লকডাউনের প্রকোপে কাজ হারানো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জীবনমৃত্যুর ভয়াবহতা সমাজের উপর মহলে ‘খবর’ হয়ে উঠতে পারে না। কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার দিনমজুর অজয় হীরার অকালমৃত্যু আরেকবার তা প্রমাণ করে দিল। বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় ক্ষতিপূরণ মিললেও এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও উঠে এল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও আন্দোলন নিয়ে নানান প্রশ্ন। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
খাস কলকাতায় আবারও শ্রমিক মৃত্যু। না, না তা নিয়ে বিশেষ হৈ-চৈ হবে না। কে-ই বা খবর রাখতে চায় যে – একজন চল্লিশ বছরের তরতাজা মানুষ, পেশায় রাজমিস্ত্রি এই লকডাউন, করোনা মহামারীর অনিশ্চিত সময়ে কোনওক্রমে একটি কাজের সন্ধান পেয়ে সংসারের সুরাহা করতে রোজগারের আশায় যান এবং কাজের প্রথম দিনেই দুর্ঘটনায় মারা যান – কেন? কীভাবে? এর দায় কে নেবে?
নির্বাচন, সরকার গঠন, বিরোধী, পরাজয়, নির্বাচনের হিংসা – সব কিছুই খবরের শিরোনাম হয়ে ওঠে। আর তার মাঝে শ্রমিকদের নিদারুণ দুর্দশা, এবং তার মাঝে কখনও কখনও অজয় হীরা-র মতো দিনমজুরদের মৃত্যু ‘খবর’ হয়ে উঠতে পারে না। একদিকে কোভিড-১৯ অতিমারীর দ্বিতীয় তরঙ্গে চূড়ান্ত প্রাণ সংশয়, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ভাইরাসের থেকেও অক্সিজেনের অভাব ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বাড়ছে, অন্যদিকে লকডাউনের কারণে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা, দিনমজুরেরা, ঠিকাদারদের অধীনে কাজ করেন যারা তারা প্রতিদিনই আরও বেশি করে নিরাপত্তাহীন এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলেছেন।
ধরা যাক সদ্য মৃত অজয় হীরার কথা। সল্টলেক সিটি সেন্টার-এর ৮ নং বস্তির বাসিন্দা ছিলেন তিনি। বাড়িতে তিনি, তাঁর স্ত্রী এবং ১৫ ও ১১ বছরের দুই মেয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর এই সংসার এক ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল। গত দু’তিন মাস কোনও কাজ ছিল না অজয়ের। সম্পর্কে তাঁর মামাতো দিদি ও বস্তিবাসী শ্রমজীবী কমিটির সদস্য তাপসী মজুমদার জানালেন, “কয়েক দিন যাবত ভাইয়ের শরীরটা ভালো ছিল না। সেদিন সকালেও আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কাজে যাবে কি না, বলেছিল কাজে গেলেই শরীরটা খারাপ লাগছে। তা শুনে আমিও বারণ করেছিলাম বেরোতে। আমাদের এখানের আরও কয়েক জন গত ২০, ২৫ দিন ধরে সিটি সেন্টারের কাছে যে মেট্রো রেলের কাজ চলছে সেখানে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করছে। সেদিন সেখানে কিছু লোক কম পড়ায়, ওকে কাজে ডাকে আর কি মনে হওয়ায়, নিশ্চয়ই রোজগারের কথা ভেবেই ভাইও তার কিছুক্ষণ পরে চলে যায়। আর সেখানেই এই দুর্ঘটনা। আর ঘরে ফিরতে পারেনি আমার ভাই।” তাপসীর কাছ থেকেই জানা গেল, কোনও নির্মীয়মান বহুতলে উপরে উঠে কাজ করতে পারতেন না অজয়, মাথা ঘোরা ও হাত-পা কাঁপার উপসর্গ দেখা দিত, তাই সাধারণত নীচেই কাজ করতেন তিনি। কিন্তু সেদিন মাথায় সরঞ্জাম নিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ তলা উঁচুতে কাজ করছিলেন আর আচমকাই ভার রাখতে না পেরে ফলস সিলিং-এর উপর পা পড়ে যাওয়াতে সঙ্গে সঙ্গে নীচে পড়ে যান। বিধানগর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। প্রথম দিন যে কাজে গিয়ে মারা গেলেন অজয়, তার পারিশ্রমিক ছিল দিনে ৪০০ টাকা।
দুর্ঘটনার পরে অজয়কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি করলেও এই দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কোনও দায় নিতে প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করে ঠিকাদার বা মেট্রোর চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগের ইঞ্জিনিয়ার। এরপর বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্যদের (অজয় নিজেও এই সংগঠনের একজন সংগঠক ছিলেন) ও ৮ নং বস্তির প্রতিবেশীদের প্রতিবাদ ও সম্মিলিত ক্ষোভপ্রকাশের সামনে আসতে বাধ্য হন তারা। অজয়ের পরিবারকে এককালীন চার লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও তাঁর স্ত্রীকে নির্মীয়মান মেট্রো স্টেশনের ভেতরে একটি সংস্থায় হাউজকিপিং-এ চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ক্ষতিপূরণ বা চাকরি একটি প্রাণের সমতুল হতে পারে না। তা কেবলই জীবন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপকরণ হতে পারে। এই মৃত্যু আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল একজন শ্রমিকের প্রাণের দাম উপর মহলের কাছে নেহাতই কম। কারণ এই নির্মাণস্থলে ন্যূনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে কাজ হচ্ছিল না। উপরে উঠে কাজ করার জন্য শ্রমিকদের যে ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জাম থাকার কথা বা নীচে যে ধরনের জরুরি অবস্থার উপযোগী ব্যবস্থা থাকতে হয় তা কিছুই ছিল না বলে জানা গেছে। এভাবে কোনও নির্মাণস্থলে কাজ চালানো সম্পূর্ণই আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের, দিনমজুরদের জীবন নিয়ে এভাবেই ছিনিমিনি খেলতে অভ্যস্ত ঠিকাদার ও নির্মাণ সংস্থা। আহত হওয়া বা মৃত্যুর বিনিময়ে কিছুটা অর্থ দিয়ে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে এই শ্রমিকদের অস্তিত্ব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগের কোনও লিখিত প্রমাণও থাকে না। সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বা পরিবারের কারওর চাকরি দাবি করাটা সমস্যাজনক হয়ে যায়।
অজয় হীরার মৃত্যু আরও একবার প্রমাণ করে দিল কোভিড মহামারী, লকডাউন ইত্যাদির মাঝে শ্রমিকদের যখন নিজেদের জীবন-জীবিকা, পরিবার-সংসার বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তখনও শুধু কম মজুরিতে তাদের শ্রম নেওয়ার মতো শোষনই নয়, সুরক্ষার যাবতীয় নিয়ম মেনে কাজের ব্যবস্থা না করেও ঠিকাদার ও নিয়োগ সংস্থা তাদের জীবনকে বিরাট ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। অজয়-রা স্রেফ সংখ্যা হয়ে যাচ্ছেন আর বাস্তব দাঁড়াচ্ছে কাজের জায়গায় অসুরক্ষিতভাবে কাজ করতে গিয়ে মৃত শ্রমিকদের কোনও পরিসংখ্যান আমাদের দেশে নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন যখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন না, তাদের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ করছেন না, তখন বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির মতো নাগরিক উদ্যোগ এগিয়ে আসছে। মহামারী, কাজ না থাকা, সংসারের চিন্তায় দিশাহারা হয়েই সম্ভবত অসুস্থ শরীর নিয়েও কাজে গেছিলেন রাজমিস্ত্রী অজয় হীরা। কাজ থেকে বাড়ি না ফিরে প্রাণহীন দেহটি গিয়েছিল মর্গে। একজন শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য মর্যাদা, জীবনের সমানাধিকারের লড়াইটা যে অতিমারীর সময়ে, সরকার, প্রশাসন, রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় আরও জোটবদ্ধ হয়ে শ্রমিকদেরই লড়তে হবে – অজয়ের মৃত্যু তাই প্রমাণ করে দিল।