তবু, অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে বিঁধবে। বিঁধবে এই কারণেই যে, বিধানসভায় প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে এক কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা পেল। প্রতিষ্ঠা পেল পরধর্মবিদ্বেষী সংখ্যাগুরুবাদী কর্পোরেট-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা। এবং অবশ্যই জনগণের রায়েই। তাদের এই জয় কতটা ধর্মীয় মেরুকরণের ফলে, কতটাই-বা রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের স্বৈরাচারী মনোভাব, হিংস্র আচরণের বিরুদ্ধে আর কতটা সিএএ, এনআরসি পক্ষে — তার নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
চূড়ান্ত ফল হাতে আসেনি। কিন্তু, এটা নিশ্চিত যে তাবড় পোল-পণ্ডিতদের মিথ্যে প্রমাণিত করে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে গেল প্রশান্ত কিশোরের ভবিষ্যৎবাণী। বিজেপি পার করতে পারল না দুই অঙ্ক। তৃতীয় বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনাকে অভিনন্দন মমতা।
তৃণমূল কংগ্রেসের এই জয় বাংলার অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এক আপাত স্বস্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। স্বস্তি এই জন্য যে, বাংলার আকাশে যোগীরাজ্যের যে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল তা কেটে গিয়েছে। আকাশ এখন অনেকটাই নির্মল। এর কৃতিত্ব অবশ্যই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলটির অন্যান্য নেতা-নেত্রী এবং সাধারণ পদাতিক কর্মীদের। তবু, বলা যাক সাধারণ ভোটারদের কাণ্ডজ্ঞান দেখলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়।
অনেকেই ভেবেছিলাম, বলেছিলাম, লিখেছিলাম, তেড়েফুঁড়ে ওঠা বামফ্রন্ট, বাম ও কংগ্রেসের প্রায় নিটোল জোট এবং আইএসএফের অন্তর্ভুক্তি বাম ও কংগ্রেসের হারানো ভোট অনেকটাই ফিরিয়ে দেবে। এবং এই অঙ্কও কষা হয়েছিল যে, ২০১৯-এ বিজেপিতে চলে যাওয়া ভোট বর্তমান জোটে ফিরে এলে আদতে তৃণমূল কংগ্রেসই লাভবান হবে। এমনটা অনেক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ও নেতৃত্ব স্থানীয় কর্মীও ভেবেছিলেন। এই পণ্ডিতি ভাবনা পণ্ড করে ছেড়েছেন আমভোটাররা। তাঁরা, বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোটাররা কোনও ঝুঁকিই নিতে চাননি। এটাই কাণ্ডজ্ঞান। ২০১৯-এর তুলনায় বিজেপির প্রাপ্য ভোটের শতকরা হারে পতন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের বৃদ্ধি প্রমাণ করে শুধু সংখ্যালঘু নন, সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোটাররাও তৃণমূলের ঝুলি ভরে দিয়েছেন। দক্ষিণ ও মধ্যবঙ্গের অধিকাংশ এবং উত্তরবঙ্গের একাংশে এই ছবি স্পষ্ট। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে ২০১৯-এর তুলনায় তৃণমূল ভাল ফল করলেও, বিজেপি যে এই জেলাগুলিতে তাদের মতাদর্শকে আদিবাসী, রাজবংশী, গোর্খা জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশের মনের গভীরে প্রোথিত করতে পেরেছে তা পরিষ্কার। পাশাপাশি, এই ফল উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে আরও একবার প্রকট করে দিল। ফলাফলের পরিপূর্ণ হিসাব প্রকাশের পরই কেন এই জয়-পরাজয় — সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তবু, মহিলা ভোট, সংখ্যালঘু ভোট, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এবং অতিমারির সময় সরকারের নানা সদর্থক ভূমিকা তৃণমূলের জয়ের পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি, বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং বাম ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ আন্দোলনেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
আরও পড়ুন: ২০১৯ ও ২০২১ এক নয়; অতিমারি পর্বের অভিঘাত বদলে দেবে জয়-পরাজয়ের বহু হিসাব-নিকাশ
তবু, অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে বিঁধবে। বিঁধবে এই কারণেই যে, বিধানসভায় প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে এক কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা পেল। প্রতিষ্ঠা পেল পরধর্মবিদ্বেষী সংখ্যাগুরুবাদী কর্পোরেট-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা। এবং অবশ্যই জনগণের রায়েই। তাদের এই জয় কতটা ধর্মীয় মেরুকরণের ফলে, কতটাই-বা রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের স্বৈরাচারী মনোভাব, হিংস্র আচরণের বিরুদ্ধে আর কতটা সিএএ, এনআরসি পক্ষে — তার নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি।
এই ভোটে সংযুক্ত মোর্চা বিশেষ ভাবে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের ক্রমে ক্ষইতে ক্ষইতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়াটা অবশ্যই এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করবে। অবশ্যই এর দায় বাম ও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের। তাঁদের অকর্মণ্যতা, নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক দিশাহীনতাই এর জন্য দায়ী। তৃণমূলের ভয়াবহ আগ্রাসনের মুখে দলীয় কর্মী এবং সাধারণ সমর্থকদের রক্ষা করা দূরে থাক তাঁদের পাশে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সান্ত্বনাটুকুও দিয়ে উঠতে পারেননি। এমন ক্ষেত্রে বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল ঠিক বিপরীত। পাশাপাশি, বিগত ১০ বছরে একটিও সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেননি তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় কোনও বামপন্থী কিংবা কংগ্রেসের প্রতিনিধি নেই — এমনটা বোধহয় তাদের চরম শত্রুরাও কখনও দুঃস্বপ্নে ভাবেননি। এই বামপন্থীদের নতুন করে ভেবে দেখতে হবে তাঁদের রাজনীতির কেন্দ্রে কার মুখ, কাদের মুখকে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে চান — মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষ?
এরই যোগসূত্রে বলা যায়, এই ফলাফলে অবশ্যই রাজ্যের নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক জনসমাজের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে গেল। সূত্রাকারে তা এমন :
# আশু কাজ কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলা করা।
# সর্বজনীন জনস্বাস্থ্যের জন্য জনমত তৈরি করা।
# যে বিভাজনের রাজনীতি রাজ্যকে প্রায় দ্বিখণ্ডিত করেছে তার মোকাবিলায় সংগঠিত হওয়া।
# নাগরিকদের সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার বিষয়ে সচেতন করা।
# পঞ্চায়েতগুলির যথাযথ মর্যাদা ফিরিয়ে আনা এবং তাকে শক্তিশালী করার জন্য জনমত তৈরি।
# সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পগুলির উপর নজরদারি এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধতা।
# আদিবাসী-দলিত-মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরা।
# যে কোনও রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রতিটি নির্বাচনে সাধারণ নাগরিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধতা করা।
# নয়া কৃষি ও শ্রম আইনের প্রেক্ষিতে এ রাজ্যের কৃষক ও শ্রমিকদের নিজস্ব দাবিদাওয়াগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া।
# এনপিআর-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা।
# ফ্যাসিজম বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা।
# এবং এক সর্বজনীন গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা।