মুক্তি প্রস্তাবিত ৬৩ জনের মধ্যে একজনও রাজনৈতিক বন্দির নাম নেই কেন?


  • August 11, 2021
  • (0 Comments)
  • 1008 Views

শোনা যাচ্ছে, স্বাধীনতা দিবসের দিনে ঐ ঘোষিত ৬৩ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে। সত্যি হলেও এই সংখ্যা মুক্তিযোগ্য বন্দির সংখ্যার তুলনায় খুবই কম। সরকারের উচিত ১৪ বছর কারা জীবন কাটানো সকল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া। নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া উচিত সকল রাজনৈতিক বন্দিদেরকেও। লিখেছেন রঞ্জিত শূর

 

সত্যিই চমকে ওঠার মত ছিল ঘটনাটা। এসইউসি (সি) দলের একজন ‘সংগঠক’ জেলবন্দি অবস্থায় ৯৬ বছর বয়সে জেলেই অসুস্থ হয়ে মারা যান। তিনি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ছিলেন। ৯৬ বছর বয়সেও জেলবন্দি! এই ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবাংলায়! তাও রাজনৈতিক কর্মী! হায়! মা-মাটি-মানুষের সরকার হায়!

 

এসইউসি (সি) দলের রাজ্য সম্পাদক সম্প্রতি তাঁদের দলের কিছু যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দির মুক্তি চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা চিঠি দিয়েছেন। এই চিঠির কিয়দংশ এরকম :

“… সিপিএম পরিচালিত সরকারের সময় রাজনৈতিক কর্মীকে মিথ্যা মামলায় এইভাবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ক্ষমতায় এলে আপনি তাঁদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আপনাকে স্মরণ করাই, আমাদের দলের সংগঠক হরিসাধন মালি (৯৬) অসুস্থ হয়ে বারবার রাজ্য সরকারের কাছে মুক্তির আবেদন করেছিলেন। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। তাঁর সর্বশেষ আবেদন ছিল, তাঁকে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন অন্তত পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হোক। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করতে হয়ছিল। আমাদের দলের আরও কয়েকজন সংগঠক এখনও জেলের মধ্যে আছেন, যাঁদের ১৪ বছরের বেশি বন্দিজীবন অতিবাহিত হয়েছে এবং যাঁরা অসুস্থ। তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর আপনাকে আমরা ২০১১-র পূর্বের প্রতিশ্রুতিকে স্মরণ করিয়ে বন্দিদের দ্রুত মুক্তির দাবি করছি।”

 

এ রাজ্যের জেলবন্দিদের নিয়ে সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন মানুষেরা জানেন, এ রাজ্যের জেলে বহু বন্দিই আছেন যারা ২০-২৫ বছর এমনকি ৩০-৩২ বছর পর্যন্ত বন্দি আছেন। বেশিরভাগই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। সুপ্রিম কোর্টের একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলার সূত্রে এবং মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর হস্তক্ষেপে এইরকম কয়েকজন বন্দি ছাড়াও পেয়েছেন। কিন্তু আরও বহু রয়ে গিয়েছেন। রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক প্রেস নোটে এইরকম ৬৩ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। ভাল কথা। আপত্তির কিছু নেই। মুক্তি তো দেও্যাই উচিত। দেওয়ারই কথা। কিন্তু ১৪ বছরের বেশি সাজা খাটা হয়ে গেছে এইরকম যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি তো আরও অনেক আছেন, তাঁরা বাদ কেন? কোন যুক্তিতে তাঁদের বাদ দেওয়া হলো সেটা বন্দিদের তো বটেই, সাধারণ নাগরিকদেরও জানার অধিকার আছে। যাঁদের বাছা হয়েছে তাঁদের কীসের ভিত্তিতে বাছা হয়েছে? যাবজ্জীবন সাজা মানে ২০ বছর সাজা ধরা হয়। বিভিন্ন কারণে বন্দিরা সাজার ‘রেমিশন’ পায়। সেইসব রেমিশন বাদ দিয়ে যাবজ্জীবন সাজা মানে ১৪ বছরেরে জেলজীবন। যদি না বন্দির বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অভিযোগ থাকে। তবে ১৪ বছরের জেলজীবনের পরেই একজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দির মুক্তি পাওয়ার কথা। এর জন্য কারা দপ্তরের অধীনে ‘সেনটেন্স রিভিও বোর্ড’ থাকে। তাঁরা বন্দির সমস্ত রেকর্ড দেখে মুক্তির সুপারিশ করেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বন্দিদের রেমিশন না দেওয়ায় জেল প্রশাসনগুলিকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন, তিনি বলেছেন, জেল প্রশাসনের উচিত রেমিশনের বিষয়টা জানানো এবং কীভাবে আবেদন করতে হয় তা শেখানো। এজন্য তিনি নিজে জেল প্রশাসকদের ওয়ার্কশপ করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আসলে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন জেলবন্দিদের অধিকাংশই নিরক্ষর, বা স্বল্প শিক্ষিত, দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। ফলত নিজেদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই থাকে না। পশ্চিমবঙ্গের জেল প্রশাসন বা জেলও কোনো ব্যতিক্রম নয়। ৯৬ বছর বয়স্ক রাজনৈতিক কর্মীর জেলবন্দি অবস্থায় মৃত্যুই তার প্রমাণ। কেন তিনি রেমিশন পাননি বা অন্য এস ইউ সি (সি) বন্দিরা রেমিশন পাচ্ছেন না ১৪ বছর বন্দি জীবনের পরেও, কেন তাঁরা মুক্তি পাচ্ছেন না সে জবাব কে দেবে? সরকারেরই তো উচিত স্বাভাবিক নিয়ম মেনে ১৪ বছর সাজা খাটার পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জেলবন্দিদের মুক্তি দেওয়া। এই একই কথা প্রযোজ্য অন্য চারজন রাজনৈতিক বন্দির সম্পর্কেও। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, একটি মাওবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাঁরা পুরুলিয়ার একজন অত্যাচারী জোতদারকে খতম করেছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে তাঁরা জেলবন্দি। আদালত তাঁদের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে। অর্থাৎ তাদেরও ১৪ বছর সাজা খাটার পর ২০১৮-তে মুক্তি পেয়ে যাওয়ার কথা, অথচ ১৭ বছর সাজা খাটার পরেও সরকার তাঁদের মুক্তি দিচ্ছে না। তাঁদের বিরুদ্ধে জেল কতৃপক্ষের বিরূপ রিপোর্টও নেই। ৪ জনের একজন এইমুহূর্তে কোভিডের কারণে প্যারোলে বাড়িতে আছেন। অর্থাৎ বিচারে তিনি ‘ভালো’ বন্দি, না হলে প্যারোল পেতেন না। তাহলে তিনি বা তাঁরা চারজন ছাড়া পাবেন না কেন?

অনেকের নিশ্চই মনে আছে, আগে প্রায় প্রতিবছরই স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হতো। এখন প্রায় হয়ই না। সমস্যা হচ্ছে দ্বিবিধ। প্রথমত, এ রাজ্যের জেলে সুস্থ প্রশাসন বলে কিছু নেই। চরম দূর্নীতিগ্রস্ত এই প্রশাসন ১৪ বছর সাজা শেষে বন্দিদের রেমিশনের আবেদন তৈরি করে রিভিউ বোর্ডের কাছে পাঠায় না। অন্যদিকে রিভিউ বোর্ডের মিটিং-ই বসে না। কার কাছেই-বা পাঠাবে। ফলত বন্দিরা জেল খাটতেই থাকে খাটতেই থাকে – ৯৬ বছর বয়সে মরে না যাওয়া পর্যন্ত। পুরুলিয়ার জোতদার ‘খতম’ মামলায় ঐ চারজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের বিষয়ে তাঁর এই সময়ের সহবন্দিদের অভিযোগ, ঐ চারজন একাধিকবার রেমিশনের আবেদন করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সরকার রিভিউ বোর্ডের কাছে এঁদের আবেদন বিচারের জন্য পাঠায়ইনি। ১৭ বছর পরেও তাঁরা জেলবন্দি। রাজনৈতিক বন্দি হওয়া সত্ত্বেও।

 

১৪ বছরের উপর সাজা খাটা হয়ে গেছে এরকম যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি পশ্চিমবঙ্গের জেলে কতজন আছেন? জানার কোনো উপায় নেই। কারণ কারা দপ্তরের ওয়েবসাইট ২০১৬ সালের পরে ‘আপডেট’ হয়নি। হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট আদেশ সত্ত্বেও নয়। আরটিআই করলে অন্তত কাছাকাছি একটা সংখ্যা পাওয়া যেতে পারে তবে সেটা সময়সাপেক্ষ। কারণ কারা দপ্তর নিজেরা কোনো উত্তর দেবে না। সব জেলকে বলবে সরাসরি উত্তর দিতে। ফলত আপনি ৬০-৬২টি চিঠি পাবেন, সেগুলিতে দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে আপনাকে সত্যে পৌঁছতে হবে। ততদিনে সংখ্যাও পালটে যাবে।

 

পশ্চিমবঙ্গ সরকার হঠাৎ স্বাক্ষরবিহীন, তারিখবিহীন, পরিচয়বিহীন প্রেস নোট সংবাদ মাধ্যমে দিয়ে বন্দিমুক্তির খবর প্রচার করেন কেন? সম্ভবত দুটি কারণে। প্রথমত, সারা দেশে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি বিষয়ে একটা চর্চা শুরু হয়েছে। দাবিটা ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। রাজ্য সরকার রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি না দেওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচিত হচ্ছে। এই আবহাওয়ায় সেই প্রশ্ন এ রাজ্যেও জোরেসোরে উঠতে পারে, তাই এদের মুক্তি দিয়ে নিজের ভাবমূর্তিতে একটা উজ্জ্বল রঙের পোচ দিয়ে নিতে চাইল। এর আরও কারণ আছে। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পরে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি রাষ্ট্রপতিকে স্মারকপত্র দিয়ে স্ট্যান স্বামীর মতো বন্দিদের মুক্তি দাবি করেছে। ইউএপিএ-কে দানবীয় আইন বলে অভিহিত করেছে, ঠিক এই সময়েই কামতাপুর আন্দোলনের একজন নেতাকে রাজ্য সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ইউএপিএ আইনে মামলা দিয়ে হুলিয়া জারি করেছে। নাগরিক সমাজে সরকারের অনুগামীরাও তাতে যথেষ্ঠ বিব্রত। মুখ্যমন্ত্রীর এই দ্বিচারিতা নিয়ে সমালোচনা করতে বাধ্য হচ্ছে তাঁর নতুন রাজনৈতিক বন্ধুরাও। ফলত সরকার এই বন্দিমুক্তির খবর দিয়ে এসব অপকর্মকে ঢাকতে চাইছে। এমনকি একটি বৃহৎ সংবাদপত্রের খবরে এটাও লিখল যে, এঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বন্দিও আছে, যা একেবারে সত্য নয়। সরকার তালিকাটি ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ধোঁয়াশা তৈরির জন্য প্রকাশই করেনি। যদি সত্যিই ছাড়া হয়, অতীতের মতো একই খবর বার বার প্রচার করে বন্দিমুক্তি আন্দোলনকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে। এসইউসি(সি) জানিয়েছে তাঁদের কোনো বন্দির মুক্তির খবর তাঁদের কাছে নেই। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চারজন ‘মাওবাদী’ বন্দির মুক্তি হচ্ছে না সেটা কারা দপ্তর সূত্রেই জানা গেছে নিশ্চিতভাবে। ফলত সরকার বন্দিমুক্তি আন্দোলনকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্যই এসব লোক ঠকানো আচরণ করছে। কোনো রাজনৈতিক বন্দিকেই মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে মাত্র। শোনা যাচ্ছে, স্বাধীনতা দিবসের দিনে ঐ ঘোষিত ৬৩ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে। সত্যি হলেও এই সংখ্যা মুক্তিযোগ্য বন্দির সংখ্যার তুলনায় খুবই কম। সরকারের উচিত ১৪ বছর কারা জীবন কাটানো সকল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া। নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া উচিত সকল রাজনৈতিক বন্দিদেরকেও।

 

লেখক মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী।

 

Share this
Leave a Comment