একচ্ছত্র আধিপত্যকামী একটি সরকার এবং তাদের এজেন্টরা আইন বহির্ভূত ক্ষমতা জাহির করা কিংবা অন্যায় প্রভাব সৃষ্টি করে আইনকে নিজের ইচ্ছাধীন করে তোলায় সিদ্ধহস্ত। এখানে সুপ্রিম কোর্ট বর্ণিত ‘খাঁচাবন্দি তোতা’ সিবিআই তাদের প্রধান হাতিয়ার। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি) সিবিআই-কে ‘প্রভুর বুলি আওড়ানো খাঁচার তোতা’ বলে র্ভৎসনা করেছিলেন। একথা সত্য যে এই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা যে কোনও যুগে, যে কোনও সরকার এবং ক্ষমতাবানদের কাছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এক হাতিয়ার হিসেবে নিন্দিত। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
একি আইনি লড়াই? আইনি লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে? নাকি কেন্দ্র বনাম রাজ্য! দেখিয়ে দেওয়ার, দেখে নেওয়ার ক্ষমতা কার কত বেশি — তারই যেন শক্তি প্রদর্শন।
সন্দেহ হয় আইন এখানে ব্রাত্য। দুর্নীতি এক অজুহাত। যে অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে একটি রাজ্য সরকারকে, বিপুল জনসমর্থনে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসা এক আঞ্চলিক সরকার এবং রাজনৈতিক শক্তিকে যারপরনাই বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলার এক কৌশল। কর্পোরেটের দানে ফুলেফেঁপে ওঠা নির্বাচনী তহবিলের প্রভূত অর্থ, আধা সামরিক বাহিনীর প্রতাপ এবং ঠুঁটো জগন্নাথে রূপান্তরিত হওয়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট বলের বন্যায় যে রাজ্যটিকে দখল করাই ছিল দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং কেন্দ্রাসীন দলটির কাছে সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত। ক্ষমতা অর্জনের লালসা এতটাই তীব্র ছিল যে, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ রাজ্যের এক জনসভায় কেবলি ভীড়, যেদিকে তাকাচ্ছেন ভীড়ে ভীড় দেখে মুগ্ধ-উল্লাসে উদবাহু, তখন তাঁর চোখে পড়েনি তাঁর রাজ্যে স্রেফ হাসপাতালের দোরগোড়ায় সার দিয়ে মানুষ দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন। রাজধানী দিল্লিতে কিংবা তাঁর সাধের নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীতে ছবিটা ঠিক একইরকম। পরিস্থিতি এমনই তীব্র হয়ে ওঠে যে নির্বাচন কমিশন কলকাতা ও মাদ্রাজ হাইকোর্টের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। মাদ্রাজ হাইকোর্ট তো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘মানুষ খুনের’ মামলা হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। যাই হোক, বাংলা জয়ের আকাঙ্ক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই প্রাণবায়ুহীন নাগরিক এবং অনির্বাণ চিতার আগুনই হয়ে উঠবে তাঁর স্বেচ্ছাচারী রাজ্যপাটের চূড়ান্ত পরিচয়। চার রাজ্যের নির্বাচনে তিন রাজ্যে প্রবল পরাজয়, দেশ জুড়ে অতিমারির প্রাবল্য সাত বছরের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতায় লাগাম পড়াবে বলে কেউ কেউ ভেবেছিলেন।কিন্তু, তিনি এবং তাঁর প্রধান সাকরেদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অতিসাধের নীতিআয়োগ দেশজোড়া অতিমারির তাড়নায় গণমৃত্যু, গণচিতা, গণকবরের দিনে স্রেফ গায়েব হয়ে গেলেন। লোপাট হয়ে গেল সরকার। রাজ্যে রাজ্যে আদালতের পর আদালত তখন নিন্দায়, র্ভৎসনায়, হুকুমের ঘা মেরে ব্যর্থ রাষ্ট্রটিকে, তার আধমরা প্রশাসনকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করে চলেছে। দিল্লি হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্টে সেই সময় সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহেতা কেন্দ্রের অন্যায় অক্সিজেন, ওষুধ নীতির পক্ষে সওয়াল গেয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ব্যর্থ হয়েছেন সে কথা ভিন্ন। কিন্তু, একটা সময় তো তাঁর মুখের কথা সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারকের কাছে, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কাছেও যেন ছিল বেদবাক্য। কোভিড ১.০ কালে যখন পথে বেরিয়ে পড়া অগনিত শ্রমিকের আশ্রয়, খাদ্য, জলের ব্যবস্থার জন্য সুপ্রিম কোর্টে কাছে এক আবেদনের জবাবে তুষার মেহেতা শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছিলেন, পথে কোনও পরিযায়ী শ্রমিক নেই। কেন্দ্র সকলের ব্যবস্থা করেছে। এই নির্জলা মিথ্যাকে মেনে আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শারদ বোবদে। প্রভাবশালী তত্ত্ব বোধহয় এখানেও খেটে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কিন্তু একটু আলাদা ঘটনাই ঘটছিল। কেন্দ্রীয় এজেন্টদের মাধ্যমে টের পাওয়া যাচ্ছিল মোদী-শাহের দাপট। ফলাফল পরবর্তী নির্বাচনী হিংসা যা অন্ততপক্ষে ২০ জনের প্রাণ নিয়েছে। নির্মম আক্রমণে আহত হয়েছেন অনেক, অজস্র বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ভাঙচুর হয়েছে যার কোনও হিসেব নেই। হয় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে, নয় আক্রান্ত হয়ে ঘরছাড়া হয়েছেন মানুষ। তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরাই এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস শুরু করে ঠিকই কিন্তু নিজস্ব প্রভাবশালী এলাকায় বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা কিছু কম খুন, কিছু কম দাঙ্গা করেননি। কিন্তু, আগুনের প্রথম ফুলকিটিই তৎপরতার সঙ্গে নিভিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল। পুলিশ-প্রশাসনের নির্বাচন কমিশনের অধীনতা নিতান্তই খোঁড়া অজুহাত। আক্রমণ যখন রাজনৈতিক, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিজয় মিছিল করে যখন একের পর এক আক্রমণ হয়েছে, তখন রাজনৈতিক নির্দেশেই তা বন্ধ করা যেত। শপথ গ্রহণ অবধি অপেক্ষা করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কী নবান্নের, কী জেলায় জেলায় পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তাও ছিল ভয়ংকর রকম প্রকট। সম্ভবত প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় অনেকেই, বিশেষভাবে যাঁরা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা বোধহয় শেষ মুহূর্তের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তল্পিতল্পা গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
অতঃপর, শপথ গ্রহণের আগের রাতেই উঠল রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি। ট্যুইটে ট্যুইটে রাজ্যপালের ‘দেখে নেব’ জাতীয় হুঙ্কার। রাজ্যপালকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন। শপথের মতো এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে যাবতীয় সৌজন্য, ভদ্রতা, সভ্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে শপথ মঞ্চে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রাজ্যপালের জ্ঞানদান থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্ত্রকের প্রতিনিধি দল পাঠানো এবং রাজ্যপালের জেলায় জেলায় বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে শুধুমাত্র আক্রান্ত বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছনো প্রমাণ করে পরাজয়ের আঘাত মোদী-শাহদের কোথায় বেজেছে। এতই তার তীব্রতা যে, বিজয়ী দলের নেত্রীকে ট্যুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ট্যুইটে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী কিংবা তাঁর দল উহ্য রয়ে গেল। অভিনন্দন পেলেন রাজ্যবাসী। শপথের আগেই অবশ্য তড়িঘড়ি দুই মন্ত্রী -সহ তৃণমূলের তিন বিধায়ক এবং এক প্রাক্তন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল এবং আদালতে মামলা শুরু করার অনুমতি নিয়ে নিয়েছিল সিবিআই। অধ্যক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি সিবিআই আধিকারিকরা।
১৭ মে গ্রেপ্তার হলেন দুই মন্ত্রী। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, সঙ্গে বিধায়ক মদন মিত্র। এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। যে গ্রেপ্তার এবং কলকাতা হাইকোর্টের ভূমিকা নিয়ে ১৮ মে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং ওয়েব পোর্টাল দ্য লিফলেটে বাজিয়ে দেবেন ‘পাগলা ঘন্টি’, “আমি সতর্ক করতে চাইছি যে, আইনের শাসনের মৃত্যু আগতপ্রায়। যখন আইনের কার্যপ্রণালীকে অগ্রাহ্য করা হয়, (তখন) খুলে যায় স্বেচ্ছাচারিতার সিংহদুয়ার, যা দেখা গেল কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিকতম রায়ে।” কলকাতা হাইকোর্টের নারদা বিষয়ক রায় এবং বিশেষভাবে এই মামলায় উচ্চ আদালতের অনুসৃত রীতিপদ্ধতির সমালোচনায় মুখর এক নিবন্ধ এভাবেই শুরু করেন প্রবীণ আইনজীবী। (Raising an alarm-This is not procedure established by Law – by Indira Jaising)
১৭ তারিখ সকাল থেকে যাবতীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তিনি লিখছেন, সাড়ে ন’টা নাগাদ ধৃত চারজনকে নিয়ে আসা হয় সিবিআই দপ্তরে। এর পর মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই দপ্তরে চলে যান। বাইরে শুরু হয় তুমুল অশান্তি। এরকম এক সময় ‘প্রভাবশালী’ সলিসিটার জেনারেল (এসজি) তুষার মেহেতা এক ই-মেলে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে এই ঘটনা জানিয়ে লিখলেন, আদালত বিষয়টি দেখুক এবং মামলায় যাতে বাধা না পড়ে। এটি চিঠি মাত্র। কোনও এফিডেভিট নয়। সাড়ে এগারোটায় হাইকোর্ট ‘প্রশাসনিক বিষয়’ বলে হস্তক্ষেপ করেনি। হঠাৎ দুপুর আড়াইটে নাগাদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করে বসলেন এবং শুনানির সময় ধার্য হলো সন্ধে ছ’টা। এদিকে সিবিআই কোর্টেও শুনানি শুরু হয়ে গিয়েছে। ৬.৪৫ নাগাদ আদালত জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন। ৭.১৫ নাগাদ সইসাবুদ পর্ব শেষ হয়। ওদিকে সমান্তরালভাবে কলকাতা হাইকোর্টেও চলছে সওয়াল জবাব। সলিসিটার জেনারেল কোনও এফিডেভিট ছাড়াই ফের মৌখিক ভাবে আবেদন করলেন মামলাটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। ৭.৪৫ পর্যন্ত এই চলল। হাইকোর্টে জামিনের খবর পৌঁছতেই আবারও জামিনের রায় স্থগিত করার মৌখিক আবেদন করে বসলেন সলিসিটার জেনারেল। শুনানি স্থগিত করে চেম্বারে ফিরলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সিবিআই আদালতের নির্দেশের পরেও ছুতোনাতায় আটকে রাখা হলো চারজনকে। সাড়ে দশটায় ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিল জামিন স্থগিত।
আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তুলেছেন:
(১) হাইকোর্ট কেন সাড়ে এগারোটায় এসজির আবেদন শুনতে চাইল না। এবং কেন মত পরিবর্তন করে দুপুর দুটোয় এমন এক মামলা গ্রহণ করল যা এক ই-মেল মাত্র, সঙ্গে কোনও এফিডেভিট নেই।
(২) কেন আদালত সাড়ে এগারোটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত কোনও লিখিত আবেদন পেশ করতে বলল না? আইনশৃঙখলার সমস্যা বিস্তারিত ভাবে জানিয়ে আবেদন জমা দেওয়ার যথেষ্ট সময় ছিল।
(৩) হাইকোর্ট কি জানত না, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৭ ধারা অনুযায়ী কোনও মামলা স্থানান্তরিত করতে হলে তা সিঙ্গল বেঞ্চে করতে হয়?
(৪) নিম্ন আদালত সমস্ত কারণ দর্শিয়ে জামিনের যে রায় দিয়েছে। কোনও আবেদন ছাড়াই কেন উচ্চ আদালত তার উপর স্থগিতাদেশ দিল? আবার এই স্থগিতাদেশের মামলাও তো হওয়া উচিত সিঙ্গল বেঞ্চে।
(৫) কেন স্থগিতাদেশ? মন্ত্রীস্থানীয় অভিযুক্তরা কি পালিয়ে যাবেন? কেন লিখিত আবেদন জমা দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো না। (প্রসঙ্গত, বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের কোনও নোটিশ দেওয়া হয়নি। হাইকোর্টে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল। কিন্তু, মামলাটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়। চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে।) ২০১৭ সাল থেকে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য এত তাড়াহুড়ো কিসের?
(৬) মুখ্যমন্ত্রীর সিবিআই অফিসে উপস্থিতিই যদি আদালতের কাছে একমাত্র বিষয় হয়ে ওঠে, তবে তো সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করলেই হতো। স্থগিতাদেশ জারির কোন প্রয়োজন ছিল?
ইন্দিরার মতে, “ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ৪০৭ ধারার এই মামলাটি সিঙ্গল বেঞ্চে না পাঠিয়ে নিজে নোটিশ জারি করে নিজের কাছে রেখে দিলেন। এ হলো মৌখিক আবেদনের ভিত্তিতে এক রিয়েল টাইম আইনি-ব্যবহারশাস্ত্র। আইনবিজ্ঞানের এক নতুন ফর্ম।” তাঁর বিস্ময়জড়িত প্রশ্ন, “এ যদি আইনের শাসনের মৃত্যু না হয় তবে আমি জানি না এটা কী! এখন আমাদের সংবিধানের ২১ ধারাকে মনে করতে হবে। স্বীকৃত আইনি পদ্ধতি ছাড়া কোনও ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। হাইকোর্টে যা হয়েছে তা আইনসিদ্ধ কার্যপদ্ধতি নয়।”
এমনটাও যে হতে পারে তার অবশ্যই একটা প্রেক্ষিত রয়েছে। একচ্ছত্র আধিপত্যকামী একটি সরকার এবং তাদের এজেন্টরা আইন বহির্ভূত ক্ষমতা জাহির করা কিংবা অন্যায় প্রভাব সৃষ্টি করে আইনকে নিজের ইচ্ছাধীন করে তোলায় সিদ্ধহস্ত।
একচ্ছত্র আধিপত্যকামী একটি সরকার এবং তাদের এজেন্টরা আইন বহির্ভূত ক্ষমতা জাহির করা কিংবা অন্যায় প্রভাব সৃষ্টি করে আইনকে নিজের ইচ্ছাধীন করে তোলায় সিদ্ধহস্ত। এখানে সুপ্রিম কোর্ট বর্ণিত ‘খাঁচাবন্দি তোতা’ সিবিআই তাদের প্রধান হাতিয়ার। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা (পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি) সিবিআই-কে ‘প্রভুর বুলি আওড়ানো খাঁচার তোতা’ বলে র্ভৎসনা করেছিলেন। একথা সত্য যে এই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা যে কোনও যুগে, যে কোনও সরকার এবং ক্ষমতাবানদের কাছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এক হাতিয়ার হিসেবে নিন্দিত। কিন্তু, কোনও সরকারই এমন নিষ্ঠুর ও নৃশংস উপায়ে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে — সিবিআই, এনআইএ, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স — বিরোধী দল, সমালোচক, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, আন্দোলনগুলির বিরুদ্ধে শিকারি কুকুরের মতো লেলিয়ে দেয়নি, যা গত সাত বছর ধরে লাগামহীন ভাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার করে চলেছে। পাশাপাশি ২০১৯ সালে জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এনআইএ (সংশোধনী) আইনের সাহায্যে এই সংস্থাটির হাতে তদন্ত ও মামলা দায়েরের বিপুল ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস লোকসভায় যে সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছিল, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে। এনআইএ এখন যে কোনও রাজ্যে বহু বিষয়েই স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত করতে পারে। এমনকি গরু কিংবা নারী পাচারেরও। স্রেফ জুড়ে দিতে হবে যে, পাচারের অর্থ সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যাচ্ছে। তাদের আধিকারিকদের ক্ষমতা, যে কোনও রাজ্যের পুলিশ আধিকারিকদের সমান। এবং ‘তফসিলভুক্ত অপরাধ’ -এর বিচারের জন্য এখন কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনও সেশন কোর্টকে স্পেশাল এনআইএ কোর্টে পরিবর্তন করতে পারে।
একই ভাবে এই ২০১৯ সালেই ইউএপিএ সংশোধন করে যে কোনও ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা আইন। যে কোনও ধরনের বিরোধী মতামত গুঁড়িয়ে দিতে এই আইনগুলির যথেচ্ছ অপব্যবহার চলছে। এবং শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, বিজেপি শাসিত প্রতিটি রাজ্যের কাছেই ইউএপিএ বা এনআইএ নিপীড়নের প্রধান হাতিয়ার। শুধু তো আইন নয়, নির্বাচন কমিশনের মতো দেশের প্রতিটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানই আজ অপ্রিয় প্রশ্নের মুখে। তাদের নানা সিদ্ধান্তই শুধুমাত্র বিরোধী রাজনীতিক নয় উচ্চ আদালতেরও তীব্র র্ভৎসনার মুখে পড়ছে। সাম্প্রতিক অতীতে দেশের শীর্ষ আদালত এবং তার নানা রায় এবং বিভিন্ন মামলায় বিচারপতিদের ভূমিকা আর কখনোই প্রাক্তন বিচারপতি কিংবা প্রবীণ আইনজীবীদের এমন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েনি। আদালত অবমাননার ঝুঁকি নিয়েও কোনও কোনও আইনজীবী বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শারদ বোবদে ঠিক অবসরের আগমুহূর্তে বিভিন্ন হাইকোর্টে চলতে থাকা অতিমারি সংক্রান্ত মামলাগুলি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে গ্রহণ করলে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন। প্রথিতযশা আইনজীবীরা লিখিত ভাবে এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেন। এমনকি পালটা মামলাও ঠুকে দেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য প্রধান বিচারপতি বোবদে জানান, হাইকোর্টের মামলা সরিয়ে নেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না। কোনও কোনও প্রধান বিচারপতি কিংবা বিচারপতিরা যে এক বড় অংশের নবীন ও প্রবীণ আইনজীবীদের বিশ্বাস হারিয়েছেন এই ঘটনা এবং এমন আরও কিছু ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়। কলকাতা হাইকোর্টের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যেই ইন্দিরা জয়সিং-দের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নজির দেখিয়ে তিনি বলেছেন, জেল নয় বেলই হলো স্বাধীনতা বা মুক্ত বিচারপ্রণালীর মৌলিক নীতি। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের সূত্রে বলা যায়, কলকাতা হাইকোর্টের ভূমিকায় সেই মৌলিক নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। এর পর উচ্চ আদালত যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার শেষ উপায়স্থল, সেই বিশ্বাসে চিড় ধরলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।