নবজাতক আর মায়ের দুর্ভোগ ঘুচবে কবে?


  • October 8, 2021
  • (0 Comments)
  • 980 Views

কেন্দ্রের ‘আশা প্রকল্প’, ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’ ও ‘মাতৃ বন্দনা যোজনা’; রাজ্য সরকারের ‘বাংলা মাতৃ প্রকল্প’ — মা ও সদ্যোজাতর কল্যাণে কত না যোজনা, কত না ঘোষণা! কিন্তু বিসমিল্লায় গলদ! বাস্তবে আজও শিশুর জন্মলগ্নটা অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কায় মোড়া। লিখেছেন চৈতালি সেন

 

প্রায় ১৮ মাস অঙ্গনওয়ারি বন্ধ। বন্ধ মিড ডে মিলও।  তার বদলে মাসিক শুকনো রেশনে আর যাই হোক পুষ্টি মেলে না। অপুষ্টি, দারিদ্র, অতিমারীর দেশে  শিশু ও সন্তানসম্ভবা কিংবা সদ্যোজাতের মায়েরা ক্রমে অপুষ্টির অতলে ডুবছে। এ একটি দিক। অন্যদিকে, যে মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয় সেই মায়েদের কেন্দ্রের ‘মাতৃ বন্দনা যোজনা’র ৬,০০০ টাকা ও রাজ্যের ‘বাংলা মাতৃ প্রকল্প’র ৫,০০০ টাকা ধাপে ধাপে পাওয়ার কথা, কিন্তু খুব ছোট্ট অংশই পাচ্ছেন এখন। অর্থাৎ কিনা, মা ও শিশুর পুষ্টির প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অজুহাত — করোনাকাল! আবার যে ‘আশা’ দিদি গর্ভবতীকে প্রায় দশ মাস নিষ্ঠার সাথে পরিষেবা দেন তিনিও সরকারি হাসপাতালে প্রসব বাবদ প্রাপ্য ৩০০ টাকা থেকে বঞ্চিত হন।

 

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির হুগলি জেলা শাখার তরফ থেকে পোলবা-দাদপুর, ধনিয়াখালি, পান্ডুয়া, বলাগড়, মগরা — এই পাঁচটি গ্রামীণ ব্লকে অগষ্ট-সেপ্টেম্বরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেল সর্বত্র ব্লক হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা থাকলেও বলাগড়, পোলবা-দাদপুর ও মগরায় সিজারিয়ান ডেলিভারির কোনো ব্যবস্থা নেই। সুতরাং সিজারিয়ানের প্রয়োজন হলে তাঁদের যেতে হবে সেই সদর হাসপাতালে। আর প্রতি সপ্তাহে পাণ্ডুয়ায় মাত্র একদিন, ধনিয়াখালিতে চারদিন সিজারিয়ান হয়। অর্থাৎ অন্য দিনগুলোতে যদি কোনো সন্তানসম্ভবার সিজারিয়ানের প্রয়োজন হয় তবে তাঁকে ছুটতে হবে সদর হাসপাতালে। আবার সিজারিয়ানের জন্য নির্ধারিত ঐ দিনগুলোতে ব্লকের ডাক্তাররা গর্ভবতীর কোনো জটিলতা দেখলে সদর হাসপাতালে রেফার করে দেন। কারণ ব্লক হাসপাতালে সিজারিয়ানের কোনো উন্নত ব্যবস্থা নেই।  অথচ সরকার নাকি মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে!

 

পরিকাঠামোগত সমস্যাও অনেক আছে। প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স এবং বেড অপ্রতুল। কোনো হাসপাতালেরই নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স নেই। ‘পেশেন্ট পার্টি’ ১০২ নম্বরে ফোন করে মাতৃযান অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে পারেন। কিন্তু সবসময়ে তা পাওয়া যায় না। তখন ‘আশা’ দিদিরা প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট গাড়ি, ভ্যান রিকশা যাই হোক না কেন আসন্ন প্রসবাকে খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে দীর্ঘ পথ বেয়ে নিয়ে যাওয়া ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। তাতে মা ও গর্ভস্থ  শিশুর অবস্থা অনেক সময় আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে, এমনকি  প্রাণহানিরও নজির আছে। তাই গর্ভবতী ও তাঁর পরিবারের লোকজন অনেক সময় সদর হাসপাতালে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে ধারদেনা করে হলেও কাছাকাছি কোনো নার্সিংহোমে যেতে বাধ্য হন। যাঁদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে তাঁদের কিছুটা আর্থিক সুরাহা হয় বটে, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসব না হওয়ার জন্য প্রসূতিরা নার্সিংহোমে যাতায়াতের কোনো গাড়ি ভাড়া এবং প্রসবের পর মায়েরা সরকারি প্রকল্পের যে প্রাপ্য অর্থ — কোনটাই পান না।

 

এছাড়া ব্লক হাসপাতালে সদ্য-ভূমিষ্ঠ শিশুর কোনো শারীরিক সমস্যা হলে, সেখানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তাকে সদর হাসপাতালে সিক নিউবর্ন স্টেবিলাইজেশন ইউনিটে (এসএনএসইউ) রেফার করা হয়। তখন সদ্যজাতককে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়াও অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোই গর্ভবতীদের মূল পরিষেবা কেন্দ্র। অথচ সেখানে গাইনোকোলজিস্ট নেই। সেই দায়িত্ব পালন করতে হয় এএনএম (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ) দের।

 

মেয়েদের আরও ভোগান্তির কথা জানা গেল। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিভিন্ন রকম টেস্ট হওয়ার কথা, কিন্তু  সর্বত্র তা হয় না। গ্রামীণ হাসপাতালগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। পাণ্ডুয়া ব্লকে চারটি হাসপাতালের মধ্যে বিএলএম মুখার্জি বৈঁচি গ্রামীণ হাসপাতাল ও ইটাচুনা হাসপাতাল দু’টিতে পরিষেবা মিললেও পোলবা-দাদপুর ব্লকে এখন নামে চারটি হাসপাতাল।  কিন্তু কী করুণ হাল তাদের! পোলবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই মানুষের ভরসা। তবে আরো ভালো পরিষেবার জন্যে পোলবা-দাদপুরের মানুষ সদর হাসপাতাল চুঁচুড়ায় চলে যান। ধনিয়াখালি ব্লকে চারটি হাসপাতালের মধ্যে মাদ্রা আর ধনিয়াখালি হাসপাতাল চলছে, বাকি দুটির মধ্যে বাগনান হাসপাতাল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে  চলে। আর ভান্ডারহাটি হাসপাতালে বহু মানুষ আসতেন প্রাথমিক পরিষেবাটুকু পেতেন, স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থাও ছিল, এখন তা এক জরাজীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে! বলাগড় ও মগরা ব্লকে মাত্র একটা করে গ্রামীণ হাসপাতাল, তা মোটামুটি চলছে। ২০১৮ সালে ধনিয়াখালি হাসপাতালকে মুখ্যমন্ত্রী স্টেট জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করলেও, পরিষেবা ও পরিকাঠামোর কোনো উন্নতি আজও হয়নি। বর্তমানে কোভিড চিকিৎসার জন্যে ডাক্তারদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে শহরে। একটি হাসপাতাল বাদে প্রায় সর্বত্রই এখনও তাঁদের ফিরিয়ে আনা হয়নি। গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি চিরন্তন অবহেলার এ আর এক নিদর্শন।

 

এই সমস্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উপরোক্ত পাঁচটি ব্লকে আলোচনার জন্য মহিলা সমিতির প্রতিনিধিরা বিডিও এবং ব্লক মেডিক্যাল আধিকারিকদের ডেপুটেশন দেন। তাঁরা সমস্যাগুলোর কথা মেনে নিয়ে বলেন — আপনারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে ধরেছেন, এই কর্মসূচি চালিয়ে যান। এমনকি আরও নানা ঘাটতির তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করেন। যেহেতু সমাধানের ক্ষমতা তাঁদের হাতে নেই, তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে বলাগড় এবং পাণ্ডুয়া ব্লক প্রশাসন ভারপ্রাপ্ত ব্লকের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ভীষণ উদাসীন। বরং সমিতির প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে তাঁকে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করান। ডেপুটেশন চলাকালীন বাইরে সমিতির ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শনও চলে।

 

জেলা যুগ্ম সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটার্জি ও চৈতালি সেন, সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জি, অর্পিতা রায়, পার্বতী মুর্মু ও সাবিয়া খাতুনরা এই সমীক্ষা ও কর্মসূচিতে অংশ নেন।  রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের সদস্যরা, ‘আশা’ দিদিরা এবং কিছু সাধারণ মহিলাও এই কর্মসূচিতে  নানা ভাবে সহযোগিতা করেন। আমাদের সমীক্ষা চলবে এবং আরও কিছু কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

 

গ্রাম বাংলায় ছোট পরিধির এই অনুসন্ধান ও আন্দোলন করতে গিয়ে সঙ্গী-সাথিদের যে উৎসাহ ও সাধারণ মানুষের তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের যে সাড়া পাওয়া গেছে, তাতে দু’টি কথা বারবারই মনে হয়। এক, আরও কয়েকটি জেলায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বহু ইস্যু তো রয়েছে তা নিয়ে এ ধরনের অনুসন্ধান-আন্দোলন গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, মা ও শিশুর সমস্যাগুলো বৃহত্তর জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের এক অন্যতম প্রধান অঙ্গ। এই ইস্যুতে রাজ্যস্তরে ‘একুশের  ডাক’ ব্যানারে একটা কনভেনশন করা যেতে পারে। এবং সমস্যাগুলোর সমাধান মূলত রাজ্য সরকারের ওপরেই বর্তায়, পরবর্তীতে স্বাস্থ্যভবন যাওয়া যায়।
মোদী সরকারের ‘আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প’ আর রাজ্য সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প’ হোক, কোনোটাতেই স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নতি হবে না। কোভিড-১৯ এর ঝড় তা আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ‘স্বাস্থ্য আমার অধিকার’ — এই দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সামিল করে বড় পরিধিতে আন্দোলন গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি।

 

লেখক সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির হুগলি জেলার যুগ্ম সম্পাদিকা।

 

Share this
Leave a Comment