সাম্প্রদায়িকতা, পৈশাচিকতা, নগ্ন স্বাধীনতার বিভৎস উল্লাসের মধ্যে সাদাত হাসান মান্টোর মুখ আজ তাঁর জন্মদিনে মনে পড়ে। লিখেছেন সৌরব চক্রবর্তী।
‘এ তুই কী করলি!’
‘কেন?’
‘জবাই করলি কেন?’
‘এভাবেই তো মজা!’
‘মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে…
আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।’
(‘জবাই আর কোপ’,সিয়াহ হাশিয়ে বা কালো সীমানা – ১৯৫২)
এইপ্রকার শব্দবন্ধ, বাক্যকে দুমড়ে-মুচড়ে আকর্ষণীয় করে পাঠকের কাছে পরিবেশন, একজন লেখক দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ এত নিপুণ দরদে চিত্রিত করছে অন্যদিকে আজকের দিনে হরিয়ানায় কিশোর জুনেইদ খানকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, ভাগলপুরে দাঙ্গায় নিহতদের শব মাটি-চাপা দিয়ে যখন তার উপর কচি-সবুজ ধানের চারা রোপণ করা হয়, ‘জয়শ্রীরাম’ বলতে অস্বীকৃত ইমামের ধড়মুণ্ড আলাদা করে সুরাতে যখন তাঁর আজীবন বোরখাবৃত স্ত্রীকে নগ্ন করে গণধর্ষণ করার ভিডিও যৌথভাবে উপভোগ করা হয়, পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক মহম্মদ আফরাজুলকে রাজস্থানে পুড়িয়ে মেরে ফেলা, গোরক্ষকদের তাণ্ডবে পহেলু খান বা উমের খানদের মৃত্যু বা গুজরাতে জীবন্ত সংখ্যালঘু পোড়ানোর সময় ‘হর-হর-মহাদেব’ ধ্বনি ওঠে তখন সাম্প্রদায়িকতা, পৈশাচিকতা, নগ্ন স্বাধীনতার বিভৎস উল্লাসের মধ্যে সাদাত হাসান মান্টোর মুখ মনে পড়ে। রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল—সবাই একযোগে সাদাত হাসান মান্টোকে খারিজ করে দিলেও গল্পকার হিসেবে তিনি নিজের অবস্থান জানতেন। মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে তিনি বলে গেছেন,
‘এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই ছোটগল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভাল গল্পকার!’
আজ তাঁর জন্মদিন। ৪৩ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন কিন্তু বিস্তারিত, এসবই সুলভ, বই কিংবা ইন্টারনেটের পাতায়। আমরা বরং নিঃশব্দে ডুব দেয়ার চেষ্টা করবো তাঁর লেখায়, ভাবনায়, কথায়, শব্দ ও বাক্যে। মান্টোর জীবনের সবচেয়ে বড়ো বাঁকটি এসেছিল ১৯৩৩ সালে তাঁর ২১ বছর বয়সে। সে সময় তাঁর পরিচয় ঘটে বিতর্কিত লেখক আব্দুল বারি অলিগের সাথে। তিনি মান্টোকে রাশিয়ান ও ফরাসী সাহিত্য পড়তে উৎসাহ দেন। আবদুল বারির সাথে পরিচয়ের অনেককাল পর মান্টো একবার লিখেছিলেন,
“আজ আমি যা, তার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রথম নাম বারি আলীগ সাহেবের। অমৃতসরে তিনমাস তার সাহচর্য না পেলে আজ আমি অন্য রাস্তায় হাঁটতাম। প্রকৃতপক্ষেই এক শেকড়চ্যুত, আদর্শহীন তরুণ, যে ততদিনে নিষিদ্ধ নেশাসমূহের এবং জীবনের অন্ধকার অলিগলিতে হাঁটবার পথের সন্ধান পেয়ে গিয়েছে, তাকে সাহিত্যের পথে টেনে আনবার যে মহৎ কাজ বারি সাহেব করেছিলেন, তার জন্য আজকের পাঠকও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।”
দেশভাগের প্রতিদিনের বাস্তবতা, তার আতঙ্ক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ছাপিয়ে আমাদের আজকের চেতনা আর অবচেতনায় সমানভাবে হানা দেয় মান্টো। সমকালে রামুতে পোড়া মন্দিরের ছাইয়ের মধ্যে স্মিত হাসির বুদ্ধ, গুজরাটের দাঙ্গা, পাকিস্তানের শিয়া মহল্লায় নির্বিচার আগুন বা খ্রিষ্টানদের প্রার্থনার সময় নির্বিচার গুলিবর্ষণ মান্টোকে বারবার ফিরিয়ে আনে। মান্টো লিখছেন,
‘যখন মহল্লায় হামলা হলো, কিছু কম বুদ্ধির লোক মারা পড়ল। যারা বাকি ছিল, তারা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে বাঁচল। একজন লোক আর তার বউ নিজের ঘরের তলকুঠুরিতে গিয়ে লুকিয়ে রইল।
খুনিরা কখন আসে—দুই দিন দুই রাত মিয়া-বিবি এই ভয়ে দমবন্ধ করে কাটিয়ে দিল। কিন্তু কেউ এল না।
কেটে গেল আরও দুই দিন। কমতে লাগল মৃত্যুর ভয়। খিদে আর পিপাসার কষ্ট তার চেয়েও বেশি হতে লাগল।
আরও চার দিন কেটে গেল। জীবন-মৃত্যু নিয়ে আর কোনো আগ্রহ রইল না মিয়া-বিবির। তাদের আশ্রয় ছেড়ে বের হয়ে এল দুজন।
মিয়া খুব দুর্বল কণ্ঠে বাইরে থাকা লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আমরা নিজেই ধরা দিচ্ছি …আমাদের মেরে ফেলো।…’ (‘যথাযথ পদক্ষেপ’, সিয়াহ হাশিয়ে বা কালো সীমানা – ১৯৫২)
পড়তে এসে প্রথমেই পাঠককে বুঝতে হবে মান্টো আপনাকে সুখকর সাহিত্য-পাঠ দেবেন না। মান্টো আপনার যাবতীয় মোহকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আপনাকে নিয়ে যেতে চাইবে সুদীর্ঘ অতীতের দেশভাগ, ধর্মীয় নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতার বেলেল্লাপনার দিকে।
লেখক খালিদ হাসান মান্টো সম্পর্কে বলেছেন,
‘মান্টো শুধু আমাদের দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের নয়, সারা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লেখকদের একজন।’
১৯৩৪ সালে মান্টো আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তিনি যুক্ত হন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনে। মান্টোর দ্বিতীয় ছোটগল্প ‘ইনকলাব পাসান্দ’ আলিগড় পত্রিকায় ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। ১৯৪১-১৯৪৩ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি রেডিও নাটকও লিখে ফেলেন, এর মধ্যে ‘আও’, ‘মান্টো কে ড্রামে’, ‘জানাজে’ এবং ‘তিন অওরাতে’। সবগুলি নাটকেই উঠে এসেছে তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের জ্বলন্ত রূপ। তাঁর গল্পে একজন প্রতিশোধকামী ছোলা বিক্রেতা পাবেন যে বাড়িওয়ালার গালাগালির কারণে তাঁকে খুন করতে চান অথচ নিষ্ফল হয়ে শুধু নিজেকেই গালাগালি দিয়ে গায়ের ঝাল মেটান। একজন দালাল পাবেন যে বেশ্যাদের অপমান করে নিজের পুরুষত্বের জাহির করে। একজন হতাশ যুবক পাবেন যে নিজের সমস্ত না-পাওয়া ভুলতে একজন কাল্পনিক প্রেমিকার প্রেমেই মজে যান। আশ্চর্য এই সমস্ত চরিত্ররা মিলেমিশে তৈরি করে একটা অদ্ভুত কোলাজ যেটা এই সময়ের মধ্যবিত্ত তথা নিম্নবিত্ত সময়ের চালচিত্র হিসাবে বাস্তবিক হয়ে উঠতে পারে।
এই চরিত্রগুলির প্রত্যেকের মানুষ হয়ে উঠবার কথা এবং যোগ্যতা দুই-ই ছিল, অথচ এই নির্মম সমাজ তাঁদের কাউকেই সে সুযোগ দেয়নি। মান্টো তাঁর প্রতিটি গল্প দিয়ে পাঠককে এদের প্রত্যেকের আত্মার অন্দরে উঁকি মেরে দেখান। এই ঝাঁকিদর্শন আমাদের উপলদ্ধি করবার সুযোগ দেয়, বিস্মিত হবার সুযোগ দেয়, যে কি অদ্ভুতভাবে এই ব্রাত্য মানুষগুলির মধ্যেই একজন মানুষ বেঁচে আছে, আজও। ক্ষয়িষ্ণু সময়ের দরুন অবচেতনে অমানুষ হয়ে ওঠা মস্ত চরিত্রদের কথা সাদাত হাসান মান্টো অসংখ্যবার লিখেছেন তাঁর ছোটগল্পে –
‘আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো…কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপরে সাইনবোর্ডে এই তখনো পড়া যাচ্ছিল…‘এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।’ (‘চ্যালেঞ্জ’, সিয়াহ হাশিয়ে বা কালো সীমানা, ১৯৫২)
কিংবা
‘ধর…ধর…পালাতে না পারে!’
একটু ছোটাছুটির পর শিকার ধরা পড়ল। বর্শা দিয়ে তাকে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করতে একজন এগিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় ধরা পড়া মানুষটা মিনতি করে বলল, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না…আমি ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি।’ (‘একেবারে ছুটি’, সিয়াহ হাশিয়ে বা কালো সীমানা, ১৯৫২)
প্রগতি লেখক সংঘের সদস্য হয়েও ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি মান্টো। সমাজের একেবারে নিচুতলা অর্থাৎ পানওয়ালা, দোকানদার, ড্রাইভার, ধোপা, দালাল, বেশ্যা ও অসংগঠিত শ্রমজীবীদের পাশাপাশি ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, হিংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনই তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি। তাঁর ‘গন্ধ’ গল্পটিতে বিত্তবান তরুণ রণধীর এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় ভিজে-কাপড়ের মজদুরনিকে তার বিলাসবহুল ঘরে আশ্রয় দিয়ে কালক্রমে সম্ভোগে লিপ্ত হয়। এই যৌনতায় সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তার ঘামে-ভেজা শরীরের দুর্গন্ধ, যা রণধীর নিজের সর্ব শরীর ও চেতনা দিয়ে আকণ্ঠ পান করে। গল্পের শেষে জেলাশাসকের গ্র্যাজুয়েট কন্যার সঙ্গে বাসররাত্রির আসঙ্গেও রণধীর সেই গন্ধের অনুপস্থিতিতে কামার্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ। গল্পের চরিত্রের এই যে ছক তা মান্টো মাত্রেই সম্ভব। শরীরের গন্ধের বর্ণনায় অদ্ভুত এক আলো আঁধারির পরিবেশ কয়েক-দশকে কেউ তৈরী করে উঠতে পারেনি। মান্টোর আরেক বিখ্যাত গল্প ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ গল্পে দেখি, দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ, তাঁর মরদ নিশ্চয় অন্য নারীসঙ্গে মজে আছে। কিন্তু আসলে সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির শবের সঙ্গে সে সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল। আখ্যানের এই তীব্র সংবেদনশীলতা বোঝেনি পাকিস্তান সরকর। অশ্লীলতার দায়ে মান্টোর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরাধীন ভারতে ৩ বার ও স্বাধীন পাকিস্তানে ৩ বার অর্থাৎ মোট ৬ বার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে মান্টোকে। কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল মান্টো কখন-ই নিজের জন্য উকিল নিয়োগ করে উঠতে পারেননি। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এইসব অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন,
“একজন লেখক তখনই কলম ধরেন, যখন তার সংবেদনশীলতা বা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।”
তাঁর রচিত ‘টোবাটেক সিং’ ছোটোগল্পটি সর্বাধিক পরিচিত, গল্পটির পটভূমি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ঘোষণা করেন দুই দেশের পাগলদের-ও ভাগাভাগি করা হবে। হিন্দু ও শিখরা ভারতে এবং মুসলমানেরা যাবে পাকিস্তানে। দেশভাগের ঘটনা, মানবতাবিরোধী রাষ্ট্রকে ব্যাঙ্গ করে এইরকম রচনার ধক্ খুব অল্প লেখক-ই দেখাতে পেরেছিলেন। মান্টো তাঁদের একজন।
১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত মুম্বাইয়ে তাঁর বোহেমিয়ান দিনযাপন, রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেরিয়ে ক্রমাগত খুঁজে খুঁজে বার করেছেন তাঁর গল্পের চমৎকার সব চরিত্রকে, ফিল্মের চিত্রনাট্য রচনা থেকে পতিত, পাপী-তাপী, মাতাল-বেশ্যাদের ডেরায় ঘুরে বেড়ানো, চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে দহরম-মহরম। তবে ভারত ছাড়লেন কেন? কারণ মুম্বই, বস্তুত সমগ্র উত্তর ভারতই, আর তত দিনে সেকুলার নেই, ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক শপথের আড়াল থেকে উঁকি মারছে মুসলিমদের একঘরে করার, কাজ না দেওয়ার, ভাতে-পানিতে মারার, হুমকি দিয়ে তাড়ানোর প্রচ্ছন্ন চক্রান্ত। যে চক্রান্ত আজকেও বর্তমান। এখন-ও ভারত-পাকিস্তান মানেই খুন-জখম-মারদাঙ্গা।
বুকে প্রবল আঘাত নিয়ে, নিজের প্রিয় নগরী মুম্বাই ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন মান্টো। কিন্তু সেখানে গিয়েও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। লিখলেন, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’র মতো গল্প, যাতে প্রতিবেশী হিন্দু বালিকা শারদার প্রেমে পড়া মুসলিম কিশোর ‘প্রেমের ধর্মের কাছে আর সব ধর্মই তুচ্ছ’ ঘোষণা করেও বিয়ের জন্য প্রেমিকাকে ইসলাম গ্রহণে চাপ দেয়। শারদা যখন পাল্টা তাকে হিন্দু হতে বলে, তখনই মুখতার ইসলামের উৎকর্ষ আর পৌত্তলিক ও গোময়পায়ী হিন্দুত্বের অপকর্ষ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ‘বুকের মধ্যে ইসলাম গুঁজে নিয়ে’ শারদার বন্ধ দরজা থেকে ফিরে আসে।
কিংবা
আর এক হাড়-হিম-করা গল্প ‘ফিরে আসা’, যাতে দাঙ্গায় স্ত্রী-হারানো সিরাজুদ্দিন পরমাসুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করতে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর স্ট্রেচারে-শোয়া অচেতন মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখে ফিরে-পাওয়ার আনন্দে সিরাজুদ্দিন পিছু-পিছু ঢোকেন। ডাক্তার তাঁকে ঘরে আলো আসার জানলা দেখিয়ে বলেন, ‘খুলে দাও’। অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষণাৎ নিজের সালোয়ারের দড়ি আল্গা করে নামিয়ে দু’পা ফাঁক করে দেয়। এত অসংখ্য বার সে বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত, যে ‘খুলে দাও’ উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় তার হাত সালোয়ারের দড়িতে চলে যায়। ১৯৪৫ সালের মধ্যে ‘ধুয়া’, ‘কালো সালোয়ার’ এবং ‘বু’ নামে তার অন্যতম বিখ্যাত কিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। বলিউডের বহু সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার তিনি। আট দিন, চল চলরে নওজোয়ান, মির্জা গালিব ইত্যাদি সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটিং তাঁর কৃতিত্ব।
১৯৫০ সালে মান্টো স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপে লিখেছিলেন, ‘এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।’ পাকিস্তানের জন্মের ৬৫ বছর উপলক্ষে ২০১২ এর আগস্টে পাকিস্থান সরকার ঠিক সেটাই করেছে। সাদাত হাসান মান্টোকে তারা ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছে।
মান্টো পেরেছিলেন তথাকথিত সমাজনীতির মুখে একশটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে। মান্টোর লেখা শুধু লেখাই নয়, ভারতের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সমকালের ইতিহাস-ও বটে। যা ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই। শতবছর পরেও মান্টো আছেন, থাকবেন। যতদিন এই আগ্রাসন খতম না হয়… মান্টো গালিবের একটি কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে একটি প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন,
‘কুছ নহী হ্যায় তো অদাওত হী সহী’ (কিছু না থাকলে শত্রুতাই থাক)।
সভাসাহিত্যিক, সুবিধাবাদীদের সাথে শত্রুতাই থাক, আজীবন।