লাতিন আমেরিকার বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বড় সময় জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একনায়কতন্ত্র, যার বিরুদ্ধে বহুধারার লড়াই লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের অঙ্গাঙ্গী অংশ। আজ যখন আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের বাস্তবতা, তখন কীভাবে দেখব আমরা এই আন্তর্জাতিক ইতিহাসকে? কী শিক্ষা নেব লাতিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের ধারা থেকে? বিশেষ করে যখন কারারুদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিকরা? যখন রাষ্ট্র, ভারভারা রাও, জিএন সাইবাবার মতো কবি, মেধাজীবীদের জেলে পুরে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করতে তৎপর? লাতিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের ধারার অন্যতম কবি – ভিক্তোর হারা। আজ ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর ৪৮তম মৃত্যুদিন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য।
ভিক্তোর হারা বলেছিলেন, “We are who we are because of love. And we want to be better because love exists. The world turns, creates, multiplies because of love.” তাঁর গানও ছিল ভালোবাসার জন্য, যে ভালোবাসার অন্য নাম মুক্তি, যে ভালোবাসার অন্য নাম সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়, কারণ ওরা, আর সবার মতো ওই হত্যাকারীরাও বিশ্বাস করত, ভিক্তোর হারার একটি গান একশত মেশিন গানের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তাই পিনোচেতের সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করতে ৪৪টা গুলি ব্যবহার করেছিল। তাঁর মাথায়, বুকে, পেটে, হাতে ও পায়ে সর্বত্র গুলির চিহ্ন ছিল। গুলি করার আগে নৃশংস অত্যাচার করেছিল তাঁর উপর। তাঁর অপরাধ ছিল একটি : তিনি গান গাইতেন। তাই যে হাতদুটো গিটার বাজাত তাদের পিষে দেওয়া হয়েছিল আর যে কণ্ঠ শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার দাবি করেছিল (‘El derecho de vivir en paz’) তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, না হলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভিত্তিমূল পোক্ত হবে না যে।
ভিক্তোর হারা, পুরো নাম ভিক্তোর লিদিয়ো হারা মার্তিনেস, চিলের গায়ক, সঙ্গীতকার, সুরকার, লোকসঙ্গীত ও লোকবাদ্যের গবেষক, নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা। বব ডিলান ও মার্টিন লুথার কিং-এর সম্মেলন যে মানুষটির মধ্যে ঘটেছিল তার নাম ভিক্তোর হারা। তাঁর জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২, চিলের লোঙ্কেন গ্রামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ভিক্তোরের মা লোকসঙ্গীত গাইতেন। ১৯৫৭ সালে ভিক্তোর চিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগে যোগ দেন। ওই বছরই বিখ্যাত গায়িকা, ‘নতুন গান’ (Nueva canción) আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা বিয়োলেতা পাররার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ভিক্তোরের লোকগীতির প্রতি আগ্রহ অন্য মাত্রা পায়। তখন তিনি কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে লোকগানের জগতকে দেখতে শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ, নাম – ‘ভিক্তোর হারা’। পাশাপাশি চলে নাটক পরিচালনার কাজ। এই বছরেই পরিচালনার জন্য ইংলন্ড থেকে পুরস্কার পান। সেখানেই বাবা-মাকে নিয়ে রচনা করেন তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘Te recuerdo Amanda’ (তোমায় স্মরণ করি আমান্দা)। ১৯৬৯-এ দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘রাখলাম তোমার খোলা হাতে’ (Pongo en tus manos abiertas)। তারপর ১৯৭০-এ তিনটি অ্যালবাম – ‘মুক্তির গান’ (Canto libre), ‘শান্তিতে বাঁচার অধিকার’ (El derecho de vivir en paz) এবং ‘জনগণ’ (La población)। ইতিমধ্যে তিনি প্রেসিডেন্ট সালবাদোর আইয়েন্দের প্রচারে অংশ নিয়েছেন। পৃথিবীর একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মার্ক্সবাদী প্রেসিডেন্ট হলেন আইয়েন্দে। তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ভিক্তোর হারার গান। আইয়েন্দের শাসনকালে তিনি সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেন। ততদিনে তাঁর সঙ্গীতের মাধুর্য গোটা লাতিন আমেরিকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে তখন ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে দক্ষিণপন্থীদের আগ্রাসন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আইয়েন্দের নির্বাচনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করছে এবং আরেকটি কুবা তৈরি হওয়ার আশঙ্কায় চিলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্যারামিলিটারি দল তৈরিতে সহযোগিতা করছে। সে দেশের অর্ধেকের বেশি জনগণ, যারা আইয়েন্দেকে সমর্থণ করেছিল, তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। সৈন্যরা কাউকে ধরলে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে নিরপরাধ।
একবার ভিক্তোর একটি স্কুলে যান গান গাইতে। সেখানে তিনি একজন মন্ত্রী, যার নির্দেশে দক্ষিণ চিলেতে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে কথা বললে সেখানেই উপস্থিত সে মন্ত্রীর ছেলে এমন গণ্ডগোল ও ভাঙচুর শুরু করে যে ভিক্তোর পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
তারপর এল সেই দিন, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩।
দিনটা শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই। কিন্তু সকাল একটু গড়াতেই রেডিওয় শোনা গেল বহু জল্পনার সেই সেনা অভ্যুত্থান বাস্তবে ঘটতে চলেছে। বলা হচ্ছে সবাই যেন যে যার কাজের জায়গায় থাকে, কারখানাগুলো থেকে কেউ না বেরোয় আর প্রস্তুত হয়ে থাকে ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য। ভিক্তোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে, যেখানে জনসংযোগ বিভাগে তিনি কাজ করতেন। তার দু’ ঘণ্টা বাদেই রাষ্ট্রপতির মোনেদা প্যালেসে বোমাবর্ষণ শুরু হয়। সালবাদোর আইয়েন্দে মৃত্যুর আগে শেষ বার্তায় বললেন: “Placed in a historic transition, I will pay for loyalty to the people with my life. And I say to them that I am certain that the seed which we have planted in the good conscience of thousands and thousands of Chileans will not be shriveled forever.” তারপরেই তিনি মেশিনগান হাতে তুলে নেন ও আত্মহত্যা করেন। এর পরে শুরু হয় আউগুস্তো পিনোচেতের একনায়কতন্ত্রের কঠিন সময়।
সেই দিন সন্ধ্যাবেলা ভিক্তোর বাড়িতে ফোন করে জানান যে, কারফিউ জারি হওয়ায় তিনি বাড়ি ফিরতে পারছেন না। পরের দিন সকালে ১০০ জন মিলিটারি কামান ও অন্যান্য অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে এগিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কোনও রকম সতর্কতা জারি না করেই মেশিন গান চলতে শুরু করে। সকলকে বাইরে বের করে আনা হয়, শিক্ষক ও ছাত্রদের সবাইকে, মাথার উপর হাত তুলে তারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিক্তোরও ছিলেন তাদের মধ্যে। তারপর তাদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় স্টেডিয়ামে। নিয়ে যাওয়ার পথেই শুরু হয় নারকীয় অত্যাচার। তারা সংখ্যায় ছিল প্রায় ৫-৬ হাজার। স্টেডিয়ামে যখন পৌঁছায় তখন সকলেই আহত, কারো পায়ে জুতো নেই তো কারো পরনের প্যান্ট পর্যন্ত নেই। তাদের টেনে-হিঁচড়ে স্টেডিয়ামের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। তারপর রাতে সেনাবাহিনী ভিক্তোরকে নিয়ে যায় এবং শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার উপর এই অত্যাচার চলতে থাকে। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। তারপর আরও ২০-৩০টা মৃতদেহের সঙ্গে ডাঁই করে ফেলে রাখে ভিক্তোরের নিষ্প্রাণ দেহ। মারা যাওয়ার দু’ ঘণ্টা আগে লিখেছিলেন জীবনের শেষ গানটি: ‘আমরা পাঁচ হাজার’ (Somos cinco mil)। ১৮ সেপ্টেম্বর স্ত্রী জোয়ান টার্নার তাঁর মৃত্যুর খবর পান এবং হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান সারা শরীর ভরা বুলেটের ক্ষত নিয়ে অর্ধনগ্ন ভিক্তোর মাটিতে শুয়ে আছেন। আর এই গোটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পিনোচেত বলেন, ‘চিলের সেনাবাহিনী আইয়েন্দের মার্ক্সবাদী সরকারের বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে উদ্ধার করে চূড়ান্ত দেশভক্তির পরিচয় দিয়েছে।’
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে পিনোচেতের শাসনকালে ৩০ হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা ও ২৭ হাজারের অধিক মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছিল। আর এই গোটা পর্বেই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদত। এমনকি চিলেতে গণতন্ত্র ফিরে আসার পর বহু মিলিটারি অফিসার উত্তর আমেরিকায় অভিবাসন পেয়ে যায় এবং সেখানে তারা বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছে, যাদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল ভিক্তোর হারাকে যে অফিসার গুলি করে হত্যা করেছিল সেই পেদ্রো বারিয়েন্তোস।
ভিক্তোরের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মামলা করেন। দাবি করেন হত্যার ন্যায্য বিচারের। ৪৪ বছর ধরে তিনি এই ন্যয্য বিচারের আশায় ঘুরে বেরিয়েছেন। তাঁর মতে ভিক্তোরের মৃত্যু কোনও ব্যক্তিগত, একক ট্রাজেডি নয়, এ হল সম্মিলিত ট্রাজেডি (collective tragedy)। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে চিলের আদালত ৮ জন অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসারকে ভিক্তোরকে হত্যার জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। কিন্তু মূল অভিযুক্ত পেদ্রো বারিয়েন্তোস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়ায় তাকে কোনও শাস্তি দেওয়া যায়নি। ২০০৩ সালে চিলের সেই অভিশপ্ত স্টেডিয়ামের নামকরণ হয় ‘ভিক্তোর হারা স্টেডিয়াম’ আর প্রতিবছর তাঁর স্মরণে রাজধানী সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত হয় হাজার গিটারের উৎসব। সেখানে মানুষ গায়: ‘শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার।’
(লেখক স্পেনীয় ভাষার অধ্যাপক ও অনুবাদক। এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় গ্রাউন্দজিরোতে ২০২০ সালে।)