২০১১ সালে মহিষাসুর স্মরণসভা প্রচলিত হওয়ার পর, ব্যাপকহারে এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে। তবে বর্তমানে লক্ষণীয় যে, এই সমস্ত মহিষাসুর স্মরণসভাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ একশ্রেণির ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের নেতাদের হাতে চলে যাচ্ছে। এবং জোর করে আদিবাসীদের সংস্কার-সংস্কৃতিগুলোকে ‘মূলনিবাসী’দের সংস্কৃতি বলে চালাতে চাইছেন। সেই কারণে দেখা যায়, মহিষাসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে আদিবাসীরা কাঠিনাচ- ভুয়াংনাচ করতে ব্যস্ত আছেন; আর মূলনিবাসীরা আলাপ-আলোচনারত। লিখছেন ভূপেন মাহাত।
“কাঁধে মাদৈল কর, হাতে কর লাঠি।
পাগ-পগড়ি বাঁধে নাচ- সারা সারি রে।।”
জঙ্গলমহলের কুড়মি ও কুড়মি জাতির হিতমিতান ডোম, ধোপা, নাপিত, কামার, কুমার প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা শাড়ি, চুড়ি পরে হায় হায়! রবে…
“ধে তা ধেই,
উরর্ দাধেন ধেই,
উরর্ ধে তা ধেইও….
তাক তা খিটিতা।”
বাজনার বোলে ঢোল, মাদল, ধমসার বাজনায় বীরের মতো নাচ করে চলেছেন। পাশাপাশি সাঁওতাল সমাজের পুরুষেরা শাড়িকে ধুতির মতো পরে মাথায় ময়ূর পালক বেঁধে ‘হায় হায়!’ রবে ভূয়াং নাচ করে চলেছেন। এটিই এখন প্রশ্ন, দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে এসব কেন?
ইংরেজ শাসনের অবসান হওয়ার পর থেকেই জঙ্গলমহলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাধিক সংগঠন সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে – করম, বাঁদনা, সারহুল, টুসুর মতো উৎসব অনুষ্ঠানে সরকারি ছুটি চাই। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত সরকারের এতে কোনো হেলদোল নেই। তবুও, অসীম প্রাণোজ্জ্বল হৃদয়স্পর্শী আদিবাসীদের উৎসব সমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত ও পরিচালিত উৎসবগুলো আদিবাসীরা গ্রহণও করেননি। এখন দুর্গোৎসবের ধুম শুরু হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে বহুল ভাবে প্রচার করা হচ্ছে। সরকারি কর্মীদের বিশেষ উৎসাহী করে তুলবার জন্য উপঢৌকন তথা পুজোর বোনাস দেওয়া হয়েছে। দুর্গাপুজোয় ব্রতী ক্লাব, সংঘ, সমিতিগুলোকে অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পুজোর ব্যানারে লক্ষ করা যাচ্ছে ‘সর্বজনীন’ শব্দটি। তবে, বাস্তবে দুর্গাপুজো কোনোকালেই সর্বজনীন ছিল না আর হতেও পারবে না।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ট্রাইব তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে ‘অসুর’ জনজাতির নাম। সেই জনজাতির বংশপরম্পরায় প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মহিষাসুর তাঁদের পূর্বপুরুষ। তাই গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে একটি আদিমতম জনজাতির বিশ্বাসে আঘাত করে সেই জাতির প্রতিনিধিকে ত্রিশূলবিদ্ধ অবস্থায় জনসমক্ষে উপস্থাপন করে উল্লাসী উৎসব অনুষ্ঠিত করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সমালোচনা করার প্রয়োজন আছে। রীতিনীতিতে অসুর জনজাতি খেরওয়াল কবিলারেই অংশ। তাই সেই রীতি অনুসারেই জঙ্গলমহলের সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু সংস্কার, সাংস্কৃতিক অনুভূতি রয়েছেই। যেমন কুড়মিদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে কাঠিনাচ। মুন্ডাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে দাঁশাইনাচ। সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে ভুয়াংনাচ।
প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী প্রাচীন কালে আদিবাসীদের রাজা হুদূড়দুর্গা (মহিষাসুর) পরাজিত হওয়ার পরেই এইসব নাচের উৎপত্তি। নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা আদিবাসীদের রীতি বিরুদ্ধ। তাই, মহান সম্রাট হুদূড়দুর্গা দেবীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করে প্রাণ বিসর্জন দেন। সম্রাটের সৈন্য-সামন্তরা নারীর বেশে শাড়ি-চুড়ি পরে দেশান্তরে পালিয়ে যায়। সেই রীতি মেনেই আজও দাঁশাই, কাঠি, ভুয়াংনাচের প্রচলন রয়েছে । তবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চাকচিক্য-বিজ্ঞাপনের বাহুল্য সেই রীতিকে ম্লান করে দিতে চাইছে। এমনই এক যুগ সন্ধিক্ষণে ২০১১ সালে পুরুলিয়ার ভালাগোড়াতে চারিআন মাহাত ও অজিতপ্রসাদ হেমব্রম মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে হুদূড়দুর্গা স্মরণসভার শুরু। ২০১১ সালে মহিষাসুর স্মরণসভা প্রচলিত হওয়ার পর, ব্যাপকহারে এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে। তবে বর্তমানে লক্ষ্যণীয় যে, এই সমস্ত মহিষাসুর স্মরণসভাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ একশ্রেণির ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের নেতাদের হাতে চলে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এদের বড় অংশই দেশভাগের পর পূর্ব-পাকিস্থান থেকে আগত। এর পরেই তপসিলি জাতির শংসাপত্রের জোরে নিজেদের ‘মূলনিবাসী’ হিসেবে প্রচার করে চলেছেন। এবং জোর করে আদিবাসীদের সংস্কার-সংস্কৃতিগুলোকে মূলনিবাসীদের সংস্কৃতি বলে চালাতে চাইছেন। সেই কারণে দেখা যায়, মহিষাসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে আদিবাসীরা কাঠিনাচ-ভুয়াংনাচ করতে ব্যস্ত আছেন; আর মূলনিবাসীরা আলাপ-আলোচনারত। ব্রাহ্মণ্যবাদের বশ্যতার বাইরে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায় তবে কি ঐ দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকগুলোর বশ্যতা স্বীকার করতে চলেছে? নামে মহিষাসুর স্মরণসভা, আর আলোচনা করা হবে এনআরসি সমস্যা নিয়ে। কিন্তু কুড়মি জাতির আত্মবিকাশের, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা নাই। সিএনটি (ছোটনাগপুর টেনান্সি) বা এসপিটি (সাঁওতাল পরগনা টেনান্সি) নিয়ে আলোচনা নেই। কারণ, আমাদের সমাজের প্রকৃত প্রতিনিধির অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে অভাব রয়েছে সংস্কার-সংস্কৃতি চেতনার। নাহলে, বিশেষ স্থানে যেনতেন প্রকারে মহিষাসুর মূর্তি গড়ে দুটো ফুলমালা পরিয়ে ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে দায় সারা, তারপর সুযোগ বুঝে সপরিবারে দুর্গাপুজার প্যান্ডেল দেখতে যাওয়ার মতো দ্বিচারিতা দেখা যায় কেন? এই সবের থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র রীতি অনুসারে ‘কাঠিনাচ বা দাঁশাইনাচ’ করা।
কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজের মৌলিকতা বিসর্জন সঠিক নয়। আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? আমার মূল পরিচয় কী? সেটা আমাকেই জানতে হবে। তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা আমাকে গ্রহণ করতে হবে যাতে আমি আমার সঠিক ইতিহাস জানতে পারি। তারপর আমার প্রাপ্য অধিকার আমাকেই অর্জন করতে হবে ন্যায়সঙ্গত পথে। সেখানে আমি যেন বিকিয়ে না যাই এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। না হলে তুমি/আমি/আমরা/আপনারা বার বার বিক্রি হব/হবেন বা্জারজাত পণ্যের মত। তাই কেউ বললেই আমি তাকে সহজে মেনে নেব না। সে ভুল বলছে না সঠিক বলছে তাকে যাচাই করে নিতে হবে সে বিষয়ে গভীর অধ্যায়ন করে। সামগ্রিক মঙ্গল আমার সমাজে হবে কিনা সেটা বিচার করতেই হবে। না হলে সে আমাকে তার লাভের এজেন্ট হিসাবে ব্যবহার করে যাবে। আর যখনি তার স্বার্থ শেষ হবে তখনই সে আমাকে ত্যাগ করবে।
একথা সকলকেই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি অনুসারে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। সেই অনুযায়ী দুর্গাপূজা ও মহিষাসুর স্মরণসভা দুটোই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কিছু উপকথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন কুড়মি সমাজের মধ্যে বিদুমুখীর গল্প, শেয়ালের গল্প, কর্মু- ধর্মুর গল্প ইত্যাদি রয়েছে; তেমনি সাঁওতাল সমাজের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানান কথা-কাহিনি। তেমনি একটি উপকথা এই ‘হুদূড়দুর্গা’র কাহিনিটি। সম্প্রতি এটিকে রং চড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌরাণিক কাহিনি ‘মহিষাসুর’এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করেই মূলত জঙ্গলমহলের মহিষাসুর স্মরণসভাগুলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে যে, “কোল কুড়মি কড়া; বেদ বিধি ছাড়া।” কিন্তু এই মহিষাসুর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত করতে গিয়ে কি পরোক্ষভাবে সেই হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিকেই স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে না? খেরওয়াল আদিবাসীদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে, এরা প্রকৃতির উপাসক। বর্ণহিন্দুরা তাদের পুজোআচ্চা, রীতিনীতিতে এই অনার্য সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে। দুর্গাপুজোয় ঘটোত্তলোন, নবপত্রিকার পূজা, সন্ধিপূজা সেই প্রকৃতির উপাসনার পরিচয় বহন করে চলেছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে রঙ্গিনী, সাতবহনী, চণ্ডী, কনকদুর্গা-সহ আদিবাসী দেবীদের পূজার পীঠস্থান রয়েছে। চণ্ডী এখানে নানা রূপে পূজিত হন যেমন জয়চণ্ডী, গুপ্তমণি, ভেটিয়াচণ্ডী, কালুয়াষাঁড়, বালিয়াবুড়ি। যা প্রাগার্য সংস্কৃতির অঙ্গ। তাহলে হঠাৎ করে এই সব পূজা বর্জন করা সম্ভব কীভাবে?
কুড়মি সমাজের পরব গণনার রীতি অনুসারে আশ্বিনের অষ্টমী তিথিতে জমিনের ধানখেতে গুঁড়ি দিয়ে জাগানোর রীতি আছে। এবং এটা সন্তানসম্ভবা ধান গাছকে স্বাদ খাওয়ানো বলে মনে করা হয়ে থাকে। তাছাড়া আরও একটি প্রবাদ পাওয়া যায় যে, “জিতা ভাসে বোধন আসে।” যা নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রচলিত হলেও প্রতিফলন দেখা যায় কুড়মি ও কুড়মি জাতির হিতমিতান জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ‘জিতিয়া পরব’ এর পর ‘বোধন’ শুরু। অনেকের মতে দাঁশাই আসলে জলের আরাধনা। অর্থাৎ এই সবের থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে, দুর্গামূর্তির রণংদেহী রূপ হয়তো-বা আদিবাসীদের সমাজের প্রকৃতির আরাধনাকে বিকৃতি ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
আদিমতম জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো টোটেমবাদ। নাগ, কচ্ছপ, হাঁস বিভিন্ন জীবজন্তু বা গাছগাছালির নামে টোটেম সাঁওতাল, অসুর, মুন্ডা, কুড়মি-সহ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু মহিষ টোটেমটি কেবল কুড়মিদের রয়েছে। ষষ্ঠী তিথিতে গেরুটিকা দেওয়ার রীতি। এক জাতীয় পাথর থেকে গেরুয়া রং মেলে। এবং বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দেওয়ালে দেওয়ালে টিকা লাগান হয়। এই অনুসারে একটি টোটেম রয়েছে গেরুআর। এটিকে অনেকেই মহিষাসুরের রক্ত হিসেবে প্রচার করছেন; তাহলে মেনে নিতে হবে যে, দুর্গার সাথে মহিষাসুরের যুদ্ধের পর এই সমূহ টোটেম সৃষ্টি। অর্থাৎ আর্য আক্রমণের পর। এটা সম্পূর্ণ ভুল। তাই, এখনও সময় আছে, আবেগ নয় বিবেক ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যে, দুর্গাপূজার বিরুদ্ধে মহিষাসুর স্মরণসভা করার প্রয়োজন আছে নাকি আদিবাসীদের আদিম সংস্কৃতি অনুসরণ করে দাঁশাই, কাঠি, ইত্যাদি নাচ এবং প্রকৃতির পূজা করা প্রয়োজন আছে। সাঁওতাল সমাজের প্রচলিত পরম্পরা দাঁশাই নাচের মধ্যে ‘হুদূড়দূর্গা’-র কাহিনি প্রচলিত থাকলেও কুড়মিদের কাঠি নাচের মধ্যে সেরকম কিছু প্রাচীন গীত এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। বরং প্রবাদ রয়েছে যে,
“বার’ই বিঁধা ষলো’ই পার্বন বিশে বাঁদনা।”
অর্থাৎ পার্বণ (বর্তমান শারদোৎসব) কুড়মি সমাজের প্রচলিত উৎসব। এর উপলক্ষ্যে করা কাঠি নাচের গীত করুণ রসাত্মক এবং বাজনা বীর রসাত্মক। ‘হায় হায়’ ক্ষেদোক্তি দিয়ে গীতটি গাওয়া শুরু হলেও বাজনাটি যুদ্ধের দামামার মতো বাজে। পরাজিত সৈনিকের মতোই যুবক কুড়মিরা শাড়ি, চুড়ি পরে হাতে লাঠি নিয়ে করুণ সুরের গীতে রনহুংকার দেয়। তবে কি এটা সেই সাঁওতালি ‘জমসিম বিনতি’ কাহিনি “চম্পা ধাবিচরে আলে (সাঁওতাল) আর কুঁড়বি মুন্ডা বিরহড় তাঁহেকানা!” কথাটির সত্যতা স্বীকার করে চলেছে সেখানে, যেখানে আর্য সেনাপতি ইন্দ্র একটার পর একটা নগর ধ্বংস করেছিলেন। ফলত সেখানকার মানুষজন অন্যত্র পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কথিত কারণ, সিন্ধু সভ্যতার শেষ চিহ্ন যে অংশে পাওয়া গেছে সেটার নামও চম্পা। কুড়মালি সংস্কৃতিবিদগণ বেশিরভাগেরই দাবি করে আসছেন সিন্ধু সভ্যতায় তাদের বসতি ছিল; সামগ্রিক খেরওয়াড় জনজাতির সাথে। অনুমান এই যে, সেখানকার রাজা ছিলেন সম্রাট হুদূড়দূর্গা। যিনি অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত হন।
আসলে কুড়মিরা প্রাচীন আদিবাসী এরা প্রকৃতি পূজারী এদের মূর্তি পূজা নেই যা রিজলে, গিয়ারসন, ডাল্টন ইত্যাদি নৃতত্ত্ববিদদের লেখা থেকে পাওয়া যায়। আমাদের সেদিকটাই প্রচার করা উচিত। কিন্তু, কিছুজন দুর্গাপুজো করছে আবার কিছুজন মহিষাসুরকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছে। দুর্গার মতো মূর্তিপুজো শুরু করিয়ে এক সময়, ১৯২১- ৩১ এর মধ্যে, সব অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে হিন্দু ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের ‘কুর্মি’রা। রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করেছে কুড়মি আদিবাসী সম্প্রদায়কেও। ফলত, বর্তমানে কুড়মিরা আর এসটি বা তফসিলি জনজাতি হিসেবে স্বীকৃত নয়। তালিকায় তাঁরা নেই। এখন শুরু হয়েছে নতুন খেলা মহিষাসুর নিয়ে যা দিয়ে তাঁদের ‘দলিত’ বানাতে চাইছে কিছু রাজনৈতিক দল, শুধু তাদের রাজনৈতিক জমি। প্রকৃতি পূজক কুরমিরা, প্রকৃতিই আমাদের আরাধ্য। আমাদের সমস্ত পূজা পরব করম, সহরাই থেকে শুরু করে সব প্রকৃতি কেন্দ্রিক। আর আমাদের মূল পূজা গরাম পূজা যা মূলত গাঁও দেওতা যা আমরা মড়ই নামে জানি। আমাদের প্রথাগত সমাজব্যবস্থায়, পুজো-পরব বিয়ে, শ্রাদ্ধ, মুখেভাত, ছিঠ ইত্যাদি কোনো কিছুতে ব্রাহ্মণ ছিল না। রিজলে, গিয়ারসন ,ডাল্টনদের মতো নৃতত্ত্ববিদদের লেখা থেকে সে কথা জানা যায়। কিন্তু নাপিত, ধোপার উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এই সব অনুষ্ঠানের পরিচালক প্রত্যেক পরিবারের কর্তারাই ছিলেন। কোনো মোড়ল এরও উল্লেখ পাওয়া যায় না। যা ছিল খুব সহজ সরল পদ্ধতি যা প্রতিটি পরিবার খুব সহজে পালন করতে পারবে। আমাদের সমাজে পণপ্রথা ছিল না। এখন এর বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলন দরকার। আমাদের মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রথা মাননীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নেতৃত্বে চালু করার আগে থেকেই চালু ছিল। এই প্রাচীন কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে আমাদের ধীরে ধীরে ফিরে যাওয়া উচিত। আমরা তা চেষ্টা করছি কিন্তু কোথাও মহিষাসুরকে নিয়ে কিছু লেখা পাইনি। তাই আমরা যা ছিলাম সেখানেই ফিরে যাওয়া উচিত। নতুন কিছু আর আমাদের স্মরণ করার দরকার নেই। কুড়মি জাতি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি যা আজ কিছুটা ক্ষতিকারক সামাজিক প্রভাবে আবিষ্ট। আমাদের বেশিরভাগ পুজো আগে অন্য নামে ছিল এগুলোকে পরিবর্তন করা হয়েছে ভুল বুঝিয়ে এবং ব্রাহ্মণ ঢুকেছে পুজোর নামে ব্যবসা করার জন্য। দুর্ভাগ্য শিক্ষিত কুড়মিরা জানার চেষ্টা করেনি এতদিন বা জানতেও দেওয়া হয়নি বা জেনেও চুপ করে গেছেন আত্মকেন্দ্রিক জীবনের বশবর্তী হয়ে। বা বলার ইচ্ছে থাকলেও উপযুক্ত পরিস্থিতি পাননি। কোনো চুরিচামারির পথ নয় বুক ফুলিয়ে বলুন আমি কুড়মি আমি আদিবাসী। এসটি স্বীকৃতি আমার অধিকার আমাকে তা ছিনিয়ে নিতে হবে।লড়াই চাই এই অধিকার অর্জনের জন্য। বিপ্লব চাই এ সমাজের বুকে।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, যাঁরা শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, আপনারা বছরের অন্য ঋতুকে কেন্দ্র করে যেমন বর্ষার প্রীতি ও শুভেচ্ছা, বসন্তের প্রীতি ও শুভেচ্ছা, হেমন্তের প্রীতি ও শুভেচ্ছা, শীতের প্রীতি ও শুভেচ্ছা, গ্রীষ্মের প্রীতি ও শুভেচ্ছা এসব শুভেচ্ছা জানান কি? আপনারা যাঁরা আদিবাসী (ট্রাইব) তালিকায় এক নম্বর স্থানে থাকা অসুরনিধন উপলক্ষ্যে শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তাঁরা পৌন্ড্রনিধন, নমঃশূদ্রনিধন, ব্রাহ্মণনিধন, কায়স্থনিধন, রাজবংশীনিধন, বাগদিনিধন, দলিতনিধন, মুসলিমনিধন – এইসব উপলক্ষ্যে কী প্রীতি শুভেচ্ছা জানাবেন?
না এটা লক্ষ্য করা যায় না।
তবে কি কেবলমাত্র আদিবাসীদের নিধন করা সবার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে? হয়তো তাই, কারণ কোনো জাতির অস্তিত্ব বিলীন করতে হলে সর্বাগ্রে সেই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে। সম্প্রতি সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে আদিবাসীদের একাংশ। রমরমিয়ে চলছে মহিষাসুর স্মরণসভা। আর পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে ‘অসুর পূজা’। ব্যাস! কিছুদিন পর আমাদের সমাজের উত্তরসূরিরা বলতে শুরু করবে এটা আমাদের যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়া এই কাল্পনিক চরিত্র দুর্গার বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে মহিষাসুরকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করলে পরোক্ষ ভাবে হিন্দু ধর্মের দেবী দুর্গাকেও ঐতিহাসিক হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়। সম্প্রতি আসামে ঐ মহিষাসুর স্মরণসভা না হয়ে ‘মহিষাসুর পূজা’ উদযাপিত হয়েছে। হয়তো-বা এইভাবেই কুড়মি জাতির টুসু পরবের মূর্তি পূজার সূচনা হয়েছিল একসময়। যা এখনও সম্পূর্ণ রূপে মূর্তি পূজা হিসেবে পরিচিত হয়নি। পদ্মপুরাণ, মনসামঙ্গল প্রভৃতি রচনার পর মনসার কাল্পনিক মূর্তি পূজার সূচনা হয়েছে, আজ থেকে হয়তো দেড়শো বা দু’শো বছর আগে। যা আসলে ছিল ‘বারি’ (জল) পূজা। এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি, একটি কোনো এক কুড়মি পরিবারে sবাঁদনা পরবের গোরোইয়া পুজোর দিনে, গোরোইয়া পুজোর ভোগের জন্য তৈরি করা ঘিয়ের পিঠা বাড়িতে পোষা বিড়ালটি খেয়ে নিতে পারে এই আশঙ্কায় বাড়ির গিন্নি বিড়ালটিকে ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে ছিলেন। পরের বছর সেই পরিবারের গিন্নি বাপের বাড়ি চলে যান। ততদিনে বেড়ালটিও মারা গেছে। এমতাবস্থায় সেই বাড়ির বউমার উপর গোরোইয়া পূজার পিঠা তৈরি করার দায়িত্ব পড়েছে। বউমার তখন পাশের পড়শি বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করতে শুরু করেছেন, “তোমাদের বাড়িতে বিড়াল আছে গো? আমি ঝুড়িতে ঢাকা দিয়ে পিঠা বানাবো!”
বিষয়টি তেমনি। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব দুর্গাপুজোর সময় খেরওয়াল সংস্কৃতি অনুসরণ করে আদিবাসী সমাজে ষষ্ঠী তিথিতে গেরুটিকা, অষ্টমী তিথিতে বিল জাগানো প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত আছে পিঠে-পুলি খাওয়ার রীতিও; সেই সঙ্গে কাঠি নাচ, দাঁশাই নাচ ইত্যাদি। কিন্তু সে সবের সঠিক প্রয়োগ- প্রচার না করে বহু আদিবাসী সংগঠন মহিষাসুর স্মরণসভায় মনোনিবেশ করে ফেলেছে। ফলে মানসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিপথগামী হতে চলেছেন আদিবাসীরা। এবং আদিবাসীদের পরিণতি ঘটবে মূলনিবাসী বা দলিত হিসেবে। তাই, আবেগসর্বস্ব কিছু করবার আগে তার ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা ও চিন্তা করা প্রয়োজন।
তথ্য কৃতজ্ঞতা: প্রলয় হাঁসদা, রূপচাঁদ মাহাত। লেখক রাজ্য কুরমি সমাজ-এর সদস্য। মতামত লেখকের নিজস্ব।
Please send me some books name on this topic for further study and details I am waiting for your answer