ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় জাগ্রত স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


  • May 9, 2021
  • (2 Comments)
  • 5100 Views

ভাববাদী, দার্শনিক, তাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। বর্তমান দুঃসময়ে তাঁর ফ্যাসিবাদ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ বিরোধী লেখা প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। আজ তাঁর জন্মদিনে ফ্যাসিবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথকে দেখার এক চেষ্টা মাত্র! লিখেছেন সৌরব চক্রবর্ত্তী

 

 

“ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতি সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেকবিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে-সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বারবারই বলেছি, পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও  সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লালন করে সারা পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে।”

— (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সি এফ এন্ড্রুসকে লেখা চিঠি। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’, লন্ডন, ৫ই আগস্ট ১৯২৬ ইং)

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন সম্পর্কে বলা হয়, সেদিন নাকি সব ধর্মের লোকেরা একই ঠাকুরের পূজা করে থাকে। বাঙালির ধ্যান ও জ্ঞানের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এটা বাঙ্গালির যাপনেই পরিষ্কার। তবে ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে সারা ভারতে যেখানে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা, একনায়কতন্ত্র – সর্বোপরি ফ্যাসিবাদের নানান বৈশিষ্ট ও রূপ ফুটে উঠছে সেখানে কবিগুরু জীবিত থাকলে এই সময়ে কী ভূমিকা নিতেন তা তাঁর জন্মদিনে আর-ও বেশী প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন না তা তাঁর লেখাতেই স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর এই অবস্থান নিয়েও সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ইতালি যাত্রার সময় মুসোলিনীর আমন্ত্রণ গ্রহণ এবং তাঁর সঙ্গে পত্রবিনিময় নিয়ে প্রচুর আলোড়ন তৈরী হয়েছিল। পহেলা নভেম্বর, ১৯৩৩ সালে প্যারিস থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিতে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। পরে যদিও রমাঁ রোল্যাঁর সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দীতে তিনি ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে সংশোধন করেছিলেন। প্রসঙ্গত, তিনিই প্রথম ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে ১৯২৬ সালের ৫ই আগস্ট সি এফ এন্ড্রুসকে চিঠি দিয়েছিলেন যা পরে ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বারব্যুস ও রোল্যাঁর নেতৃত্বে যে প্রথম ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলন হয়, তার ঘোষণাপত্রে ভারতবর্ষ থেকে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই স্বাক্ষর করে বারব্যুসকে চিঠি লিখেছিলেন। সুতরাং সাময়িক ভ্রান্তি তৈরী হলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বমহিমায়। রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদী বিরোধিতার নিদর্শন আর-ও পরিস্কারভাবে উপলব্ধ করা সম্ভব সেই সময়ের ভারতবর্ষের অবস্থান দেখলে। ১৯২৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করে। সাংস্কৃতিক কর্মীদের গুরুত্ব দেয়া হয় এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সেখানে সংগঠনের কাজ হিসেবে বলা হয় – ‘সমস্ত পচনশীল ঘৃণ্য জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাদী মনোভাবের সক্রিয় বিরোধিতা।’ ১৯৩২ সালের ১০ই জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সাহিত্যিক সংঘের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘আমরা পৃথিবীর সমস্ত কবি, নাট্যকার, সাহিত্যিক ও লেখকদের আহ্বান জানাচ্ছি তাঁরা যেন তাঁদের প্রতিভার ক্ষুরধার অস্ত্র নিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত সংগ্রামী মানুষকে রক্তাক্ত অত্যাচার থেকে রক্ষায় সচেষ্ট হন।’ ১৯৩৫ সালে ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করলে ২৬শে জুলাই এলবার্ট হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালের ১লা আগস্ট এখানেই কলকাতার ছাত্ররা যুদ্ধবিরোধী দিবস পালন করে। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল, এই সময়কালের মধ্যে গোটা ভারত জুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন দেখা যায়। এইসব আন্দোলনে সরাসরি যোগদান না করলেও তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তিনি ক্রমাগত সারা বিশ্বের বুকে গজিয়ে উঠা ফ্যাসিবাদের সমালোচনা করে গেছেন। ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের প্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেন ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি। এই কবিতার প্রায় প্রতিটি স্তবক ফ্যাসিবাদের হাতে নিপীড়িত মানবসভ্যতার হাহাকারের চিৎকার,

 

“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে

প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,

যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল

অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,

এসো যুগান্তের কবি,

আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে

দাঁড়াও, ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;

বলো ‘ক্ষমা করো’

হিংস্র প্রলাপের মধ্যে

সেই হোক

তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”

 

১৯৩৭ সালের ১৫ই ডিসেম্বর নানকিং-র পতনের পর ২৫শে ডিসেম্বর তিনি ‘যেদিন চৈতন্য মোর’ কবিতায় লিখছেন,

 

“… মহাকাল সিংহাসনে –

সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,

কন্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী

কুৎসিত বীভৎসা বপরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন

নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের

হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধ কন্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে

নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।”

 

প্রসঙ্গক্রমেই উল্লেখ্য যে, কবি শুধুমাত্র আক্রমণকারী ফ্যাসিবাদের নিন্দা করেই ক্ষান্ত হননি, ধিক্কার জানিয়েছেন লীগ অব নেশনস তথা বিশ্বশান্তির বরকন্দাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ শক্তির উদাসীনতা ও নির্বীর্যতাকেও। সচেতন পাঠক স্মরণ করতে পারেন কবির ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতাটি

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’

 

তৎকালীন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় জাপানের সৈনিকেরা যুদ্ধযাত্রার পূর্বে ‘ভগবান বুদ্ধে’র মূর্তির সামনে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রার্থনা করছে। একদিকে হিংসার আগুনে সভ্যতাকে পুড়িয়ে দেওয়া, অন্যদিকে এই অপকর্মের সমর্থনে অহিংস নীতির পথিকৃৎ ‘ভগবান বুদ্ধে’র শরণ নেওয়া সৈনিকদের এই দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামি দেখে রচনা করেন সুপরিচিত ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ কবিতাটি —

“যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে।

ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা

কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।

মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভরতি করতে

বেরোলো দলে দলে।

সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে

তাঁর পবিত্র আশীর্বাদের আশায়।”

 

‘ছড়া’ কাব্যগ্রন্থের একটি ছড়ায় হিটলারের করুণ চিত্র দেখা যায় –

“মিউনিকে নিয়ে গেছে ছাঁটা গোঁফ যত্নেই
তারে আর কোনোমতে ফেরাবার পথ নেই
বিড়াল ফেরার হল, নাই নামগন্ধ
জজ বলে, তাই বলে মামলা কি বন্ধ।”

 

ধর্মীয় উন্মাদনা, ক্ষমতার আস্ফালন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শুধু কবিতা নয়, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ, নাটক ও চিত্রকলাতেও পথ দেখিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে তিনি লিখছেন,

“ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে আমার বুদ্ধি তাঁরই দেওয়া;

সেই বুদ্ধি বলিতেছে যে ঈশ্বর নাই;

অতএব ঈশ্বর বলিতেছেন যে ঈশ্বর নাই;

অথচ তোমরা তাঁর মুখের উপর জবাব দিয়া বলিতেছ যে ঈশ্বর আছেন। এই পাপের শাস্তিস্বরূপে তেত্রিশ কোটি দেবতা তোমাদের দুই কান ধরিয়া জরিমানা আদায় করিতেছে।”

 

সমানভাবে ‘রাজা’ ও ‘রক্তকরবী’ নাটকে ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানবতাকে স্থাপিত করার যে প্রয়াস তা বৃহৎ-অর্থে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনী রাজনীতির বিরুদ্ধেই লড়াইয়ের বার্তা। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪০ সালের ২০শে জুন অমিয়বাবুকে চিঠিতে লিখলেন,

“ডারুয়িন বলেছেন, বানরের অভিব্যক্তি মানুষ, কিন্তু মানুষের অভিব্যাক্তি এ কোন জানোয়ারে। প্রাণিজগতের আদি যুগে বর্মেচর্মে ভারাক্রান্ত, বিকট জন্তুরা আস্ফালন করে পৃথিবীকে দলিত করেছিল তাঁরা তো প্রাণলোকের অসহ্য হয়ে উঠলো, টিকতে পারলো। …”

তিনি আর-ও লিখলেন,

“‌এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব – ইতিহাস ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না।”‌

 

মৃত্যুর কয়েকমাস আগে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ রচনার পাতা কয়েকের সীমিত আয়তনেই রবীন্দ্রনাথ খুব সংহতভাবে ফিরে দেখেছেন তাঁর গোটা জীবন ও সমসাময়িক বিশ্বকে। এই লেখা যখন তিনি লিখছেন তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদের মদমত্ত আস্ফালন কোটি কোটি মানুষের জীবনকে নরক করে দিচ্ছে। তারই উল্টোদিকে চলছে এর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম। তিনি লিখছেন,

“নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন হতে একদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য আমার সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত হল তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা – কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক – শাসনচালিত কোনো দেশেই ঘটে নি। অথচ এই দেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। যখন সভ্যজগতের মহিমাধ্যানে একান্তমনে নিবিষ্ট ছিলেম তখন কোনোদিন সভ্যনামধারী মানব – আদর্শের এতবড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারিনি; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভিতর দিয়ে বহুকোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্যজাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।

যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত।”

 

ভারতবর্ষীয় সামাজিক সদাচারের প্রসঙ্গে মনুসংহিতার উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

সিভিলিজেশন’, যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি, তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়। এই সভ্যতার যে রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার। অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন। সেই নিয়মগুলির সম্বন্ধে প্রাচীনকালে যে ধারণা ছিল সেও একটি সংকীর্ণ ভূগোলখণ্ডের মধ্যে বদ্ধ। সরস্বতী ও দৃশদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী যে দেশ ব্রহ্মাবর্ত নামে বিখ্যাত ছিল সেই দেশে যে আচার পারম্পর্যক্রমে চলে এসেছে তাকেই বলে সদাচার। অর্থাৎ, এই আচারের ভিত্তি প্রথার উপরেই প্রতিষ্ঠিত — তার মধ্যে যত নিষ্ঠুরতা, যত অবিচারই থাক। এই কারণে প্রচলিত সংস্কার আমাদের আচারব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে চিত্তের স্বাধীনতা নির্বিচারে অপহরণ করেছিল।”

 

রবীন্দ্রনাথের সমকালেই আম্বেদকর ও দলিত আন্দোলনের তরফে মনুস্মৃতি পোড়ানোর ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের জাত ব্যবস্থা ও দলিতদের ওপর বহুযুগ লালিত কাঠামোগত অত্যাচারকে উপড়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা থেকে। রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে এই নিয়ে কিছু না বললেও তাঁর লেখা প্রবন্ধে এই নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে, ভারতে বর্তমান ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের যে রূপরেখা সেখানে মনুবাদী সংস্কৃতি ও ভাবধারার প্রভাব চূড়ান্ত। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবৎ, সাদ্ধি প্রজ্ঞা-সহ অনেক বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরাই এই মনুস্মৃতির উপর ভরসা করেই ফতোয়া জারি করেন, মহিলারা বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন না, মহিলাদের কাজ শুধুমাত্র সন্তান প্রসব, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ-ই মূল ভিত্তি ইত্যাদি।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ছিন্নপত্রে’ যে কথাটি লিখেছিলেন সেটা দিয়ে তাকে আরো গভীরভাবে বোঝা যায়

“আমার স্বীকার করতে লজ্জা করে এবং ভেবে দেখতে দুঃখ হয়- সাধারণ মানুষের সংসর্গ আমাকে বড় বেশি উদভ্রান্ত করে দেয়- আমার চারদিকেই এমন একটা গণ্ডি আছে, আমি কিছুতেই ভাঙতে পারিনে- অথচ মানুষের সংসর্গ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাও আমার পক্ষে স্বাভাবিক নয়-থেকে থেকে মানুষের মাঝখানে গিয়ে গড়তে ইচ্ছা করে- মানুষের সঙ্গে যে জীবনোত্তাপ তাও যেন প্রাণ ধারণের পক্ষে আবশ্যক।” (‘ছিন্নপত্র’, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৪)।

 ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের পরেই ভারতের পরিস্থিতি একেবারে খারাপ হয়ে গেছে এই ধারণা ভুল। ভারতে ফ্যাসিবাদের বীজ দীর্ঘদিনের। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেই বীজ থেকে গাছ হয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের পরিধি পালটে দিয়েছে। দেশজুড়ে মব লিঞ্চিং, ধর্ষণ করে হত্যা, ধর্ষকের সমর্থনে মিছিল, জিএসটি, নোটবন্দি, করোনার সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভোগ, না খেতে পেয়ে মৃত্যু, কাজ হারিয়ে আত্মহত্যা, গোটা দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলন, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে গুলি, দিল্লীতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাঙ্গা – এককথায় সারা ভারত জুড়ে এক অরাজকতার পরিবেশ তৈরী হয়েছে এই ৭ বছরে। মানুষকে ক্রমাগত ধর্মীয়ভাবে ভুলিয়ে রাখার কারণে মানুষ তার মূল দাবি থেকে দূরে সরে গেছে এবং প্রতিনিয়ত যাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে আরএসএস জোরকদমে কাজ করছে ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর জন্য।

 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় এইসব দেখে গেলে খুব কষ্ট-ই পেতেন। এই সময়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের বড়ো অংশ মুখে কলুপ এটে থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবিত থাকলে এইসমস্ত ঘটনা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় আগ্রাসন ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করতেন। তাঁর পূর্বের রচনাসমগ্র অন্ততপক্ষে সেইদিকেই ইঙ্গিত করে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য জরুরি এবং জরুরি থাকবেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে শুধু ভাবজগতের চিন্তা বা আধ্যাত্মিকতা দিয়ে যারা বিচার করেন, তারা রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবিচার করেন। মানবমুক্তির কথা রয়েছে তার সাহিত্যের পরতে পরতে। যেমন ‘দুই বিঘা’ কবিতার এক সর্বগ্রাসী ভূমি দস্যুকে আজও আমরা অতিক্রম করতে পারিনি। তাঁর ‘বাঁশী’ কবিতায় তিনি যে শিক্ষকের কথা বলেছেন সেই শিক্ষকের কথাটির আজ পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন হয়নি। আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃত অংশটুকু বোধহয় এই আলোচনার উপসংহার হতে পারে,

“১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। কবি মৃত্যুশয্যায়। তবু উদ্বিগ্ন হয়ে বার বার জানতে চাইছেন, প্রশান্ত মহলানবিশের কাছে – ‘কী পরিস্থিতি রণাঙ্গণের? প্রশান্ত মহলানবিশ জানান, ‘এখনো এগিয়ে চলেছে দস্যু বাহিনী,’ কবি ডুবে যান নীরব বিষণ্ণতায়।…অবশেষে শেষবারের জন্য সংগা এলো কবির। চোখে একই স্বপ্ন। কিন্তু প্রশান্ত মহলানবিশের উত্তর এবার ভিন্ন। ‘সোভিয়েত বাহিনী প্রতিরোধ করেছে।’ রবীন্দ্রনাথ উৎসাহে অধীর হয়ে উঠেন, বলেন, ‘পারবে, দানবকে ঠেকাতে ওরাই পারবে।”

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: Pratip Nag on May 9, 2021

    ১৯৩৭ সালে League against Fascism and War এর ভারতীয় শাখার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

  • comments
    By: শৌনক on May 12, 2021

    অসাধারণ

Leave a Comment