সত্য ও সুবিচারের এক সরব দর্শন
‘সত্য এতো তিক্ত হয়ে উঠেছে কেন, ভিন্নমত এতো অসহনীয়, সুবিচার এতো ধরা ছোঁয়ার বাইরে?’ কারণ ক্ষমতা ও উচ্চাসনে থাকা ব্যক্তিদের কাছে সত্য বড় তেতো। ভিন্নমত ক্ষমতাসীন উচ্চকোটির কাছে বড় অপ্রিয়। সুবিচার ক্ষমতাহীন, প্রান্তিক, বঞ্চিত মানুষের কাছে তাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবুও, সত্যিটা বলতেই হবে। ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে তুলে ধরতেই হবে। এবং সুবিচারকে পৌঁছতে হবে দরিদ্রের দুয়ারে। আমি নীরব দর্শক নই।
আই অ্যাম নট আ সাইলেন্ট স্পেকটেটর, প্রয়াত স্ট্যান স্বামীর সংগ্রামী জীবনের নানা টুকরো টুকরো কাহিনি ও স্মৃতির প্রতিফলনে ভরা বইটির স্ট্যানকৃত মুখবন্ধের শুরুটা ঠিক এমনই। আত্মজীবনী বলতে যা বোঝায় , তাঁর একদা কর্মস্থল ইন্ডিয়া সোশ্যাল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এই ক্ষুদ্র বইটি তেমন নয়। তবে তিন দশকের বেশি সময় আদিবাসী, বনবাসী মানুষের সঙ্গে তাঁর একাত্ম লড়াইয়ের পটভূমি যদি কেউ বুঝতে চান, বুঝতে চান তার গতিপ্রকৃতি এবং আদর্শগত অবস্থান, তবে অবশ্যই এই বই তাঁদের সাহায্য করবে।
ভূয়ো ভীমা কোরেগাঁও মামলা তো প্রথম নয়, এর আগেও আদিবাসীদের মর্যাদা ও আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকারের পক্ষে লড়াই করার জন্য বহুবার রাজরোষে পড়েছেন তিনি। ঝাড়খণ্ডের পাথালগড়ি আন্দোলনকে সমর্থন এবং আন্দোলনকারীদের সহায়তা করার জন্য তৎকালীন বিজেপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। কেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা? কী তাঁর অপরাধ? স্ট্যান তার আট দফা কারণ দর্শিয়ে ছিলেন। এ যেন নিজের বিরুদ্ধে নিজে আনা আইনি ও সাংবিধানিক অধিকারে ভরা ‘চার্জশিট’। স্ট্যান লিখেছিলেন –
১। আমি সংবিধানের পঞ্চম তফসিল কেন রূপায়ণ করা হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম
২। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন পেসা আইন [পঞ্চায়েত (এক্সটেনশন টু শিডিউলড এরিয়াস) অ্যাক্ট, ১৯৯৬], যা এই প্রথম স্বীকার করে যে, ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বশাসনের এক উৎকৃষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরম্পরা রয়েছে তাকে নিপুণভাবে অবজ্ঞা করে চলা হচ্ছে।
৩। সুপ্রিম কোর্টের সমতা রায় (১৯৯৭) বিষয়ে সরকারের নীরবতায় আমি উষ্মা প্রকাশ করেছিলাম।
এভাবেই বনবাসী আইন, ২০০৬; ‘জমির মালিক জমির নীচের খনিজের মালিক’ সুপ্রিম কোর্টের এই রায় (২০০০) কেন সরকার মানছে না; ঝাড়খণ্ড সরকারের জমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৩ এবং ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ নীতির বিরোধিতা এবং গ্রাম ও বন থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী আদিবাসী ও মূলবাসী যুবকদের ‘নকশাল’ বলে নির্বিচার গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইগুলি যে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কারণ বলে তিনি অভিহিত করে গেছেন। এই ক্ষুদ্র বইটি আরও একবার প্রমাণ করবে আসলে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় তাঁকে জড়িয়ে দেওয়ার পিছনে মূল অভিপ্রায় ছিল ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের জল-জমি-জঙ্গলের লড়াইয়ে আঘাত হানা। কর্পোরেট রাষ্ট্রের এ এক আদিবাসী বিরোধী ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’।
দীর্ঘ আন্দোলন জীবনের এমনই ১৩টি রচনা ছাড়াও বইটির সম্পদ এনআইএ রাঁচিতে তাঁকে যে জেরা করেছিল তার বিবরণ এবং মহারাষ্ট্রের তালোজা কারাগারে লেখা ‘জেলখানার ডায়েরি ও কবিতা’। স্ট্যানের ইচ্ছানুসারেই বইটির একটি আন্তরিক ভূমিকা – ‘আ ফ্লেম দ্যাট বার্নস ব্রাইট’ – লিখেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক এবং ‘দ্য বার্নিং ফরেস্ট’-এর লেখক নন্দিনী সুন্দর। বই প্রকাশের পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউট-এর ডিরেক্টর ড. জোসেফ জেভিয়ার। যে ইনস্টিটিউটে ১৬ বছর শিক্ষকতা করেছেন স্ট্যান স্বামী। তার মধ্যে ১১ বছর ছিলে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর। আদিবাসীদের একজন হয়ে ওঠার জন্য সেই আকাদেমির জগৎ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে তিনি চলে এসেছিলেন বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচির নামকুনের জেসুইট পাদ্রিদের পরিচালিত কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাগাইচায়।