প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এখনও এই রাজ্যকে, এ রাজ্যের মানুষকে, পুলিশ-প্রশাসনকে নির্বাচনের নামে, গণতন্ত্রের নামে পণবন্দি করে রাখলে বিপর্যয় মোকাবিলায় অহেতুক কালক্ষেপ হবে, অতিমারির সুনামি ঘটবে। তার লক্ষণ স্পষ্ট। পোকামাকড়ের মতো মরছে মানুষ। এভাবে চললে এ রাজ্যেও মরবে। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
যেন মড়ক লেগেছে। শ্মশানের আগুন আজ অনির্বাণ দাবানল। পুড়ে যাচ্ছে শ্মশানও। লাগাতার আগুনের তাপে গলে গিয়েছে ইস্পাতের গ্রিল, গ্যাস ফার্নেসের চিমনি। অকেজো ফার্নেস, অতঃপর স্তুপাকৃত কাঠের চুল্লিতে একসঙ্গে পুড়ছে পাঁচ পাঁচটি দেহ। উপচে পড়া লাশ, দীর্ঘ লাশের সারি। তাই আড়ে-বহরে বাড়িয়ে তুলতে হচ্ছে শ্মশানক্ষেত্র। শহরের পার্ক, গাছে গাছে ভরা পার্ক, পাখির ডাকে সকাল হওয়া সন্ধে নামা পার্ক, শিশুদের ছুটোছুটি, প্রবীণের ধীর পদচারণার নাগরিক উদ্যান — ঝলসে যাওয়া ডালপালায়, আশ্রয়হীন পাখিদের আকুল ওড়াওড়ি আর আত্মজনের পাতালভেদী তীক্ষ্ম আর্তনাদে যেন হাবিয়া দোজখ। গলগল করে লাশপোড়া ধোঁয়া উগরে দেওয়া চিমনির দিকে আঙুল তুলে কিশোরী এক বলছে, ওই দেখো, আমার মা ভগবানের কাছে চলে যাচ্ছে।
ধর্মীয় রীতিনীতি চুলোয় দেওয়ার, অর্থাৎ, মাটি বাড়ন্ত তাই দাহ করার নিদান হেঁকেছেন আর্চবিশপ। বছর চারেক হলো ফতেপুরের এক ভোটসভায় গ্রামে গ্রামে শ্মশান গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী চাই কবরস্তান না শ্মশান?” ফতেপুরের জনতা শ্মশান চেয়েছিল। কথা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। একটু বেশিই রেখেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তো তাই! শুধু শ্মশান নয় গোরস্তান বৃদ্ধির রেখচিত্রে আর যাই হোক অসাম্য, বঞ্চনা কিংবা দ্বেষ-বিদ্বেষের খোঁজ আর মিলবে না।
হাসপাতালে শয্যার আকাল, শয্যা মিললেও অক্সিজেনের আকালে, প্রাণদায়ী ওষুধের আকালে খাবি খেতে খেতে মরছে মানুষ। একই শয্যায় গাদাগাদি মরণাপন্ন, ক্ষীণশ্বাস নারী-পুরুষ। সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স ভরা মুমূর্ষু রোগী, রোগীর পরিজন চাতকের মতো অপেক্ষায়। সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স ভরা মৃতদেহ। কত এল, কত গেল হিসেব নেই। নেই কেননা হিসেবে জল মেশানো হচ্ছে। যেমন ঘিয়ের অভাবে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেহ। সাংবাদিকরা রাতভর মর্গ থেকে, শ্মশান থেকে কবরস্তান থেকে সংগ্রহ করছে লাশের মোট সংখ্যা। অমুক দিনে অমুক হাসপাতালে কত মরল, দাহ হলো, গোর দিল কতগুলো। ড্রোন উড়িয়ে সারি সারি চিতার আগুনমালা গেঁথেছে চিত্র সাংবাদিক। আর সেই ছবি কাগজের পাতায় সাঁটিয়ে কালো কালো অক্ষরগুলো চিৎকার করে বলছে — নে গোন এবার, কটা বলেছিলি? দেখ ৬৫টা লাশ জ্বলছে। এ ছবি এক প্রাচীন বাণিজ্য নগরী সুরাতের। শ্রমিকের, বণিকের এক সব পেয়েছির দেশ, এক এলডোরাডোর। নগর সভ্যতার যত শতেক ছটা, বর্ণবৈভব, শ্বাশত ভারত-সংস্কৃতির রামধনু যে নগরগুলির চন্দ্রাতপ, যে নগরী বিস্মিত বিস্ময়ের অবধি রাখে না — এ ছবি সেই লক্ষ্মৌ, এলাহাবাদ (অধুনা প্রয়াগরাজ), বারাণসীর। এ ছবি মুম্বাই থেকে ভোপাল সর্বত্র। এ ছবি ক্রম প্রকাশ্য ভোট জর্জরিত এই রাজ্যে। ডার্করুমের দড়িতে ঘাড়ে ক্লিপ সেঁটে দোল খাচ্ছে। ফেটে পড়ল বলে। আর এক মুর্দাজীবী বানিয়া শীতলখুচিতে লাশ বেচছে তো আসানসোলে দাঙ্গা বেচছে।
তবে, সবই এমন অন্ধকারের ছবি নয়। শিল্পোপযোগী অক্সিজেনের উৎপাদন কমিয়ে মানব ব্যবহারযোগ্য অক্সিজেন উৎপাদন ও বিলি করবেন বলে স্থির করেছেন দেশের শীর্ষ ধনকুবের। নিশ্চয় অন্য আরও কোনও ধনকুবের — ইস্পাত কারখানার মালিক — লোহা গলানোর বয়লার উৎসর্গ করতে পারেন গণদাহের জন্য। কিংবা একটি কয়লা খনি। জ্বালানি তো লাগবে। শহরের পার্ক যখন শ্মশান হতে পেরেছে ন্যাশনাল পার্কও তো হতে পারে। দাহের জন্য এত কাঠ মিলবে কোথায়, গোর দেওয়ার জন্য একলপ্তে এত জমি! নীতি আয়োগ নিশ্চিত ভাবছে। ভাবছেন বোধহয় সিইও অমিতাভ কান্ত, আরও এক সুযোগ এসেছে এবার সত্যি সত্যিই এই ‘টু মাচ অফ আ ডেমোক্র্যাসি’-টার সব সাধ-আহ্লাদ ঘুচিয়ে দেওয়া যাবে। ভাবছেন, আবারও এসেছে সঙ্কটকালের সেই সুবর্ণ সুযোগ। নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ভাবছেন এই সঙ্কটকে সুযোগে বদলে দেওয়ার। ভেবে ফেলেছেন নিশ্চয় দুঃসময়কে কীভাবে সুসময়ে বদলে নেওয়া যায়। বিপর্যয়-ধনতন্ত্র এই সুযোগ আঁকড়ে ধরবেই। মোদী-ফান্ডের টাকায় বেশি দামে ভ্যাকসিন কিনে বেচেছে দেশ-বিদেশে। আর বিগত তিনমাসে টিকাকরণ হয়েছে মাত্র দেশের সাত শতাংশ অর্থাৎ ১৩৬ কোটির দেশের ১২কোটি মানুষের। এ নাকি ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি! দুর্নীতি নয়, স্ক্যাম নয়, সিন্ডিকেটবাজি নয়! প্রাণদায়ী ওষুধ খোদ উৎপাদকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে পার্টি অফিস থেকে বিলি করার স্কিম নিয়েছিল গুজরাত বিজেপির রাজ্য সভাপতি। প্রভুর সার্থক চ্যালাই বটে। ওষুধের দোকানে স্টক শেষ, উৎপাদক বলছে স্টক শেষ। আর রাজ্য জুড়ে মানুষ পাগলপারা ছুটে বেড়াচ্ছে। গুজরাতি সংবাদপত্র প্রথম পাতা জুড়ে ছেপে দিয়েছে সভাপতির মহৎ কীর্তির কাহিনি। গোটা গোটা হেডলাইনের মাঝে ছেপে দিয়েছে মোবাইল ফোন নাম্বার। জীবনদায়ী ওষুধ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, চিতায় ঢালার ঘি থেকে চন্দনকাঠের গুঁড়ো সবই গিয়েছে কালাধান্ধার গ্রাসে। বণিকের সার্থক রাম্যরাজ্য বটে।
দলে দলে ঘরে ফিরছেন ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকেরা। গণতন্ত্রের উৎসব মুখর রাজ্যে, নিঃশব্দে তাঁরা সেঁধিয়ে যাচ্ছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। কোভিড বিধি নেই, অতএব নেই তাপমাত্রা মাপা কিংবা বিধিবদ্ধ কোয়ারেন্টাইন। মৃত্যু হয়েছে নির্বাচন প্রার্থীর, বিদায়ী বিধায়কের, প্রবীণ নির্বাচনী এজেন্টের। আক্রান্ত দূর রাজ্য থেকে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান থেকে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক। তবু হুঁশ নেই নির্বাচন কমিশনের। কথায় আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। আর আত্মঘাতী বাঙালি যেন এই অবলা জীবটির মতো স্বাভাবিক বোধটুকুও হারিয়ে বসেছে । চার্টাড বিমান কিংবা হেলিকপ্টার বিহারী রাজনীতিকরা ক্ষমতার মদমত্ততায় অন্ধ। অন্যদিকে, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এখনও এই রাজ্যকে, এ রাজ্যের মানুষকে, পুলিশ-প্রশাসনকে নির্বাচনের নামে, গণতন্ত্রের নামে পণবন্দি করে রাখলে বিপর্যয় মোকাবিলায় অহেতুক কালক্ষেপ হবে, অতিমারির সুনামি ঘটবে। তার লক্ষণ স্পষ্ট। পোকামাকড়ের মতো মরছে মানুষ। এভাবে চললে এ রাজ্যেও মরবে। ‘মউত কি সওদাগর’ আর তার বানিয়া রাষ্ট্রের তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা ‘কোভিড জয়’ করেছি বলে তারা মিথ্যা সাফল্যের কথা শুনিয়েছে দেশকে। এখনও মিথ্যা দাবি জানিয়ে বলছে, “আমরা ভ্যাকসিন ছাড়াই কোভিড জয় করেছি।” আর সংক্রমণের এই ভয়াবহ দ্বিতীয় ধাপে এসে আঙুল তুলছে সাধারণ মানুষের দিকে। বাংলার, বাঙালিরও অন্তর্জলি যাত্রার শেষ দেখতে চায় তারা। আর আমরা? আমরা কি বলব না — ঢের হয়েছে, দফারফা করে ছেড়েছেন আমাদের। আর নয়। এক দফাতেই শেষ করুন বাকি তিন পর্ব।
পড়ে দেখুন: ইতরতার অভিযান