এই প্রাণহীন ভেসে যাওয়া নিছকই ‘জল দূষণ’ নয়, মনুষ্যত্বের চরম দূষণ। মহানগরের দিনরাত জ্বলা চুল্লিগুলি; ফুটপাতে, পার্কে, কার পার্কিংয়ে কাঠের চুল্লিতে প্লাস্টিকে মোড়া লাশগুলি আরও ভয়াবহ দূষণ ছড়িয়ে চলেছে। এই সব দূষণই আসলে দাম্ভিক, উগ্র, কর্তৃত্ববাদী, চূড়ান্ত ক্ষমতালোভী রাজনীতির দূষণ। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
মৃতেরা এখনও ভাসমান। আতঙ্ক ছড়িয়েছে গঙ্গা-যমুনার তীরে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং এই বঙ্গেও। আতঙ্ক, উদ্বেগ এই জন্যই যে, এই শত শত মৃতদেহ থেকে গঙ্গায় দূষণ ছড়িয়ে পড়বে। যাঁরা, যে গ্রামবাসীরা গঙ্গার জল সরাসরি নিত্য ব্যবহার করেন তাঁদের আতঙ্কের কারণ আছে বই-কি। মৃতদেহ পচে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাবে এবং জল দূষিত হবে। মানুষ তো বটেই জলজপ্রাণীও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হবে। সুতরাং, উদ্বেগ, আতঙ্কের কারণ অমূলক নয়। এটা একটা দিক। অন্যদিকটা হলো এই বিপুল ভেসে যাওয়া লাশ দেখে আমরা সম্ভাব্য অপরাধীদের খুঁজে বার করার চেষ্টা শুরু করলাম। জানতে চেষ্টা করলাম গঙ্গায় লাশ ভাসিয়ে দেওয়া গ্রামীণ পরম্পরা কিনা? বিহারের আমলা বললেন, সে রাজ্যে এমনটা হয় না। উত্তরপ্রদেশের আমলা জানালেন, এমন প্রথা নাকি রয়েছে। এ কথাও উঠে এল যে, কাঠের অভাব, অর্থের অভাবে আত্মীয়-স্বজন এমন পথ বেছে নিয়েছেন। কোথাও আবার আঙুল উঠল সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধেও, যারা নাকি গাড়ি বোঝাই লাশ ফেলে দিয়েছে নদীতে। যে কথা বলা হলো না, যে কথাটা প্রায় কোথাও উঠে এল না — তা হলো ভয়াবহ সংক্রমণ গ্রামীণ ভারত, চিকিৎসকহীন, সেবিকাহীন, অক্সিজেন-ওষুধহীন এককথায় ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিকাঠামোহীন প্রত্যন্ত ভারতে পৌঁছে গিয়েছে। এর চেয়ে বড় আতঙ্কের কিছু হতে পারে না। ‘পতিতপাবনী’ গঙ্গা বুকে করে বয়ে নিয়ে এসে না দেখালে আমাদের ঘুম ভাঙত না। যেমন গত বছরটিতে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক।
ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, সম্পদশালী মহানগরে, দেশের তাবড় সম্পদ যেখানে কেন্দ্রীভূত, সেই সব তথাকথিত সবপেয়েছির দেশে — দেশের রাজধানী দিল্লি, বাণিজ্যের রাজধানী মুম্বাই, আইটি রাজধানী বেঙ্গালুরু, হিরের রাজধানী সুরাট, ‘মডেল’ খ্যাত আমেদাবাদ, একদা সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা-এলাহাবাদ- লক্ষ্ণৌ-চেন্নাইয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই ‘পাওয়ার এলিট’, অর্থাৎ, ব্যবসায়ী-রাজনীতিক-আমলারাও কত অসহায়, কত বিপন্ন। শত শত লাশ দেশের রাজধানীর ফুটপাতে, কার পার্কিংয়ের নির্ধারিত স্থানে পুড়িয়ে ফেলতে হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই। এই ভয়ংকর দৃশ্য সারা বিশ্বকেই শিহরিত করেছে।
কিন্তু, তার চেয়েও বোধহয় ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে চলেছে গ্রামীণ ভারতে যার খবর আমাদের কাছে নেই। যদি উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে গঙ্গা ও যমুনায় ভাসতে না দেখা যেত কোভিডে মৃত মানুষের লাশ। না দেখা যেত মধ্যপ্রদেশে। আমাদের চোখে পড়ত না যে, প্রত্যন্ত গ্রামীণ ভারতেও পৌঁছে গিয়েছে কোভিডের সংক্রমণ। এবং পরিস্থিতি ভয়াবহ। ১২ মে আইসিএমআর-কে উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, দেশের ৭১৮টি জেলার মধ্যে ৫৩৩টি জেলায় কোভিড পজিটিভ ১০ শতাংশের উপর।
ওই ১২ মে ডিজিটাল নিউজ পোর্টাল দ্য প্রিন্ট-এ উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ চিত্রটির এক ভয়াবহ ছবি তুলে ধরেছেন স্বরাজ ইন্ডিয়ার ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট যোগেন্দ্র যাদব (নাম্বারস আর ক্লিয়ার. সেভিং রুরাল ইউপি ফ্রম কোভিড ক্যাটাসট্রোফি মাস্ট বি আ ন্যাশনাল মিশন।) স্বউদ্যোগে এবং বন্ধুবান্ধবদের সহয়তায় বারাণসী, উন্নাও, রায় বেরেলি, প্রতাপগড়, মিরাট, বুলন্দশহর জেলার ১৪টি গ্রামে খোঁজখবর চালিয়ে দেখেছেন এই গ্রামগুলিতে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মৃত্যুর হার সাধারণ সময়ের চেয়ে তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে। তাঁর দাবি, এই হার যদি উত্তরপ্রদেশের (মোট জনসংখ্যা ২৩.৫ কোটি) উপর প্রক্ষেপ করা যায় তবে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৪.৭ লক্ষ। সরকারের হিসাব মানতে তিনি মোটেও রাজি নন। বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় সব রাজ্যের বিরুদ্ধে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা লুকোনোর অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগের সত্যতাও রয়েছে। এক লক্ষ্ণৌতেই যেখানে ৭ মে থেকে ১৩ মে পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১২৪ সেখানে শ্মশান-গোরস্তানের হিসেব যোগ করে দেখা গিয়েছে চারশোরও বেশি কোভিড আক্রান্তের অন্তেষ্টি হয়েছে।
দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলিতেই যেখানে কোভিড ২.০-এর ধাক্কায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে সেখানে গ্রামীণ ভারতের বিশেষ করে পূর্ব ও মধ্য উত্তরপ্রদেশের মতো গরিব গ্রামগুলোর পরিস্থিতি অনুমান করে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভারতে প্রতি ১০,০০০ জন পিছু চিকিৎসকের সংখ্যা ৯ জন। একটি হিসেব বলছে, উত্তরপ্রদেশে ২৩ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৪,১৩৮ জন। এবং ১৯,৯৬২ জন কোভিড আক্রান্তের জন্য মাত্র ১ জন চিকিৎসক মিলেছে। (ইন্ডিয়া টুডে, মে ১৭, ২০২১)। অর্থাৎ, হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসা নেই। ঘরে পড়ে থাকলে দু’চারদিন জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও মৃত্যু। কোথায় টেস্ট, ট্রেসিং আর কীসব প্রটোকল যেন কাগজে-টিভিতে রোজ পড়া যায়, শোনা যায়। কোথায় কী! গ্রামে গ্রামে গতবারের তুলনায় কোভিড ছড়াল তার বহু কারণ রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে কুম্ভমেলা একটি কারণ। আরও একটি কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন। ওই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের একমাসে প্রায় ৭০০ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। এঁরা সকলেই ছিলেন ভোটকর্মী। পাশাপাশি, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লির মতো রাজ্যগুলিতে কোভিড সংক্রমণের বাড়াবাড়ি হতেই ঘরে ফিরে এসেছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। বিনা পরীক্ষায় তাঁরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছেন। পরীক্ষার ব্যবস্থা কিংবা কড়াকড়ি ছিল না নিভৃতবাসের। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে যোগী সরকার। এই ভয়ংকর স্বাস্থ্য বিপর্যয়কে প্রথম থেকেই অস্বীকার করে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। উল্টে যাঁরা বিপদের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, তীব্রতার মাত্রা বিষয়ে সচেতন করছিলেন তাঁদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে জেলে ভরার হুকুম জারি করেছেন যোগী।
দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এমন সরকার রয়েছে বলেই দেশ ভেসে যায়। লাশ ভেসে যায়। এই প্রাণহীন ভেসে যাওয়া নিছকই ‘জল দূষণ’ নয়, মনুষ্যত্বের চরম দূষণ। মহানগরের দিনরাত জ্বলা চুল্লিগুলি, ফুটপাতে, পার্কে, কার পার্কিংয়ে কাঠের চুল্লিতে প্লাস্টিকে মোড়া লাশগুলি আরও ভয়াবহ দূষণ ছড়িয়ে চলেছে। এই সব দূষণই আসলে চূড়ান্ত উগ্র, কর্তৃত্ববাদী, চূড়ান্ত ক্ষমতালোভী রাজনীতির দূষণ।