‘মুক্তধারা’ নাটকে রাজা ‘মারনেওয়ালার ভিতরকার মানুষ’ ধনঞ্জয়কে কারাবন্দি করেছিলেন। কারণ রাজার আশঙ্কা ছিল প্রজাদেরকে উত্তেজিত করতে পারলে সেই শিবতরাই রাজ্যের প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেন। তাই তিনি ভীত হয়েছিলেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা কি সেই একই ভয়ে শঙ্কিত? কিন্তু পারবেন তো তিনি আটকাতে? প্রশ্ন তুললেন সুমন সেনগুপ্ত।
উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ সম্প্রতি খবরের শিরোনামে এসেছে। এক মুসলমান বৃদ্ধকে নিগ্রহের ঘটনায় আট জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে উত্তর প্রদেশ পুলিশ। অপরাধ তারা এই ঘটনাটির ভিডিও এবং সেই সম্পর্কিত খবর সামাজিক মাধ্যম টুইটারে শেয়ার করেছে। শুধু তাই নয় টুইটারের বিরুদ্ধেও ওই একই ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে টুইটারকে যে এখন থেকে তাঁরা আর শুধু ইন্টারমিডিয়ারি বা মাধ্যম নয় তবু তারা কেন এই ধরনের খবর তাঁদের মাধ্যমে চলতে দিয়েছেন তার দায় নিতে হবে। অর্থাৎ মানে দাঁড়াল এটাই যে কোনও মানুষকে নিগ্রহ করাটা শাস্তি যোগ্য নয়, কিন্তু তা প্রচার করাটা অপরাধযোগ্য।
কিছুদিন আগে আর একটি ঘটনা ঘটে। ব্যঙ্গ চিত্র শিল্পী মঞ্জুল নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করে একটি ব্যঙ্গ চিত্র আঁকেন। তাতে তিনি দেখান যে যে সময়ে কোভিডের দ্বিতীয় সংক্রমণ হচ্ছে সে সময়ে নরেন্দ্র মোদী টেবিলের তলায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু যখনই সংক্রমণ কমে এসেছে তখনই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন। এই ব্যঙ্গ চিত্র একদমই মনঃপুত হয়নি সরকারের। ফলে তাঁরা টুইটারকে চিঠি দিয়ে জানতে চায় যে কেন তাঁরা তাঁদের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করেছেন।
টুইটার সেই চিঠিটি মঞ্জুলকে পাঠায় এবং চিঠিতে জানায় যে তাঁরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তাই সরকারের এই নির্দেশ মানে নি। এই চিঠি পাওয়ার পর, মঞ্জুল নিজেই টুইটারে লেখেন যে তাঁর ৩২ বছরের কর্মজীবনে তিনি প্রথম এইরকম একটি চিঠি পেলেন, যাকে বকলমে হুমকিও বলা যায়। বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রথম সারির দৈনিকে তাঁর আঁকা ব্যঙ্গ চিত্র ছাপা হলেও এরকম অভিজ্ঞতা তাঁর প্রথম।
এই মঞ্জুল কীভাবে এই ব্যঙ্গচিত্রের জগতে এলেন সেটাও তিনি বলেছেন। একদিন এক পুলিশ মঞ্জুলের থেকে উৎকোচ চায়, তাতে তাঁর এত রাগ হয় যে তিনি একটি ছবি এঁকে ফেলেন। কোনও প্রথাগত শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও তিনি ধীরে ধীরে এই ব্যঙ্গচিত্রের জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি এই কাজটি করছেন। আজকে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁরা ক্ষমতায় আসার আগে বিভিন্ন সময়ে মঞ্জুলের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র ব্যবহার করেছেন। তিনি আরও লেখেন যে যদিও কোনও সরকারই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, কিন্তু এই সরকার যেন একটু বেশি পরিমাণে অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে। তিনি এই চিঠির একটি সমুচিত জবাবও দেন টুইটারেই। তিনি তাঁরই আঁকা একটি পুরোনো ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে বলেন, সরকার যদি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আর একটু বেশি সচেতন হতেন তাহলে এত মানুষ হয়তো মারা যেতেন না। এই মুহুর্তে দেশের যারা পরিচিত ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী প্রত্যেকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন, প্রত্যেকে নিজের নিজের টুইটার হ্যান্ডেল এবং ফেসবুক থেকে সরকারের সমালোচনা করে নানান ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন যার প্রত্যেকটি এই সরকারের সমালোচনায় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।
ঘটনা এখানেই থেমে থাকে নি, মঞ্জুল যেই সংবাদসংস্থায় চাকরি করতেন সেখান থেকে তাঁর চাকরিও গেছে। এতেও তাঁর সহকর্মীরা যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছেন এবং তাঁরা তাঁদের প্রতিবাদ তাঁদের কালি-কলম-তুলি দিয়েই করেছেন। তাঁরা বলেছেন এই ব্যঙ্গচিত্র আসলে আয়না, যেখানে সরকারের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। যখন দেখা যায় যে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে এবং সরকার তার সমালোচনা না সহ্য করতে পেরে এই শিল্পীদেরই আক্রমণ করছেন তখন বোঝা যায় কোথাও কিছু গণ্ডগোল আছে। যদি সরকার এই ব্যঙ্গচিত্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দেখা যাবে আরো হাজার ব্যঙ্গচিত্র আরও হাজার রকমের প্রতিবাদ তৈরি হবে, যা সামাল দিতে সরকারকে আরো বেগ পেতে হবে ভবিষ্যতে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীরা এসেছেন যাঁদের সৃষ্টি অমর হয়ে আছে। যাঁদের সৃষ্টিকে হাতিয়ার করে সরকার অবধি বদল হয়েছে তার নিদর্শনও হয়তো পাওয়া যাবে।
ইতিহাস থেকে শুরু করে সাহিত্য সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে হাস্যকৌতুক শিল্পী বা বিদূষকদের ভুমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে। সম্রাট আকবর থেকে শুরু করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সকলেই এই বিদূষকদের তাঁদের দরবারে মর্যাদাপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। তাঁরা শুধু রাজা, সম্রাটদের মনোরঞ্জন করতেন না, কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য ও পরামর্শের মধ্য দিয়ে নীতি বিষয়ক সমালোচনাও করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে, বিশেষ ভাবে মোদী-শাহদের আমলে দেখা গেছে রাজার সমালোচকের বদলে স্তাবকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে আজকের দিল্লির সুলতানদের নেওয়া সিদ্ধান্তের কোনও সমালোচককেই তাঁরা আর সহ্য করেন না।
রবীন্দ্রনাথের নাটকেও এই জাতীয় চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। “আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন খেপা সে” বলে যারা মানুষকে সচেতন করার কাজটা করতেন। “মুক্তধারা” নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগীর যা ভুমিকা ছিল এখনকার সময়ে ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীদের ভূমিকা অনেকটা সেরকম।
“রণজিৎ: তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?
ধনঞ্জয় : খ্যাপাই বৈকি, নিজেও খেপি।
আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন খ্যাপা সে?
রণজিৎ: পাগলামি করে কথা চাপা দিতে পারবে না। খাজনা দেবে কি না বলো।
ধনঞ্জয়: না, মহারাজ দেব না।
রণজিৎ: দেবে না? এত বড় আস্পর্ধা?
ধনঞ্জয়: যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।
রণজিৎ: আমার নয়?
ধনঞ্জয়: আমার উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।
রণজিৎ: তুমিই প্রজাদের বারণ করো খাজনা দিতে?
ধনঞ্জয়: ওঁরা তো ভয়ে দিয়ে ফেলতেই চায়, আমি বারণ করে বলি প্রাণ দিবি তাঁকেই, প্রাণ দিয়েছেন যিনি।
নাটকের বিবেক জাতীয় চরিত্ররা কিংবা ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীরা সারা বিশ্বে চিরদিনই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে এসেছেন। বেশিররভাগ সময়েই তাঁদের বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্ষুরধার সৃষ্টি আঙুল তুলেছে ক্ষমতার দিকে। আমাদের দেশের ব্যঙ্গচিত্রের ইতিহাসও যথেষ্ট চর্চিত। আর কে লক্ষণ থেকে আজকের সময়ের মঞ্জুল নানান সময়ে এঁদের অনবদ্য সৃষ্টির মাধ্যমে বারংবার প্রশ্ন করেছেন। এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও কুট্টি, চণ্ডী লাহিড়ী বা অন্যান্য ব্যঙ্গচিত্রীরা নিশানা থেকে নিস্তার পাননি রাজ্যের রাজনীতিক বা মুখ্যমন্ত্রীরা। যে সময়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেই সময়েও এই শিল্পীদের কলম ও তুলি গর্জে উঠেছিল। ইপি উন্নি, অশোক ডোঙরে, আবু আব্রাহাম-সহ অন্যান্যদের ব্যঙ্গচিত্র আজও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। যখনই আজকে সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে যেভাবে এই সময়ের ব্যঙ্গচিত্রীদের সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখনই সেই পুরনো সৃষ্টিগুলোকে কেউ না কেউ সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন। আবারও সেই প্রশ্ন তুলে ধরা হয় তবে কি আমরা এই মুহুর্তে এমন একটা অবস্থার মধ্যে রয়েছি যাকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলে? নাহলে জরুরি অবস্থা সরকারি ভাবে ঘোষণা না করেও এই সামাজিক মাধ্যম দিয়ে সরকারের সমালোচকদের উপর সম্পুর্ণ নজরদারি করাকে কী বা বলা যায়?
কিছুদিন আগে মুনাবর ফারুকি নামে এক কৌতুক অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় শুধুমাত্র এই আন্দাজ করে যে, তিনি মুসলমান হওয়ার কারণে হয়তো বা হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে কোনও কৌতুক পরিবেশন করতে পারেন। তারপর তাঁকে বহুদিন জেলেও রাখা হয়। আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এটা কি কখনো শোনা গেছে — যে কৌতুক তিনি পরিবেশন করতে পারেন তা ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করতে পারে, সেই আন্দাজ করে কোনও মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? আসলে ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোনও ব্যক্তি যিনি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারেন, যা সহ-নাগরিকদেরও সমালোচনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে তিনি রাষ্ট্রের কাছে একজন বিপজ্জনক নাগরিক। অতএব, তাঁকে গ্রেপ্তার করা জরুরি। এমনিতেই কীভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী এবং এই সামাজিক মাধ্যমগুলোর পায়ে বেড়ি পড়ানো যায় তা নিয়ে সরকারের তরফে নতুন আইন আনা হয়েছে এবং কারা এই নতুন আইন মেনে চলছেন না, সে বিষয়ে যথেষ্ট নজরদারি রাখা হচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী জি সেভেন এর ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বলেছেন, তাঁর সরকার মত প্রকাশের অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হচ্ছে তার বিপরীত।
‘মুক্তধারা’ নাটকে রাজা ‘মারনেওয়ালার ভিতরকার মানুষ’ ধনঞ্জয়কে কারাবন্দি করেছিলেন। কারণ রাজার আশঙ্কা ছিল প্রজাদেরকে উত্তেজিত করতে পারলে সেই শিবতরাই রাজ্যের প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেন। তাই তিনি ভীত হয়েছিলেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা কি সেই একই ভয়ে শঙ্কিত? কিন্তু পারবেন তো তিনি আটকাতে? যেভাবে ‘মুক্তধারা’ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মানুষের তৈরি করা যান্ত্রিক বাঁধ সেভাবেই মানুষের জনস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে না তো সমস্ত কিছু? আপাতত ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে বিবেকী মানুষের প্রতিবাদের স্রোত বেরিয়ে আসছে আশার কথা এটাই। আপাতত বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিবাদ উঠে আসছে আশার কথা সেটাই, যারা আঙুল তুলে সরকারকে প্রশ্ন করতে পিছপা নয়, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ এই প্রতিবাদের পরিসর হয়তো সীমাবদ্ধ। সামাজিক মাধ্যমেই তা বেশি জোরালো, কিন্তু আগামী দিনে যে তা রাস্তায় নামবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
লেখক একজন প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।