মুমূর্ষুর পাশে না থাক, নিরন্নের পাশে না থাক, সহায়-সম্বলহীনের পাশে না থাক মোদী-শাহরা যে ছিলেন, সরকার যে ছিল, সরকার যে আছে তা হাড়ে হাড়ে জানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তার হিংস্রতা প্রতিহিংসাপরায়ণতায় এতটুকু মরচে পরেনি। রাজ্যের মন্ত্রীদের বিচারবহির্ভূত গ্রেপ্তার, দশদিন হেফাজতে থাকতে বাধ্য করা কিংবা রাতারাতি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে বদলির নির্দেশ জারি প্রমাণ করে সরকার আছে। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
না এভাবে হয় না। নরেন্দ্রে মোদী, অমিত শাহরা বুঝছেন না। মোদী-শাহ বুঝছেন না ভারত নামে দেশটি তাঁদের রাজ্য গুজরাট নয়। বাংলাও নয়।
সে যতই আইন মুচড়ে আধা সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার কিংবা মুখ্যসচিবকে পত্রপাঠ বদলির হুকুম দেওয়া হোক না কেন — মুখ পুড়বেই। হিন্দু জাতীয়তাবাদ আর উদারনৈতিক অর্থনীতির ককটেল গিলিয়ে দেশের সব মানুষকে একই সঙ্গে ভুলিয়ে রাখা যায় না। যাবে না। তাদের তো খেতে-পরতে হয়, রুজিরোজগার লাগে, অসুস্থ হলে ওষুধ লাগে, পথ্য লাগে। সাত বছর ধরে অর্থনীতি কেবলই খাদের দিকে গড়াচ্ছে। আমজনতার তো রামের ভরসায় বসে থাকলে চলে না।
অথচ, বিজেপি নামক দলটি আর তার আদি পিতৃপ্রতিম সংগঠন আরএসএস দেশটাকে হিন্দুত্বের কারাগারে পরিণত করতে চাইছে। এক নেতা, এক দল, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষার হিন্দুত্বের কারাগারে। ‘গুজরাট মডেল’, এখন আর উচ্চারিত হয় না ঠিকই তবে প্রকৃত অর্থে গুজরাট মডেলটিকেই মোদী-শাহ-ভাগবতরা মনে প্রাণে লালন করেন। সেই মডেলটিকে সারা দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে গত সাত বছর ধরে বিজেপি সরকারের একমুখী সংকল্প হচ্ছে — আইনসভা থেকে স্বাধীন স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, আমলাতন্ত্র থেকে পুলিশ-সেনাবাহিনী, আদালত থেকে সংবাদমাধ্যমকে হাতের পুতুল করে তোলা। সে কাজে তারা অনেকটাই সফল। বিশেষ ভাবে সংসদ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আমলাতন্ত্র, সিবিআই-এনআইএ-পুলিশ এবং সংবাদমাধ্যমের এক বৃহৎ অংশকেই কী কেন্দ্রে, কী বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে তারা সেবাদাসে পরিণত করেছে। প্রতিবাদী হলেই দল ও সরকার সমস্বরে দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী কিংবা মাওবাদী তকমা লাগায়। তকমাই তো শুধু নয় তার জন্য নিষ্ঠুর আইনগুলির শরীরে মাংসাশী পশুদের শ্বদন্তের মতো, তীক্ষ্ণ নখের মতো ধারা গেঁথে নিয়েছে। এবং তা আইনি পদ্ধতিতেই সংসদকে ব্যবহার করেই। আশির দশক থেকে এমনটাই তো গুজরাট শাসনের রণনীতি। বিপদে যখন পড়েছে তখন গণহত্যা ঘটিয়ে, গুজরাটি-হিন্দু অস্মিতা ও নিরাপত্তার নামে, আমাদের গুজরাট শ্লোগানে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের অ্যান্টি গুজরাটি, বা অ্যান্টি-ন্যাশনাল টেররিস্ট’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে।
অতিমারি ১.০ মোদী শাসনের ব্যর্থতাকে প্রকট করে ছেড়েছিল। প্রতাপমত্ত রাজারাজরাদের সমস্যা হচ্ছে ভুল স্বীকার করাকে তারা দুর্বলতা ভাবে। সে দুর্বলতা, দেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতাই যদি দেখাতে হয় তবে সাহসী-ক্ষমতাশালী-অপরাজেয় বিকাশপুরুষের পাশাপাশি সর্বভূতে বিরাজকারী ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি তিল তিল করে গড়ে তোলা কেন? পথ তো মোদী বদলালেনই না, উল্টে চরম ব্যর্থতাকে প্রচারের ঢক্কানিনাদে, অজস্র মিথ্যার পাহাড় গড়ে অতিমারি ২.০-কে একরকম আহ্বান করে আনলেন, যেন কোভিড ভগীরথ। নির্বাচন আর মহাকুম্ভের উদাহরণ তুলে সংবাদভাষ্যে তাঁকেই বলা হলো কোভিড-১৯ এর ‘মহাবিস্তারক’। চার রাজ্যের নির্বাচনে তিন রাজ্যে শোচনীয় হারের পর স্রেফ গায়েব হয়ে গেলেন মহাপ্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী। যাবতীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে, জলের মতো বিপুল অর্থ ঢেলে, প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে না পারার ব্যর্থতা বোধহয় সহজ ভাবে নিতে পারেননি মোদী। তাঁর ফোলানো, ফাঁপানো ভাবমূর্তি এক ধাক্কায় চুপসে যাওয়ায় রাগে, দুঃখে বোধহয় গোঁসাঘরে খিল দিয়েছিলেন। সেই অন্ধরাগেই কি কখনও সিবিআই, কখনও মুখ্যসচিবের বদলির ছোবল?
এদিকে, গুজরাতি, হিন্দি সংবাদমাধ্যম; দিল্লি, এলাহাবাদ, বম্বে, চেন্নাই হাইকোর্ট; পরবর্তীতে মায় সুপ্রিম কোর্ট ফালাফালা করছে কেন্দ্রীয় এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম টাইমস, গার্ডিয়ান, দ্য অস্ট্রেলিয়ান, ইকনমিস্ট, ল্যান্সেট যা কলমের ডগায় এসেছে তাই লিখেছে। যা লেখা উচিত। কেউ বলেছে, ‘অতি আত্মবিশ্বাসী, উন্নাসিক, অপদার্থ’, কেউ লিখেছে ‘ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুন’ মোদী; কেউ-বা তীক্ষ্ণ খোঁচা মেরেছে তাঁর ‘আমি-সর্বস্ব’ ভাবমূর্তিতে। ভর্তুকিযুক্ত রান্নার গ্যাসের বিজ্ঞাপন থেকে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটে যাঁর সহাস্য মুখ, সেই নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকার কোথায় বলে রব তুলে দিয়েছে দেশের জাতীয় ম্যাগাজিনগুলি। ইন্ডিয়া টুডের কভার স্টোরি ‘দ্য ফেইলড স্টেট’, আউটলুকের প্রচ্ছদ জুড়ে ঘোষণা, ‘মিসিং। নেম: গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, এজ : সেভেন ইয়ার্স, ইনফর্ম : সিটিজেনস অব ইন্ডিয়া।’ ফ্রন্টলাইনের প্রচ্ছদে মোদীর মুখের নীচে গোটা গোটা করে লেখা ‘বাংলিং বিগ টাইম’। মোদীবাদী বলে খ্যাত একগুচ্ছের চ্যানেলের সংবাদপাঠক, পাঠিকাকেও দেখা গেল বিজেপির মুখপাত্রদের দিকে বেশ কড়া কড়া প্রশ্ন ছুড়ে দিতে। বোঝা গেল, দিল্লির শ্মশানের পোড়া লাশের গন্ধ আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। অকাল মৃত্যুর ভয় গ্রাস করেছে তাঁদেরও।
দিশেহারা বিজেপি এই ‘রামের ভরসা’ ছেড়ে পালটা প্রচারে নামল। কেন্দ্রের ৩০০ আধিকারিককে নিয়ে প্রশিক্ষণ হলো কীভাবে অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়া, সমাজমাধ্যমে সরকারের সদর্থক ভূমিকা তুলে ধরা যায়। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ‘পজিটিভিটি আনলিমিটেড’ শিরোনামে আরএসএস ও বিজেপি কর্মী, নেতাদের মনোবল ফেরাতে বক্তৃতামালার আয়োজন করলেন। কেন্দ্রীয় সরকার, আত্মনির্ভর ভারত, ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার, অক্সিজেন কন্সেনট্রেটর, জীবনদায়ী ওষুধ, ভ্যাকসিনের জন্য দোরে দোরে হত্যে দিল। অন্যদিকে হঠাৎই বিহারের গঙ্গায় ভেসে উঠল লাশ। বিহার থেকে উত্তরপ্রদেশ গঙ্গায়, গঙ্গার তীরে, চড়ায় আবিষ্কৃত হলো হাজার হাজার লাশ। বানিয়ে তোলা, ফেনিয়ে তোলা সদর্থক আখ্যান চাপা পড়ে গেল লাশের পাহাড়ের নীচে। সরকার কোথায় ধ্বনি আরও তীব্র হলো। আর লুকিয়ে থাকা গেল না। দৈনিক মৃত্যুর হার সবে তিন হাজারের ঘর থেকে নেমে এসেছে, পিএম টু ডিএম ভার্চুয়াল মিটিং ডাকল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। ১৮ও ২০ মে-র দুটি মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী জেলাশাসকদের গ্রামীণ ভারতে সংক্রমণ নিয়ে সতর্ক করলেন। অথচ এপ্রিল মাসের প্রথম থেকেই মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে কোভিড-১৯ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যাওয়ার পর ঘুম ভাঙল কেন্দ্রীয় সরকারের।
সরকার কি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে ছিল? না, দিল্লির একমেবাদ্বিতীয়ম সম্রাট এবং তার প্রধান সেনাপতি সহ যাবতীয় মন্ত্রী টানা ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল তখন চার রাজ্য জয়ের অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছেন। যখন ক্ষান্ত দিলেন ততদিনে দেশটাই শ্মশানে পরিণত হয়েছে। দিল্লির প্রতিটি শ্মশানঘাটে, কবরে যখন লাশের পাহাড় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী তখন তাঁর ঘোর অপছন্দের ‘ল্যুটিয়েন দিল্লি’-র জাতীয় মিউজিয়াম, জাতীয় মহাফেজখানা, বিজ্ঞান ভবন-সহ একগুচ্ছ ঐতিহাসিক সৌধ, ঐতিহ্য ভবন গুঁড়িয়ে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’র স্বপ্নে ব্যাকুল। শত শত শ্রমিককে নামিয়ে এই ভয়াবহ কোভিড-কালে, জাতীয় গুরুত্বের তকমা লাগিয়ে গড়ে তুলতে ব্রতী তাঁর সাধের দিল্লি। আরএসএসের দিল্লি। যেখানে স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কণামাত্র চিহ্ন থাকবে না। তেরঙা জাতীয় পতাকা নয় যেখানে একদিন উড়বে হিন্দুত্ববাদীদের ভাগোয়া নিশান। কল্পনাতীত দিল্লির নয়া নিরো রাজত্বের এই ক্রুরতা, এই মনুষ্যত্বহীনতা।
মুমূর্ষুর পাশে না থাক, নিরন্নের পাশে না থাক, সহায়-সম্বলহীনের পাশে না থাক মোদী-শাহরা যে ছিলেন, সরকার যে ছিল, সরকার যে আছে তা হাড়ে হাড়ে জানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তার হিংস্রতা প্রতিহিংসাপরায়ণতায় এতটুকু মরচে পরেনি। রাজ্যের মন্ত্রীদের বিচারবহির্ভূত গ্রেপ্তার, দশদিন হেফাজতে থাকতে বাধ্য করা কিংবা রাতারাতি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে বদলির নির্দেশ জারি প্রমাণ করে সরকার আছে। সরকার আছে এটা প্রমাণ করতে দিল্লিতে পোস্টার মারার অপরাধে গ্রেফতার করা হলো ৪০ জনকে। কী লেখা ছিল পোস্টারে? লেখা ছিল, “মোদীজি আমাদের বাচ্চাদের টিকা কেন বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন?” কংগ্রেস দলের লেটার হেড নকল করে মিথ্যা খবর করে ধরা পড়ে গেলেন বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। ট্যুইটার তাঁর পোস্টে লিখে দিল বানানো খবর বা ‘ম্যানুফ্যাকচারড মিডিয়া’। রেগে কাঁই অমিত শাহ ট্যুইটারের দিল্লির দপ্তরে পুলিশ পাঠিয়ে দিলেন। কে বলে সরকার নেই!
সরকার আছে। খুলে পড়েছে তাঁর পোশাক। অতি যত্নের রাবীন্দ্রিক জোব্বাটিও। বাংলার নির্বাচনের প্রাক্কালে যে জোব্বাটি শরীরে চাপিয়ে নিয়েছিলেন।
কবিরা তো সত্যদ্রষ্টা তাঁরা সেই উলঙ্গ রাজাকে অবশেষে চিহ্নিত করতে পারলেন। রাজকোটের গুজরাটি কবিই লিখলেন, “আজকে দেশে উঠেছে আওয়াজ ‘রাজা রে তুই নাঙ্গা!’/ ল্যাংটো রাজার রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা।” (শববাহিনী গঙ্গা, কবি পারুল খক্কর। অনুবাদ: মানস সরকার ও শ্বারদ্বত মান্না।)
আজ থেকে প্রায় ৪৭-৪৮ বছর আগে বাংলার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এক শিশুকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তাঁর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায়। যখন একদল ‘ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ স্তাবক’ রাজাকে উলঙ্গ দেখেও হাততালি দিচ্ছিল, বলছিল ‘শাবাশ শাবাশ’ — সেই ‘পরান্নভোজী’, ‘কৃপাপ্রার্থী’, ‘উমেদার’, ‘প্রবঞ্চক’-দের ভিড়ে তিনি খুঁজছিলেন এক শিশুকে যে সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে বলবে — “রাজা তোর কাপড় কোথায়?” প্রায় পাঁচ দশক বাদে সেই শিশুই বোধহয় দেখা দিল কবির রূপে। বলে উঠল — “রাজা রে তুই নাঙ্গা।”
How can I financially contribute?