হিমঘরের জায়গা নিয়ে কোনো দরকষাকষি চলবে না। এই প্রশ্নে জমি কমিটি কোনো আলাপ-আলোচনায় যাবে না এবং সরকারের সিদ্ধান্তের যে কোনো নড়চড়কেই চুক্তিভঙ্গ হিসাবেই ধরা হবে। গ্রাউন্ডজিরোর রিপোর্ট।
ভাঙড় সব্জিচাষের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলের মাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রতি বছর এখানে বিপুল সব্জি চাষ হয়। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গবাসী “চারফসলি” শব্দবন্ধের সাথে পরিচিত। অর্থাৎ এই সমস্ত মাটিতে বছরে চারটি ফসল হয়ে থাকে। কিন্তু ভাঙড়ের বেশ কিছু এলাকা সাত কিংবা আট ফসলি। গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন উভয় প্রকার সব্জিই এখানে বিপুল পরিমাণে চাষ হয়ে থাকে। কলকাতার সব্জির চাহিদার অধিকাংশই ভাঙড়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই আসে। কিন্তু সমস্যা হল, ভাঙড়ে সবজি গুদামজাত করার জন্য কোনো হিমঘর নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষকদের অভাবী বিক্রি করতে হয়। কতিপয় কৃষক নিজেরাই কলকাতা লাগোয়া বাজারগুলিতে অথবা হাইওয়েগুলির ধারে সব্জি বিক্রি করেন। তাঁরা ফসলের অপেক্ষাকৃত ভাল দাম পেলেও অধিকাংশ কৃষকদের পক্ষে এভাবে সব্জির খুচরো বিক্রি সম্ভব নয়। ফলে তাঁরা ফড়েদের কাছে তুলনামূলকভাবে বেশ কিছুটা সস্তা দরে ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। সব্জি যেহেতু দ্রুত পচনশীল তাই এই সমস্যা আরও গভীর। যদিও এতে শহরের খুচরো বাজারে সব্জির দাম মোটেই কম থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ফড়েদের মুনাফা বাড়াতেই সাহায্য করে।
সুতরাং, এখানকার কৃষকদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবিই হল অবিলম্বে ভাঙড়ে একটি বহুমুখী হিমঘর স্থাপন। পাওয়ারগ্রিড বিরোধী ভাঙড় আন্দোলন পরিসমাপ্তির সময়ে সরকারের সঙ্গে আন্দোলনরত জমি জীবিকা কমিটির যে চুক্তি হয়, তাতে সতেরো দফা আঞ্চলিক উন্নয়নমূলক শর্ত সংযোজিত করেছিল জমি কমিটি। তার মধ্যে বিদ্যাধরী নদীর সংষ্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ দাবির সঙ্গে হিমঘর স্থাপন করার দাবিটিকেও যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিল। সরকার অন্যান্য দাবির মতো সেই দাবিও মেনে নিয়েছিল। সেই মর্মে সরকারের সঙ্গে জমি কমিটির চুক্তিও হয়। কিন্তু তারপর তিনটি বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও হিমঘর স্থাপন করার কাজ শুরু হল না। যদিও ইতিমধ্যে জমি চূড়ান্ত করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস চলতি বছরের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে আসার পর থেকেই জমি কমিটি হিমঘরের ব্যাপারে চাপ বাড়ায়। অতঃপর সরকার জানায় খুব তাড়াতাড়িই হিমঘরের কাজ শুরু হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই জানা যায়, হিমঘর স্থাপন করা হবে রুবি হাসপাতালের কাছে বাইপাসের কাছে একটি অঞ্চলে। এতে কৃষকদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। জমি কমিটি তাদের তীব্র আপত্তি জানায়। কিন্তু সরকার তাদের পরিকল্পনায় অনড় থাকে এবং প্রবোধ দিতে থাকে এই বলে যে, ভাঙড়ের কৃষকদের কাছ থেকে সব্জি সংগ্রহ করে হিমঘরে নিয়ে আসার দ্বায়িত্ব সরকারের। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, ফড়েদের দাপট অক্ষুন্ন রাখার জন্যেই সরকারের এই জায়গা পরিবর্তনের খেলা।
জমি কমিটি পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, হিমঘরের জায়গা নিয়ে কোনো দরকষাকষি চলবে না। এই প্রশ্নে জমি কমিটি কোনো আলাপ-আলোচনায় যাবে না এবং সরকারের সিদ্ধান্তের যে কোনো নড়চড়কেই চুক্তিভঙ্গ হিসাবেই ধরা হবে। সেক্ষেত্রে জমি কমিটিও চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য থাকবে না। লক্ষ্মীপুজোর পর অবস্থা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জমি কমিটি জানিয়ে দেয়। কিন্তু তার মধ্যে কোনো আশানুরূপ সরকারি উদ্যোগ না থাকার ফলে গত ২৭ অক্টোবর সাবস্টেশন অঞ্চলে সারাদিনব্যাপী অবস্থান এবং ‘সাবস্টেশনে তালা মারো’ কর্মসূচি নেওয়া হয়। পুলিশ-প্রশাসন জমি কমিটির নেতৃত্বকে এই ধরণের কর্মসূচি না নিতে বলে। এমনকি, পুলিশ পাঠিয়ে এবং লাঠিচার্জ করে আন্দোলন দমন করার হুমকিও দেওয়া হয়। জমি কমিটি পালটা জানিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে পুলিশের যে কোনো আক্রমণ মোকাবিলা করেই কর্মসূচি করবে জমি কমিটি। কোনো হুমকি বরদাস্ত করা হবে না। একই সঙ্গে কুড়িটি গ্রামে জোরদার প্রচার, গ্রামসভা ইত্যাদি শুরু হয়ে যায়। গ্রামসভাগুলিতে কৃষকদের বড় ধরনের জমায়েত এবং তাদের জঙ্গিমূর্তি দেখে প্রশাসন প্রমাদ গোনে। অবশেষে, ২৬ তারিখ রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে হস্তক্ষেপ করা হয় এবং ২০ নভেম্বরের মধ্যে হিমঘরের বিষয়টি সাব-কমিটির বৈঠক ডেকে ফয়সালা করা হবে বলে জানানো হয়। ২৬ তারিখ বিকেলে সরকারিস্তরে একটি মিটিংও ডাকা হয়। সেখানে, রাজ্যে বর্তমানে উপনির্বাচনের কারণে মডেল কোড অফ কনডাক্ট চালু আছে বলে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদাধিকারী মিটিংয়ে থাকতে পারছেন না বলে জানানো হয়। জমি কমিটির নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ জানানো হয়, এই বাধ্যবাধকতা মেনে সরকারকে যেন এই সময় দেওয়া হয়।
জমি কমিটি সরকারের এই অনুরোধ মেনে নিয়ে আগামী ২০ তারিখ পর্যন্ত ‘সাবস্টেশনে তালা মারো’ কর্মসূচি স্থগিত রেখেছে। ইতিমধ্যে গ্রামে গ্রামে প্রচার আরও নিবিড় করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও ২৭ তারিখ পূর্ব ঘোষণামতই সাবস্টেশন সন্নিহিত খামারআইটের মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। তাতে কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
এ লড়াই চলবে