ছত্তিশগড়ে সিআরপিএফ-এর গুলিতে খুন তিন আদিবাসী, আহত আঠেরো, পুলিশ হেফাজতে আট


  • May 20, 2021
  • (0 Comments)
  • 2808 Views

ছত্তিশগড়ে আবার রাষ্ট্রের হাতে আতঙ্কবাদ দমনের নামে আদিবাসী হত্যা। যখন দেশের মানুষ অতিমারী, অনাহার, বেকারত্ব, ত্রাস ও সরকারি অব্যবস্থার শিকার, তখনও এই মিথ্যাবাদী অকর্মণ্য অত্যাচারী সরকার আদিবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে সশস্ত্র সুরক্ষা বাহিনীর ক্যাম্প তৈরি করতে ব্যস্ত। প্রতিবাদের জবাব – গুলি ও গ্রেপ্তার। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

গত এক বছরে ছত্তিশগড়ের বস্তারের বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র সুরক্ষা বাহিনীর প্রায় ২০টি ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। আদিবাসী মানুষদের মাওবাদী সন্দেহে সর্বদা নজরদারির আওতায় রাখার জন্য এবং তাদের উপর যথেচ্ছ দমন-পীড়ন চালানোর জন্য বস্তারের মতো এলাকায় বহু বছর ধরেই সরকার এই পদ্ধতি অবলম্বন করছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় যখন সারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারতও কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত, দেশের নাগরিকেরা মহামারীকালীন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছেন, জীবন-জীবিকা বিপন্ন, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কার্যত ভেঙে পড়েছে, শ’য়ে শ’য়ে মানুষ স্রেফ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন – তখন সেই অবস্থা সামলাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ সরকার আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমির অধিকার ক্ষুণ্ণ করে তাদের গ্রামেই সশস্ত্র সুরক্ষা বাহিনীর ক্যাম্প তৈরি করে যাচ্ছে।

 

সুরক্ষাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের স্পট

 

গত ১৩ মে ছত্তিশগড়ের বীজাপুর ও সুকমা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সশস্ত্র সুরক্ষা বাহিনীর একটি নতুন ক্যাম্প বসানো হয়। প্রথম দিন থেকেই এই এলাকার আদিবাসী মানুষেরা – সংখ্যায় তাঁরা প্রায় ৫০০০ জন – সঙ্ঘবদ্ধভাবে এই ক্যাম্পের সামনে প্রতিবাদ দেখাতে শুরু করেন। এমন অভিযোগও উঠে এসেছে যে কোনও এক গ্রামবাসীর জমির উপরেই তৈরি হয়েছে এই ক্যাম্প। যেখানে ক্যাম্প তৈরি হয়েছে, সেই এলাকা সংলগ্ন একটি রাস্তা বন্ধ করা হয় ও সেই রাস্তা নির্মাণের সময়ে যাতে সুরক্ষাবাহিনীর অফিসারদের মাওবাদী হামলা থেকে নিরাপদ রাখা যায়, তার জন্যই এই ক্যাম্পের প্রয়োজন – এমনটাই প্রশাসনিক সূত্রে প্রচার করা হতে থাকে। ক্যাম্পটি চালু হওয়ার পর থেকে ৫০০০ গ্রামবাসী প্রতিদিন নিয়মিতভাবে এসে এর বিরোধিতা করছিলেন। কিন্তু ১৭ মে যখন আদিবাসীরা প্রতিবাদ করতে শুরু করেন, তার কিছুক্ষণ পরেই সুরক্ষাবাহিনী বেপরোয়া গুলি চালাতে শুরু করে। এই ঘটনায় তিন জন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক ও অন্য গ্রামবাসীরা এরপরে জানান যে শুধু এই তিন জনই নন, মোট ন’জন গ্রামবাসী মারা গিয়েছেন পুলিশের গুলিতে, আঠেরো জন আহত হয়েছেন এবং ছ’জন নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হয়েছিল এই ছ’জনকেও হত্যা করা হয়েছে। পরে জানা যায়, নিখোঁজ নন, আট জন গ্রামবাসী আটক রয়েছেন পুলিশি হেফাজতে।

 

নীচের টুইটার লিঙ্কে সাংবাদিক আশুতোষ ভরদ্বাজ তুলে ধরেছেন আদিবাসী মিছিলে গুলি চলার মুহূর্তটি।

 

প্রতিবাদরত গ্রামবাসীদের উপর গুলিচালনার ঘটনার পরে আই জি পুলিশ প্রশাসনের তরফে প্রথমে যথারীতি জানানো হয় যে, গ্রামবাসীদের মধ্যে নকশালরা লুকিয়ে ছিলেন এবং গ্রামবাসীদের সামনে রেখে তারাই সুরক্ষাবাহিনীর উপরে হামলা চালায় – ফলে আত্মরক্ষার্থেঈ নাকি সুরক্ষাবাহিনীকে গুলি চালাতে হয়। যদিও এই ঘটনার যে ভিডিও ও ছবি সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে, বিনা প্ররোচনায়, কোনওরকম আক্রমণ ছাড়াই প্রতিবাদকারী গ্রামবাসীদের ভিড়ের উপরে বেলাগাম গুলি চালায় বাহিনী। গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক মহিলা ও কিশোর-কিশোরীও ছিলেন। গ্রামবাসীরাও স্পষ্ট জানিয়েছেন যে কেবলমাত্র তারাই প্রথম দিন থেকে প্রতিবাদ করছিলেন, কোনও নকশাল আন্দোলনকারী সেখানে কোনওদিনই ছিলেন না। তাঁরা নিজেরা ক্যাম্প চান না, কারণ সেখান থেকে মহিলাদের হেনস্থা, পুরুষদের সঙ্গে মারপিট ইত্যাদি ঘটতে থাকে। অর্থাৎ ক্যাম্প মানেই আদিবাসী গ্রামবাসীদের উপর হেনস্থা ও অত্যাচার। প্রাপ্ত ভিডিও ও ছবিতে দেখা যাচ্ছে আহতদের আঘাত গুরুতর, হাত-পা-মাথায় গভীর চোট রয়েছে। গুরুতর আহতদের কয়েক জনকে মূলত স্থানীয় সাংবাদিকদের উদ্যোগেই পরে বিজাপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যদিও, এসব সত্ত্বেও সরকার ও প্রশাসন সমানেই বলে চলেছে, নকশালী আক্রমণ ঠেকাতেই তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।

 

গুলিতে আহত আদিবাসীরা; খাটিয়ায় শুয়ে আহতরা; মৃতদের পরিবারবর্গ; তিন আদিবাসী কিশোর যাদের মধ্যে একজন গুলিতে মৃত

 

মনে রাখা দরকার গত ৩ এপ্রিল ছত্তিশগড়ে পুলিশ কর্মীদের উপর হামলায় ২২ জন পুলিশ আধিকারিক মারা যান। তারপরেই কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্‌ রাজ্য পরিদর্শনে গিয়ে বলেন এর বদলা নেওয়া হবে। ঝাড়খন্ডের স্বাধীন সাংবাদিক রূপেশ কুমার সিং, যিনি নিজে নকশাল হওয়ার মিথ্যে অভিযোগে জেলবন্দী ছিলেন, তিনি এই ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, “আপনারা খেয়াল করে দেখবেন, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সরকার গঠনের আগে বলেছিল, নকশালদের সঙ্গে তারা শান্তিবার্তা নিয়ে আলোচনায় বসবে। কিন্তু সরকার গঠনের এতদিন পরেও তাদের তরফে কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। আর এখন তো এই কথা হাওয়ায় ভাসছে যে কেন্দ্র সরকারের এজেন্ট হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মুকেশ বাঘেল কাজ করছেন। তিনি নিজে একথা বলেওছিলেন যে, কেন্দ্রের সঙ্গে একজোট হয়ে আমরা এখানে নকশালবাদকে শেষ করে দেব। আমি সেইজন্য স্পষ্টভাবেই বলি ও লিখি যে, এখানে আদিবাসীদের দমন-পীড়নে বিজেপি-কংগ্রেসের অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে অপারেশ গ্রীন হান্ট কংগ্রেসেরই করা; আমাদের ঝাড়খন্ডেও আদিবাসীদের উপর কংগ্রেসের শোষণের অনেক উদাহরণ আছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হল, এই ঘটনা নিয়ে বামপন্থী দলগুলি কোনও বিবৃতিই দেয়নি। সমাজবাদী পার্টি, কংগ্রেস বা লিবারেল নেতৃত্বর বক্তব্যও শোনা যায়নি। ছাত্র-যুব সংগঠন, কৃষক সংগঠন, মজদুর সংগঠন, মহিলা সংগঠন বা বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকেও কোনও বিবৃতি আসেনি। সেনা বা পুলিশ-প্রশাসনের উপর আক্রমণ হলে সবাই সরব হয় আর আদিবাসীদের হত্যা কি হত্যা নয়? তাঁদেরও জীবনের অধিকার রয়েছে।”

 

প্রতিবাদে শামিল গ্রামবাসীরা, যাদের মাওবাদী বলে দাগাবার চেষ্টা করে রাষ্ট্র

 

এদিনের গুলি চালনার ঘটনার পরে স্থানীয় সাংবাদিকদের মারফত জানা গেছে, গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে পিছু না হটে আবারও প্রতিবাদে শামিল হতে প্রস্তুত। কিন্তু তারা যাতে বাড়ি থেকেই বেরোতে না পারেন, তারা জন্য প্রচুর সংখ্যায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ছত্তিশগড়ের ভূমকাল সমাচার সংবাদপত্রের সম্পাদক কমল শুক্লার তৎপরতায় ১৮, ১৯ তারিখ ট্যুইটার-এ #বস্তার_মে_নরসংহার_বন্ধ_হো ট্রেন্ড করছিল। তিনি জানালেন “ প্রশাসন সাংবাদিকদের সহায়তায় আহতদের বীজাপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করেছে। যারা আটক রয়েছে তাদের মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানাচ্ছে। এভাবে আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদ আটকানোর চেষ্টা করছে পুলিশ প্রশাসন।” জানা যাচ্ছে, আন্দোলন বন্ধ করে দিতে হবে এই শর্তে আটক আট জন গ্রামবাসীকে মুক্তি দেওয়া হবে – এমনটা জানিয়েছেন, বীজাপুরের কালেক্টর।

 

সোনি সোরি, লিঙ্গারামের মতো আদিবাসী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের কার্যত নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে, প্রশাসনের তরফ থেকে আন্দোলনস্থলে পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমির অধিকার রক্ষায় লড়ে যাওয়া এই নেতৃবৃন্দ আন্দোলনস্থলে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর। ঘটনার পরদিন ১৮ তারিখ স্থানীয় ভূমকাল সমাচার সংবাদপত্রের ডাকা এক অনলাইন আলোচনায় উপস্থিত হয়ে সোনি সোরি জানান, “সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আদিবাসী মানুষেরা। গ্রামবাসীরা। কোনও পক্ষই এটা জানতে আগ্রহী নন যে তাঁরা কি চান। অথচ তাঁদেরই বারেবারে প্রাণ যাচ্ছে, মারাত্মক আহত হচ্ছেন। জমি-বাড়ি সব চলে যাচ্ছে। জঙ্গলের উপরে অধিকার হারিয়ে ফেলছেন। একদিকে রাষ্ট্র, প্রশাসন তাঁদের উপর শোষণ-দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, অন্যদিকে নকশালরাও আন্দোলন চালাচ্ছেন। এই দুইয়ের মাঝে আদিবাসীরাই বিপন্ন। শান্তিবার্তা নিয়ে কথা উঠলে তাহলে দু’পক্ষকেই তা মানতে হবে। কেন গ্রামসভা ডাকা হচ্ছে না? গ্রামসভা ডেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া তো আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার। তা থেকে কেন তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে? আদিবাসীদের জীবন ও জল-জঙ্গল-জমির অধিকারের দাবিতে লড়াই, আন্দোলন জারি থাকবে।” এদিনের আলোচনায় এই বক্তব্যও স্থানীয় সমাজকর্মীদের মধ্যে থেকে উঠে আসে যে, আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকেই যেহেতু কৃষিজীবী রয়েছেন ও ক্যাম্প হওয়ার ফলে তাঁদের কৃষি ব্যহত হচ্ছে, সুতরাং বৃহত্তর কৃষক অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে এই প্রতিবাদকে যুক্ত করে, একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের সঙ্গেও যুক্ত করা প্রয়োজন।

 

প্রতিবাদী আদিবাসীদের জমায়েত

 

আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের মোতায়েন করা সেনার মধ্যে ছত্তিশগড় ও ঝাড়খন্ডে বিরোধের সম্পর্ক নতুন নয়। কিন্তু গত ১৭ তারিখের ঘটনা নতুন করে এক্ষেত্রে উত্তেজনা ছড়িয়েছে কারণ দিনের আলোয়, প্রায় পাঁচ হাজার গ্রামবাসীর উপর এমন যথেচ্ছ গুলি চালনার ঘটনা অনেক দিন পরে ঘটল। গুলি চালনার ফুটেজ থেকে বোঝা যাচ্ছে, শুধু ভয় দেখানো নয়, হত্যা বা আহত করাই পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল। ভূমকাল সমাচার সংবাদপত্রের সম্পাদক জানিয়েছেন, ঘটনার এক-দু’দিনের মধ্যে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পে পৌঁছে আন্দোলন শুরু করতে না পারলেও সংবাদ প্রকাশে তাঁরা আরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং আরও বেশি সংখ্যায় প্রতিবাদে শামিল হওয়ার উদ্যোগও নিচ্ছেন। দেশ যখন মহামারীর সঙ্গে যুঝছে, তখন রাষ্ট্র ও প্রশাসন প্রান্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়কে এভাবেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মূলস্রোতের সংবাদপত্রে রাষ্ট্রের সেনার হাতে নাগরিকের এই হত্যা ও আহত হওয়ার এই ঘটনা ‘খবর’ হয়ে ওঠে না।

 

ছবি – গৌরী লঙ্কেশ নিউজ, দা কুইন্টভূমকাল সমাচার ইত্যাদি

Share this
Leave a Comment