় এ রকমই কয়েকজন মানুষের। তাঁদের ব্যক্তিজীবন থেকে আন্দোলনের বৃহত্তর বৃত্তে সামিল হওয়ার যাবতীয় অভিজ্ঞতা শোনার মধ্যে দিয়ে আন্দোলন ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হয়। এই প্রসঙ্গে তিন জন মানুষের কথা না জানালে দিল্লি কৃষক আন্দোলনের এই পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
পবন: কাপুরতলা থেকে আসা বছর ২৬-২৭ এর পবন সিং। সুঠাম উদ্যমী মাঝারি উচ্চতার স্বাধীন চিত্রগ্রাহক। বাবা প্রাক্তন সেনা – সেই সূত্রে পবনের স্কুল ও কৈশোর জীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে। কৃষক আন্দোলন প্রসঙ্গে জানান, “বাংলার সিঙ্গুরে কৃষকদের সেজ বিরোধি আন্দোলনের খবরাখবর কাগজ মারফৎ রাখতাম আর আজ কৃষকদের নয়া কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনে আমি স্বশরীরে হাজির ফটোগ্রাফার হিসাবে, এই সময়টাকে ধরে রাখার তাগিদে”।
নওদীপ: মহামারীর পর দীর্ঘ সময় ধরে কুন্ডলীর ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টের কারখানা যখন একে একে খুলছে ঠিক তখনই শ্রমিকদের কাজ হারানোর নোটিস ঝুলিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। অমানবিক এই আচরণের বিরুদ্ধে ও শ্রমিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে কারখানার বাইরে অবস্থানে বসলে পুলিশ নওদীপকে প্রকাশ্যে মারধোর করে ধরে নিয়ে যায় ১২ জানুয়ারি ২০২১। চলে শারীরিক নিগ্রহ। দলিত ভুমিহীন কৃষক পরিবারের মেয়েটি কিন্তু হাড় কাঁপানো শীতে বৃটিশ উপনিবেশের ক্ষত ছুঁয়ে থাকা পাঞ্জাবের পাগড়ি সেন্টিমেন্ট যে আজকে ২০২১-এ একই পরম্পরায় কাজ করে চলেছে সেই ছবিটি আমাদের হিন্দি ইংরেজী মেশানো ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯০৭ সালে বৃটিশ রাজের আনা ‘কলোনিয়াল ফার্ম বিলের’ বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘পাগড়ি সামাল জাঠা’ কৃষাণ আন্দোলনের সাথে আজকের তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধ অবস্থান সময়ের ব্যবধানে অনেকটা হলেও, গুণগত হিসাবে একই। গল্পটা সেই। বাদাম ভাজার বদলে কৃষক ভাজা। ১৯০৭ সালে গোরা চামড়ার মানুষ ভেজেছিলেন। আর এখন নেটিভরাই সে কাজ বহাল তবিয়তে চলিয়ে যাচ্ছেন।
শিব কুমার: ২৬ শে মার্চ ২০২১ কুন্ডলীর শ্রমিক আন্দোলনের সাথে থাকা বছর ২৪ বয়সের শিব কুমারের সঙ্গে আলাপ হয়। ITI পাশ করা দলিত পরিবারের ছোট ছেলে। শান্ত, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। শ্রমিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে তক্কবাগিশ এই ছেলেটি কোনও রকম অ্যারেস্ট মেমো ছাড়াই গ্রেপ্তার হয় ১৬ জানুয়ারি ২০২১। চলে পুলিশি নিপীড়ন। অত্যাচারের জেরে ভাঙে হাত ও পা। এতকিছুর পরেও মনে করেন কৃষক-শ্রমিক যৌথতা আন্দোলনকে দৃঢ় করবে। ভাঙা পা মুড়ে বসার মতো অবস্থায় না থাকলেও মানসিক জোর-ভরসার তেজ তাঁবু ছাউনি পার করে আমাকে স্মৃতির পথ ধরে অনেক দিন আগে পড়া কেন্টাকির ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল। আমেরিকার কেন্টাকি, ১৯৩০ সাল। খনি শ্রমিকেরা মালিকের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। সে সময় নেমে এসেছিল ভাড়া করা গুন্ডা ও পুলিশি আক্রমণ। আর এই আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি রচনা হয়েছিল গান। সেই গানে আহবান ছিল – Which side are you on boys?/ Which side are you on?
২২/ ০৯/ ২০২০। বিরোধী শূন্য অবস্থায় লোকসভায় পাশ হয়ে যায় তিনটি বিল আর রাজ্যসভায় সাতটি বিল। যার মধ্য অন্যতম কৃষি বিল ও শ্রম কোড। কেড়ে নেওয়া হয় ধর্মঘটের অধিকার। দীর্ঘদিনের অধিকার ও আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে থাকা ধর্মঘটকে অনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সংসদীয় বাম-ডান প্রত্যকেই কর্ম সংস্কৃতির পক্ষে সওয়াল করেন। যা শহর-ভারতের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক চেহারায় প্রকাশ পেতেও শুরু করে। সরকারের হরতাল না করার বাধ্যবাধকতার একমুখী চাপের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন ৮ ডিসেম্বর সর্বভারতীয় বন্ধের ডাক দেয়। যে হরতালের ধ্বনি আসমুদ্র হিমাচলে অধিকার তথা দাবির সমার্থক হয়ে আন্দোলনের সদর্থক চরিত্র স্পষ্ট করে।
সরকার তার নিজস্ব কৌশলে কৃষি বিল, শ্রম কোডকে বলবৎ করার কসুর করেননি। মহামারীর করাল আবহাওয়ার মধ্যেই কৃষকসমাজ একত্রিত হয়ে দিল্লিকে লক্ষ্য করে কেবল এগিয়ে আসেননি, দিয়েছে বিভাজনের বিপরীত এক সংস্কৃতি। কৃষক আন্দোলনে গড়ে ওঠা লঙ্গরখানা তাই আশপাশের আধপেটা খেতে পাওয়া শ্রমিক পরিবারগুলির জন্যও করেছে আহারের বন্দোবস্ত। করোনা কালে কাজ বন্ধ শ্রমিক পরিবারগুলি ও আশপাশের গ্রামগুলির মধ্যে এই কৃষি আন্দোলন হৃৎপিন্ডের চরিত্র নিয়ে কাজ করে গেছে। যার ফলাফল শ্রমিক-কৃষক একতার সচেতন উচ্চারণ। সরকারের গড়া কৃষি বিল, শ্রম কোড শ্রমিক-কৃষক সমাজকে যৌথ লড়াইয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ করছে, এ কথা অস্বীকার করার জায়গা আর নেই। প্রশ্ন হল কৃষি আন্দোলনের এজাতীয় চরিত্রে, শ্রমিক-কৃষক যৌথতার এই সম্ভাবনায় সরকার অস্বস্তিতে পড়েনি তো?
২০১২ দিল্লির গুরগাঁও মারুতি অটোমোবাইল কারখানার কর্তৃপক্ষ স্থায়ী শ্রমিকদের অসন্তোষ শেষ পর্যন্ত (HR) অনীশ কুমার দে-কে হত্যা ও ধর্মীয় হিংসার রুপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। যে কারণে ১৪৮ জন শ্রমিককে গুরগাঁও জেলে আটক করা হয়। ষড়যন্ত্র ছিল আন্দোলনের পায়ে পায়ে জড়িয়ে। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দিল্লির টিকিরি বর্ডারে পৌছান, পশ্চিমবঙ্গের বৈদ্যবাটির মানবাধিকার কর্মী মৌমিতা বসু। মৌমিতার মৃত্যু সে অর্থে অমানবিক ষড়যন্ত্রের অন্যতম। ভিড়ে থাকা আন্দোলনকারীর ছদ্দবেশ মৌমিতাকে শারীরিক ও মানষিকভাবে করে লাঞ্ছিত। যে বক্তব্য আরও স্পষ্ট হয় সংযুক্ত কিষান মোর্চার সাথে যুক্ত অভিক সাহার সাক্ষাৎকার থেকে। ৩০ এপ্রিল শেষ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমরা পর্যবেক্ষণ-আলোচনা-সমালোচনা-উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছাই ঠিক তেমনই তরুণী মৌমিতা আন্দোলন পরিসরের স্পন্দন অনুভব করে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পিতার কাছে কৃষক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এমন বয়ান না দেওয়ার অঙ্গিকারে আবদ্ধ করেন। এমনই দীর্ঘ ১২ মাসের এই আন্দোলনে মারা গেছেন ৭০০ জন। যাদের গড় বয়স ৫৭। তীব্র শীত কিংবা ভয়ানক গরমে আন্দোলনকারী কৃষকেরা শরীরিক অসুস্থতায় মারা গেছেন আছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা। প্রতিটি মৃত্যু শহীদের। যা কৃষক মৃত্যুর তালিকাকে করেছে দীর্ঘতর। মৃত্যু মিছিলের প্রতক্ষ মদত দাতার ভূমিকায় কিন্তু স্বাধীন দেশের ভোটে, সংখ্যা গড়িষ্ট ভাবে জয় যুক্ত সরকার।
একদিকে কৃষি প্রধান হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশে রাজ্যভোটের দামামা, সঙ্গে খোলা বাজারের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি নীল নকশার প্রস্তুতিতে ভারতের মতো কৃষি প্রধান দেশের কৃষি অর্থনীতির উপর থাবা বসাতে চাইছে। অন্যদিকে কৃষি আন্দোলন তার অবিচল লক্ষ্যে স্থির থেকেছে। ২০ নভেম্বর নেট-দুনিয়া, সংবাদমাধ্যম কাঁপিয়ে জনবিরোধী সরকার কৃষি বিল রদের নিদান ঘোষনা করল। অঙ্কের হিসাবে যা এক জটিল সমীকরণ। লাভ-লোকসানের পরিসরের বাইরে সরকার কি তবে জীবন পণ করা কৃষকদের দাবির কাছে নত হল? না কি ভারতরাষ্ট্র তার জনবিরোধী ষড়যন্ত্রের খেলায় আরও এক ইতিহাস তৈরির দিকে পা বাড়াল?
পাদটীকা
[i] গোস্বামী সব্যসাচী; আড়মোড়া ভাঙে আজ স্থবির সময়; চক্রবর্তী দীপংকর( প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক); অনীক; জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২০; কলকাতা ২০০৭; পৃষ্ঠা ৭
- কোয়েল সাহা : গবেষক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, সন্দীপ সাহা : চিত্র সাংবাদিক।
অনবদ্য সংকলন।
দলিল হিসেবে ভবিষ্যতে বহু কাজে লাগবে।
ধন্যবাদ গবেষক ও ছিত্রসংবদিক কে