বাথরুমের ভূত, পচা বিরিয়ানি, টাটানো কোমর আর অনাদায়ী ছুটির গল্প


  • June 19, 2021
  • (0 Comments)
  • 2537 Views

ভারতীয় শহরগুলির যেসব অংশে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স মাথা তুলে ওঠে, তার কাছেপিঠে গড়ে উঠবেই উঠবে বস্তি এলাকা, যেখান থেকে মূলত মহিলারা আসেন এই ফ্ল্যাটবাড়িগুলিতে কাজ করতে। গৃহশ্রম ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে, দেশ জুড়ে সবচাইতে বেশি সংখ্যক মহিলা শ্রমিক কাজ করেন। তবু একে শ্রমের মর্যাদা দেওয়া হয় না। অর্থাৎ, ন্যূনতম মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটি, বোনাস, পেনশন কোনও সুবিধাই এই শ্রমিকরা পান না। এসমস্ত অধিকারের দাবিতে, এবছর ১৬ জুন, আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবসে মহিলা গৃহশ্রমিকদের সাথে সংগ্রামী ঘরেলু-কামগার (গৃহশ্রমিক) ইউনিয়ন বা এস.জি.ইউ. কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর ও দিল্লিতে নানা অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদ জানাল। এই উপলক্ষ্যে কয়েকটি বস্তি অঞ্চলে নতুন করে কাজও শুরু করল এস.জি.ইউ.। দিল্লির উপকণ্ঠে এমনই এক বস্তি অঞ্চল থেকে রিপোর্ট করছে গ্রাউন্ডজিরো। পরিচিতি গোপন রাখার প্রয়োজনে গৃহশ্রমিকদের নাম বদলে দেওয়া হল এবং অঞ্চলটির নামও উল্লেখ করা হল না।    

 

হিন্দু, মুসলমান, শিখ, যাই হোক না কেন, মানুষকে মানুষ বলে না দেখলে পুজোআচ্চা করে কোনও লাভ নেই।“ এমনটাই মনে করেন বছর পঁচিশের আনজুমা বিবি। প্রসঙ্গ – খাবার নষ্ট করা ঠিক নয় বলে তাঁর কাজের বাড়ির ধর্মপ্রাণা ম্যাডাম তাঁকে পচে যাওয়া বিরিয়ানি খেতে দিয়েছিলেন। আনজুমা বিবির বাড়ি উত্তরবঙ্গ। দিল্লির উপকণ্ঠে একটি বস্তিতে তাঁর বসবাস প্রায় দশ বছর। যদিও দেড় হাজারের কাছাকাছি ঘর, একটি মন্দির, একটি মসজিদ ও একটি সাধারণ টয়লেট (জন সুবিধা পরিসর) নিয়ে তৈরি এই বস্তির বয়স তিরিশ বছরের কাছাকাছি।

 

ভারতীয় শহরগুলির যেসব অংশে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স মাথা তুলে ওঠে, তার কাছেপিঠে গড়ে উঠবেই উঠবে এমন বস্তি এলাকা। এই বস্তিগুলি থেকেই গৃহশ্রমিকরা এই ফ্ল্যাটবাড়িগুলিতে কাজ করতে আসেন।

 

 

একই অঞ্চলে, একই কারণে, গজিয়ে ওঠে এক বা একাধিক শপিং মলও। মহিলাদের কেউ কেউ আবার সেই মলেও কাজ করেন – ধোয়ামোছা, সিকিউরিটি গার্ড। পুরুষরাও নানাভাবে ফ্ল্যাট এবং মলের কাজের সাথে যুক্ত থাকেন – ড্রাইভার, মালি, গার্ড, পুরুষ গৃহশ্রমিক ইত্যাদি। আবার কেউ ছোট দোকান দেন, কেব্‌ল লাইন বা ডিশ এন্টেনার এজেন্ট হন কেউ, কেউ বা ময়লা ফেলেন, অর্থাৎ ‘কুড়াদার’-এর কাজ, আবার অটো বা ভাড়ার গাড়ি চালান কেউ ইত্যাদি। অর্থাৎ মূলত অসংগঠিত ও অদক্ষ শ্রমের এক বিরাট ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অর্থনৈতিক কেন্দ্র স্কাইলাইন বদলে দেওয়া ফ্ল্যাটবাড়িগুলি।

 

 

দিল্লির উপকণ্ঠে এমনই এক অঞ্চলে সংগ্রামী ঘরেলু-কামগার ইউনিয়ন (এস.জি.ইউ.) এবছর মহিলা গৃহশ্রমিকদের সাথে তাঁদের নানা অধিকারের দাবি নিয়ে কাজ শুরু করল। এই অঞ্চলেই আনজুমা বিবিদের নিবাস। ১৬ জুন, আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবসে তাঁদের নিয়েই এই ইউনিয়নের একটি নতুন শাখার গোড়াপত্তন করা হল। আলাপ-আলোচনায় উঠে এল বস্তিবাসী গৃহশ্রমিকদের একজোট হবার কথা, চাকরি চলে যাবার ভয় জয় করার কথা, বোনাস, ছুটি ও ন্যূনতম মজুরির দাবি, লকডাউন, নোটবন্দী ও অপর্যাপ্ত রেশনের কথা, মানুষকে মানুষ বলে, শ্রমকে শ্রম বলে দেখবার কথা। বক্তব্য রাখলেন এস.জি.ইউ.-এর সদস্যরা এবং মহিলা গৃহশ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ:

 

 

অনুষ্ঠানের শেষে আড্ডার ছলে উঠে এল নানা প্রাত্যহিক যন্ত্রণার কথাও। কাজের বাড়ির বাসন বা বাথরুম ব্যবহার না করতে দেওয়ার অপমান, চুরির বদনাম, কখনও যৌন হেনস্থাও। বাথরুম প্রসঙ্গে রহিলা বিবি তাঁদের সাধারণ টয়লেট-এর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠলেন, “মাঝে মাঝে মনে হয় ওদের বলি, এসে দেখে যাক আমাদের পেচ্ছাপ-পায়খানার জায়গাটা, আমরা কেমন পরিষ্কার করে রাখি!” গৃহশ্রম ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করলেও, দীর্ঘসময় বাথরুম ব্যবহার না করতে পারা ছাড়া আরও একটা বিষয় লক্ষ্য না করে উপায় নেই যে, এই মহিলাদের অনেকেই ভোগেন কোমর ও হাঁটুর ব্যথায়। মাটিতে বসলে বা মাটি ছেড়ে উঠলে অনেকের মুখে অজান্তেই যন্ত্রণার দাগ ফুটে ওঠে। কখনও সখনও ব্যতিক্রমী কিছু পরিবার ছাড়া কাজের বাড়িতে গৃহশ্রমিকের স্বাস্থ্য বিষয়ে তেমন বিবেচনা নেই। ভ্যাক্সিন নেবার পরে দু’দিন কাজে যেতে না পেরে যে মহিলা সদ্য চাকরি খুইয়েছেন, তাঁর গল্পেও এই কথাই উঠে আসে।

 

 

ব্যাঙ্গালোর, বম্বে, গুরুগ্রাম, দিল্লি ইত্যাদি শহরে, এই বস্তিবাসী গৃহশ্রমিক পরিবারগুলির বড় অংশ বাঙালি, অসমীয়া বা বিহারি। দিল্লির এই বিশেষ অঞ্চলটিও তেমনই। মূলত উত্তরবঙ্গ ও অসম থেকে পঁচিশ বছর, কুড়ি বছর, দশ বছর আগে এই মেয়েরা গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন এবং এখনও এসে চলেছেন। গ্রামে থাকলে কাজ মেলে না – পুরুষদেরই মেলে না, মেয়েদের তো কথাই নেই। কাজ মিললেও, তার মাইনেতে সংসার চলে না। চললেও, টিমটিম করে। সে টাকায় ক্রমাগত বেসরকারি হয়ে যাওয়া ঝাঁ চকচকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার নাগাল পাওয়া যায় না। ফ্ল্যাটবাড়িতে খাটতে খাটতে বস্তিবাসী বাবা-মায়েদের মনে তাঁদের ছেলেমেয়েকে বস্তিজীবন থেকে ফ্ল্যাটজীবনে থিতু হতে দেখবার যে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ইচ্ছে জাগে, তাকে ছোঁয়া যায় না। পড়াশুনো বা খেলাধুলোর প্রায় কোনও সুযোগ নেই, বিশেষ করে বস্তি সংলগ্ন যে একটি মাঠ ছিল, তার গা বরাবর সরকার থেকে পাঁচিল তুলে দেবার পর থেকে। বস্তি সংলগ্ন খেলার মাঠ বা খোলা জমিতে বস্তিবাসীর প্রবেশ আটকানোর এই নিয়ম ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

 

বরং, মায়েদের আক্ষেপের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে, যেহেতু তাঁদের কাজের বাড়িতে ছুটির দিন বলে কিছু নেই, অসুস্থতার কারণে বা অন্য কোনও কারণে বাধ্য হয়ে ছুটি নিতে হলে, ম্যাডামরা এমনও বলেন যে, নিজে আসতে না পারলে তোমার মেয়েকে পাঠিয়ে দাও! বলা বাহুল্য, সংগঠিত শ্রম ক্ষেত্রে এমন বিচিত্র আদেশ কল্পনারও বাইরে।

 

 

তবু, বহু দুঃখেও মেয়েদের হাসি যায় না। তাই একজন যখন ক্ষোভ দেখান: “গরীব মানুষকে সবাই মিলে ‘মজাক’ বানিয়ে রেখেছে”, তখন আরেকজনের মনে পড়ে যায় ‘মজাক’ বানানোর অন্যরকম গল্প। যথারীতি বাথরুম ব্যবহার করতে না দেওয়া সত্ত্বেও একদিন দায়ে পড়ে, কাজের শেষে ম্যাডামকে না জানিয়েই সে বাড়ির বাথরুমে ঢুকেছিলেন তিনি। তাইতে বাড়ির লোক বাথরুমের দরজা বন্ধ দেখে কেমন ভূতের ভয়ে কাছাখোলা হয়ে পড়ে, সে গল্পে সকলে হেসে কুটিপাটি। আরেকজনের বক্তব্য, “বললে পারতিস, ভুল হয়ে গেছে, এই তোমার ঘরের মেঝেতেই করা উচিত ছিল!” আবার আরেকজন যুক্তির কথা তোলেন, “তোমার বাসনে, আমার এই হাতই তো রুটি বানিয়ে রাখল। তোমার বাথরুমও তো আমার এই হাতই পরিষ্কার করে…

 

 

লকডাউনে এই মানুষগুলির অবস্থা দুর্বিষহ। রেশন সবাই পান না। রেশনের লিস্ট তৈরির সময়ে কিছু স্থানীয় মানুষের দুর্নীতিকেই এর পিছনে দায়ী করলেন মহিলারা। তবে যাঁরা রেশন পেয়েছেনও, তাঁদের মত, রেশনের চাল-ডাল-তেলের পরিমাণ মাস চালাবার পক্ষে যথেষ্ট না। তবু তো এক অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে এই বস্তির মানুষদের ঘরভাড়া দিতে হয় না। অন্যান্য অঞ্চলে স্থানীয় জাঠ বা রাজপুত গুন্ডারা অনেকসময় সরকারি জমিকেও নিজেদের জমি বলে দাবি করে বস্তিবাসীদের থেকে ভাড়া আদায় করে নেন।

 

লকডাউনে চাকরি খোয়ানোর উপর রয়েছে নিজের বাড়ির কর্মভার এবং অন্যান্য নানা সমস্যা, যা বিশেষ করে মহিলাদেরই পোহাতে হয়। যেমন, আমিনা বিবির স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। ঝঞ্ঝাটে তিতিবিরক্ত হয়ে শেষে স্বামীকে ত্যাগ করে দুই ছেলেকে নিয়ে আলাদা রয়েছেন আমিনা। এপ্রিলে তাঁর কাজটিও গেছে। সংসার চালাতে ওষ্ঠাগত প্রাণ তাঁর। তবু স্বামীর কাছে টাকা নেওয়ার কথা তিনি ভাবতেই পারছেন না এই মুহূর্তেও। “এ জন্মে যা হয় হোক, উপরওয়ালা সব দেখছেন,” এটুকুই ভরসা তাঁর।

 

জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দাম বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে কমছে চাকরি। তবু গৃহশ্রমিকরা ‘শ্রমিক’ পদবাচ্য হন না। তাঁদের ন্যূনতম মাইনে ধার্য হয় না। ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদির মাইনে ওই অঞ্চলে আপাতত মাসে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে; রান্নার কাজের দর আরেকটু বেশি, মাসে ৩০০০ অবধি। কিন্তু এই শ্রম কোথাও নথিভুক্ত হয় না। তাঁদের অধিকার রক্ষার আইনগুলি ড্রাফ্‌ট হয়েই থেকে যায়। তাঁরা বোনাস পান না, পেনশন পান না, তাঁদের সংগঠন তৈরি হয় না, হলেও রেজিস্ট্রেশন মেলে না। এই মুহূর্তে গোটা দেশে হাতে গোনা কয়েকটি রেজিস্টার্ড গৃহশ্রমিক সংগঠন রয়েছে মাত্র (এস.ই.ডব্লিউ.এ., এন.ডি.ডব্লিউ.এফ. ইত্যাদি)। এই প্রতিটি কারণেই গৃহশ্রমিকদের একজোট হওয়ার প্রয়োজন এত তীব্র। একইসাথে ইউনিয়নগুলির তরফে প্রয়োজন, সংগঠিত করার সাথে সাথে চাকরির বাইরেও মহিলা গৃহশ্রমিকদের প্রাত্যহিক জীবনকে বোঝা ও তার ভিতরকার নানা অধিকারের দাবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা।

 

 

এরই মধ্যে এস.জি.ইউ. এবং তার মতো নানান ছোটবড় শ্রমিক সংগঠনগুলি এগিয়ে আসছে ও গৃহশ্রম ক্ষেত্রে সংগঠিত শ্রমক্ষেত্রের অধিকারগুলিকে লাগু করতে চেয়ে। দিল্লি ছাড়াও এস.জি.ইউ. এবছর ১৬ জুন কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোরের কয়েকটি অঞ্চলে গৃহশ্রমিকদের সাথে মিলে প্রতিবাদ করেছে। দাবিপত্রে চাওয়া হয়েছে:

 

  • ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা
  • গৃহশ্রমিকদের পক্ষে আইনিকরণ
  • সবেতন ছুটি
  • কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবার আগে অন্তত এক মাসের নোটিস
  • ট্রেড ইউনিয়ন তৈরির অধিকার
  • লেবার ট্রাইব্যুনাল তৈরি
  • অপরাধের অপবাদ, ভেদাভেদ, যৌন হেনস্থা বন্ধ করা

 

Share this
Leave a Comment