গো সুরক্ষা বিধি আর কিছু প্রাসঙ্গিক কথা


  • July 18, 2021
  • (2 Comments)
  • 1207 Views

গো সুরক্ষা বিধির ফলে অসমের আর্থসামাজিক পরিবেশে যা সব নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেগুলোকে বিবেচনাতে রাখা তো দূরেই থাক, উত্তর প্রদেশ সহ যে সব রাজ্যে এমন আইন আনা হয়েছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যেও যে খুব বিরূপ পরিস্থিতি ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে সেই সব কথাকেও গুরুত্ব দেওয়া হল না। লিখেছেন হর কুমার গোস্বামী

 

রাজ্যে খ্রিস্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ থেকেও বেশি। দুধ এবং কৃষিকাজে ব্যবহারের বাইরেও এইসব মানুষ গরুকে প্রোটিনজাত খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করে আসছেন। আগেকার অবিভক্ত অসমের, তথা আজকের মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল, নাগাল্যাণ্ডকে ধরে বৃহৎ অসমের অধিকাংশ মানুষের খাদ্যতালিকাতেই গোমাংস অতীতকাল থেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে।

 

এই কথা সবাই জানেন যে গো-বলয়ের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে গো-রক্ষার শ্লোগান একটি নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়ে এসেছে। গো-রক্ষার শ্লোগানের আড়ালে মুসলমান তথা দলিতদের উপরে উচ্চবর্ণের আধিপত্য-বাসনাকে জোর করে চাপিয়ে দেবার প্রবণতা কাজ করে। সংঘ পরিবার ধর্মীয় মেরুকরণের স্বার্থে যে এতে হাওয়া পানির যোগান দেয়, সেই কথা গত সাত বছরে আখলাক কাণ্ডের থেকে শুরু করে গোবলয়ের অসংখ্য ঘটনার থেকে বোঝা গেছে।

 

অসমের গ্রামীণ অর্থনীতির যেটুকু বুনিয়াদ ছিল, তাও ইতিমধ্যে প্রায় ছিন্নভিন্ন। বিমুদ্রাকরণ, জি এস টি, মহামারি, লকডাউনের মতো ঘটনাগুলো অসম সহ গোটা ভারতের অর্থনীতিকে ইতিমধ্যেই এক ভয়ঙ্কর নেতিবাচক স্থিতিতে নিয়ে গেছে। এই সবের বাইরেও অসমের অর্থনীতিতে বড় আঘাত হানবার অন্য এক কারক ছিল এনআরসি, যার কথা অধিকাংশ লোকে ভাবেনই না। রাজ্যের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ এর ফলে ব্যাপক ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে গেছেন। আর এই সব এখন এমন ভয়ঙ্কর যে মানুষ বাধ্য হচ্ছেন কিডনি অব্দি বিক্রি করতে। মরিগাঁওতে যে ঘটনা সামনে এল তা ইতিমধ্যে গোটা রাজ্যকে কাঁপিয়ে গেছে। সেই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত বলে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ লোকজনের নামও সংবাদপত্রে আসছে।

 

অসমিয়া শাসক শ্রেণির বিচার-বিবেচনাহীন কতকগুলো হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলেই আগেকার বৃহৎ অসম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছিল। অতীতের অভিজ্ঞতাগুলোর থেকে অসমের শাসকশ্রেণি তথা এদের আশিস-পুষ্ট বৌদ্ধিক শ্রেণিটি কখনও কোনও শিক্ষা নেয় নি। আর ভবিষ্যতেও যে নেবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। হাজারটা সমস্যাতে ভারাক্রান্ত, প্রায় সব দিক দিয়েই পিছিয়ে পড়া রাজ্যটিতে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার সেগুলোর থেকে নজর পুরো ঘুরিয়ে রেখে এবারে রাজ্যসরকার নিয়ে এসেছে এই গো সুরক্ষা বিষয়ক বিধি। গোবলয়ের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্ধ অনুকরণে এই বিল নিয়ে আসতে গিয়ে দেখনো হল ব্যাপক উৎসাহ। এর ফলে অসমের আর্থসামাজিক পরিবেশে যা সব নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেগুলোকে বিবেচনাতে রাখা তো দূরেই থাক, উত্তর প্রদেশ সহ যে সব রাজ্যে এমন আইন আনা হয়েছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যেও যে খুব বিরূপ পরিস্থিতি ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে সেই সব কথাকেও গুরুত্ব দেওয়া হল না।

 

প্রোটিন-জাত খাদ্য সামগ্রী উৎপাদনে  রাজ্যটি আজ পর্যন্ত স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে নি। ডিম, মাছ ও মাংসের জন্যে বিরাট পরিমাণের ধন রোজ রাজ্যের বাইরে চলে যায়। অবশ্য সিণ্ডিকেট রাজের দৌলতে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া সেই টাকারই একটি অংশ মাফিয়া ট্যাক্স হিসেবে পুলিশ আমলার উর্ধ্বতম কর্তাদের থেকে শুরু করে শাসক দলীয় নেতা মন্ত্রীর পকেটে পর্যন্তও গিয়ে পৌঁছায় বলে প্রায়ই শোনা যায়। এই বিলের  ফলে রাজ্যের পরনির্ভরশীলতা যে গুণিতক হারে বৃদ্ধি পাবে, সেই সঙ্গে বাড়বে মানুষের পকেটের টাকা অন্য রাজ্যে বহিঃর্গমনের প্রক্রিয়াও, সে কথা নির্দ্বিধাতে বলা যায়।

 

আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগে পর্যন্ত তথাকথিত মূল স্রোতের অসমিয়া গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িতেই ঠাকুর ঘর থাকুক চাই নাই থাকুক গোয়াল ঘর একটা থাকতই। কিন্তু এখন? আজ প্রায় বাড়িতেই গোয়াল ঘর নেই। বলদ দিয়ে হাল বোয়ানো, মাটি চাষ করা ইত্যাদি উঠেই গেছে, তার জায়গা নিয়েছে ঘণ্টা হিসেবে ভাড়াতে নিয়ে আসা ট্র্যাকটর। হালের গরু বা গোয়াল ঘরের দুধেল গাই – বা মাদি বাছুর কৃষক পরিবারের বিপদেরও সম্বল ছিল। সময়ে বিক্রি করেও কিছু নগদ ধন হাতে পাওয়া যেত। আর সেই গরু যদি অচল হয়? গ্রামে গ্রামে বুড়ো, অসুস্থ গরুর সন্ধানে একদল লোক ঘুরে বেড়াতেন। সস্তা দরে কিনে অন্যত্র বিক্রি করাই এদের কাজ ছিল। এদেরকে সেই অচল গরু বিক্রি করাটাই ছিল চিরাচরিত নিয়ম। তাতে করে অহেতুক গরু লালন পালন করার ভার থেকে যেমন মুক্ত হওয়া যেত তেমনি কিছু নগদ টাকা হাতে আসার নিশ্চয়তাটাও ছিল। এই নয়া বিলে মূল স্রোতের অসমিয়া কৃষক এখানেই পড়বেন বিপদে। কৃষিজীবী সমাজের গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই গো-পালন কমে এসেছে। সেই অভ্যাস যে এখন আরও সংকুচিত হয়ে প্রায় বিলীন হবে সে আরও নিশ্চিত।

 

এই বিলের ফলে আইনি জটিলতাতে জড়িয়ে পড়বার ভয়ে সমাজের এক বড় অংশের মানুষ খাদ্য হিসেবে গো মাংস গ্রহণের থেকে বিরত থাকবে ঠিকই, কিন্তু অন্য মাংসের চাহিদা হবে আকাশ ছোঁয়া। মাংস নামের জিনিসটিই, বিশেষ করে রেড মিট নিম্ন আয়ের মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাবে। এর প্রভাব অবশ্যই পড়বে বড় অংশের হিন্দু সমাজের উপরেই। গ্রামঞ্চলে, বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের একক বসতি প্রধান ভেতরের অঞ্চলগুলোতে চোরাগোপ্তা গো মাংসের বাজার হয়তো চলতে থাকবে। কিন্তু মিশ্রিত অঞ্চলে এই সম্প্রদায়গুলোর যে মানুষজন বাস করেন তারা নিশ্চিত এই উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাদ্যের থেকে বঞ্চিত হবেন। অর্থাৎ বিলটি জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ন্যূনতম প্রোটিন যুক্ত আহারটুকুও গ্রহণের অধিকারের উপরেই আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আক্রমণ নামিয়ে নিয়ে এল। এমন কথা লেখাটা অতিশয়োক্তি হবে না।

 

আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে। যে গরুগুলো বুড়ো বা অক্ষম দুর্বল হয়ে যাবে সেগুলোর কী হবে? গৃহস্থ করবেন কী? নিশ্চয় ছেড়ে দেবেন? যেভাবে করেছেন গো-সুরক্ষার আইনি কবচ পরানো উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যের কৃষকেরা! ফলে এই সব ছাড়া গরুর থেকে ফসল রক্ষা করতে আমাদের রাজ্যের কৃষকদেরও রাত জেগে ক্ষেত পাহারা দিতে হবে। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যেও তাই করতে হচ্ছে। ছাড়া গরু ইতিমধ্যেই সেই সব রাজ্যের কৃষকদের এক বড় মাথা ব্যথা। যোগী আদিত্য নাথের আদলে এখানেও নিশ্চয় নিরাশ্রিত গরুর জন্যে গোশালা তৈরি হবে। ইতিমধ্যে সরকার সেরকম ঘোষণাও দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোর জন্যে দরকারি অর্থ আসবে কোত্থেকে? ইতিমধ্যে ভেঙে পড়া অর্থনীতির রাজ্যের বাস্তবতার সঙ্গে কি এই ব্যবস্থা খুব সঙ্গতিপূর্ণ হবে? বিলটি এমন বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক সময় বছরের প্রথম দিনেই গরুবিহুতে ‘লাউ খা, বেগুন খা। বছরে বছরে বেড়ে যা’ বলে যে গরুকে নাওয়ানো ধোয়ানো হত সেই গরু বা গাভীর অস্থি চর্মসার চেহারা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলাই আগামী দিনগুলোর ভাগ্যলিপি। এই কথা বুঝে উঠতে অসমিয়া কৃষকের আর বেশিদিন দিন গুণতে হবে না।

 

মেঘালয়, অরুণাচল, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরামের মতো রাজ্যগুলোতে অসম থেকেই গরু সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে। এই বিল এই প্রক্রিয়াকেও ব্যাহত করবে। এর প্রতিক্রিয়া কী হয়, দেখতে হয়তো সময় লাগবে।

 

গরুকে যে সব ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন পরম্পরাগত খাদ্য হিসেবে গণ্য করে আসছিলেন এই বিল তাঁদের খাদ্যাভ্যাস তথা অধিকারের উপর সংবিধান বহিৰ্ভূত অগণতান্ত্রিক এক আক্রমণ বলে গণ্য করলেও এই মুহূর্তেই তাঁরা এর সরব বিরোধিতার থেকে সচেতন ভাবেই নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। হয়তো কারণটি মনস্তাত্ত্বিক। কিন্তু তাঁদের ভেতরটা যে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকবে সেটি নিশ্চিত।

 

আবার লিখছি, টার্গেটে রয়েছেন সম্প্রদায় বিশেষ। বস্তুত এই বিল সমাজের বড় এক অংশের  মানুষকে ন্যূনতম প্রোটিনটুকুর থেকেও বঞ্চিত করার এক চক্রান্ত। শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের উপরেই এক এক আক্রমণ।

 

এই আক্রমণের আড়ালে গো মাংস রপ্তানির সঙ্গে জড়িত তথা সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ কোনো শক্তিশালী মহলের স্বার্থও জড়িত হয়ে থাকতে পারে, যেটি হয়তো এখনই স্পষ্ট নয়। গো মাংসের এক বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার আছে এবং সে বাজারে গো মাংস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ভারতের স্থান ইতিমধ্যেই শীর্ষে। লাইসেন্স রাজ স্থাপনের ইংগিত সেরকম এক  সম্ভাবনার কথা ভাবার বাস্তৱ ভিত্তি দিয়েই রাখছে।

 

এক কথাতে গো সুরক্ষা বিল অসমের ভঙ্গুর অর্থনীতির শ্মশান যাত্রার পথে একটি বড় পদক্ষেপ বলে লিখলে মনে হয় বাড়িয়ে লেখা হবে না। নিঃসন্দেহে জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষকেই এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। হিন্দুত্ববাদের পাঠ নিয়ে আঞ্চলিক স্বকীয়তা, খাদ্যাভ্যাস,জনতার আর্থিক স্বার্থ ইত্যাদি আর সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দিল্লির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তির নজরে যারা ‘গুড বয়’ হতে চাইছেন তাঁদের প্রকল্পকে বুমেরাং করে আসল পাঠ পড়াবার দায়িত্ব এই জনতাকেই নিতে হবে। অবশ্যই এর সামনের সারিতে থাকবেন গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামীরা। কর্পোরেট স্বার্থে উচ্ছেদ, ফেক এনকাউণ্টার আর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের গহ্বরে এরা অসমকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে। এর থেকে বেরিয়ে আসবার এটিই নির্ণায়ক বাঁক। এর অন্যথা হলে অসমের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন …

 

লেখক গুয়াহাটির বাসিন্দা, সমাজকর্মী ও আইনজীবী।

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: সুশান্ত কর on July 18, 2021

    সংক্ষেপে সুচিন্তিত লেখা।

  • comments
    By: Debabrata Deb on July 18, 2021

    খুবই সুন্দর লেখা। সাবলীল। এরকম আইনের ফলে অন্য রাজ্যের কৃষক, নিম্ন আয়ের গ্রাম্য গৃহস্থের কি কি ক্ষতি হয়েছে তার একটা বর্ণনা দিলে যুক্তি গুলো আরও জোরালো হতো।

Leave a Comment