অতি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বলেই হোক কিংবা প্রান্তিক বনবাসী – রাভারা জড়িয়েমড়িয়ে একযোগে থাকে বলেই যে যৌথ চাষবাস, লাভের গুড় কিংবা লোকসানের চিরতা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়ার এই মন, এই উদ্যোগ সহজেই তৈরি হতে পেরেছে বিষয়টা ঠিক এমন সরল নয়। এর পিছনে অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ পরম্পরা রয়েছে। রয়েছে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
শাল, জারুল, জাম, কদম, চিকরাশির চারাগুলো স্বাবলম্বী হলেই গাড়া হবে বনে। আর শাক-সব্জি বিক্রি করা হবে বাজারে। বক্সা নিমাতি রাভা বনবস্তির ১০ বিঘা জমির তিন ভাগের এক ভাগ জুড়ে কোথাও কোদাল দিয়ে সাফ-সুতরো করা হচ্ছে জমি, কোথাও হাতে হাতে ছোট্ট কালো পটে ভরা হচ্ছে ঝুরঝুরে সার-মাটি। সারি দিয়ে সাজিয়ে রাখছেন কেউ, কেউ কেউ-বা আবার তৈরি করে রাখা উঁচু থাক করা একফালি বীজশয্যায় নিবিড় মনোযোগে সারি দিয়ে পুঁতে চলেছেন বাঁধাকপির বীজ। ওই ২০ ফুট বাই তিন ফুটে পোঁতা হবে ৬০০০ বীজ। বনের গাছের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৬,০০০ পট। কর্মীদের মধ্যে মেয়েরাই সিংহভাগ। ১২০ জন কর্মীর মধ্যে পুরুষ হবেন ১০ জন। লিঙ্গসাম্যের এই উলটপুরাণের পিছনে রয়েছে রাভা মাতৃপ্রধান সমাজের পরম্পরা। ঘরেবাইরে তাই – ঘর সামলানো থেকে মিটিং-মিছিল, চাষবাস – মেয়েদের অপেক্ষাকৃত বেশি উপস্থিতি, আবার মেয়েদের কথায় ছেলেরা বনে হাজিরা দিতে গিয়েছেন তাই পুরুষদের সংখ্যা এদিন কম। বনের কাজ মানে বিছন দেওয়া, ডালপালা ছাঁটাছাঁটি। সেওতো ডুমুরের ফুল। আবার কাজ মিললে ২৫০ টাকা রোজ। তাই হাজিরা না দিলেই নয়।
নিমাতি বনবস্তির তিন দিকই বনে ঘেরা একদিকে চা-বাগান। গ্রামের গা-ঘেঁষে চাষের জমি শুরু, এক্কেবারে বনের গায়ে তার শেষ। ধানের সময় সবুজ হয়ে থাকে মাঠ। ধানের সময় মানে এই আমন ধানের সময়। বছরে একটাই এই চাষ, পরিবার পিছু গড়ে চার-পাঁচ বিঘা জমিতে। পুরোটাই উদরপূর্তির জন্য। যদি হাতিতে না খায় তবে সবটাই ঘরে ওঠে। বন লাগোয়া জমিতে হাতি নামেই। বছরে চার-পাঁচ মাসের খোরাক আসে মাঠ থেকে। বছরের বাকি সময়ের খোরাকও জোগায় মাঠঘাট, নদীঝোরাবন। মাঠেঘাটে কাজ মানে নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমিতে কামলাগিরি। ধান রোয়া, ওঁরা বলেন ধান গাড়া। পাটের খেতে ধানের খেতে নিড়ানি। নদীতে পাথর তোলা। বনের কাজ নেই বললেই চলে। বছরে হাতেগোনা কয়েকদিন মাত্র। বন জন শ্রমজীবী মঞ্চের আহ্ববায়ক (বক্সা) বিশ্বনাথ রাভার দাবি বড়জোর তিন সপ্তাহ। ‘বিদেশ’ যাওয়ার চল রয়েছে। বিদেশ মানে ভুটান, ভিন রাজ্যের শহরে নানা কিসিমের দিনমজুরির কাজ। তবু বন আছে বলে জ্বালানি আছে। নানা শাকপাতা আছে, কান্দা বা আলু, ছাতু আছে। নদীতে মাছ মেলে বর্ষাকালেই বেশি। অন্য সময় ছোট ঝোরাগুলি শুকিয়ে যায়। লকডাউনে ১০০ দিনের কাজ অপেক্ষাকৃত বেশি দিন হয়েছে। রেশনের চাল-গম মেলে এটুকু যা স্বস্তি। খাওয়াপরার হিসেব বুঝতে চাইতে বসলে জিভ শুকিয়ে আসে। তবু লাজলজ্জার মাথা খেয়ে তথ্যের কড়ি গুনে নিতে হয়। বন তার কৌলীন্য হারিয়েছে, বনের মানুষদের দূরে থাক, বনের পশুদেরও সে আশ্রয় দিতে পারে না, পেটভরা খাবার জোগাতে পারে না। যে কোনও বনবাসীকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা একথাই বলে। বনাধিকারিকরা তা অবশ্য স্বীকার করবেন না। খোলা-ঝোরায় মাছ, কাঁকড়া বাড়ন্ত। যার একটা কারণ যদি প্রাকৃতিক হয় তবে অন্য কারণ অবশ্যই চাষের জমির কীটনাশক, রাসায়নিক সার। গরু-ছাগল অনেক ঘরেই আছে অধিকাংশই সকালে বনের ধারে তাদের ছেড়ে আসে, বিকেলে তারা ফিরে আসে নিজেরাই। ফি মাসে একটা-দুটো চিতাবাঘের পেটে যায়। দেখে রাখার বাড়তি মানুষ নেই যে। ছোটদের স্কুল আছে, পড়া আছে। বড়দের সারাদিন গরু-ছাগল পাহারা দিলে চলে না। মাঠেঘাটে হাজিরা না দিলে ভাত জুটবে না। ওঁরা যে কোনও দিনমজুরির কাজে যাওয়াকে বলেন হাজিরায় যাওয়া।
এর পরেও নিমাতির পুরুষ-মহিলা স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। বক্সার বাঘ বনে শাল-জারুল-চাপ-চিকরাশি, জাম-কাঁঠালের মতো ফলের গাছ লাগাবেন বলে। হাতি খাবে, হরিণ খাবে, বাঁদর খাবে বলে। এতো সেই একরকম ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ব্যাপার-স্যাপার। ঋতি নাকি রীতি রাভার মত অবশ্য অন্য। ছোট্ট পটে মাটি ভরতে ভরতে বললেন, “জঙ্গলে গাছ গাড়ব। গাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরই সুবিধা।” বন গ্রামসভার সভাপতি প্রসাদ ওঁরাও (রাভা বস্তিতে এই একঘরই ওঁরাও পরিবার।) জানালেন, “ধান চাষ, সব্জি চাষ নিজের জন্য আর বড় গাছ বনের জন্য। এতে আর্থিক সুবিধা হবে। আবার মিলমিশও বাড়ছে।” এই কর্মকাণ্ডের ১০ বিঘা জমির আঁতুর ঘরটি যে ‘কমিউনিটি ল্যান্ড’ অর্থাৎ এই বনগ্রামের যৌথ মালিকানাভুক্ত জমি সে তথ্যটি জানালেন বিশ্বনাথ রাভা। সেই জমিতেই একযোগে চলছে ‘কমিউনিটি কালটিভেশন’। বিশ্বনাথ বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, “জঙ্গল আরও বাড়াব।” কেন বাড়াবেন? “সমস্যা হচ্ছে আমাদের।” কীরকম সমস্যা? “পশু-পাখি ঘরে ঢুকে পড়ছে। জঙ্গলে খাবার নাই। ফায়ার উড মেলে না।”
গত জুন মাসে অবশ্য একপ্রস্থ সব্জি চাষ হয়ে গিয়েছে। আট বিঘা জমির ভেন্ডি, বরবটি, ঝিঙা, শসা, করলা, লংকা পাইকারি মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। বিশ্বনাথ জানান, চাষ শুরু হতে দেরি হয়ে যাওয়ায় লাভ তেমন না-হলেও লোকসান হয়নি। চাষের খরচ উঠে গিয়েছে। খেয়ে দলে ৩০ শতাংশ ফসল হাতি নষ্ট না করলে কিছুটা লাভের মুখ দেখা যেত। হাতি, হরিণ, বাঁদর, ময়ূরের জন্য বনবস্তিগুলিতে সব্জি চাষের ইচ্ছাটাই প্রায় মরে গিয়েছে বললেই চলে। তবু, চাষ করলেন যে? বিশ্বনাথ জানান, নিজের হলে বেশি ক্ষতি হতো, পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। সবাই মিলে আছি বলে ফসল বাঁচানো সহজ। লোকসানটা ভাগ হয়ে যায়। যৌথতার এও একটি শিক্ষা বলা যায়।
অতি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বলেই হোক কিংবা প্রান্তিক বনবাসী – রাভারা জড়িয়েমড়িয়ে একযোগে থাকে বলেই যে যৌথ চাষবাস, লাভের গুড় কিংবা লোকসানের চিরতা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়ার এই মন, এই উদ্যোগ সহজেই তৈরি হতে পেরেছে বিষয়টা ঠিক এমন সরল নয়। এর পিছনে অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ পরম্পরা রয়েছে। রয়েছে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। বেগারি নয়, মজুরির অধিকার। বনবস্তিতে পঞ্চায়েতি রাজের অধিকার। বনবাসী অধিকার আইন অনুযায়ী বনের উপর ছোটখাট বনজ সম্পদের উপর বনবাসীর অধিকার – এই সবই তাঁদের বুঝতে শিখিয়েছে যে, বনের জ্বালানির খড়িকাঠ, কন্দ, শাক-পাতা, খোলা-ঝোরার মাছ-কাঁকড়া-শামুকের উপর যেমন তাঁদের অধিকার রয়েছে, তেমনই বনের, বনের পশু-পাখি, সাপখোপ, কীটপতঙ্গের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সে দায়িত্ব ও কর্তব্য জীববৈচিত্র রক্ষা করার। বনদপ্তর,পর্যটন দপ্তর মায় পঞ্চায়েতের হাতে তা ছেড়ে দিলে সরকারি বাবুরা, রাজনীতির ব্যবসায়ীরা সব বেচে দেবে। দিয়ে চলেছেও। আর বেচে দেবে বলেই তো সারাদেশেই আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসীদের উচ্ছেদ করতে আদাজল খেয়ে লেগে আছে কর্পোরেটবন্ধু সরকার। অন্যদিকে, উপর থেকে নীচ – যেন এক ‘সিন্ডিকেট রাজ’ বেআইনি পথে কাঠ বেচা, হাতি-গণ্ডার মারা, বনের জমি, আদিবাসীদের জমি রিসোর্ট আর লজ ব্যবসায়ীদের বেচে দেওয়া – চলেই আসছে। লাটাগুড়ি লজ-রিসোর্টের জঙ্গল হয়ে গেছে। রিসোর্টের পথ করে দিতে ১৪৪ ধারা জারি করে রাতারাতি হাতির করিডোর সাফ করে দিয়েছে বন আর জেলা প্রশাসন। অভিযোগ, এক প্রভাবশালীর স্টার রিসোর্টের পথ করে দিতেই এই আত্মঘাতী উদ্যোগ। রিসোর্ট মাফিয়াদের নজর এখন চিলাপাতায়।
এ রাজ্যের আদিবাসী এলাকায় পঞ্চম তফসিল রূপায়িত হয়নি। পেসা বা পঞ্চায়েত (এক্সটেনশন টু শিডিউলড এরিয়াস) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ আইনও নয়। যে আইন প্রথম স্বীকার করল ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বশাসনের এক উৎকৃষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরম্পরা রয়েছে। বন জন শ্রমজীবীর লালসিং ভুজেল, সুন্দরসিং রাভারা জঙ্গলের মাটিতে দাঁড়িয়ে বনাধিকার আইন রূপায়নের জন্য লড়াই চালাচ্ছেন গত প্রায় পনেরো- বিশ বছর ধরে। ২০০৬-এর আইন মোতাবেক গ্রামসভা তৈরির লড়াই, জমি-বাস্তুর পাট্টার লড়াই, বনজ সম্পদ সংগ্রহের লড়াই, বনরক্ষার লড়াই। তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছে যৌথ কৃষিকাজ। সুন্দরের ভাষায়, “বনবাসীদের গ্রামসভা বনবস্তির মানুষদের এক জাতীয় স্বায়ত্বশাসন। আমাদের গ্রাম ভিত্তিক, বন ভিত্তিক উন্নয়ন আমাদের মতামত নিয়ে স্থির করতে হবে। বাইরে থেকে তা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সে কাজটাই শুরু করেছি নার্সারি তৈরির মধ্য দিয়ে।” মঞ্চের প্রতিনিধি স্বরূপ সাহা জানালেন, “লকডাউনের সময় দেখা গেল তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। গ্রামে কাজ নেই। জঙ্গলের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছে। ওদিকে খেতের পথ খেত পড়ে থাকে কেউ চাষ করে না। জমির প্রকৃত ব্যবহার হচ্ছে না। তখন এই ভাবনাটা নানা আলোচনার মধ্যে দিয়ে উঠে এল।” প্রাক ঔপনিবেশিককালে এঁদের মধ্যে কৌম ভাবনা ছিল। জমি ছিল সামাজিক সম্পত্তি। সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সিদ্ধান্ত সমাজের সবাই মিলে নিতেন। সেই কৌম অভ্যাসের ছিটেফোঁটাই এখন পড়ে রয়েছে। তার কিছু কিছু ফিরিয়ে আনা যায়। পুনরুজ্জীবিত করা যায়। যেমন সামাজিক সম্পত্তির বোধ, একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে কাজ করা। এমনই এক ভাবনা থেকেই এই যৌথতা বলে জানালেন স্বরূপ। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজরা শুধু বনের দখল নিয়ে অবাধ লুঠপাট চালায়নি। আদিবাসীদের বেগার দাসে পরিণত করেছিল। লালসিং বলেন,”আদিবাসীদের বিদ্রোহ, বেগারি বিরোধী লড়াই এ সবই আদিবাসী, জনজাতিদের স্বশাসন ফিরে পাওয়ার লড়াই। স্বাধীনতা উত্তর আদিবাসী এলাকা আইন, পেসা, বনাধিকার আইন এ সবই আদিবাসীদের আত্মমর্যাদা, স্বশাসন ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই রচিত হয়েছে। এবং তা হয়েছে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর। কিন্তু একের পর এক সরকার এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তো কার্যত আদিবাসীদের ন্যূনতম অধিকার স্বীকার করে না।”
স্বাধীনতার পর পরই আদিবাসীদের বিষয়ে নেহরুর পঞ্চশীল নীতিও তাঁদের নিজের পথে উন্নয়ন ঘটানো, শিল্পসংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো, জমি ও জঙ্গলের উপর তাদের অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া, নিজস্ব শাসনপ্রণালী ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজ করার কথা বলে। মঞ্চের অন্যতম প্রতিনিধি সৌমিত্র ঘোষের মতে, “উৎপাদন সম্পর্ক, ক্ষমতা সম্পর্ক, শাসন সম্পর্ক, শোষণ সম্পর্ক দিয়ে আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থাটা বুঝতে হবে। পাকেচক্রে তাঁদের হাতে কিছুই নেই। এই উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে বদল ঘটাতে হবে। উৎপাদন ব্যবস্থাকে সমাজের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এখানকার অর্থনীতি কৃষি প্রধান। এই কাজটা তাই চাষবাস দিয়েই শুরু করা হয়েছে।” যৌথতার এই উদযাপন কি ফিরিয়ে দেবে বন আর বন ও শ্রমজীবীদের আত্মমর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার? তা জানতে অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু, প্রসাদ ওঁরাও, বিশ্বনাথ ও রীতি রাভারা অবশ্য আশাবাদী যে এবার সব্জি ভাল হবে। সব্জি চাষে লাভও বেশি। সারা বছর ধানের পাশাপাশি সব্জি চাষ করলে আর বাইরে কাজ করতে লাগবে না – এমনই প্রত্যয়ের সুর শোনা গেল বিশ্বনাথের গলায়।