সম্মান রক্ষার দায় নিয়ে আর কত মেয়ে মরবে …


  • June 29, 2021
  • (0 Comments)
  • 1438 Views

দেশে আইন আছে। বিচারব্যবস্থা রয়েছে। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্বেচ্ছায় বিয়ে করে নিজেদের মতো করে জীবন কাটাতে চাইলে তাদের আইনত বাধা দেওয়ার কোনও জায়গাই নেই। বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান টিঁকিয়ে রাখার দায় নিয়ে দিনে পর দিন অসম্ভব মানসিক ট্রমা, অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচারের যন্ত্রণা আর অপমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় আর তারপর একদিন চুপচাপ মরে যেতে হয় মেয়েদের। এখনও। কয়েক দশকের আন্দোলনের পরও, এখনও চলতে থাকা অবিরাম লড়াইয়ের পরেও। বিস্ময়া আর কিরণের সামাজিক অবস্থান আলাদা। কিন্তু মেয়েদের সম্পত্তি মনে করায়, তাদের উপর জোর করে পরিবারের সম্মান রক্ষার দায় চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনও তফাৎ থাকে না। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

সম্মান রক্ষার্থে খুন – অনার কিলিং। শব্দগুলো আর নতুন করে স্তম্ভিত করে দেয় না। এ দেশে থেকে মেয়েরা এখন এই শব্দগুলো শুধু নয়, এই মৃত্যুগুলোর সঙ্গেও পরিচিত। অনেক বছর হয়ে গেল এই নৃশংসতার, তাই মেয়েরাও বোধহয় এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারাও জেনে গেছে যে যেকোনও সময়ে পরিবার, সমাজ সব জায়গা থেকে বীভৎসতম আঘাতটা তারা পেতে পারে। যত বড় চাকরিই করুক বা যত সহজ-সাধাসিধে একটা জীবনের স্বপ্নই দেখুক না কেন, জীবনটা যখনই নিজের হাতে নিতে চান, যেমনই হোক একটা নিজস্ব যাপনের চিন্তা করেন, তখনই মেয়েদের জীবনটাই একটা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া সবই যেন অন্যের উপর নির্ভরশীল – বিশেষত পরিবারের পুরুষদের। অবশ্য মানসিকতাটা যেখানে পুরুষতান্ত্রিক, সেখানে পুরুষ, নারী নির্বিশেষে যে কেউই এই নির্যাতনে, এই হত্যায় শামিল হয়ে যান।

 

আর নারীর সম্মান, যা নিয়ে না কি এই সমাজের, এই পরিবারের বড়ই মাথাব্যথা তা তো শুধুই নারীর শরীরকেন্দ্রীক। তাই তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই হোক, নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই হোক বা পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্যই হোক না কেন – তার শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে, পিষে দিলেই চলবে। আর সেই শরীর থেকে প্রাণটা বের করে নিতে পারলে আরওই নিশ্চিন্ত। কি মুশকিল! বলাই তো হচ্ছে সম্মান রক্ষার্থে হত্যা। হ্যাঁ, পরিবারের সম্মান। তা সেই সম্মান তো পরিবারের মেয়ের, মানে মেয়ের শরীরেই থাকে। সেটা রক্ষা করার জন্য একটু মরে যেতে পারবে না?

 

এই মেয়েগুলো তবুও বড় বেয়াড়া। এরা তবু্‌ও বারবার ভালবাসতে চায়। বারবার নিজেদের একটা স্বাধীন জীবনের কথা ভেবে সেইমতো এগিয়ে যায়। জানে যে যে কোনও সময় চূড়ান্ত অত্যাচারিত হতে পারে, মরে যেতে পারে, তবুও ভয় পায় না। ভয় পেলেও পিছিয়ে আসে না। কেন জানি না বিশ্বাস করে, একদিন পৃথিবীটা বদলে যাবে। মেয়ে বলে নয়, মানুষ বলে সম্মান পাবে, বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পাবে, নিজের জীবন কেমন হবে সেটা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পাবে। নিজেদের চারপাশেই কত উদাহরণ দেখে, নিজেদের জীবনেই হয়তো ঘটে যায় কত নির্মম ঘটনা, তবু শ্বাসটুকু থাকা পর্যন্ত আশা ছাড়ে না, সাহস ছাড়ে না, লড়াই ছাড়ে না মেয়েগুলো।

 

বিস্ময়া ভি নায়ার, কেরালার ২৪ বছরের আর্য়ুবেদ-এর ছাত্রী মেয়েটির গত বছর বিয়ে হয়েছিল। আপাতত সে মৃত। আত্মহত্যা না কি হত্যা তা নিয়ে তদন্ত চলছে। পণের জন্য মারা গেছে বিস্ময়া। তাঁর স্বামী এস কিরণ কুমার যে কি না অ্যাসিস্ট্যান্ট মোটর ভেহিকেলস ইন্সপেক্টর বিরাট অঙ্কের পণ নিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের আগের ও পরের যেসব প্রি ও পোস্ট ওয়েডিং ছবি এই খবরের প্রতিবেদনের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে, তাতে যাকে বলা যায় ‘পারফেক্ট ম্যাচ’। বিস্ময়ার খুশি চেহারাটা মন ভালো করে দেওয়ার মতো। ছবিতে তাঁর স্বামীকে দেখলেও বোঝার উপায় নেই মানুষের মধ্যে কতটা নিষ্ঠুরতা থাকতে পারে। বিপুল পরিমাণ পণ নিলেও গাড়িটি পছন্দ হয়নি তার, দাবি ছিল আরও টাকার। আর তাই শুধু মৌখিক হেনস্থাই নয়, চরম শারীরিক অত্যাচারও চালিয়েছে বিস্ময়ার উপরে। এমনকি বিস্ময়ার নিজের বাড়িতে গত জানুয়ারি মাসে তাঁর পরিবারের সামনেই তাঁকে প্রচন্ড মারধোর করে তাঁর স্বামী। নিজের শরীরে আঘাতের চিহ্নসহ তাঁকে বাঁচানোর জন্য পরপর এসওএস হোয়াটস্‌ অ্যাপ মেসেজ পাঠিয়েছিল বিস্ময়া মৃত্যুর আগের দিন রাতে তার পরিবারের কাছে। পরদিন স্বামীর বাড়ির বাথরুম ঝুলতে দেখা যায় তাঁকে। তাঁর পরিবারের দাবি আত্মহত্যা নয়, মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের মেয়েকে। এস কিরণ কুমারের চাকরি গেছে তৎক্ষণাৎ, গ্রেপ্তারও হয়ে গেছেন। কেরালার সাউথ জোন-এর আইজি হর্ষিতা আথাল্লুরি জানিয়েছেন – এস কিরণকুমারের যাতে কঠোরতম শাস্তি হয়, পুলিশ-প্রশাসন তারজন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে। হত্যা হোক বা না-ই হোক অত্যাচারের কারণে একটি মেয়ের জীবন চলে যাওয়াটা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

বিস্ময়ার স্বামী পণ নেওয়া, অত্যাচার এমনকি হত্যা প্রমাণিত হলে তার জন্য কঠোর সাজা পাবেন, সে কথা সত্যি। কিন্তু শুধুই কি তিনি একা, বিস্ময়ার পরিবার কি কোনওভাবেই এই মৃত্যুর জন্য দায়ি হয়ে রইল না? মাত্র ২৪ বছরের একটি মেয়ে যার লেখাপড়া শেষ হয়নি, যে নিজের কেরিয়ার তৈরি করতে চায় তাঁর বিয়ের জন্য এই যে তৎপরতা তা শুধুই সমাজের চাপে পড়ে না কি মেয়ে মাত্রেই বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে সেই ভাবনা থেকে – এই প্রশ্নটা আর কতজন বিস্ময়ার মৃত্যুর পর তুলবো আমরা? বিস্ময়া তাঁর উপর ঘটে চলা অত্যাচারের কথা পরিবারের কাছে গোপন করেনি, তবুও তাঁকে এই ‘ট্রমাটিক’ সম্পর্ক ও বিয়ে থেকে বের করে আনার জন্য সম্পূর্ণ চেষ্টা করেনি তাঁর পরিবার। নিজের বাড়িতে (অবশ্য বিয়ের আগে ও পরে কোনটি যে একজন মেয়ের নিজের বাড়ি তা নিয়ে বোধহয় বারেবারে ভাবার অবকাশ তৈরি করে দিয়ে যায় এই ঘটনাগুলো) নিজের পরিবারের সামনে তাঁর স্বামী প্রচন্ড মারলেও সেই স্বামীর কাছ থেকে তাঁকে স্থায়ীভাবে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয় না, তাঁকে সংসার করতে যেতেই হয়। যে রাত্রে তিনি বাঁচার জন্য এসওএস বার্তা পাঠাচ্ছিলেন, তাঁর পরিবার যে কোনও উপায়ে পৌঁছে যায়নি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কেন? সেই সম্মান রক্ষার্থেই। একবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সব কিছু সামলে নিয়ে, সহ্য করে, সমঝোতা করে মেয়েদের চেষ্টা করে যেতে হয় বিয়েটাই টিঁকিয়ে রাখার।

 

বিস্ময়ার ঘটনাটি নিয়ে পরপর দু’দিনের মধ্যে কেরালায় তিন জন মেয়ে পণ সম্পর্কিত অত্যাচারের কারণে মারা গেছেন। কেরালা – যে রাজ্যটি দেশের মধ্যে নানাবিধ সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাগত উন্নতির সূচকে প্রথম স্থানে রয়েছে, সেখানে লিঙ্গবৈষম্য ও নারীর প্রতি হিংসার ঘটনায় যে পরিসংখ্যান চোখে পড়ে তা রীতিমতো আশঙ্কিত করে। কেরালাতে নারী সাক্ষরতার হার সারা দেশের মধ্যে সেরা – ৯৫%। সে রাজ্যের নারীদের ক্ষমতায়ণের অনেকগুলি জনপ্রিয় সংগঠন, রাজ্যের মহিলা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অধীনে মহামারীকালীন সময়ে বিভিন্ন স্তরে কোভিড ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার হিসাবে মহিলাদের সফল ভূমিকা – কিছুই ভুলিয়ে দিতে পারে না এ রাজ্যে পণের জন্য মহিলাদের মৃত্যুর ক্রমশ বাড়তে থাকা সংখ্যা। ২০১৯-২০ সালে পণের জন্য মৃত্যুর নথিবদ্ধ ঘটনার সংখ্যা ৬। কিন্তু স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে অত্যাচারিত মহিলাদের সংখ্যাটি শিউরে ওঠার মতো – ২০২০ সালে ২৭১৫টি ঘটনা। বিস্ময়ার ঘটনার পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন চব্বিশ ঘন্টা মহিলাদের জন্য পুলিশ হেল্পলাইন চালু করেছেন পণের জন্য অত্যাচার, গার্হস্থ্য হিংসা ও অন্যান্য লিঙ্গ পরিচিতি নির্ভর অপরাধ রিপোর্ট করার জন্য। কিন্তু যেখানে মেয়েদের পরিবারই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ পণ দেওয়ার রীতি মেনে চলেছেন, চরম অত্যাচারের ঘটনা জানার পরও মেয়েদের বিয়ে থেকে বের করে আনছেন না – সেখানে সামাজিক আন্দোলনের প্রবল চাপ তৈরি না করলে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে – অবস্থা বদলাবে না, মেয়েরা বাঁচবে না।

 

গত এক মাসে ব্যক্তিগতভাবে অন্তত দু’টি এমন ঘটনার কথা নিজেই শুনেছি। সদ্য দেড় বছর বিয়ে হয়েছে মেয়েটির, নানা শারীরিক দুর্বলতা রয়েছে অপুষ্টিজনিত কারণে। ইতিমধ্যেই সন্তান আসছে না কেন তাই নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অশান্তি, শারীরিক নির্যাতন। মেয়েটির প্রেমের বিয়ে। মা আয়ার কাজ করেন। বাবার উপার্জন স্বল্প। অনেক বুঝিয়েও পুলিশের কাছে পাঠানো যায়নি তাদের। এখন মেয়েটি চেষ্টা করছেন স্বনির্ভর হওয়ার, তবে স্বামী ছেড়ে আসার কথা ভাবতেও পারেন না। আরেক মেয়ের মা গৃহ পরিচারিকা। মেয়েটি স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করতে করতেই প্রেম করে বিয়ে করে ফেলে। নানা কারণেই বিয়ের পর থেকে অশান্তি, অত্যাচার। এই মুহূর্তে মেয়েটি চাকরি খুঁজছেন। চাকরি পেলে কি স্বামীর সংসার ছেড়ে আসবেন, প্রশ্ন করেছিলাম তাঁর মা-কে। উত্তর ছিল – না, চারপাশের লোকজন কি বলবে! তাই ঐ যে পরিবারের সম্মান, নিজের সম্মান, সমাজ নির্দ্ধারিত সম্মান সব কিছু বজায় রাখার জন্য মেয়েগুলো একটু মারধোর, একটু অপমান গিলে নিতে হয়। খুব বেশি হলে মরে যেতে হয়। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারলেও ক্ষতগুলো শুকোয় না। ঐ যে সম্মানটা তো থাকে।

 

২৪ বছরের বিনয় দাহিয়া আর ১৯ বছরের কিরণ ভালবেসেছিলেন। ঘর বেঁধেছিলেন। জানতেন ওদের এই ভালবাসা, বিয়ে, একটা খুব সাধারণ অথচ নিজস্ব জীবন মেনে নেবে না ওদের জাতপাত মেনে চলা পরিবার, সমাজ। তাই পালিয়ে এসেছিলেন ওরা। বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন দিল্লির দ্বারকায়। বিনয় ট্যাক্সি চালাতে শুরু করেছিলেন। গত বছর অগাষ্ট মাসে কিরণ সাবালিকা হওয়ার পর বিয়ে করেছিলেন ওরা পালিয়ে, ভয় পেয়েছিলেন, জানতেন আক্রান্ত হতে পারেন। তাই পাঞ্জাব ও হরিয়াণা হাইকোর্টে নিরাপত্তা চেয়ে আপিল করেছিলেন। হাইকোর্ট থেকে সোনপত-এর সিনিয়র সুপারিনটেন্ডেন্ট-কে বলা হয়েছিল পিটিশনারদের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে…তাদের ভয় কতটা সত্যি তা খতিয়ে দেখতে। কিরণের পরিবার প্রথম থেকেই এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে ছিল ও তাদের হত্যার হুমকিও দিয়ে রেখেছিল। তাঁরা পালিয়ে যাওয়ার পর কিরণের পরিবার থেকে তাঁদের মেয়েকে গুম করার অভিযোগ দায়ের করে। তবু, এই সব ভয়, বাধা পেরিয়ে তারা যে ঘর বাঁধলেন সেখানে বাঁচতে পারলেন না একটা বছরও। গত ২৪ জুন সাত-আট জন দুষ্কৃতি তাদের বাড়িতে হামলা চালায়, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বিনয়কে মেরে ফেলে, কিরণ গুরুতর আহত। কিরণের পরিবারের সদস্যদের পুলিশ এই হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে আটক করেছে। মনে করা হচ্ছে এ সম্মান রক্ষার্থে হত্যা। হামলার পর বিনয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিরণ বাড়ির ছাদ থেকে আরেক বাড়ির ছাদে লাফিয়ে পড়েছিলেন। পালাচ্ছিলেন যখন তখনও তাঁদের উপর ক্রমাগত গুলি চালানো হয়। রাত তখন ন’টা। সারা দিনের কাজের শেষে বিনয় আর কিরণ হয়তো তখন রাতের খাবার সারতে বসবেন ভাবছিলেন, হয়তো ভাবছিলেন হিসেব করে দেখবেন কত টাকা জমল, এই লকডাউনে আরও কীভাবে কাজ করে গুছোবেন নিজেদের নতুন জীবন তা ভাবছিলেন হয়তো, হয়তো ঝগড়া করছিলেন, হয়তো আদর। এই সবকিছু তাদের ছিল আর কিরণের (কারণ মূলত মেয়েদের পরিবারই যেহেতু সম্মান রক্ষার্থে খুন করিয়ে থাকে) পরিবারের ছিল মেয়ের নামে সম্মান। সেই সম্মান সে বুঝি নিয়ে গেছিল নিজের ভালবাসার সঙ্গে থাকবে বলে। তাই কোনও মায়া বা ভালবাসা নয়। নিজের ‘বিরাদরি’তে বিয়ে না দিতে পারার যে লজ্জা তা একমাত্র মেয়েকে আর তার ভালবাসার মানুষকে হত্যা করেই মোছা যায়। তাই পরপর চার, পাঁচটা গুলি দু’টো শরীরে চালিয়ে দেওয়া কি এমন ব্যাপার। বিনয় মৃত। কিরণ বাঁচবেন না মরবেন বলা যাচ্ছে না? বেঁচে গেলেও, কীভাবে বেঁচে থাকবেন? কাদের সঙ্গে থাকবেন?

 

সম্মান রক্ষার্থে হত্যার শিকড়টা ছড়িয়ে রয়েছে এ দেশের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাতে তো বটেই সেইসঙ্গে জাতপাতের বৈষম্যে ভরা এই দেশের সমাজব্যবস্থায়। একটি মেয়ে তার পরিবারের সম্পত্তির মতো। তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলে অনেক মহিলা সদস্যও মনে করেন বাড়ি মেয়েটির নিজের পছন্দ মতো সঙ্গীর সঙ্গে জীবন কাটানোর কোনও অধিকারই নেই। বিশেষত নিজের জাতের বাইরে তো নয়ই। নিজের জাত-বর্ণের বাইরে বিয়ে হওয়া মানেই সম্মান সম্পূর্ণভাবে খুইয়ে ফেলা। উচ্চ অবস্থান থেকে নেমে যাওয়া অনেকটা নীচে। আর তা বাড়ির মেয়ের জন্য হবে তা হতেই পারে না। কোনও বাড়ির সম্পত্তি যেমন বাড়ির লোকেরা ঠিক করেন, কীভাবে কোথায় রাখা হবে, মেয়ের বিয়েও কোন বর্ণের কোন জাতের ছেলের সঙ্গে হবে তা ঠিক করার দায়িত্ব নিয়ে নেয় কোনও কোনও পরিবার আর তার বাইরে প্রেম বা বিয়ে করতে চাইলেই এভাবে সম্মান রক্ষার নামে দু’টি নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে দিতে হয়। জাতপাতের নামে, বর্ণবিদ্বেষের নামে বারেবারে এভাবেই বলি হতে থাকেন মেয়েরা, তাদের ভালবাসারা। বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান টিঁকিয়ে রাখার দায় নিয়ে এভাবেই দিনে পর দিন অসম্ভব মানসিক ট্রমা, অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচারের যন্ত্রণা আর অপমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় আর তারপর একদিন চুপচাপ মরে যেতে হয় মেয়েদের। এখনও। কয়েক দশকের আন্দোলনের পরও, এখনও চলতে থাকা অবিরাম লড়াইয়ের পরেও। বিস্ময়া আর কিরণের সামাজিক অবস্থান আলাদা। কিন্তু মেয়েদের সম্পত্তি মনে করায়, তাদের উপর জোর করে পরিবারের সম্মান রক্ষার দায় চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনও তফাৎ থাকে না।

 

দেশে আইন আছে। বিচারব্যবস্থা রয়েছে। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্বেচ্ছায় বিয়ে করে নিজেদের মতো করে জীবন কাটাতে চাইলে তাদের আইনত বাধা দেওয়ার কোনও জায়গাই নেই। অথচ সমীক্ষা থেকে জান যাচ্ছে দেশে সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনা ‘আন্ডার রিপোর্টেড’। অনেক এ ধরনের হত্যাকে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা বলেও চালিয়ে দেওয়া হয়। কারণ অধিকাংশ ঘটনা টাকার জোর ও প্রশাসনের উপরমহলের সঙ্গে দহরম-মহরমে চাপা পড়ে যায়। একটি মেয়ে, একটি ছেলে আচমকা উধাও হয়ে গেলে এই বিরাট জনসংখ্যার দেশে কিই বা যায় আসে। কয়েক দিন নিকটজনদের বিলাপ, তারপর তো শুধুই ছবি হয়ে যাওয়া বা তারা যে কোনও দিন ছিল সেটাই ভুলিয়ে দেওয়া।  ২০১৮ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৮-তে ৩০টি সম্মান রক্ষার্থে খুনের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনায় রায় দানের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ২৮৮টি ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছিল। ২০১৮ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর একটি পরিসংখ্যান যাতে ভারতে কোন কোন রাজ্যে সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে তা উল্লেখ করা হয়েছিল তাতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যগুলি হল – ঝাড়খন্ড, হিমচল প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, আসাম, গুজরাট, জম্মু ও কাশ্মীর, কেরালা, ওড়িশা, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা ও দিল্লি। সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মেয়েদেরকেই হত্যা করা হয়, তারপরে থাকেন পুরুষেরা ও তারপরে থাকে যুগলদের হত্যা করার ঘটনা।

 

আমরা মহামারী আক্রান্ত পৃথিবীতে বাঁচছি। আমাদের জীবৎকালে এমন পরিস্থিতি প্রথম বার। জীবনগুলোই বদলে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু তার মাঝেও নারীর অবস্থান আর তার প্রতি ঘটতে থাকা হিংসা কোনওভাবে কমে না। বরং মহামারী, গৃহবন্দী দশা এ সবকিছুর জন্য ক্রমেই বাড়তে থাকে এই হিংসা। সামাজিকভাবে, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ চলবে। অবশ্যই তা চলা উচিতও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ক্রমাগত এই হিংসা নিয়ে কথা বলে না গেলে, বারেবারেই নিজের আশেপাশে এমন ঘটনা দেখলে রুখে না দাঁড়ালে, এমন মেয়েদের বা এমন যুগলদের দেখলে তাদের সাহস দিয়ে যেতে না পারলে, দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থাকে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসাবে কাজ করে যেতে না পারলে, এই অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে পাল্টানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। এই পরিবারগুলি, যারা হয়তো নিজের মেয়েকে ভালবাসে, চিন্তা করে তাদের ভালো থাকা নিয়ে – তাদের বোঝাতে হবে মেয়ে মরে গেলে তার সম্মান, তার সঙ্গে জোর করে জুড়ে দেওয়া পরিবারের সম্মান – কিছুই আর থাকে না, ফলত মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে, মেয়ের বেঁচে থাকাটা স্বাধীনভাবে নিজের শর্তে সেটাই সবচেয়ে সম্মানের। সম্মান রক্ষার্থে যে পরিবার বাড়ির মেয়ে, তার ভালবাসার মানুষকে খুনের পরিকল্পনা করতে পারে, তারা যাতে আইনের হাতে কঠোরতম শাস্তি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

একটা সহজ, স্বাভাবিক জীবন। একা, বিবাহিত, নিজের বেছে নেওয়া সঙ্গীর সঙ্গে – জীবনের ন্যূনতম চাওয়া-পাওয়াগুলো নিয়ে বাঁচতে চাওয়া। এটা অপরাধ নয়। এই সমাজেই বহু একা মা, একা মেয়ে তা করে দেখাচ্ছেন। তাঁদের কথা বারবার বলতে হবে। যাতে এই মেয়েগুলো সাহস পায়। যাতে অনেক বিস্ময়া, কিরণ বোঝেন আর লড়ে যান এটা প্রমাণ করতে যে মেয়েদের যোনি, স্তন পেরিয়ে হাড়, মাংসের একটা আস্ত মানুষের শরীর রয়েছে। আর তা স্রেফ সম্মান রক্ষা করার জন্য মরে যেতে তৈরি হয়নি। এই মেয়েদের মায়েদের অবস্থান, তাদের ভূমিকাগুলোও স্পষ্টভাবে বোঝা প্রয়োজন। এই ঘটনাগুলি ঘটে ও তারপর একশ ঘটনার ভিড়ে হারিয়ে যায়। কিন্তু এই সমস্ত কিছু ওলট-পালট হয়ে যাওয়া পৃথিবীতেও মেয়েদের উপর ক্রমশ বাড়তে থাকা গার্হস্থ্য হিংসা শুধু নথিবদ্ধ হয়ে থাকার আর প্রতিবেদন লেখার বিষয় নয়। জোটবদ্ধ প্রতিরোধ, সচেতনতা আর প্রতিবেশ থেকে রুখে দেওয়ার প্রয়াস না থাকলে বিস্ময়া আর কিরণদের দেহের উপর দেহ জমা হতে থাকবে। এমনিই এ দেশে মৃতদেহের স্তুপ জমেই চলেছে, আরও মৃতদেহের ভার বইতে পারব তো?

 

Share this
Leave a Comment