কৃষক আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে গ্রাউন্ডজিরো-র তরফে সুদর্শনা চক্রবর্তী কথা বললেন আন্দোলনের সঙ্গে এমন কয়েক জনের সঙ্গে যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এবং পর্যবেক্ষক।
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন একতা উগ্রাহান-এর সভাপতি যোগীন্দর সিং -এর বক্তব্য, “দেখুন, মোদী সাহেব কৃষি বিল প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিন কয়েক আগে করলেন তাতে তো অনেক দেরি করে ফেললেন তিনি, এ তো আরও আগেই করার ছিল। তবু বলব, ‘দের আয়ে দুরুস্ত আয়ে’। আমরা খুশি। কিন্তু মোদী সাহেবকে তো খাতায়-কলমে আইনিভাবে এই প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে। তা হাতে এলে তবেই বুঝতে পারব কী রয়েছে তাতে, কৃষকদের বিরুদ্ধে তো যাচ্ছে না! কারণ এতদিন ধরে তিনি কৃষকদের দাবি উপেক্ষা করেছেন, ৭০০ জন কৃষক শহীদ হয়ে গেছেন, এমএসপি-পিডিএস থাকবে কি না, রাষ্ট্র শস্য সরাসরি কিনবে কি না, সে সব নিয়ে সরকার এখনো কিছু বলছে না। সারা দেশ আমাদের সঙ্গে রাস্তায় বসেছে। এই আন্দোলন শুধু কৃষকদের আর নেই। যাদের জমি নেই, যাদের জীবিকাও কৃষিকাজ নয় তারাও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। এটা খাদ্য সুরক্ষার বিষয়। তা তো আর শুধু কৃষকদের বিষয় নয়। কাজেই মোদী সাহেব যে কিছু কৃষক কৃষি বিলের ভালো দিক বুঝতে পারলেন না বলছেন, তা একদমই ঠিক কথা নয় – এক বিরাট সংখ্যক কৃষক, মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। কম সংখ্যক বলে তিনি আমাদের ‘গুরুর’কে ধাক্কা দিতে চেয়েছেন। এরকম করা মোটেই ঠিক হয়নি তাঁর। এই আইন প্রত্যাহারের নানান কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক চাপ তো বটেই। সামনে বিভিন্ন রাজ্যে যে নির্বাচন রয়েছে সেখানে কি ঘটতে চলেছে তা নিয়ে বিজেপি যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছে। নির্বাচন ইতিমধ্যে হয়ে গেছে এমন রাজ্যেও তারা হারের মুখে পড়েছে – যেমন পশ্চিমবঙ্গ। আমাদের লড়াই চলছে, চলবে।”
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন একতা উগ্রাহানে যোগিন্দর সিং জাঠ্ঠার পাঞ্জাবের জেলা স্তরের তরুণ নেতা গুরভেজ রোহিওয়ালা বললেন, “সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের যে বড় লড়াই ছিল তা ছিল কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে। মোদী যে কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন, তা আমাদের প্রথম জয়। আগামী দিনে সারা দেশে নিজেদের অধিকারের লড়াই লড়ছেন যে কৃষক ও শ্রমিক মানুষেরা, আমরা তাদের সকলের লড়াইয়ের সঙ্গে থাকব এবং এই সংঘর্ষ/সংগ্রাম জারি থাকবে। আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় আমরা খুশি, কিন্তু এটিকেই আমরা একমাত্র জয় বলে মেনে নিচ্ছি না। এরপরে আরও লম্বা লড়াই রয়েছে। আমাদের লড়াই, আবারও বলছি, কর্পোরেট আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, যা চলতে থাকবে। মোদী যে এখন এই তিনটি আইন প্রত্যাহার করলেন, তার পেছনে অনেকগুলো কারণই আছে – নির্বাচন ইত্যাদি। জনগণের সংগ্রামের সামনে শাসককে তো একটা সময়ে নতজানু হতেই হয়। ১৯০৬ সালেও কালা কানুন লাগু হয়েছিল। তখন চাচা অজিত সিং, শহীদ ভগৎ সিং-এর চাচা – উনি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উনি ন’মাস পরে এই লড়াই জিতেছিলেন। আমাদের বর্তমান কৃষক আন্দোলন এক বছর ছুঁল। এই মানুষগুলোর আবেগ, সততা, নাছোড় জেদ, শৃঙ্খলা – এই সবকিছুর গুরুত্ব আছে। আমাদের মায়েরা – যাদের আবেগ ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছিল, তাঁরা আমাদের মানসিকভাবে এই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন যে এই লড়াই এক দীর্ঘ – এই লড়াই ভারত সরকার, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেই শুধু নয়। সারা বিশ্বের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের এক নতুন দিশা দেখিয়েছেন ভারতের কিষাণরা। কারণ কর্পোরেট পুঁজিপতিরা সারা পৃথিবীকে দখল করতে চায় আর ভারতের কৃষক সাথীরা সামনের সারিতে থেকে তাদের বিরুদ্ধে লড়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।”
অমৃতসরের গুরু নানক দেব ইউনিভার্সিটি-র ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বর্তমানে জলন্ধরের দেশ ভগৎ ইয়াদগার কমিটির সহকারি সম্পাদক ডঃ পরমিন্দর সিং জানালেন, “একটা কথা তো সত্যি যে প্রধানমন্ত্রী মোদী তিনটি কৃষি বিল সরকার প্রত্যাহার করবে এমনটা ঘোষণা করার ফলে কয়েকটা জিনিস প্রমাণ হল। প্রথম কথা, গত এক বছর ধরে কৃষকদের যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন তার একটা জয় এল। আরেকটা বিষয় হল এ দেশের বর্তমান শাসক সরকার, প্রধানমন্ত্রী মোদীর যে ক্যারিশ্মা সারা দেশ জুড়ে ছিল তাতে একটা চিড় ধরে গেল। মোদীর রাজত্বের এইটাই প্রথম বড় হার, যা কৃষকদের গণতান্ত্রিক লড়াই থেকেই এল। এই লড়াইটা কিন্তু সিস্টেমের বাইরের কিছু নয়। বর্তমান যে শাসনব্যবস্থা তার মধ্যেও এ ধরনের আন্দোলন-লড়াই একটা গভীর ক্রাইসিস, সমস্যা তৈরি করে দেয়। এই লড়াইটা হয়তো সংসদে নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক কন্ঠ রাষ্ট্র ও সরকারের উপর কী প্রভাব ফেলে তা এখন অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। জনগণের লড়াইয়ের একটা নতুন দিক খুলে গেল। দ্বিতীয়ত, কৃষকেরা স্পষ্টতই বলে দিয়েছেন তাঁরা ঘটনা পরম্পরার উপর ও কী ঘটতে চলেছে সেদিকে নজর রাখবেন। প্রধানমন্ত্রী দু’টি কথা বলেছেন – একটি কমিটি তৈরির কথা এবং সমগ্র কৃষি নীতির পরিবর্তন। এই দু’টি কথা একটা সন্দেহ ও উদ্বেগ তৈরি করছে। সমগ্র কৃষি নীতির পরিবর্তনের বিষয়টি যদি সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করেন অর্থাৎ আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, তাতে যে পরিবর্তনগুলির কথা বলা হচ্ছে – আপনি কেমন শস্য চান যা আমাদের মতো দেশে ফলানো যাবে – যা এখানে সস্তায় ফলবে এবং যা এ দেশ বা পশ্চিমের ‘এলিট’ শ্রেণীর বা পশ্চিম বাজারের জন্য উপযুক্ত হবে। ফলে এরকম বদলই তারা আনতে চাইবে যা এই স্কিমের মধ্যে পড়বে। এর ফলে ভারতে খাদ্য সংকট তৈরি হতে পারে। এদিকে খেয়াল রাখতে হবে যে, তারা এই তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার করেও কী পলিসি আনতে চায়। আরেকটি জরুরি বিষয় হল, সংসদ যখন খাতায়-কলমে এই বিলগুলি প্রত্যাহার করবে, তখন তারা কী লিখতে চলেছে কেউ জানে না। ফলে একদিকে যেমন একটা জয় এসেছে, তেমনি আবার অপেক্ষা করে দেখতে হবে কী হতে চলেছে। এই বিল প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় হল এরা এমএসপি নিয়ে কোনও কথা বলেনি। এমএসপি বিষয়টা শুধু একটু ছুঁয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এমএসপি আইনি অধিকার হিসাবে দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে কিছু বলেননি। যে আইনি অধিকার কৃষকেরা চাইছেন, তা না দেওয়া হলেও দেশে খাদ্য সংকট তৈরি হতে পারে। এমএসপি দিয়ে রাষ্ট্র ফসল কেনে – এটাই পিডিএস-এর একমাত্র গ্যারান্টি। এমএসপি দিয়ে যদি রাষ্ট্র ফসল না কেনে, তাহলে পিডিএস পুরোপুরি উবে যাবে। বিশেষত শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষদের পিডিএস-এর দাবি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়বে। পিডিএস থাকার জন্য এমএসপি ও রাষ্ট্রের ফসল নেওয়ার যে প্রক্রিয়া তা অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু তা নিয়ে কোনও কথা হচ্ছে না। তাই এই জয় যেন অর্ধেক হয়ে থাকছে। আইন প্রত্যাহার হচ্ছে, অথচ এমএসপি-পিডিএস থাকছে না, নতুন পলিসি আসছে – তাহলে বলা যায় না যে বিপদ চলে গেছে। সংসদে কী হচ্ছে আমাদের তা দেখতে হবে। আমি মনে করি ইতিমধ্যে এমএসপি ও পিডিএস নিয়ে সরকারের উপর সঠিক চাপ তৈরি করতে হবে।”
ফীচার ছবি – যোগিন্দর সিং উগ্রাহান