অতিমারিই হোক কিংবা অন্য কোনও অতিবিপর্যয় শুধুই কি তা বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা আইনের মতো অতিআইন, পুলিশ-প্রশাসনের চোখ রাঙানিতে মোকাবিলা করা যায়? অসুস্থ মানুষ কড়া ওষুধ আর চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির তলার শরীর পেতে দিলেই কি সুস্থ হয়ে যায়? সেবা লাগে, শুশ্রূষার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় সেবিকার স্পর্শ, সেবিকার মন। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
এই তো ক’দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “একদম লকডাউন করলে আর লোকে খেতে পাবে না। অনেক গরিব মানুষ আছেন, যাঁরা দিন আনেন দিন খান। তাঁদের কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।” সংবাদপত্র তো এমনই লিখল। যদিও, সকাল-বিকেলে ঘণ্টা পাঁচেকের জন্য উড়েঘুরে বেড়ানোর ছাড় পেয়েছিল মানুষ। গাড়িঘোড়া চলছিল। তবে, লোকাল ট্রেন বন্ধ হলো পুরোপুরি। লোকালে কি গরিবগুর্বো চড়ে? কী জানি! সরকার যে মনে করছে না তা সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট। আর এমন প্রশ্ন করাও যাবে না। গ্লোবালায়িত সরকারি নীতি নির্ধারক আমলারা তো সেই বরফ কঠিন হিমেল মেরুদেশের বাসিন্দা। কিংবা, লর্ড জর্জের ভাষায়, সেই ‘ইস্পাতের খাঁচা’ (স্টিল ফ্রেম) যার মধ্যে সরকার এবং প্রশাসনের সম্পূর্ণ অবয়বটি স্থিত। তো কে প্রশ্ন করবে এই শ্লাঘ্য সিস্টেমকে? এবারও তো মুখের উপর ঘরঘর করে নামিয়ে দেওয়া হলো শাটার। বনধ। চাক্কা বনধ। ঝাঁপ বনধ। একেবারেই কম্বল চাপা দিয়েই ছাড়ল সরকার। যেন বলল, যাও পেটে কিল মেরে শুয়ে থাক।
আম-জনতা থেকে ভোকাল নেটিজেনরা এই হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। বিগত বছরের ২৪ মার্চের কথা স্মরণ করছেন তাঁরা। ৪ ঘণ্টার নোটিশে দেশজোড়া লকডাউনের সঙ্গে রাজ্যের এই আচমকা লকডাউনের তুলনা করছেন। বলা হয় জনগণের স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। মিথ্যা নয় তা। সত্যি হলে তাঁদেরও মনে পড়ত, ২৪ মার্চের ঢের আগেই রাজ্যে রাজ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল লকডাউন। এ রাজ্যেও। পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাব, গত বছর ১৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ২২ মার্চ ইউনিয়ন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যই লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একমত হয়। এর পরপরই কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ৭৫টি জেলায় পূর্ণ লকডাউনের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে পরামর্শ দেয়। এ-রাজ্যের ক্ষেত্রে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় পূর্ণ লকডাউনের পরামর্শ দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার সে পরামর্শ শুধু মান্য করেনি, কয়েকশো যোজন এগিয়ে, ২৩ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ কলকাতা-সহ রাজ্যের ছোট-বড় সমস্ত শহর এবং প্রত্যেকটি জেলার বেশ কিছু অংশ জুড়ে চারদিনের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা – যাকে ‘মিনি লকডাউন’ বলা যেতে পারে – জারি করে বলে ‘ঘরে থাকুন’। একরাত কাটতে- না-কাটতেই, ‘পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ওইদিন অর্থাৎ, ২৩ মার্চ বিকেল পাঁচটা থেকে সারা রাজ্যকেই লকডাউনের আওতায় আনা হলো এবং ২৭ তারিখের বদলে তা বাড়িয়ে দেওয়া হয় ৩১ মার্চ পর্যন্ত। শুধুমাত্র এ-রাজ্য নয় ২২মার্চ থেকে এক এক করে দেশের ৩২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ততদিনে পূর্ণ লকডাউন কিংবা রাজ্য জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২৪ মার্চ রাত আটটায় ২১ দিনের জন্য দেশজোড়া পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। ওইদিন রাত ১২টা থেকে শুরু হয় লকডাউন। কোনও রাজ্যই সেই সময় এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেনি। সম্ভবত স্বস্তি পেয়েছিল এই ভেবে যে, অতিমারির দায়, লকডাউনের দায়িত্ব আর তাদের উপর বর্তাবে না।
অতীতের কথা থাক। প্রশ্ন হলো ১০ দিনের মধ্যে রাজ্য সরকার এমন ৫৬” সিদ্ধান্ত নিতে গেল কেন? একথা সত্যি সংক্রমণ বাড়ছিল। আট দফা নির্বাচনের প্রতি দফায় তা বিপুল হারে বাড়ছিল। ২৭ মার্চ প্রথম দফায় সংক্রমণের দৈনিক হার যেখানে ছিল ৬৪৬, সেখানে অষ্টম দফায় ২৯ এপ্রিল তা গিয়ে হয় ১৭,৫১২। ৫ মে জারি হলো বিধিনিষেধ। লোকাল ট্রেন বন্ধ হলো, হাট-বাজার খোলা রাখা হলো সকালে-বিকেলে পাঁচ ঘণ্টা। সেদিন সংক্রমণের হার ছিল ১৭,৬৩৯। ১০ মে সোমবার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে যেদিন গরিবের কথা ভেবে ‘একদম লকডাউন’-এর বিরুদ্ধেই মত দিলেন মুখ্যমন্ত্রী সেদিন রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৯,৪৪৫। আর ১৫ মে রাজ্যব্যাপী লকডাউন ঘোষণার দিন দৈনিক সংক্রমণের হার ছিল ১৯, ৫১১। ১০ মে যে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘লকডাউনের মতো আচরণ দরকার’ পুরোপুরি লকডাউন নয়, জমায়েত না-করে ঘরে ঘরে ঈদ পালনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, পাঁচ দিনের মাথায় সেই নীতি বদলে গেল কোন রহস্যময় কারণে? এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন। কিংবা তাঁর উপদেষ্টারা।
চিকিৎসক, ভাইরোলজিস্ট এবং সান্ধ্য চণ্ডীমণ্ডপের হরেক কিসিমের মারি-অতিমারি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শিরোধার্য করেই না-হয় মেনে নেওয়া গেল যে সংক্রমণ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়া রুখতে এই লকডাউন জরুরি ছিল। যার ফলে যানবাহনে, বাজার-হাটে, অফিস-কাছারি আর কল-কারখানায় শারীরিক দূরত্ব বাধ্যতামূলক ভাবে বাড়বে। ফলত, সংক্রমণ কমে আসবে। দ্বিতীয়ত, এই সুযোগে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোটিও বাড়িয়ে তোলা যাবে। পরিকাঠামো বৃদ্ধির কথা বাদ দিন, ওসব শুনলে ময়দানের বেতো খচ্চরগুলোও হাসে। কিন্তু, যে কথা বলা হলো না, এই ১৫ দিন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কী হবে! কোভিড ১.০ এর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এভাবে অর্থনীতির চাকা রুদ্ধ করে দিলে কী হয়। এই যে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলা হলো – বাড়ি যান, ১৫ দিন পরে দেখা যাবে। যাওয়ার আগে ১৫ দিনের মাইনেটা হাতে পেয়েছিল শ্রমিক-কর্মচারীরা। ১৫ দিন বন্ধ থাকার পর এই মে মাসের পুরো বেতন পাবেন দোকান কর্মচারী, ছোট ছোট কলকারখানার শ্রমিকেরা। মাসের মাঝখানে এভাবে সব অর্থনৈতিক কাজকর্মে দাঁড়ি টেনে দিলে মানুষগুলো কোন মুখে বাড়ি ফিরলেন? কী হাতে বাড়ি ফিরলেন? একে তো লোকাল ট্রেন বন্ধ, তার উপর মাঝারি হোক কিংবা দূরপাল্লার বাস ৫০ শতাংশই বন্ধ। একবার ভাবা উচিত ছিল না এই মানুষগুলোর বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থার কথা? অতিমারিই হোক কিংবা অন্য কোনও অতিবিপর্যয় শুধুই কি তা বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা আইনের মতো অতিআইন, পুলিশ-প্রশাসনের চোখ রাঙানিতে মোকাবিলা করা যায়? অসুস্থ মানুষ কড়া ওষুধ আর চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির তলার শরীর পেতে দিলেই কি সুস্থ হয়ে যায়? সেবা লাগে, শুশ্রূষার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় সেবিকার স্পর্শ, সেবিকার মন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলদের জন্ম হয় এই যুদ্ধ ক্ষেত্রেই। যদিও অতিমারিকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করাটাই এক যুদ্ধবাজ মদ্দাটেপনা। সে তুলনায় কোথাও নেই সেই সেবার দয়া, কোথাও নেই সেই সেবিকার সমানুভূতি। সমানুভূতি দূরে থাক, কতদূর সংবেদনহীন, বোধহীন হতে পারে এই ইস্পাতের খাঁচায় পোরা লোকগুলো যে বলে দিতে পারে, টিকা নিতে হলে গাড়িঘোড়া জোগাড় করে নিতে হবে। অর্থাৎ, যাঁদের গাড়ি আছে তাঁরাই টিকা কেন্দ্রে যেতে পারবেন।
কোভিড ১.০ এবং অপরিকল্পিত লকডাউনের ধাক্কায় অসুস্থ, রুগ্ন অর্থনীতির নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। সবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল দেশ। এক অহংমন্য, আত্মরতিমগ্ন প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে তা আবার ধসে পড়তে শুরু করেছে। রাজ্যে রাজ্যে স্থানীয়ভাবে লকডাউনের জেরে এপ্রিলে কাজ হারিয়েছেন ৭৫ লক্ষ শ্রমিক। ওই একই মাসে দেশের বেকারত্বের হার আগের চার মাসের সর্বোচ্চ ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এই পরিসংখ্যান সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র। সম্প্রতি সংবাদসংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ জানিয়েছেন, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় দেশের শ্রমজীবীদের অবস্থা গত বছরের থেকেও বেশি খারাপ হয়েছে। দ্রেজের মতে, একের পর এক রাজ্যগুলি যেভাবে লকডাউন করে চলেছে তা অচিরেই জাতীয় লকডাউনের আকার নেবে। তাঁর মতে করোনার কমিউনিটি সংক্রমণের কথা কেন্দ্রীয় সরকার মানতেই চায়নি। ঘণীভূত সঙ্কটকে অস্বীকার করার ফলেই আজ এই পরিস্থিতি। দেশ এই আত্মসন্তুষ্টির মূল্য চোকাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন নামক একচোখো, কেন্দ্রীয় সরকারের তাঁবেদার একটি সংস্থার একগুঁয়েমির মূল্য চোকাতে হচ্ছে আমাদের। এ কথা ঠিক। কিন্তু, এ রাজ্যের সরকারের কাছে কি এই সঙ্কট সমাধানের জন্য কোনও বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে? এখনও তার দেখা মেলেনি। জানুয়ারি মাস থেকেই দেশ করোনামুক্ত বলে উদ্বাহু হয়ে নেত্য শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল। একে একে গুটিয়ে ফেলা হচ্ছিল তাবড় আপৎকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা। অক্সিজেন বেড, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা। তুলে দেওয়া হয়েছিল সব আইসোলেশন সেন্টার। দেশের মানুষের কথা না ভেবে রপ্তানি করা হয়েছে ভ্যাকসিন, অক্সিজেন, জীবনদায়ী ওষুধ। বেলানোও হয়েছে। অন্যদিকে, ১০০ দিনের কাজের ২০২১-২২ বাজেটে ২০২০-২১-এর তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হলো ৩৮,৫০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে যেখানে ম্যানডেজ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৪০ কোটি, ২০২১-২২ সংস্থান রাখা হয়েছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ম্যানডেজের। ডাউন টু আর্থকে গত ফেব্রুয়ারিতেই এই তথ্য জানিয়েছেন এনআরইজিএ সংঘর্ষ মোর্চার দেবমাল্য নন্দী। বাংলার ক্ষেত্রে তা ৪১ কোটি থেকে নেমে ২২কোটিতে দাঁড়িয়েছে বলে বছর রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের অভিযোগ। এখানেই শেষ নয়, বাংলার নির্বাচনের প্রায় শেষ পর্বে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঘোষণা করেছিলেন গরিব কল্যাণ যোজনায় মে ও জুন মাসে রেশন গ্রাহকদের বিনামূল্যে দু’কিলো করে চাল ও তিন কিলো করে গম দেওয়া হবে। মে মাসের মাঝামাঝি হলো এ রাজ্যের এফসিআই গুদামে চাল বাড়ন্ত। কর্তাদের মতে, রেকের অভাবে চাল আসবে মে মাসের শেষ নাগাদ।
অর্থাৎ, অতিমারির বিপদ এবার বহুগুণ। ‘স্টিল ফ্রেম’-এর ঘেরাটোপে দেশ রক্ষা পাবে না। ৮ মে রাজ্যের রাজনীতিক, মেধাজীবী, সমাজকর্মীরা মুখ্যমন্ত্রীকে এক আবেদনে এই সঙ্কটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছেন। সকলের হাত এক না হলে, সকলের ইচ্ছা ও কর্মশক্তি একজোট না হলে এই মহাসঙ্কট থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
নীচে এই সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গণ আন্দোলনের কর্মী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, গবেষক, সাংবাদিক ও শিল্পীদের তরফে প্রকাশিত মুখ্যমন্ত্রীর নামে খোলা চিঠিটি তুলে দেওয়া হল।
[pdf-embedder url=”https://www.groundxero.in/wp-content/uploads/2021/05/Open-letter-to-CM.pdf” title=”Open letter to CM” width=”700″]