আদালত বলেছে যে রাজ্য সরকারগুলো যেন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণ করে, যা এতদিন করাই হয়ে ওঠে নি, তাঁরা কিন্তু আধার সংযোগের কথা বলেনি, কেন্দ্রীয় সরকার আদালতকে বলেছে যে আধার সংযোগ না করার ফলেই ‘এক দেশ এক রেশন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। আদালত তাই নির্দেশ দিয়েছে, যে যদি সেটাই একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাই করা হোক। কিন্তু এই সংযোগের ফলে যে বহু মানুষ রেশনের সুবিধা থেকে বাদ পড়তে পারেন, তার আভাস কিন্তু সরকার আদালতকে দেয়নি। তাঁরা শুধু বলেছে যে বাংলা সহ কয়েকটি রাজ্য এই বিষয়ে পিছিয়ে আছে বলে সমস্যা হচ্ছে। লিখেছেন সুমন সেনগুপ্ত।
রোজ নতুন নতুন কথা, রোজ নতুন নতুন ব্যস্ততা। রোজ নতুন নতুন আলোচনা। ২০১৪ সাল থেকে ভারতবাসীকে নিত্যনতুন পরিকল্পনার ফাঁদে ব্যতিব্যস্ত রাখাটাই যেন এই নরেন্দ্র মোদী সরকারের অন্যতম কাজ। কখনও ব্যাঙ্কে লাইনে দাঁড়িয়ে পুরনো টাকা বদলানো, কখনও মোবাইল সংযোগ নেওয়া বা ব্যাঙ্কের কাগজপত্রের সঙ্গে আধার যুক্ত করার জন্য লাইনে তো কখনও নিজেকে ডিজিটাল গ্রাহক বানিয়ে তোলার প্রক্রিয়াতে সামিল করা। শেষতম প্রক্রিয়ার পোষাকি নাম ‘এক দেশ এক রেশন’।
গতবছর যখন প্রথম কোভিড ঝড় সামলানোর পন্থা হিসেবে লকডাউন ঘোষণা করা হল, মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে, সারা ভারত দেখল কীভাবে পরিযায়ী শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন এবং রাস্তায় মারা যাচ্ছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রশ্ন তুলল, কেন এই শ্রমিকেরা যে রাজ্যে কাজ করতে যান, সেই রাজ্যে থাকতে পারেন না, এই রকম অতিমারীর সময়ে? কেন সেই রাজ্যেই এই রকম অতিমারীর সময়ে তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা যায় না? অথচ সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য পড়ে পড়ে নষ্ট হবে তা তো মেনে নেওয়া যায় না। ২০১৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা আইন লাগু হওয়া সত্ত্বেও কেন এই অব্যবস্থা? অনাহারে, মৃত্যুর আশঙ্কায় কর্মহীন মানুষ তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরছেন এবং পথে বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন এই দৃশ্যের পরিবর্তে কি একটু মানবিক কোনও পদ্ধতি নেওয়া সম্ভব নয়, যাতে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিক অন্তত দু-মুঠো খাবার পান! তখন কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের যে গণবণ্টন ব্যবস্থা আছে সেটিকেই আরও একটু সম্প্রসারণ করার প্রস্তাব দিলেন। সরকার বলল, যদি সারা দেশে একটি রেশন ব্যবস্থা চালু করা যায়, এবং প্রত্যেকটি মানুষ তাঁদের আধার নম্বরকে তাঁদের রেশন কার্ডের সঙ্গে সংযোগ করে ফেলেন, তাহলে প্রক্রিয়াটিকে অনায়াসে ‘এক দেশ এক রেশন’ কার্ড বলা যায়। যেহেতু সরকারের যুক্তি অনুযায়ী আধার নম্বর সারা দেশে প্রযোজ্য একটি অভিনব সংখ্যা এবং কোনও ব্যক্তি ছ’মাস কোনও এক স্থানে বাস করলে তিনি সেখানকার বসবাসকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পারবেন, সেহেতু সেই ব্যক্তি যদি তাঁর আধারে বাসস্থানের পরিবর্তন করিয়ে নেন, তাহলে সমস্যার কিঞ্চিৎ কিছু সমাধান হয়।
বেশিরভাগ গণমাধ্যম সম্পাদকীয় লিখে, এই ব্যবস্থাকে দু-হাত তুলে স্বাগত জানাল এবং বলল যে এবার হয়তো আর ওই শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল হাঁটার দৃশ্য দেখতে হবে না। এবার হয়তো সবাই দুবেলা পেট পুরে খাবারটুকু অন্তত পাবেন। কিন্তু দেখা গেল হচ্ছে ঠিক বিপরীত। যাঁরা কিছুদিন আগে অবধি রেশন পাচ্ছিলেন, এই আধার সংযোগ করার চক্করে, উল্টে তাঁদের নামই বাদ যেতে শুরু করেছে। রোজ খবর আসছে। কখনো ঝাড়গ্রাম থেকে, কখনো বাঁকুড়া থেকে, তো কখনো আবার বনগাঁ সীমান্ত থেকে। রোজ কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও মানুষ রেশন পাচ্ছেন না। আগে এই খবর আসতো বাংলার বাইরে থেকে, এখন এই খবর বাংলার ভেতরের কোনও না কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছে। ছোট ছোট বৈদ্যুতিন মাধ্যমের এই খবর হয়তো এখনো সেই অর্থে ‘ভাইরাল’ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু অচিরেই যে এই খবর কাগজের প্রথম পাতায় স্থান করবে তা সহজেই বলে দেওয়া যায়।
ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ‘দুয়ারে রেশন’। ক্ষমতায় আসার পরেই দেখা গেল নতুন সরকার রেশন কার্ডের সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার কাজকে প্রাধান্য দিতে শুরু করল। অর্থাৎ ‘এক দেশ এক রেশন’ কার্ডের যে কেন্দ্রীয় প্রকল্প আছে তাতে অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এই বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চাপ ছিল যেহেতু এই মুহুর্তে দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকেরা তাই তাঁদের কাছে সরকারি সুবিধা অর্থাৎ বিনামূল্যে রেশন পৌঁছে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। তাই স্থায়ী বাসস্থান না থাকলে যাতে কোনও মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হন তার জন্য এই ব্যবস্থা সমস্ত রাজ্য সরকারকে নিতে হবে।
এই বক্তব্যে সেই অর্থে কোনও ভুল নেই, কিন্তু আবারও সেই প্রাথমিক প্রশ্নে ফেরা জরুরি। আধার কি বাসস্থানের শংসাপত্র? আধার কি জন্মের শংসাপত্র? আরটিআই-তে কিন্তু এই দুটি প্রশ্নেরই উত্তরেই বলা হয়েছে, না। তাহলে কেন আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডের সংযোগ করানোর জন্য এই চাপাচাপি? আসলে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশনের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোকে করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, তা কিন্তু বলে দেয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারই কিন্তু এই এক দেশ এক রেশন প্রকল্পের সঙ্গে আধার যুক্ত করার প্রস্তাবটি দিয়েছে। আদালত কিন্তু বলেছে যে রাজ্য সরকারগুলো যেন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণ করে, যা এতদিন করাই হয়ে ওঠে নি, তাঁরা কিন্তু এই আধার সংযোগের কথা বলেনি, কেন্দ্রীয় সরকার আদালতকে বলেছে যে এই সংযোগ না করার ফলেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। আদালত তাই নির্দেশ দিয়েছে, যে যদি সেটাই একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাই করা হোক। কিন্তু এই সংযোগের ফলে যে বহু মানুষ বাদ পড়তে পারেন, তার আভাস কিন্তু সরকার আদালতকে দেয়নি। তাঁরা শুধু বলেছে যে বাংলা সহ কয়েকটি রাজ্য এই বিষয়ে পিছিয়ে আছে বলে সমস্যা হচ্ছে।
এই আদেশের পর সব রাজ্যেই এই আধার সংযোগের কাজ শুরু হয়ে গেছে। হওয়ার কথা ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণের কাজ, চালু হয়েছে আধার সংযোগের কাজ। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে আধারের এবং রেশন কার্ড সংযোগ করার পরেও রেশন না মেলার অভিযোগ আসছে। বিভিন্ন সময়ে কাজের ধরন, বয়সের কারণ বা অন্যান্য অনেক কারণে মানুষের আঙুলের ছাপ মেলে না, তাহলে কি সেই মানুষটির অস্তিত্ব থাকে না? রাজ্য সরকার দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে রেশন কার্ডের সঙ্গে আধারের সংযোগ করাচ্ছেন, কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? যেখানে আধারের তথ্য ভান্ডার কোনোদিন পরীক্ষিত হয়নি, কত ভুয়ো আধার আছে তা জানা নেই, দেশের নানান প্রান্তে বহু সময়ে বহু সন্ত্রাসবাদীও ধরা পড়েছেন যাঁদের কাছে ভুয়ো আধার পাওয়া গেছে, সেখানে আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডের সংযোগ তো দুর্নীতি নয় অপরাধও।আধার শুধু বাদ দেওয়ার উপকরণ নয় একটি বড় দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাও বটে।একজন মানুষের পরিচয় যখন একটি সংখ্যায় পর্যবসিত হয় তখন সেই মানুষটির কি অস্তিত্ব বিপন্ন হয়?
২০১৩ সালে যে খাদ্য নিরাপত্তা আইন লাগু হয় তাতে বলা হয় যে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে রেশন কার্ড দিতে হবে। ২০১১ জনগণনার নিরিখে কাজ শুরু হয়েছিল আর এই মুহুর্তে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় ৮০ কোটি মানুষের কাছে রেশন পৌঁছনোর জন্য যা করার তাই করতে হবে। খাদ্য সুরক্ষা আইনে বলে একজন মানুষ পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য পেতে পারেন অথবা পরিবার পিছু ৩৫ কেজি মাসিক খাদ্যশস্য পাবেন অন্তোদ্যয় যোজনায়। প্রতিটি অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট রেশন দোকান থেকে ওই মানুষেরা তাঁদের জন্য বরাদ্দ খাদ্য সংগ্রহ করতেন এতদিন। তাহলে ‘এক দেশ এক রেশন’ নতুন কি করবে? যা বোঝা যাচ্ছে তা হল, এই প্রকল্পের ফলে একজন বিহারের মানুষ যদি বাংলায় বা কেরালায় কাজ করতেও যান, তাহলে তিনি সেই রাজ্যে যেখানে থাকবেন সেখানকার কোনও রেশন দোকান থেকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে পারবেন।
শুনতে আকর্ষণীয় মনে হলেও বেশ কিছু প্রশ্ন এসেই যায়। প্রথমত, সরকারের কাছে কি এই তথ্য আছে যে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক এই সরকারি খাদ্যবণ্টন ব্যবস্থা থেকে আগে থেকেই খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতেন? কিংবা কতোজনের আদৌ রেশন কার্ড আছে? আত্মনির্ভর ভারতের যে ঘোষণা করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাতে বলা হয়েছে যে আট কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গণবণ্টন ব্যবস্থার মধ্যে, তার মানে বোঝা যায় যে অন্তত ন্যূনতম এই সংখ্যার মানুষের কোনও রেশন কার্ড ছিল না।
দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যান, বেশির ভাগ সময়েই পরিবারকে গ্রামে রেখেই যান যাতে পরিবারের মানুষেরা রেশন দোকান থেকে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে সংসার চালাতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বেশির ভাগ রাজ্যেই যেহেতু পরিবার পিছু একটি করে কার্ড তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এটা সবসময়েই সত্যি যে তাঁরা শহরে কাজে গেলেও তাঁদের পরিবারের কার্ডটি বাড়িতে থাকে। তাহলে যদি কোনও ব্যক্তি তর্কের খাতিরে ধরা যাক রেশন কার্ডটি নিয়ে গেলেন এবং শহর থেকে রেশন তুললেন, তাঁর পরিবার কীভাবে পাবে সেই খাদ্যশস্য? যদি আমাদের রাজ্যের মতো প্রত্যেকটি মানুষের জন্যে আলাদা কার্ডও থাকে তাহলেও শহরে এবং গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে রেশন নিতে গেলে যদি মানুষেরা অসুবিধার সম্মুখীন হন, সেই অসুবিধা সামলানো যাবে কী করে? কোনও একজনকে যদি বলা হয় যে তাঁর প্রাপ্য রেশন তোলা হয়ে গেছে, তিনি কী করে প্রমাণ করবেন যে তোলা হয়নি? গ্রামের মহিলারা কি এতোটা প্রযুক্তি বান্ধব হয়ে উঠেছেন, কিংবা এতোটা সোচ্চার হতে পারবেন যদি তাঁর চোখের সামনে দুর্নীতি হয়েও যায়, যদি বলা হয় যে শহরে তাঁর পরিবারের প্রাপ্য রেশন তোলা হয়ে গেছে, তাহলে তিনি কীভাবে তার প্রতিবাদ করবেন?
তৃতীয়ত বেশ কিছু রাজ্য কেন্দ্রের যে খাদ্যশস্য দেওয়ার প্রকল্প চলছে তার বাইরে গিয়ে আরও বেশ কিছু জিনিষ দিয়ে থাকে। তামিলনাডু, ছত্তিশগড় এবং হিমাচল প্রদেশ ডাল এবং ভোজ্য তেলও সরবরাহ করে ভর্তুকি দিয়ে। যেখানে কেন্দ্র শুধু চাল এবং গম দেয়, সেখানে রাজ্য সরকারের তরফে এই তেল এবং ডাল দেওয়ার ফলে মানুষ উপকৃতই হচ্ছেন। কেন্দ্র যেমন চালের জন্য পয়সা নিয়ে থাকে, কোনও কোনও রাজ্য বিনামুল্যে চাল দিয়ে থাকে। তাহলে একজন বাঙালি শ্রমিক যদি তামিলনাডুতে কাজ করতে যান, তাহলে তিনি বিনামূল্যে চাল পাবেন, এবং ভর্তুকিতে তেল এবং ডাল ও পাবেন। নাকি তাঁকে বলা হবে যে তিনি এইগুলো পাওয়ার যোগ্য নন, যেহেতু বাংলায় এই খাদ্যদ্রব্য তাঁর পাওয়ার কথা নয়? এর সঙ্গে খাদ্যাভাসের বিষয়টিও আছে, একজন মানুষের যদি শুধু ভাত খাওয়ার অভ্যেস থাকে, তিনি যদি রাজস্থানে বা পাঞ্জাবে যান তাহলে কি তাঁকে রুটি খেয়ে থাকতে হবে, যেখানে গণবণ্টন ব্যবস্থা দিয়ে শুধু গমই সরবরাহ করা হয়? সমস্ত খাদ্যাভাসকে এক করে দেওয়াও অগণতান্ত্রিকতাও বটে। আপনি কী খাবেন বা খাবেন না সেটাও তো রাষ্ট্রের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এই অসুবিধাতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যা হবে তা নয়, রসদ সংক্রান্ত সমস্যাও তৈরি হবে। আগে কী হতো কোনও একটি অঞ্চলের রেশন দোকানে নির্দিষ্ট পরিমাণের খাদ্য দ্রব্য ফুড কর্পোরেশন বা কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে আসতো, কিন্তু ‘এক দেশ এক রেশন’ এর সঙ্গে যদি গণবণ্টন ব্যবস্থাকে জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কত মানুষের জন্য খাদ্যদ্রব্য আনতে হবে তা হিসেব করাও মুশকিলের হবে। ধরা যাক বিহার থেকে ২০ জন শ্রমিক বাংলার একটি জেলায় কাজ করতে এসেছেন এক মাসে, পরের মাসে সংখ্যা বাড়তে পারে কমতেও পারে, তাহলে কোনও একটি রেশন দোকানে খাদ্যশস্য সরবরাহ হবে কোন হিসেবের ওপর দাঁড়িয়ে? তার ফলে অঞ্চলে যারা স্থায়ী বাসিন্দা তাঁরা ঠিকঠাক পরিমাপ মতো খাদ্যশস্য পাবেন তো?
‘এক দেশ এক রেশন’ হয়তো সম্ভব কিন্তু তার জন্য যা যা প্রযুক্তিগত অদলবদল করতে হবে তা কি এই মুহুর্তে করা সম্ভব? এর সঙ্গে যদি আধারকে যুক্ত করানো হয়, তাহলে কি সমস্যা বাড়বে না কমবে? গত লকডাউনের সময়ে বেশ কিছু রাজ্য এই আধার দিয়ে যাচাই বা বায়োমেট্রিক্স দিয়ে মানুষ চেনার পদ্ধতি সাময়িক ভাবে বাতিল করেছে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন তো ক্ষমতায় আসার পরেপরেই এই প্রক্রিয়াতে মানুষ বাদ পড়ছেন বলে বাতিল করেছেন। যখন উচিত ছিল বিভিন্ন রাজ্যে আরো বেশি বেশি যৌথ সরকারি রান্নাঘরের, যখন প্রয়োজন ছিল শহরে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের জন্য শুকনো খাবারের প্যাকেটের বা রেশন ব্যবস্থাকে আরও সর্বাঙ্গীন করে তোলার তখন আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডকে সংযোগ করলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। বেশ কিছু রাজ্য কিন্তু সবার জন্য রেশন ব্যবস্থা চালু করে ফেলেছে , যারা ইচ্ছুক তাঁরা যাতে সরকারি ব্যবস্থা থেকে খাদ্যদ্রব্য নিতে পারেন, কিন্তু তাতে আধার সংযোগ বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এই করোনা পরিস্থিতিতে একটি পিওএস মেশিন অর্থাৎ পয়েন্ট অফ সেল মেশিনে সমস্ত মানুষজনকে আঙুলের ছাপ মেলানো সেটাও কি খুব সমীচীন হচ্ছে?
লেখাটি শেষ করা যাক একটি আন্তর্জাতিক এবং একটি জাতীয় উদাহরণ দিয়ে। আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ উগান্ডার কোটি কোটি মানুষ সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কারণ তাঁদের অনেকেরই ডিজিটাল পরিচয়পত্র নেই। উগান্ডা সরকারের আইন অনুযায়ী এই ডিজিটাল পরিচয়পত্র জাতীয় সুরক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, কিন্তু সেই ব্যবস্থাকে যখন সরকারি পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে বহু মানুষ বাদ পড়ছেন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা, মোবাইলের সিম নেওয়া, পাসপোর্ট তৈরি করা বা চাকরি পাওয়া প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই এই ডিজিটাল পরিচয়পত্রকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সমস্ত কিছু চেনার চেষ্টা হচ্ছে , ফলত যা হবার তাই হচ্ছে, অসংখ্য মানুষ বাদ যাচ্ছেন। কোভিডের প্রতিষেধক পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই পরিচয়পত্রটিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, কিন্তু তারপরে বেশ কিছু সংগঠন মামলা করার ফলে সেই প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে।
এরপর আসা যাক আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের একটি উদাহরণে। কয়েকবছর আগেই বহু সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছিল একটি খবর। ১১ বছরের সন্তোষী ‘ভাত ভাত’ করতে করতে মারা যায়। তার পরিবারের রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার যুক্ত না থাকার ফলে সরকারি রেশন না পেয়ে খিদের জ্বালায় মারা যায় কিশোরীটি। যদিও তৎকালীন সরকারের তরফে এই মৃত্যু আধারের কারণে বঞ্চনার জন্য তা মেনে নেওয়া হয়নি, কিন্তু এটা স্বীকার করা হয়েছিল অপুষ্টিজনিত অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়। যে কয়েকটি রাজ্য এই রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছিল তাঁদের মধ্যে ঝাড়খণ্ড অন্যতম। অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ এই বিষয়ে বিশদে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন যে শুধুমাত্র এই বায়োমেট্রিক দিয়ে বা আধার দিয়ে চিনতে গিয়ে বহু মানুষ রেশন পাচ্ছেন না। শুধু ঝাড়খণ্ডেই বহু মানুষ রেশন না পেয়ে মারা গেছেন এরকম অজস্র উদাহরণ আছে।
সুতরাং পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবন্ধীকরণের যে রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে তার পরিবর্তে আসল উপভোক্তাদের বাদ দেওয়ার কাজটি সুচতুরভাবে এই কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারই করবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? যখন আমরা জানি, যে আধার এনপিআরের প্রথম ধাপ এবং সেখান থেকেই এনআরসি তৈরি হবে, তখন আধারের সঙ্গে রেশন কার্ড যুক্ত করার প্রক্রিয়া কি ঘুরপথে এনআরসি করার দিকে আরও একটি পদক্ষেপ নয়? এটাও ভাবার কি সময় হয়নি?
বহু মানুষ এই মুহুর্তে ভাবছেন কি করে আবার নতুন করে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, কি করে বামপন্থীরা আবার ‘শূন্য’ থেকে ফিরে আসবেন, তা নিয়ে পাতার পর পাতা গবেষণা চলছে। সকলেই অন্তত একটা বিষয়ে একমত হচ্ছেন, যে রাস্তায় নেমেই এই রাস্তার খোঁজ করতে হবে, অথচ চোখের সামনে যে এমন পরিষ্কার একটা রাস্তা আছে, তা কিন্তু অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। যদি খোঁজ নেওয়া যায়, এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মানুষ চিনে রেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের কিংবা দেশের যেকোনো রেশন দোকানে রোজ কোনও না কোনও মানুষ অসুবিধায় পড়ছেন, সামাল দিতে হয়তো এককালীন নম্বর বা চোখের মণি দিয়ে চেনার পদ্ধতিও কোথাও কোথাও হচ্ছে, কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে কি? যে বামপন্থীরা রাস্তা খুঁজছেন কীভাবে মানুষের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা যায়, তাঁরা কি চোখের সামনে পড়ে থাকা সংগঠন তৈরি করার এই সুযোগটি দেখতে পাচ্ছেন না? আন্দোলন সংগঠিত করার এর চেয়ে ভালো সুযোগ কি আর আসবে? ‘জাতের লড়াই নয় ভাতের লড়াই চাই’ বা ‘ধর্ম দিয়ে পেট ভরে কি’ এই জাতীয় শ্লোগানে যে বামপন্থীরা ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ ভরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা কি এই লড়াই করতে দ্বিধা করছেন? কিন্তু কেন? অথচ এই ‘ভাতের লড়াই’-ই যে বামপন্থীদের আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলবে তা বুঝতে গেলে কিন্তু বিরাট করে মার্ক্স পড়ে ফেলতে হবে, তা নয়।
লেখক একজন প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।