বাংলায় ফ্যাসিবিরোধী কাজের সীমা ও সম্ভাবনা


  • August 2, 2021
  • (0 Comments)
  • 1722 Views

ভোটের আগে পরে বাংলায় বামপন্থার পুনরাবিষ্কার ও পুনরুজ্জীবন নিয়ে তাল তাল কথা বলা, লেখার পর — এখন সবকিছু আরও বেশি করে তাল পাকাচ্ছে, যাকে বলে ঘেঁটে মণ্ড হয়ে যাওয়া। অ-সিপিএম বামদের যে মঞ্চ থেকে  ‘নো ভোট টু বিজেপি’স্লোগানটি বাজারসই করা হয়, সে মঞ্চে বর্তমান লেখকও ছিল। সেই অধিকার কিংবা সুবাদে মঞ্চের ভূতভবিষ্যৎ, বলা ভাল, হালবাংলায় ফ্যাসিবিরোধী কাজের গতিপ্রকৃতি সমস্যা সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে আরও কিছু কথা (তাল পাকানো হলেও) বলে ফেলা যাক। লিখেছেন সৌমিত্র ঘোষ

 

 

ভোট পরবর্তী বাংলা

বাংলায় ভোট ইত্যাদি বেশ ক’মাস হল মিটে গেছে। ভোটের ফল বেরোনোর পরপরই, হয়তো খানিক আগে থেকেই করোনা ২.০ হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকাল থেকে রাত আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, পরিচিতজনের অসুস্থতা আর মৃত্যুসংবাদ ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভোট-পরবর্তী সম্ভাব্য মোচ্ছব-আবহ। রোগের দাপট আপাতত কিছু কম, এই সুযোগে অন্য কিছু পুরোনো-নতুন কথা পেড়ে ফেলা যায়, মনে হল। সে সুবাদে এই লেখা।

 

ভোটের সঙ্গে মোচ্ছবের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক আছে। বাংলার ভোটটা এবার আর দশটা বিধানসভা ভোটের মতো ছিল না। ভারতের বর্তমান শাসকেরা যে অমিত, প্রমত্ত রাষ্ট্রশক্তি, পেশিবল ও পুঁজি-প্রযুক্তি নিয়ে বঙ্গবিজয়ে নেমেছিলেন, হালের ইতিহাসে তেমন নজির নেই। পূর্বে এবিষয়ে একাধিক লেখায় চর্চা হয়েওছে। ফলে যাবতীয় ধুয়াধার ধামাকাবাজি (দোসো সিট লেকে হম আ রহে ও সুনার বাংলা ইত্যাদি) এবং অহোরাত্র রংদার চনমনে ছবিবাজি (রোডশো-সমাবেশ-পুষ্পবৃষ্টি-জয় শ্রীরাম) সত্ত্বেও ভোটে যখন বিজেপি-সঙ্ঘওয়ালারা বিশ্রীরকম হেরে গেল, মনে হবার সম্যক কারণ ছিল, মোচ্ছব-মুহূর্ত সমাগত ওই। এই লেখকের মতো বিস্তর মানুষ আতঙ্কে, উৎকণ্ঠায় দিনযাপন করছিল। মে মাসের দ্বিতীয় দিবসে তাঁদের কেউ কেউ (করোনা যাঁদের এবারের মতো রেহাই দিল) হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যেসব প্রাত্যহিক ও দূরগামী কাজে এতদিন মন দেওয়া যাচ্ছিল না, সেগুলি নিয়ে ভাবনার ফুরসত তৈরি হল। নেহাৎ চারপাশে করোনা হা-হা করছিল, নচেৎ মণ্ডামিঠাই বিলি ও বিজয়মিছিল তৎসহ লালনীলসবুজ আবির এসব যে হতোই সে বিষয়ে সন্দ কী? লাল আবির কেন? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

 

ভোটের ফল নিয়ে বিস্তর লেখাজোখা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, নতুন বিশেষ কিছু বলবার নেই। বিজেপি কেন হারল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে তৃণমূল কেন জিতলেন, সে প্রসঙ্গ বহুচর্চিত, সেই সঙ্গে বামপন্থীদের অখণ্ডমণ্ডলাকার ধূধূ শূন্যমার্গী হয়ে ওঠাটাও। বামপন্থী অর্থাৎ বড়, ভোটপন্থী, সরকারে-যাওয়া বামপন্থী, যথা সিপিএম। সুতরাং, সে প্রসঙ্গে কালক্ষেপ করবার কারণ দেখি না।

 

তবে, লাল আবির কেন? এ লেখা যাঁদের নিয়ে এবং যাঁদের উদ্দেশ্যে, তাঁরা সবাই লালপ্রিয়, লালপন্থী এবং নিঃসন্দেহে বাম। অ-সিপিএম বাম যারা সাংখ্যমাধ্যমে দড় ও সোশ্যাল মিডিয়াকে হামেহাল বিপ্লব-পরিসর (কিম্বা ঘাঁটি এলাকা অথবা মুক্তাঞ্চল) ভেবে থাকেন, ভোটের ফল প্রকাশের পর তাঁরা রাশিরাশি মুষ্টিবদ্ধ লাল হাত, ঝান্ডা, গোলাপ ফুল, ইমোজি ও ‘সেলাম’ লিখে ফোনপর্দা ভরিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর, ডিজি-সিপিএমওয়ালারা (যে সিপিএম সাংখ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতঃ তিনু শত্রু মারেন তাঁরা বা যেসব টেকস্যাভি নব্য সিপিএম টুম্পাগানের বিপ্লবী প্যারডি বানিয়ে ফোনে ফোনে লাল আগুন ছড়াচ্ছিলেন) যখন তাঁদের বামবিরোধী, তিনুদের দালাল এবং কংশাল ইত্যাদি বলে গাল পেড়েছে (এখনও পাড়ছে), তার বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তুলে টু-লাইন লড়াই দিচ্ছিলেন (নিজেদের মধ্যে লড়াই, সে কারণে টু-লাইন), বোঝা যাচ্ছিল, শূন্যমার্গীতা সত্ত্বেও এবারের ভোটের একটা লালবাম (বা বামলাল) দিকও রয়েছে, সেই ন্যারেটিভটা সত্বর পাকড়ে ফেলতে হবে।

 

এই লেখাটা এ পর্যন্ত পড়ে (যদি কেউ পড়েন সেই দুরাশায়) কারুর যদি মনে হয়, আরে দূর, পবিত্র বামপন্থা নিয়ে এ কি অসৈরন ছ্যাবলামি হচ্ছে, ছ্যা ছ্যা, লেখক নাচার। ভোটের আগে পরে বাংলায় বামপন্থার পুনরাবিষ্কার ও পুনরুজ্জীবন নিয়ে তাল তাল কথা বলা, লেখার পর — এখন সবকিছু আরও বেশি করে তাল পাকাচ্ছে, যাকে বলে ঘেঁটে মণ্ড হয়ে যাওয়া। অ-সিপিএম বামদের যে মঞ্চ থেকে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগানটি বাজারসই করা হয়, সে মঞ্চে বর্তমান লেখকও ছিল। সেই অধিকার কিম্বা সুবাদে মঞ্চের ভূতভবিষ্যৎ, বলা ভাল, হালবাংলায় ফ্যাসিবিরোধী কাজের গতিপ্রকৃতি সমস্যা সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে আরও কিছু কথা (তাল পাকানো হলেও) বলে ফেলা যাক।

 

কথা নিয়ে কথা

সেই কবে কোন পুরাকালে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, কথা কেবল মার খায় না, কথার বড় ধার। সম্ভবত সে লেখা জরুরি অবস্থার সমসাময়িক, যে জরুরি অবস্থায় ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় বলিয়াছিলেন, “কথা কম, কাজ বেশি।” হায়, সে ইন্দিরাও নাই, সে সঞ্জয়ও নাই! দু’বছরের জরুরি অবস্থার জায়গায় নতুন অবস্থার বিষধোঁয়া আমাদের জিভে, টাগরায়, গলায়, ফুসফুসে চিরস্থায়ী। শঙ্খ ঘোষ, কথা বলতে যিনি কোনোদিনই ভয় পাননি, সবে চলে গেলেন। তবু, আসুন, কথা বলি। কথা নিয়ে কথা, কাজ নিয়ে, কথা বলার কাজটাও কাজ, তা নিয়েও। কেন জানি মনে হচ্ছে, কাল কোথায় বুকে প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে দাঁড়ানো হবে, কবে মোমবাতি জ্বলা প্রতিবাদ ফেসবুক ভিজিয়ে দেবে, অথবা ঝড় উঠবে ট্যুইটারে, কিংবা কবে কবে সভাসমিতিকনভেনশন হবে, এই সব অবশ্যই অতি প্রয়োজনীয় কাজ/কর্মসূচি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার পরিবর্তে আমরা কথা নিয়েও কথা বলি। কী বলছি, কাকে বলছি, কেন বলছি? কে শুনছে, কোথায়, কীভাবে? সেই শোনাটা আমরা শুনছি কি? অথবা আপাত নীরবতার অনন্ত নৈরাশ্যের গভীরে প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের ঝর্নার যে বাঙময়তা, সে জলধ্বনিও কি শুনতে শিখেছি আমরা? যদি না শুনি, বুঝি, কথা বলব কী করে? শুনতে ভুলে গেলে তো কথা বলাও যায় না।

 

শোনার কথা দিয়েই শুরু করি। ভোটের ফলাফল যে ঠিক এইরকম দাঁড়াবে, সেটা আমরা কেউই প্রায় বুঝতে পারিনি। ফল বেরুনোর আগে গ্রাউন্ডজিরোয় প্রকাশিত অন্য একটা লেখায় বলার চেষ্টা করেছিলাম, আমাদের দেখা-শোনা-বোঝার গোটা প্রক্রিয়াটাই বড় মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার ছবি-শব্দের মধ্যে আ-গলাবুক ঢুকে আছে, ফলে সমাজে কী ঘটছে, কোন অংশের কোন জনসমষ্টি ও শ্রেণির মানুষ ঠিক কী ভাবছেন, সেটা আমাদের জানাবোঝার চৌহদ্দিতে সচরাচর ধরা পড়ে না। পুঁজি ও রাষ্ট্ৰ যুগপৎ যে মিডিয়াবিশ্ব তৈরি করে আমাদের ইন্দ্রিয় ও মগজের দখল নিয়েছে, সেই ছবি-মাদারিতে আমাদের চোখ ও মন ধাঁধায়, দেশদুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে ‘পারসেপশন’ তৈরি হয়। ‘আমাদের’ বলতে এখানে গোলা ও গোদা অর্থে বামপন্থীদের বোঝানো হচ্ছে, অর্থাৎ যে বা যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে মনে করেন, তাঁদের। অনেক অনেক চাঁদ আগেকার একটা সময়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিষয়ে তাঁদের ধারণা তৈরি হতো সমাজের সঙ্গে নিরন্তর চলতে থাকা কথাবার্তায়, যাতে তাঁরা সমাজসম্পৃক্ত ব্যক্তি-সংগঠক বা দলপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিদিন অংশ নিতেন, অনেকসময় সেই কথাবার্তা শুরুও করতেন নতুন করে। সে যুগে মিডিয়ার এই সর্বগ্রাসী রমরমা ছিল না, পুঁজিরাষ্ট্রের প্রভাবের বাইরে থেকেও সমাজে কী ঘটছে তা নিয়ে নিজস্ব ধারণা তৈরির সুযোগ থাকত। এই কথাবার্তা বা সংলাপ থেকে সমাজে বামপন্থী রাজনীতির প্রসার ঘটত। কেননা বিশেষ সামাজিক পরিসরে যে যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও ক্ষমতাসম্পর্ক উপস্থিত, সংলাপপ্রক্রিয়া যুক্ত থাকত তার সঙ্গে। জমি নেই এমন চাষি, রাষ্ট্ৰহীন উদ্বাস্তু, মার খাওয়া উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী, শ্রমের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত শ্রমিক, বেকার যুবা, রাগী ছাত্র, এঁরা নিজেদের আলাদা আলাদা পরিসরে নিজেদের মতো করে যে সব কথা বলতেন, বামপন্থী সংগঠকরা তা মন দিয়ে শুনতেন, নিজেদের কথাও বলতেন। সে কথার একটা মুখ্য অংশ জুড়ে থাকত সেতুবন্ধ ঘটানো। আলাদা সামাজিক পরিসরগুলোর মধ্যে কথাবার্তা চালু করার চেষ্টা। যেহেতু আমমানুষ বাস্তবকে বোঝেন নিজের জানাচেনা মহল্লা থেকে, একেবারেই ব্যক্তিগত কিংবা কৌম অভিজ্ঞতা থেকে — সেতুবন্ধনের কাজটা কোনোকালেই সহজ ছিল না। অনন্ত ধৈর্য নিয়ে বামপন্থীরা তথাপি এই কাজ করতেন, করে যেতেন। ‘মতাদর্শগত’ গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে এবং নেতৃত্বের সংঘাতে দল ভাঙত বারবার, আজকের বন্ধু কমরেড কালই ঝাঁ করে শ্রেণিশত্রু হয়ে যেতেন। তথাপি, বামপন্থী সংগঠকদের বুনিয়াদি কাজ বদলাত না, তাঁরা সাধ্যমতো সমাজে থাকতেন, মানুষের কথা শুনতেন।

 

মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা, সমাজে প্রোথিত থেকে অনেকের অনেকরকম কথা শোনা এবং কখনোসখনো নিজের কথা বলার এই যে রাজনৈতিক-সামাজিক বামপন্থী অভ্যাস, বাংলার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে তা যেমন পুষ্ট হয়েছিল উনিশশতকের সমাজসংস্কার আন্দোলন এবং বিশ শতকের ঔপনিবেশিকতাবিরোধী সংগ্রামের বিভিন্ন ধারা থেকে, তেমন অসংখ্য আদিবাসী এবং কৃষক বিদ্রোহের স্মৃতি থেকেও। ওপরের দিকে মাথাভারী দল থাকত, দলীয় আমলাতন্ত্রও, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে যথেচ্ছ উপদলীয় শাসনও চলত। ওপরের ভুল নীচের দিকের কাজকে নষ্ট করত, সামাজিক ঐক্য ও যুথবদ্ধতার অনেক পরিশ্রমে গড়ে তোলা আবহ, মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেত দলকেন্দ্রিক কাজের সংকীর্ণতায়। নেতৃত্বের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেও বারবার বামপন্থীদের সামাজিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, তবে সেসব গল্প সবাই একটুআধটু জানেন। এসব সত্ত্বেও, কমবেশি চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে (তিরিশের দশকের গোড়া থেকে সত্তরের শেষ অবধি, হয়তো আশির দশকেরও কিছুকাল) নীচের কাজটা চলেছে। মাছের সঙ্গে জলের যে সম্পর্ক, বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গে সমাজেরও সেরকম — মাওয়ের এই পুরোনো সত্যি কথাটা তো আকাশ থেকে পড়েনি। সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে একের পর এক শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে, চাষিরা জমি ও ফসল দখল করেছেন, মধ্যবিত্ত ছাত্র-শিক্ষক-সরকারি কর্মচারীরা সেই সব লড়াইয়ের সমর্থনে পথে নেমেছেন, লাঠিগুলি খেয়েছেন, জেলে গেছেন। এবং এই সম্পর্ককে ভিত্তি করে, এরই জেরে বামপন্থীরা ভোটে জিতেছেন, সরকারে গেছেন। যাঁরা ভোটে যেতেন, যাঁরা যাননি, তাঁদের কর্মী সংগঠকদের প্রায় কেউই সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকে টুকরো করে দেখেননি। সবাই জানতেন, যা করতে চাওয়া হচ্ছে, তা তাড়াহুড়ো করে হবে না। ভোট আসবে, ভোট যাবে, মানুষের সঙ্গে থেকে তাঁদের কথা শোনার কাজ বদলাবে না।

 

সামাজিক সংলাপ না শুধু দলের কথা বলা?

কথা শোনার, বলার, আবার শোনার, ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে সামাজিক সংলাপে অংশ নেবার, সংলাপ গড়ে তোলার এই কাজটা একটা সময় গুরুত্ব হারাল। সমাজে অন্য রকম ভাবনাচিন্তা খুঁজে বার করা, সেই খোঁজকে সমাজবদলের মৌলিক রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত করে দেখার অভ্যাসের জায়গা নিল দলের চোখ, কিম্বা দলের নেতাদের চোখ দিয়ে রাজনীতি জানাবোঝা। সরকারে যাওয়া সিপিএম, সরকারে না-যাওয়া, সিপিএমকে নয়া সংশোধনবাদী বলে চিহ্নিত করা নকশালপন্থী সংগঠনেরা দল এবং দলীয়পন্থাকে এতটাই প্রাধান্য দিতে শুরু করলেন যে, সমাজ থেকে দল, দলীয় সংগঠনকে আলাদা করে নেওয়া, দেখা, ভাবা শুরু হল। এই লেখক এক সময় সরকারি সিপিএম করত। আশির দশকের গোড়ায়, দলের কেন্দ্রীয় কমিটি কিছু ‘পার্টি চিঠি’ ছাড়লেন। বি টি রণদিভে তখনও জীবিত। তাঁর নামাঙ্কিত সে সব চিঠির একটায় বলা ছিল — গণ-সংগঠনগুলোকে ‘দলীয়’ বানিয়ে ফেলাটা ঠিক হচ্ছে না, ‘গণ’, অর্থাৎ সামাজিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এই সব সংগঠনগুলো মানুষের মতামত ‘সৃষ্টিশীল’ভাবে ধারণ করতে পারছে না। বাংলার বিপ্লবী ছাত্র-যুব নেতারা খুব চটে গিয়ে বললেন, ছাত্র-যুবরা সমাজতন্ত্র চাইবে না তা হলে?

 

চাইবে তো বটে, কিন্তু কে, কীভাবে? শুধু সিপিএম কেন, যাবতীয় অ-সিপিএম দলেও এক প্রবণতা। দল যদি সবকিছুই সবচাইতে ভালো করে জানে, দলের বাইরের যে ‘গণ’সমাজ সেখান থেকে জানবার বুঝবার তো আর কিছু থাকতে পারে না। কখন বিপ্লবী পরিস্থিতি, কখন নয়, কখন সরকারে যেতে হবে আর কখন হবে না, এসব কঠিন ভারী প্রশ্ন তো আছেই। সেই সঙ্গে, সমাজের বিভিন্ন খাঁজে-কোনায় গলিঘুপচিতে যে অজস্র অসংখ্য  প্রাত্যহিকের সংঘাত, দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেসব নিয়েও দলের বোঝাটাই চূড়ান্ত — এমন একটা ভাবনা, সেই থেকে অভ্যাস, অভ্যাস থেকে অভ্যাসজড়ত্ব অর্থাৎ ফেটিশ তৈরি হতে থাকল। সিপিএম এবং সঙ্গী যে সব দল বামফ্রন্টে ছিল, তাদের ক্ষেত্রে এই ফেটিশের ফল দাঁড়াল সার্বিক রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পচন। আগে এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, নতুন কিছু বলার নেই, সবাই দেখছেন — বুঝছেনও বটে। যাঁরা সিপিএম নন, এবং নিজেদের যুগপৎ কমিউনিস্ট এবং বিপ্লবী মনে করছিলেন, সেই সব দলের ভাবনা ও কাজ এই জায়গাটায় সিপিএম থেকে খুব আলাদা কিছু ছিল না। ১৯৬২-৬৪ এবং ১৯৬৭-৬৯এ কমিউনিস্ট দল যখন বড় করে ভাঙে, দল নয় এমন ‘গণ’ বা সামাজিক সংগঠনগুলোয় সেই ভাঙনের প্রভাব পড়ল, কালক্রমে ছোট-বড় সমস্ত বামদলের নিজস্ব ‘গণ-সংগঠন’, যা দল বা দলীয় নেতাদের নির্দেশে চলে, তৈরি হয়ে গেল। নকশালপন্থী রাজনীতি থেকে উদ্ভুত অসংখ্য অ-সিপিএম বাম দলের গণ-অনুশীলনের ক্ষেত্র ও সামাজিক প্রভাব সিপিএমের তুলনায় এমনিতেই হ্রস্বতর, তার ওপর তারা সরকারি ক্ষমতায়ও ছিল না, তারা ক্রমশ টুকরো ও ছোট হতে থাকল, সমাজের বিভিন্ন পরিসরে যাঁরা দলের হয়ে কাজ করতে গেলেন, তাঁরা প্রায়শই একই ব্যক্তি/ব্যক্তিকুল, ফলে তাঁরা এক ‘গণ’ বা ফ্রন্ট কাজ থেকে অন্য ফ্রন্টের কাজে দৌড়ে বেড়াতে থাকলেন, কাজের কাজ কিছু হল না। না দল বাড়ল, না গণসংগঠন। উল্টে সমাজবিযুক্ত দলনির্ভর যান্ত্রিক অনুশীলনে একসময়ের যৌথগুলো খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল, হতেই থাকল।

 

সিপিএমদের নিয়ে চাট্টি বাজে কথা অনায়াসে বলা যায়। সে দল ও তদনেতৃবৃন্দ দীর্ঘদিন ধরে ঘোষিত অবিপ্লবী, সবাই জানে। সমস্যাটা যাঁরা সিপিএম নন, ঘোষিত বিপ্লবী, তাঁদের নিয়ে। দল বাড়ানো, ভাঙানো, ভাঙা, বানানো এইসব নিয়ে তাঁদের গত চল্লিশ বছরটাক গেছে, অন্তত বাংলায়। কেন গেছে, কেন এখনও যায়, কেন সিপিএম বাংলার সমাজজীবন থেকে যাবতীয় দল ও গণ-শিকড়বাকড় শুদ্ধ উৎখাত হয়ে যাবার পরও তাঁরা এমন রাজনীতির কথা বলতে পারলেন না, যা মানুষ দাঁড়িয়ে শোনেন, শুনতে চান?

 

নো ভোট টু বিজেপি প্রচার ও বাম সমন্বয়

এ প্রসঙ্গে হালের নো ভোট টু বিজেপি প্রচারের কথা এসে পড়ে। এই প্রচারটায় অনেকগুলো অ-সিপিএম বাম দল, ব্যক্তি ও সংগঠন একসঙ্গে এসে একটাই কাজ করার চেষ্টা করেছেন। ভোটের ফল থেকে বোঝা যাচ্ছে, সেই কাজটার সঙ্গে বাংলার মানুষের একটা বড় অংশের ভাবনা মিলে গেছে। ফ্যাসিবিরোধী নাগরিক ঐক্য গড়ার ডাক দিয়ে যে মঞ্চ তৈরি হয়, তার সাংগঠনিক কাজ বা প্রচারকাজের শরীরী চৌহদ্দির মধ্যে এই ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে, মঞ্চ না থাকলে এই ভাবনার বিকাশ হতো না ও বিজেপি হাসতে হাসতে ভোটে জিতত — ব্যাপারটা এমন সম্ভবত নয়। মঞ্চ যা বলেছে, তা সমাজের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা প্রতিরোধের স্বরের অনুরণনমাত্র। ওপর থেকে বলা, রাষ্ট্রের জোর দিয়ে বলা, পুঁজি দিয়ে বলা এক ধরণের কথাকে সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে। হয়তো অনেক আগে থেকেই করছিল। মাটিতে কান পাততে আমরা বামপন্থীরা ভুলে গিয়েছি, আমাদের রাজনীতির জগৎ ছোট হতে হতে ফোনপর্দা ও দলবৃত্তে সীমিত, মানুষ কী ভাবেন কী বলেন তা শোনার সামর্থ্য, হয়তো বা ইচ্ছাও আমাদের নেই। ফলে, ‘নো ভোট টু’ প্রচারে যাঁরা চার মাস সকাল-সন্ধ্যা নিরলস দৌড়ে গেলেন, তাঁরাও জানতেন না, প্রচারের ফল কী হতে পারে। সবাই বিভিন্ন আধসেদ্ধ ওপিনিয়ন আর এক্সিট পোল ইত্যাদি দেখছিলেন। তাঁরা জানতেন না, ওই সমূহের অংশ হিসেবে এই লেখকও জানত না, কী হতে চলেছে।

 

আজকের অবস্থায়, জানাটা সম্ভব ছিলও না হয়তো। জানতে হলে, শুনতে হয়, শুনতে শিখতে হয়। ‘নো ভোট টু’ প্রচার নিয়ে অল্প কিছু কথা আগে বলেছিলাম। মনে হয়েছিল, পুঁজিতাড়িত যে ভোটপ্রচার আমাদের কানের, চোখের ও মনের মাথা খাচ্ছে, তার যে মোদ্দা একতরফা বলবার ধরন — আমাদের এই প্রচারও তার বাইরে নয়, অন্তত ধরনে। শহরকেন্দ্র থেকে নেতারা গিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন, প্রচারগাড়ি ঘুরছে, গান বাজাতে বাজাতে ও স্লোগান দিতে দিতে। এ ছাড়া ফেসবুক ট্যুইটারে মুহুর্মুহু ঝড়। যে কথাটা বলা হচ্ছিল — তার মোদ্দা নির্যাস, অর্থাৎ বিজেপিকে ভোট নয় — এটা লোকে বুঝছিলেন হয়তো। হয়তো বলছি তার কারণ, আমরা সাধারণত বলে চলে আসতাম, কে শুনছেন কী বুঝছেন তা শোনাবোঝার উপায় ছিল না।

 

ছিল না, কারণ, বামপন্থী রাজনীতির হালের ঘরানায় অনর্গল নিজের কথা বলার চল আছে। দল-উপদল-গণ এসব  আগের থেকেই ছিল, ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তির ও বিগ টেকের দৌলতে কথা বলার, বলে যাবার, ২৪x৭ বলতেই থাকার বিশেষ সুবিধা উপলব্ধ। দলের অগুন্তি টুকরো বা দলখণ্ড ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে নতুন অশরীরী টেকটুকরো তৈরি করছে। উপরি সুবিধা, নিজের কথাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে যাওয়া অর্থাৎ অ্যামপ্লিফাই করা। ক্রমাগত বলার, জোরে চেঁচানোর, অন্যের কথা না শোনার, নিজের কথার প্রতিধ্বনির বাইরে অন্যধ্বনি, ভিন্নস্বর না-শুনতে পাওয়ার একটা সংস্কৃতি চিরকালই সমাজে ছিল। বামপন্থীদের লড়াই শুরু হয়েছিল এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধতা দিয়ে। যেহেতু শুধুই বলার এবং না-শোনার প্রক্রিয়াটা শাসকের, শোষকের, সামাজিক অসাম্য ও স্থিতাবস্থা যাঁরা টিকিয়ে রাখতে চান, তাঁদের। পরিতাপের কথা, সমাজমুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে বামপন্থীরা যখন রাষ্ট্ৰক্ষমতায় গেলেন, শাসকের আধিপত্য ও বাচনভঙ্গি, এমনকি তাদের ক্ষমতার ভাষা তাঁরা রপ্ত করলেন দ্রুত। সমাজের যেখানে যেখানে ভিন্নস্বর অন্য কথা ছিল, তার সমস্তটাকে দল, রাষ্ট্ৰ ও দেশবিরোধিতা বানিয়ে ফেলে নির্মূল করার চেষ্টা হল। যেভাবে এখন এখানে বিজেপি সরকার করছে। এই ইতিহাসের বোঝা বঙ্গীয় বামপন্থীদেরও কাঁধে। কথা বলার অভ্যাস থেকে তাঁরা বেরোতেই পারছেন না।

 

শুনব না বল? বামপন্থার এখন তখন

একটা উদাহরণ দিই। সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন হয়ে পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে পার্টিরাষ্ট্ৰগুলো তৈরি হয়েছিল, তার প্রায় সবকটা আপাতত হয় ভেঙে চৌচির নয় কমিউনিস্ট পার্টির নামে নির্বিচার পুঁজিতন্ত্র ও রাষ্ট্ৰবাদ চালানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যথা চীন। রাষ্ট্ৰ ও পার্টি দুইয়ে মিলে দুর্নীতি ও স্বৈরশাসনের পরাকাষ্ঠা। যার মূলে একটা সহজ ধারণা: আমার, আমার দলের বাইরে সব শত্রু বা মতলববাজ, কিংবা আমি ঠিক এবং আমার মতের বাইরে সব ভুল।

 

অথচ, পুঁজিতন্ত্র বলুন বা হালের ফ্যাসিবাদ, এর বিরুদ্ধে ইদানীং যে সব লড়াই হচ্ছে তাতে পার্টিরাষ্ট্রের ঐতিহ্য, যা মূলত আধিপত্য বিস্তারের, একতরফা বলে যাবার ও না-শোনার, তাকে সচেতনভাবে বর্জন করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গত কুড়ি বছরের মধ্যে নতুন আন্দোলন যা হয়েছে, তার একটাতেও পুরোনো দল বা দলরাষ্ট্রের কথা আসেনি। এই সব আন্দোলনের সবগুলো স্থায়ী হয়নি, কিছু উল্কার মতো দ্রুত জ্যোতি বিচ্ছুরণ করে ফুরিয়েছে,  যথা তথাকথিত আরব বসন্ত, কিছু অন্যভাবে অন্য চেহারায় সমাজে প্রভাব বিস্তার করছে, শিকড় গাড়ছে, যথা অক্যুপাই আন্দোলন। কোনও দলের নেতৃত্ব (বা কর্তৃত্ববাদী, ওপর থেকে নীচে আসা নেতৃত্বের ধরন) এই সব আন্দোলনের চরিত্র বা প্রক্রিয়া নির্ধারণ করছেন না, বরং সমাজের সঙ্গে আনুভূমিক একটা যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে বহু জায়গায়। যা আন্দোলনরত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংগঠনকে এক বা একাধিক দীর্ঘ সংলাপের অংশ করে তুলছে। সমাজে এর ফলে একটা স্থায়ী ধাক্কা লাগছে, বহু পুরোনো অভ্যাসজড়ত্ব ভাঙছে। মেহিকো বা মেক্সিকোর চিয়াপাসের জাপাতিস্তা আন্দোলনের কথা সবাই জানেন, অনেকেই কুর্দিস্তানের রোজাভায় ঘটে চলা সমাজবিপ্লবের কথাও শুনেছেন। খোদ আমেরিকার রাজনৈতিক সামাজিক মানচিত্রে গত দু’বছরে দুনিয়া কাঁপানো প্লাবন আছড়াচ্ছে। পরিচিত, বহুচর্চিত তিনটে উদাহরণ দেওয়া হল। এরকম আরো অসংখ্য ছোটবড় আন্দোলন পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটছে, আমাদের দেশেও। চিহ্নিত, নির্দিষ্ট সংগঠন নেই, নেতৃত্বের পুরোনো ধারণা পরিত্যক্ত, দল তো নেয়ই। অথচ, এই সব আন্দোলন থেকে সমাজে স্থায়ী, বৈপ্লবিক, উথালপাথাল বদল সূচিত হচ্ছে। জাপাতিস্তা আন্দোলনে স্থানীয় আদিবাসীরা, মহিলারা অগ্রণী। শোষণ-বঞ্চনার সামাজিক অর্থনৈতিক পরিসরগুলোকে তাঁরা একটা একটা করে ভাঙছেন। রোজাভায় পুরসভার স্তরে বিকেন্দ্রিত নাগরিক সরকারের একটা ধারণা তৈরি করা হচ্ছে, তার নেতৃত্বেও মহিলারা। আমেরিকার গত নির্বাচনে তৃণমূল স্তরে সক্রিয় অসংখ্য ছোট সংগঠন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির কাজ করেন, নির্বাচনে অংশ নেন। এক্ষেত্রে কালো মানুষ, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়া থেকে আসা মানুষ, এবং মহিলারা বিশেষ ভূমিকা নিচ্ছেন, ফলে সমাজের গভীরে জমে থাকা শ্বেত আধিপত্য ও পিতৃতন্ত্রের যে ক্লেদ, তা অবশেষে সরতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের জোরে পুরোনো ক্ষমতা সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

 

এত কথা দিয়ে কী বলতে চাওয়া হচ্ছে আসলে? পুরোনো কায়দার কর্তৃত্ববাদী দল বা সংগঠন, বা এসব নিয়ে পুরোনো ভাবনাগুলো যদি জীর্ণ বস্ত্র যথা ছুঁড়ে ফেলা না-যায়, নতুন কিছু করা যাবে না। ‘করা’ বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে সমাজে নতুন বসতি গাড়ার বুনিয়াদী কাজকে। সেই বসতি থেকে পুরোনো অন্যায় ও অসাম্যের বিন্দুগুলোকে ধাক্কা দেওয়া, ভাঙার বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে, যা না ঘটলে সমাজ বদলায় না, অন্য সমাজ নির্মিতও হয় না।

 

যে সব আন্দোলনের কথা বলা হল, যে কাজের কথা বলতে চাইছি, রাষ্ট্ৰ থেকে সমাজকে আলাদা করে না দেখলে সেগুলোর গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য বোঝা সম্ভব নয়। সমাজমুক্তির যে লড়াই, সে উদ্দেশ্যে যে আন্দোলন, তা রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে কাজ করে। রাষ্ট্ৰ ও পুঁজির অবিরল বিরুদ্ধতায় তার শরীর ও মন তৈরি হয়। কোনও একদিন বিপ্লব ঘটবে, সমাজতন্ত্র আসবে, যেহেতু ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ অনুযায়ী তাই ঘটার কথা — এ হেন বস্তাপচা ছেঁদো আপ্তবাক্য দিয়ে কিস্যু হবে না। যেহেতু এই ভাবনায় বিপ্লবী সমাজবদলের প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্ৰক্ষমতা দখলের সমার্থক ভাবা হয়, এবং যতদিন সেই মহাক্ষণ (লাল কিল্লে পে লাল নিশান) সমাগত না-হয়, মন দিয়ে সবাই মিলে দলবাজি, গ্ৰুপবাজি (তৎসহ পারলে সরকারে যাওয়া, গিয়ে বামফ্রন্ট হওয়া) এসব করে যাওয়াটাই এসময়ের বিপ্লবী কাজ — এই ভাবনাটাও উবে যায় না। পুরোনো দুর্গন্ধযুক্ত এই অভ্যাসগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাতিল করা দরকার। বললেই এটা ঘটবে না, জানি। বামপন্থী দল/দলখণ্ডে এরকম বিস্তর লোকজন বসে আছেন, যাঁরা মনে করেন স্তালিন মরে যাবার পর থেকে বিশ্ববিপ্লব গেল-গে-যা! এবং রাষ্ট্ৰক্ষমতা দখল না-করলে আবার বিপ্লব কিসের, ওসব তো ‘সিআ’ কিংবা ‘ফন্ডেড’ এনজিওকুলের ষড়যন্ত্র। এঁরা এতবছর ধরে যেভাবে ভেবেছেন (আসলে না-ভেবেছেন) এবং দল ভেঙে অন্য দল করেছেন, করেই গেছেন, সেই রফুচক্কর থেকে বেরিয়ে আসা না-মুমকিন সাব্যস্ত হতে পারে। কিন্তু বেরিয়ে আসতেই হবে। যাঁরা অভ্যাসবশত ও অন্য দলজনিত কারণে বেরুবেন না, তাঁদের কোনও হালতে বামপন্থী বলা যাবে না। এই সাফ কথাটি সাফ বুঝতে হবে, বলতেও হবে।

 

সমাজমুক্তি কোন পথে: বিপ্লব না ‘ভারতীয়’ বিপ্লব?

রাষ্ট্ৰ থেকে সমাজকে আলাদা করে দেখতে শিখলে, ‘ভারতীয় বিপ্লব’ বলেও আলাদা করে কিছু থাকে না। থাকবেই বা কেন? রাষ্ট্রীয় ‘ভারত’ ব্যাপারটা সায়েব শাসকদের তৈরি, মিলিটারি সীমামানচিত্র শুদ্ধু। সেই ভারত শাসকদের কাছে আজও আছে। শুধু আছে নয়, দেশের যাবতীয় লোককে জবরদস্তি সে ভারত গেলাতে বিজেপিওয়ালারা বদ্ধপরিকর। আমাদের, বামপন্থীদের দেশ, দেশের আমমানুষের দেশ আর বিজেপি সঙ্ঘের দেশ এক হবে কেন? আমার ভাবনাবুদ্ধি অনুযায়ী, আমার দেশ, আমার রাজ্য, আমার জেলা, পাড়া, জঙ্গল, সমুদ্র, নদী, যা ইচ্ছা হতে পারে। সমসংস্কৃতির স্বাধীন বিকাশ ঘটে যে পরিসরে, তা-ই দেশ। সমাজমুক্তির বাম ধারণা তৈরির আদিপর্বে দেশ ধরে বিপ্লবভাবনা বিকশিত হতো না। বরং দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিকতার একটা ভাবনা সমস্ত বাম আন্দোলনের কেন্দ্রে বসত করেছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। রাষ্ট্রের, শাসকদের, পুঁজিমালিকের বিরুদ্ধতা চালিয়ে যেতে হবে, ওরা যা বলবে যা শেখাবে আমরা তার উল্টো কথা বলব, শিখব। আমাদের জ্ঞান বিরুদ্ধতার, ওদের শাসনের। সে জ্ঞান আমাদের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু হয়ে গোটা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত, শাসকের বানানো রাষ্ট্ৰ দিয়ে সে জ্ঞানের সীমা নির্ধারিত কদাচ হবে না। এইটা বুঝে নিলে, আমাদের সামনে অনেকরকমের নতুন পুরোনো কাজের এক সম্ভাবনাময় দুনিয়া খুলে যায়, আমরা ভাঙতে ভাঙতে গড়তে গড়তে যাই। দূরাগত সামরিক কিম্বা রাষ্ট্রিক প্রক্রিয়া নয়, বিপ্লব একটা প্রাত্যহিক অথচ চিরকালীন কাজ হয়ে ওঠে। সে কাজে মানুষের সচেতন সৃষ্টিশীল অংশগ্রহণ থাকে, এমন গণতন্ত্র থাকে যা যুথবদ্ধতাকে সামাজিক অভ্যাস করে তোলে।

 

রাষ্ট্রের, পুঁজির বোলবোলা ইদানীং তো এত বেশি যে, ওই পরিসরে সমাজ ঢুকে পড়ছে, সমাজকে আর চেনাই যাচ্ছে না আলাদা করে। ফলে সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রপুঁজির আওতার বাইরে স্বাধীন কাজ ও ভাবনার সুযোগ কমছে। আমরা প্রায়শই ভুলে যাচ্ছি আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ, নিজেদের আবিষ্কার করা, তা সে শ্রেণিব্যবস্থা বিলোপকারী শ্রমিকশ্রেণির অংশ হিসেবে হোক, অথবা সেই যৌথচৈতন্যের শরিক হিসেবে।

 

‘নো ভোট টু’-র কথা বলতে গিয়ে কত কথা চলে এল। আসতেই হবে। ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা মানে ফি ভোটে ‘বিজেপিকে ভোট দিও না’ বলে চেল্লানো নয়। মনের সঙ্গে মনের সংযোগ গড়ে তুলে পুঁজিরাষ্ট্রের আধিপত্যের দেয়ালে চিড় ধরানো। শ্রেণির লড়াই থেকে যে ফাঁক প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে, সে ফাঁক খুঁজে বার করা। ‘নো ভোট টু’ প্রচারে যাঁরা ছিলেন, নানান ভাবে যাঁরা ফ্যাসিবিরোধী প্রচারে অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা কি সে কাজটা করছেন? এটা যে আদৌ একটা কাজ সেটাও কি বুঝছেন? সমাজের কথা শোনা দূরস্থান, ‘নো ভোট টু’ মঞ্চে যাঁরা আছেন তাঁরা কি একে অন্যের কথা শোনার অভ্যাসটাও করেছেন এতদিনে?

 

ফ্যাসিবিরোধী ঐক্য? বাম রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা

কেন এই প্রশ্ন? ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচার শেষ, ভোটের ফল বেরিয়ে গেছে, যাঁরা এতদিন একসঙ্গে প্রচার করেছেন, তাঁরা নিজের নিজের টুকরোয় ফিরে গিয়ে দলস্বার্থ সামলানো শুরু করলেন। এতে কেউ ভুল বা অন্যায় দেখেন না, চল্লিশ বছর এভাবে গেলে, আগামী চল্লিশ বছরও যেতে পারে। দলবহির্ভূত যে ব্যক্তিরা আছেন, বঙ্গীয় কায়দায় তাঁরাও নিজের নিজের কথায় বদ্ধমূল — যে যা বলছেন তার চাইতে ভাল কিছু হয় না। ফলে, সবাই মিলে কথা বলতেও চাওয়া হচ্ছে যখন, তখনও সংলাপ গড়ে উঠছে না, সবাই যে যার নিজের কথাই বলছেন। সেই কথাগুলো একজায়গায় আসছে না, হয়তো আসার কথাও নয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে কী করে, প্রথমত, যদি না বহু মানুষের বহু কথা শোনা হয়, সমাজের স্বর শোনার অভ্যাস নতুন করে গড়ে তোলা না যায়?

 

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চ বা নাগরিক উদ্যোগ গড়ে তুলে যাঁরা বিজেপি বিরোধী প্রচার করলেন, তাঁদের প্রায় সবার মনে হচ্ছে, অতঃপর কী? অর্থাৎ, ভোট শেষ হয়ে গেল, এরপর ভোটের কথা বলা যাবে না। তবে কী নিয়ে প্রচার চলবে? প্রচার চালাতেই যে হবে, এ বিষয়ে মতদ্বৈধতা বিশেষ ছিল না। ফলে, আসল ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, প্রচারের বিষয়। বিজেপি সরকারের অসংখ্য বাজে কাজের ও নীতির মধ্যে কোন কোনটা ধরে মানুষকে বোঝানো যায় — হে জনগণ, ফ্যাসিবাদী প্রচারে বিভ্রান্ত হোয়ো না, আমরা যা বলছি শোনো। একবারও ভাবা হচ্ছে না, আমাদের প্রচারের অপেক্ষায় না থেকে অনেক মানুষ নিজেদের মতো করে ঠিক করে ফেলেছেন — বিজেপির কাজকর্ম তাঁদের পছন্দের নয়। যেহেতু ভোটের ব্যাপার, ভোটে বিজেপির মূল বিরোধী তৃণমূল, মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। সেভাবে কথা শুনলে দেখা যাবে, অনেকে তৃণমূলের কাজকর্মও পছন্দ করেন না। মানুষের ভাবনার, ভাবনা তৈরি হয়ে ওঠার সামাজিক যে প্ৰক্রিয়া, তার ভিতর যদি না ঢোকা যায়, ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধতা শুধু ‘প্রচার’ দিয়ে সম্ভব? আরএসএস মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে, এটা বলা যথেষ্ট নয়। মানুষের কাছে আরএসএস পৌঁছতে পারছে কী করে, অথচ আমরা পারছি না কেন? এটা ভাবতে হবে না? মানুষের মনের সন্ধান নিতে হবে না? না হলে বুঝব কী করে? চটকল আর চাবাগানের কাজ-হারানো শ্রমিক, উচ্ছেদ হওয়া কৃষক, আদিবাসী এবং শহরের বস্তিবাসী মানুষ কেন জিনিসপত্রের দাম বাড়া বা বেকারির চাইতে প্রয়োজনীয় মনে করছেন রামমন্দির করা কিংবা কাছের দূরের মুসলমান মহল্লাকে সবক শেখানো? যাঁরা এসবে কান ও মন দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন? যাঁরা দিচ্ছেন না, কেন দিচ্ছেন না?

 

এই কেন-র উত্তর খুঁজতে গেলে সমাজের গভীরে যেতে হয়, ধৈর্য নিয়ে মানুষের কথা শুনতে হয়। এবারের ভোটে, বাংলার নানান জেলা ও মহকুমা শহরে, এমনকি গ্রামেও বহু মানুষ ‘নো ভোট টু’ প্রচারে যোগ দিয়েছেন, অনেকেই চাইছেন মঞ্চটা চলুক। সেটা কীভাবে ঘটবে সে বিধান দেবার ধৃষ্টতা লেখকের নেই। অথচ মঞ্চের মধ্যে থেকেও এই আলোচনাটা তোলার সুযোগও ঘটে উঠছে না নানা কারণে। সুতরাং এই লেখা, যাঁরা সহযোগী, বন্ধু, সহযোদ্ধা তাঁদের ইচ্ছা করেই খানিক খোঁচানোও। তাঁরা ভাবুন এবং ভাবনার লেনদেন করুন। কাল বা পরশু বা তরশু তিনটে জম্পেশ কনভেনশন সভা এবং গুটি দুয়েক মিছিল যেমন করে হোক নামাতে হবে, নইলে বাজার খারাপ হবে, এই ভাবনায় তাড়িত হয়ে কিছু করে ফেললে সেটা বিশেষ সুবিধার হবে না। বরং অন্য কিছু কাজ, অভ্যাস সবাই মিলে তৈরি করা যাক। যথা:

 

অন্যের কথা শোনা। দলের মধ্যে আলোচনা চললেও, দলের বাইরে যাঁরা, তাদের কথা মন দিয়ে শোনা, তদনুযায়ী, দলের সিদ্ধান্ত বদলানো।

 

ভাবা:

কে করছেন, কী করছেন, করা মানে কী? সমাজমুক্তির রাজনীতি চর্চা মানে দল করা নয়, দল করলেই ওই রাজনীতি তৈরি হয়ে যায় না। কাজ- কাজ বলে যাচ্ছি, ‘কাজ’টা কী হচ্ছে?

 

ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চের গত চার মাসের কাজ এবং আমাদের যৌথকাজের অতীত অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে, এবং বর্তমান সময়ের সংকট ও সম্ভাবনার বিন্দুগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার প্রয়োজন বিষয়ে অবহিত হয়ে, সামনের দিনে আমরা কী কাজ কীভাবে করতে পারি, তা নিয়ে ভাবা দরকার। ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চের কাজের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বাংলায় ভোটের আগের দু’বছর ধরে, ভোট সামনে রেখে রাষ্ট্ৰ ও পুঁজির চূড়ান্ত হামলা ও আধিপত্যবিস্তারের চেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলার নাগরিকদের একটা বড় অংশ যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, তা বিশেষ উল্লেখ্য ও আলোচনার যোগ্য। এতদসত্ত্বেও, সামাজিক প্রতিরোধের ক্ষেত্র ও ঘটনাগুলোকে অনেক সময়েই আমরা চিহ্নিত করতে পারি না। পারলেও সেই ক্ষেত্র/ঘটনার সঙ্গে স্থায়ী রাজনৈতিক সংলাপ বা যোগাযোগ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে পারি না। এই যোগাযোগটা গড়ে তোলা যায় কী করে?

 

প্রস্তাব

বাংলার সমাজে দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাসিবিরোধী কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো উপাদান বর্তমান, ভোটের ফলে এটা বোঝা যাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঁজির সর্বগ্রাসী আধিপত্যের প্রাচীরে ফাটল যে ধরে, ধরানো যায়, প্রতিরোধ যে নিচ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে নির্মিত হয়ে উঠতে পারে, ভোটের ফল প্রকাশের আগে তা তো বুঝে ওঠা যায়নি!

 

রাজনৈতিক অভিমুখ ও উদ্দেশ্য ভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাসিবিরোধী কাজ  গড়ে তোলা যায় না। রাজনৈতিক অভিমুখ ও উদ্দেশ্য বলতে পূর্বনির্ধারিত কিছু কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে না। সমাজের যে যে অংশে (শ্রেণি-জনগোষ্ঠী-লিঙ্গ), ক্ষেত্রে (ভৌগোলিক), পরিসরে (সামাজিক-সাংস্কৃতিক) ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ নির্মিত হয়েছে, সেই সেই অংশ, ক্ষেত্র ও পরিসরে রাষ্ট্ৰপুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে ও সমাজমুক্তির পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্ঘায়নের (অর্গানাইজিং) কাজ চালানোর মতো অবস্থা আছে, প্রাথমিকভাবে এটা ধরে নেওয়া যায়। এই সব অংশ, ক্ষেত্র, পরিসরকে নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে, সামাজিক সংলাপ নির্মাণের চেষ্টা চালানো অতি প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কাজ।

 

ফ্যাসিবিরোধী যে যৌথ কাজের সঙ্গে আমরা যুক্ত, তাকে এই রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যান্ত্রিকভাবে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ কিংবা যৌথ ফ্যাসিবিরোধী কাজকে মঞ্চের বর্তমান অবয়ব (সেখানে যুক্ত ব্যক্তি, সংগঠন ইত্যাদি) দিয়ে বিচার করাটা রাজনৈতিক মূর্খতা হবে, এতে আমরা মঞ্চ সম্পর্কে সমাজে যে প্রত্যাশা ও ধারণা তৈরি হয়েছে তার প্রতি সুবিচার তো করবই না, রাজনৈতিক কাজের যে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়েও অনুসন্ধান চালানো যাবে না।

 

এই অনুসন্ধান কিসের? সমাজের গভীরে প্রোথিত প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষার, যুথবদ্ধতার, যৌথ ঐতিহাসিকতার। এই অনুসন্ধান কিসের? রাষ্ট্ৰপুঁজির বিরুদ্ধে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে বিরুদ্ধক্ষমতা সমাজ নির্মিত করে, তার। এই অনুসন্ধান কিসের? সামাজিক বিরুদ্ধক্ষমতাকে সচেতন রাজনৈতিক প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত করবার সজীব, বিবর্তনশীল, পরিবর্তনশীল দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার। সুতরাং, এই অনুসন্ধান আজকের সময়ের, পরিস্থিতির উপযোগী সমাজমুক্তির রাজনীতির।

 

সুতরাং, এমন প্রস্তাব ভাবা যেতে পারে, ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চের (ধারণা ও সম্ভাবনাগত অর্থে, বর্তমান আহ্বায়কমণ্ডলীর মধ্যে সীমিত না রেখে) ভবিষ্যৎ কাজের প্রসঙ্গে আমরা এক বা একাধিক আলোচনা করি। উপরে সংক্ষেপে যা বলার চেষ্টা করা হল, তার ভিত্তিতে এবং সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত চর্চার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে, অনুসন্ধানের কাজকে শারীরিকতা প্রদানের উদ্দেশ্যে, নিন্মলিখিত বিষয়গুলি ঠিক করা দরকার:

 

১/ সামাজিক সংলাপের ক্ষেত্র, পরিসরগুলি নির্দিষ্ট করা।

 

২/ এই সংলাপ কীভাবে শুরু হবে, তার প্রাথমিক ধারণা হাজির করা।

 

৩/ এই সংলাপ শুরুর জন্য কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নকে সামনে রাখা দরকার। সেগুলো কী কী বা কী ধরনের হতে পারে তা নির্দিষ্ট করা। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে কিছু প্রশ্নকে একটু দাগিয়ে দেওয়া যায়, আরও বহু প্রশ্ন এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে, তা মাথায় রেখেই:

 

ক) গণতন্ত্র প্রসঙ্গে চর্চা, বিশেষ করে নিচু থেকে গড়ে ওঠা সামাজিক যৌথ যে গণতন্ত্রের অনুশীলন করে, বা করতে চায়। দু-একটি সংক্ষিপ্ত উদাহরণ, আদিবাসীদের বা অন্যান্য প্রান্তিক মানুষদের যৌথ, যথা গ্রামসভা, সমাজ, বা পঞ্চায়েত। স্থানীয় স্তরে মানুষের দৈনন্দিন সমাজজীবন ও পরিবেশ, জীবিকা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সামগ্রিক অর্থে সংস্কৃতি — যা জীবনকে ধারণ করে — এই সবের সঙ্গে এই যৌথ অনুশীলনের অঙ্গাঙ্গী যোগাযোগ রয়েছে। এই অনুশীলনের মূল কথা কৌম মূল্যবোধ ও যুথবদ্ধতার প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে সমাজবদলের চেষ্টা করা।

 

খ) সমাজবদলের যৌথ চেষ্টাকে ইদানীং সামাজিকীরণ, সাধারণীকরণ বা কমনিং হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। অনেকে মিলে, সামাজিক যৌথের মাধ্যমে গণতন্ত্র অভ্যাস করাটা যে কোনও সামাজিক স্তরেই সম্ভব, শহরে, গ্রামে সর্বত্র।

 

গ) বাংলার ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক পরিসরে যে প্রগতিশীল ফ্যাসিবিরোধী সামাজিক সাম্যপন্থী অর্জন এখনও অবধি জীবিত, তাকে এবারের নির্বাচনে সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এই অর্জন যৌথ অর্জন, কমনিং না-হলে, না-ঘটলে এই অর্জনের উত্তরাধিকার আমাদের অনেকের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত না। এই কাজটা নিয়ে আরও ভাবার এবং অনুশীলনের অবকাশ রয়েছে।

 

ঘ) সংসদীয় গণতন্ত্রের পুঁজিরাষ্ট্ৰ নির্ভর প্রক্রিয়া নয়। সমাজ, যৌথজীবন ও কমনিং-এ আধারিত অন্য গণতন্ত্রের কথা আমরা রাষ্ট্ৰ-রাজনৈতিক (পার্টি পলিটিক্স) স্তরেও নিয়ে যেতে পারি। পঞ্চায়েত এবং পুরসভা পরিসরে কমনিং-এর সম্ভাবনা, দাবি ও আন্দোলন, এর বিন্দু কী কী হতে পারে, সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা হলে অন্য ধরনের কাজ সমাজে তৈরি হতে পারে। বিচ্ছিন্ন ভাবে, খণ্ডে খণ্ডে কিছু কমনিং-এর কাজ চলতে থাকে। সমাজমুক্তির রাজনীতির সঙ্গে এই কাজ কীভাবে জুড়বে, চ্যালেঞ্জ সেইখানে। আমাদের কাছে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ, সামাজিক পরিসরে যে সব বিরোধ এবং বিরোধভাস বর্তমান, যথা লিঙ্গ-জাতি-জাতিসত্ত্বা-ধর্ম, যা কমনিং-এর মুক্তিকামী প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত পরিচয়ের রাজনীতির দিকে ঠেলে, ফ্যাসিবাদকে পুষ্টও করে, গণতন্ত্র অনুশীলনের কাজে সেগুলি কীভাবে যুক্ত, তা যত্ন নিয়ে বোঝা।

 

ঙ) অন্য গণতন্ত্র প্রসঙ্গে রাজনৈতিক চর্চা যদি সমাজে গড়ে তুলতে পারা যায়, তা নির্বাচনী রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে বাধ্য। আমাদের কাজের সঙ্গে কীভাবে এই রাজনীতির সম্পর্ক গড়ে উঠবে, বা সে সম্পর্ক সমাজমুক্তির রাজনীতির সাধারণ অভিমুখ থেকে আমাদের পথভ্রষ্ট করবে কিনা, তা নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার।

 

ওপরে যা বলা হল, আপাতভাবে মনে হতে পারে, শ্রেণিরাজনীতির সঙ্গে বিষয়গুলো সম্পর্করহিত। বিশদে ভাবলে বোঝা যাবে, তা নয়। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ও চর্চায় শ্রেণিরাজনীতিকে আমাদের যুক্ত করতেই হবে, বা ওই রাজনৈতিক বীক্ষা ছাড়া এই চর্চা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

 

গড়ার জন্য ভাঙা

গড়তে গেলে ভাঙতেই হয়। সত্যি কথা বলতে কি, ভাঙার মধ্যে গড়া থাকেই, বা গড়ার মধ্যে ভাঙা, বিশেষত যে গড়ার আভাস এতক্ষণ ধরে দেওয়ার চেষ্টা হল। কী ভাঙতে হবে? নিজেকে, নিজের দল/দলখণ্ড/সংগঠনকে সমস্ত ভাবনার চূড়ায় বসানোর অভ্যাস, চূড়া থেকে বাণী ও ভাষণ দেবার অভ্যাস। কী ভাঙতে হবে? সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাজকে আলাদা করে দেখার অভ্যাস, যাতে সমাজের সঙ্গে বামপন্থীদের সম্পর্ক গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বা মেসিয়ানিক গাড্ডায় গিয়ে না-পড়ে, এবং সেখানেই আটকে না-থাকে। আমি আর আমার দল যা দেখছি, বুঝছি, তার বাইরে বিস্তীর্ণ অজানা কমজানা দুনিয়া অসংখ্য বিপর্যয় ও সম্ভাবনায় কাঁপছে। সেই দুনিয়াটাকে জানব কী করে যদি নিজেকে, নিজেদের না ভাঙি?

 

সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে রাজনীতির যে মার্ক্সীয় চর্চা, তাতে কি এখনকার বামপন্থী দল/দলখণ্ডগুলো আর আকৃষ্ট হয় না? ওপর ওপর দেখে বুঝে ঝটিতি খানিক মন্তব্য করার যে সোশ্যাল মিডিয়ামার্কা পদ্ধতি, তার বাইরে গিয়ে বিশদ রাজনৈতিক তর্কে কি কেউ যেতেই চাইছেন না? দলটল নিয়ে এই লেখাটায় ইচ্ছে করেই পাঁচরকম কথা বলা হল, সে কথায় কারোর বিরোধ থাকলে তাঁরা সেই তর্কটা করুন না। গ্রাউন্ডজিরোয় অথবা অন্যত্র (ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে নয়, প্লি-ই-ই-জ) লিখে লেখককে তাঁরা গাল দিন, দিতে থাকুন, তাঁদের মুখে মাথায় রক্তজবার পাপড়ি ও রেণু এসে পড়বে।

 

সব দল জানে, সুতরাং রাজনৈতিক কথাবার্তা দলে বসে হবে, এটাও যদি কেউ বিশ্বাস করেন, সেটাই বলুন না ভাল করে। লোকেরও তো জানার দরকার, আপনার/আপনাদের দল ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলন নিয়ে ঠিক কী ভাবছে।

 

(লেখক বামপন্থী ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী।)

 

(এই লেখায় ব্যক্ত মতামত লেখকের নিজস্ব। ফ্যাসিবিরোধী কাজ ও নো ভোট টু বিজেপি মঞ্চের কাজ নিয়ে সৌমিত্র ঘোষের এই লেখা গ্রাউন্ডজিরোয় প্রকাশেরআগে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনকে পাঠানো হয়। আমাদের মনে হয়েছে যে বিষয়গুলো এই প্রবন্ধে উঠে এসেছে, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা দরকার। সবাইকে অনুরোধ করা হয় লেখাটা পড়ে যা মনে হয় সেটা  (পূর্ণ প্রবন্ধ আকারে, টুকরো মন্তব্য নয়) যদি পাঠাতে পারেন, খুব ভাল হয়। এখনআমরা কোনও এমন লেখা বা পূর্ণ রচনা পাইনি। তা এলে আমরা পরপর সবগুলো দিতে পারি, বিতর্কও চলতে পারে। — সম্পাদকমণ্ডলী গ্রাউন্ডজিরো )

 

পড়ে দেখুনফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র ও বামপন্থা: ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন কোন পথে?

 

Share this
Leave a Comment