দানিশের ছবি কাঁদাত আমাদের, রাগিয়ে দিত আর দিত অনেকখানি সাহস। যতবার দানিশের ছবিগুলোর কাছে ফিরে যাব আমরা ততবারই আমরা দেখতে পাব এক দমবন্ধ সময়ের মুখ, যা মানুষকে তাঁর সম্মান, অধিকার, জীবন, জীবিকা সব কিছু থেকেই বঞ্চিত করছে। দেখতে পাব ফ্যাসিজম আর উগ্র মৌলবাদের নানা চেহারা। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
মানুষটির সাদা পোষাকে রক্তের ছোপ, হাঁটু মুড়ে বসে মাথা নীচু করে দুই হাতে মাথা ঢেকে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মারের হাত থেকে বাঁচতে। চার পাশে হিংস্র মানুষেরা লাঠি হাতে ঘিরে ধরে মারছে তাঁকে, চোখ-মুখ, শরীরী ভাষায় তাদের শুধুই ঘৃণা আর একজন নিরস্ত্র, নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলতে চাওয়ার নৃশংস ইচ্ছা। এই ছবিটা আমৃত্যু তাড়া করে ফিরবে আমাদের। আমাদের – আমরা যারা এখনও এই অন্ধকার সময়েও মানুষের বেঁচে থাকার, ঘৃণা ও হিংসাহীন এক পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বপ্ন দেখি। দানিশ দেখতেন হয়তো এই স্বপ্ন। দানিশ সিদ্দিকি – ৪০ বছরের ভারতীয় চিত্র সাংবাদিক, আগফানিস্তানে তালিবান ও আফগান সেনার মধ্যে যুদ্ধের ছবি তোলার ‘অ্যাসাইনমেন্ট’-এ গিয়ে যিনি নিহত হয়েছেন তালিবানি আক্রমণে।
যে ছবিটির কথা দিয়ে শুরু করলাম এই লেখা তা ২০২০ সালে দিল্লিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপরে নির্মম, নৃশংস আক্রমণের সময়ে দানিশের তোলা অনেকগুলি ছবির একটি। এই ছবিটি ফ্যাসিস্ত সরকারের আমলে ভারতের মতো বহুত্ববাদী একটি দেশে মানবতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে কোন পর্যায়ে চলে যেতে পারে তার দলিল হয়ে থাকবে। গত বছর এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই আক্রমণের ছবি তুলে কার্যত ঘটনাক্রমের ‘ডকুমেন্টেশন’ করে রাখার জন্য হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে দানিশকে এমনকি কিছু সময়ের জন্য গোপন ঠিকানাতেও থাকতে হয়েছে। কিন্তু দানিশ সিদ্দিকি – চিত্রসাংবাদিক – এক অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন যেন। ছবি তোলা তাঁর কাছে শুধু পেশা ছিল না, সাংবাদিকতার পেশা ছিল তাঁর কাছে এক দায়বদ্ধতা।
দানিশ সিদ্দিকিকে আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে প্রয়োজন ছিল। শুধু তাঁর অসময়ের মৃত্য আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে তাই নয়, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের ‘অ্যাসাইনমেন্ট’-এ প্রাণ দিয়েছেন বলে আমরা তাঁকে কুর্নিশ জানাচ্ছি বলেই নয় – তিনি এই অসহনীয় উগ্র হিংস্র সময়ের দলিল ফ্রেমবন্দী করতেন বলে। তাঁর না থাকায় নিরপেক্ষ চিত্র সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে শূণ্যতা তৈরি হল তা ভরাট করা সহজ হবে না। এই তরুণ সাংবাদিককে আদর্শ করে অনেকেই সাংবাদিকতাকে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছেন। তবে তাঁর মতো পেশা, প্যাশন, সাংবাদিক বিশ্লেষণ, অ্যাড্রিনালিন রাশ আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একসঙ্গে অনুভব করে কাজে নিয়ে আসা খুব সহজ নয়। এ শুধু চর্চার বিষয় নয়, এ এক অন্য উপলব্ধি। সংবাদ পরিবেশনকে টিআরপি-এর খেলায় মাপতে শুরু করলে অথবা প্রোপাগ্যান্ডা সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে দানিশ সিদ্দিকি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। দানিশের ছবি আমাদের ভাবাত, দানিশের ছবি আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত, দানিশের ছবি আমাদের সত্যি আর মিথ্যেটা চিনে নিতে শেখাত, দানিশের ছবি আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কোন্ দিকে হওয়া প্রয়োজন তা বুঝতে সাহায্য করত, দানিশের ছবি আমাদের সহ-নাগরিকদের প্রতি মানবিক হতে শেখাত। দানিশের ছবি কাঁদাত আমাদের, রাগিয়ে দিত আর দিত অনেকখানি সাহস। যতবার দানিশের ছবিগুলোর কাছে ফিরে যাব আমরা ততবারই আমরা দেখতে পাব এক দমবন্ধ সময়ের মুখ, যা মানুষকে তাঁর সম্মান, অধিকার, জীবন, জীবিকা সব কিছু থেকেই বঞ্চিত করছে। দেখতে পাব ফ্যাসিজম আর উগ্র মৌলবাদের নানা চেহারা।
দানিশ আমাদের চোখ হয়ে উঠেছিলেন। না কি আমরা ওঁর চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম সত্যিগুলো, বাস্তবটা, ছুঁতে পারছিলাম সেই মানুষগুলোকে যাঁদের সরকার, প্রশাসন, মৌলবাদ, উগ্রপন্থা সবকিছু মিলে অদৃশ্য করে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। দানিশ বিশ্বাস করতেন একজন সাংবাদিক হিসাবে, একজন চিত্রসাংবাদিক হিসাবে ভয়ের উর্দ্ধে উঠতে হবে, যাতে বাস্তব তা যতই রূঢ় হোক না কেন, তা শাসককে যতই অস্বস্তিতে ফেলুক না কেন, তা তুলে আনতে হবে। শাসকের চোখ রাঙানি আর পুঁজিপতিদের লগ্নিতে ফুলেফেঁপে ওঠা মিডিয়াতে দানিশ তাই ব্যতিক্রম হয়ে রয়ে যান। তিনি ছবি তুলেছেন – ঘটনার, মানুষের, মুহূর্তের, এমনকি নৈঃশব্দের। তিনি একইসঙ্গে প্রবল হিংসা আর অন্যদিকে শীতল নিষ্ঠুরতার ছবি তুলতে পেরেছিলেন। তার কারণ বোধহয় তিনি ছুঁতে চেয়েছিলেন মানুষকে, মানুষের অস্তিত্বকে, তাদের অবস্থানকে। তাই বাংলাদেশের মাটি ছোঁয়া রোহিঙ্গা মহিলার নতশীর ছবিটা আমাদের লজ্জিত করে। ঘর হারানোর মানুষের বিপন্নতা আমাদের নিশ্চিন্ত যাপনের ভিত নড়িয়ে দেয়। সেইজন্যই অপদার্থ কেন্দ্র সরকার বিনা নোটিশে লকডাউন ঘোষণার পর অগুন্তি পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়ি ফেরার ছবির মাঝে এক শ্রমিক বাবার কাঁধে সন্তান নিয়ে পথ হাঁটার ছবিতে সেই মানুষটির চোখের দৃষ্টি আমাদের বহু দিন-রাত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। আমাদের ঘুম কেড়ে নেবে কোভিডে মৃত মানুষদের চিতা জ্বলার ছবি। সমস্ত হল্লা থামিয়ে দেবে শ্রীলঙ্কায় বিস্ফোরণে মৃতদের রয়ে যাওয়া বাড়িগুলির শান্ত অন্তরমহলের ছবি। আমাদের রাগিয়ে দেবে কাশ্মীরের নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার ছবি। এভাবেই দানিশের ছবি আমাদের চেনা জীবন, সুরক্ষিত অবস্থানকে টলিয়ে দিয়ে যাবে। আমাদের ভাবাবে, আমাদের বাধ্য করবে রাস্তা চিনে নিতে। যা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড় করাবে আমাদের, প্রশ্ন করতে সাহস যোগাবে আমাদের।
যে ছবিটির কথা বলে শুরু করেছিলাম, সেই ছবিটি ফেসবুক-এ শেয়ার করতে চাইলে ‘সেনসিটিভ কনটেন্ট’ বলে ‘হাইড’ হয়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে, ক্লিক করে খুলতে হচ্ছে। অনেকেই হয়তো না দেখে চলে যাচ্ছেন। অথচ দানিশেরই তোলা অপর একটি ছবি – দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএএ বিরোধী শান্তিপূর্ণ মিছিলে পিস্তল হাতে এক বিজেপি সমর্থক, উগ্র হিন্দুত্ববাদী তরুণের ছবি ‘সেনসিটিভ কনটেন্ট’ হিসাবে ‘হাইড’ হয়ে যাচ্ছে না। এই ‘হিপোক্রিসি’, ভন্ডামির মুখোশই তো বারেবারে খুলে দিয়েছেন দানিশ। একজন সংখ্যালঘু মানুষের বিপন্নতা লুকিয়ে রাখতে হয় আর একজন ‘ভক্ত’-এর গুন্ডামি দেখা যায় জনসমক্ষে। দানিশ এই দুটো ছবিই তুলে ফেলতে পারতেন, শুধু ছবির মধ্যে দিয়ে সময়, পরিস্থিতি, রাজনীতি তুলে আনতে পারতেন তিনি তাই নয়, তিনি বুঝিয়ে দিতে পারতেন এই সময়ের পৃথিবীতে মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখাটা কত জরুরি। পুরস্কারজয়ী চিত্রসাংবাদিক ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও পুরস্কারেই বোধহয় ধরা সম্ভব নয় তাঁর হৃদয়ের সেই গভীর বেদনাবোধ, সেই একবগ্গা জেদ, সেই আশ্চর্য সাহস যা তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াত দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত, পৃথিবীর নানা উপদ্রুত অঞ্চলে। তিনি কি জানতেন না যে, যে কোনও সময়ে তিনি ‘টার্গেট’ হয়ে যেতে পারেন, মরে যেতে পারেন? নিশ্চিতভাবেই জানতেন। তবু তিনি ভয় পাননি, তবু তিনি ক্যামেরাকে ব্যবহার করেননি প্রশাসনের স্তুতি করার জন্য। তাঁর ক্যামেরা আমৃত্যু সত্যি দেখেছে, সত্যিকারের ছবি তুলেছে।
দানিশ সিদ্দিকির মৃত্যু আরও একটি বিষয়ের দিকে আমাদের নজর ঘুরিয়ে দিল। যুদ্ধক্ষেত্রে বা উপদ্রুত এলাকায় কাজ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি। অনেক সময়েই প্রশাসন, যে মিডিয়ার হয়ে সাংবাদিক যাচ্ছেন, তাঁরা এই নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করে ফেলেন, যেন তা একান্তই সাংবাদিকের নিজস্ব বিষয়। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই এই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক নির্দিষ্ট নিয়মাবলী দ্রুত চালু হওয়া প্রয়োজন।
এ দেশে নির্লজ্জ বিজেপি-আরএসএস সমর্থক, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী দানিশের মৃত্যুতে আনন্দ ও উচ্ছাস প্রকাশ করছে। তারা এই ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছে যে, তাদের অপকর্ম, তাদের হিংস্রতার ছবি তোলার জন্য আর কেউ রইলেন না। তারা ভুলে যাচ্ছে দানিশ মারা গেছেন, তাঁর ছবিগুলি রয়ে গেছে সাক্ষী হয়ে। দানিশ মারা গেছেন, কিন্তুতাঁর আদর্শে তৈরি হয়ে গেছেন আরও কিছু সাংবাদিক, যাঁদের ক্যামেরা, যাঁদের কলম চুপ থাকবে না, দানিশেরই মতো বাস্তব চিত্রই তুলে আনবেন তাঁরা। এ দেশের বহু মানুষ হয়তো ব্যক্তি দানিশকে চেনেন না, কিন্তু তাঁর তোলা ছবিগুলি দেখিয়ে দিয়ে গেছে মানুষের অধিকারের জন্য লড়াইতে জোটবদ্ধ হওয়ার সময় এখন। সেই ছবিগুলো নষ্ট হবে না, ওগুলো মাথায় গেঁথে গেছে। দানিশ সিদ্দিকি মরে গিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন – অন্ধকার সময়েও গান তৈরি হবে, অন্ধকার সময়ের গান তৈরি হবে।
Exceelent post, intend to see the photographs shooted by Danish Siddiqi 🙏