ভীমা কোরেগাঁও মামলা, ১৬ নাগরিকের বন্দিত্ব এবং তাঁদের অন্যতম স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু প্রমাণ করে যে, ন্যায়বিচারের আশ্রয় আমরা হারিয়েছি। এবং এই দেশের বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অন্য তিন স্তম্ভের মতোই ন্যায়ধর্মহীন, নিষ্ঠুর, সমানুভূতি বর্জিত ও কাণ্ডজ্ঞানহীন। মাঝেমধ্যে যে আলোকবর্তিকার হদিশ মেলে তা নিছকই ব্যতিক্রম। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
এই অপরাধ ক্ষমাহীন। যদি অভিযোগ ওঠে আদিবাসী-প্রাণ মানবাধিকার কর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু আসলে এক ঠান্ডা মাথার খুন — তবে অভিযোগকারীদের অতিশয়োক্তির দোষে দোষী বলা যাবে না। যখন যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ হাজির করে বলা যায় যে, গুরুতর অসুস্থ এক অশীতিপর বৃদ্ধকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এবং তা বিচারব্যবস্থার গণ্ডির মধ্যেই। যে মানুষটির দীর্ঘ আন্দোলন-জীবনই ছিল ‘সবার পিছে, সবার নীচে, সব হারাদের’ বৃত্তে ঘেরা, আইন ভঙ্গকারী রাষ্ট্র এবং তাদের সাঙ্গাৎ পুঁজিপতিদের তাবড় বেআইনের বিরুদ্ধে আইনি ও সাংবিধানিক পথে। তাঁকে বন্দি করা হল এক চরম বেআইনের আইনি ফাঁদে। যে মানুষটি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের বিস্থাপনের বিরুদ্ধে, জল-জঙ্গল-জমির আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার বুঝে নিতে তাত্ত্বিক ও আইনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে চলেছিলেন, রাঁচি শহরের অদূরে বাগাইচা জেসুইট ক্যাম্পাসে গড়ে তুলেছিলেন এক প্রশিক্ষণ শিবির, গড়ে তুলেছেন প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে, আদিবাসী অধিকার থেকে উচ্ছেদ হওয়া এবং বিনাবিচারে জেলবন্দি আদিবাসীদের জন্য গবেষণা কেন্দ্র, পথে নেমে নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলনের — তিনি যে রাষ্ট্রশক্তির চক্ষুশূল হবেন সে নতুন কোনও কথা নয়। কথা এই যে, বিচারবিভাগীয় হেফাজতে তাঁকে মরতে হল কেন?
মহারাষ্ট্রের যে পুণে শহরে কখনও যাননি স্ট্যান স্বামী, যে ভীমা কোরেগাঁও আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সুদূর কোনও সম্পর্ক ছিল না, মাওবাদীদের সঙ্গে তো নয়ই — সেই স্ট্যানকে জোড়া হল এই সবেরই সঙ্গে। আসলে সাঙ্গাৎ পুঁজিপতিদের ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে বিস্থাপন আন্দোলন হয়ে উঠেছিল এক প্রবল প্রতিস্পর্ধা। এবং সেই পথেই পাথালগড়ি আন্দোলন। রাষ্ট্রের কাছে বড় জরুরি ছিল তাঁকে জেলে পোরার।
না, এ কোনও আদালতের বিচার্য বিষয় নয় যে একজন ব্যক্তিকে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা যখন গ্রেপ্তার করে এবং নিষ্ঠুরতম ইউএপিএ ধারায় — তার পেছনে রাষ্ট্র, জমি লুটেরা কর্পোরেটের নিগূঢ় অভিপ্রায়টি কী তা খুঁজে দেখার। কিন্তু, আদালত কি এতটাই বোধশূন্য যে, এ জাতীয় আইন দেশের সংবিধান, ন্যায়বিচার, ন্যায়ধর্ম নির্ভর বিচার এবং সর্বোপরি জীবনের অধিকারের চূড়ান্ত বিরোধী — সে বিষয়ে অবহিতই না? এমন শত শত উদাহরণ উচ্চ ও শীর্ষ আদালতের হেফাজতে তো রয়েছেই। তবে কেন, আদালত এমন প্রতিটি ক্ষেত্রে, ভীমা কোরেগাঁও মামলার প্রতিজনের ক্ষেত্রে প্রতিটি অভিযোগ তলিয়ে দেখবে না? আইনের শুকনো, মরা নথিই আর পুলিশি নির্জলা মিথ্যাই গ্রাহ্য হবে?
আদালত তো জানত, অতিমারি পরিস্থিতির মধ্যে দুরারোগ্য পারকিনসন রোগে আক্রান্ত এক অশীতিপর বৃদ্ধকে ‘টেররিস্ট’ অভিযোগে জেলবন্দি করা হয়েছে। আদালত তো জানত, স্নায়ুরোগে জর্জরিত এই বন্দি নিজের হাতে খেতে পারেন না তাঁর স্ট্র ও সিপার প্রয়োজন হয়, যা এনআইএ-র আধিকারিকরা তাঁকে রাঁচি থেকে গ্রেপ্তারের সময় নিয়ে আসতে দেয়নি এবং তালোজা জেল কর্তৃপক্ষ তা জেনেবুঝে সরবরাহ করেনি। কীভাবে জানত? জানত যখন আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল এই অশীতিপর মানুষটিকে। আদালতের উচিত ছিল না, এ কথা বলা একজন মাওবাদী হলেও তাঁর জীবনের অধিকার কেড়ে নিতে পারে না এনআইএ এবং তাদেরই মদতে জেল আমলারা। সুষ্ঠু ভাবে দিনের পর দিন তাঁর খেতে না পারাটা আসলে তাঁকে না-খাইয়ে, অন্ন থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার সামিল? জীবনের মহত্তম অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সামিল। আদালতকে নির্দেশ দিতে হয়েছিল স্ট্র ও সিপার সরবরাহের। অর্থাৎ, নাগরিকের জীবন রক্ষার দায়, জীবনের অধিকারের দায় স্বীকার করেই এই রায় দিয়েছিল উচ্চ আদালত। অর্থাৎ, জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত করছিল। আদালতের উচিত ছিল না এমনটা জানার পর এই চরম অসুস্থ মানুষটির উপর, বিচারাধীন বন্দির উপর, বিচারবিভাগীয় হেফাজতে থাকা ব্যক্তিটিকে রক্ষা করার? উচিত ছিল না কো-মর্বিটি লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিটিকে কোভিডে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার? নৃশংস খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিটিরও সেই সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। আদালত সে দায়িত্ব পালন করেনি। তাঁকে মরতে দিয়েছে। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। বম্বে হাইকোর্টে শেষ জামিনের আবেদনে রাঁচির বাগাইচা আশ্রমে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন আদিবাসী-প্রাণ ফাদার স্ট্যান স্বামী। আদালত তা মঞ্জুর করেনি। আদালত তো জানে না, প্রকৃতির সন্তানকে চার দেওয়ালের অন্ধকারে পুরে রাখলে সে মরমে মরে যায়। তবু, স্ট্যান লিখেছিলেন খাঁচাবন্দি পাখিও গাইতে পারে। তিনি বন্দি শিবিরে সহ-বন্দিদের মানবিক মুখগুলিও এঁকে রেখে গিয়েছেন।
মাদ্রাজ হাইকোর্ট করোনা-কালে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কিত এক মামলায় মন্তব্য করেছিল — কমিশনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা উচিত। আজ কার বিরুদ্ধে খুনের মামলা হবে? স্ট্যানের মৃত্যুর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যিনি এই সেদিনও স্ট্যানের মুক্তির বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেছিলেন; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, এনআইএ ও ইউএপিএ যাঁর যাবতীয় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার দ্বিমুখী হাতিয়ার; জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, আইন রক্ষার জন্য বেআইনে যাদের নির্ভরতা; নাকি বিচারব্যবস্থা? আইনসভা, প্রশাসন, পুলিশের প্রতিহিংসা ও দমনমূলক হিংস্র অন্যায়ের হাত থেকে নাগরিককের রক্ষা পাওয়ার যে স্তম্ভটি শেষ আশ্রয়স্থল? ভীমা কোরেগাঁও মামলা, ১৬ নাগরিকের বন্দিত্ব এবং তাঁদের অন্যতম স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু প্রমাণ করে যে, ন্যায়বিচারের আশ্রয় আমরা হারিয়েছি। এবং এই দেশের বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অন্য তিন স্তম্ভের মতোই ন্যায়ধর্মহীন, নিষ্ঠুর, সমানুভূতি বর্জিত ও কাণ্ডজ্ঞানহীন। মাঝেমধ্যে যে আলোকবর্তিকার হদিশ মেলে তা নিছকই ব্যতিক্রম।
ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু আসলে এক বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড। এ অপরাধের ক্ষমা নেই।