বাংলায় বিজেপি উত্থানের জন্য কারও যদি প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে তবে তা সব দলের। বিজেপির উত্থানের পর থেকে বাম ডান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের কোনও দলই বিজেপির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলেনি। সম্ভবত হিন্দু ভোট হারানোর আশঙ্কা কাজ করেছে। আজ তৃণমূল নিজের অস্তিত্ব টেকানোর স্বার্থে বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। যেহেতু বামেদের এই মুহূর্তে সে দায় নেই তাই তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিরোধিতার অভিমুখ বিজেপি থেকে তৃণমূলের দিকে ঘুরিয়ে দিতে। লিখেছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র।
এ কথা এখন সিপিএমের কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গবাসী মাত্রই জানে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে ডেকে নিয়ে এসে এ রাজ্যে জায়গা করে দিয়েছিল এবং তাদের জোরেই বিজেপি এখানে আসন জেতে। শূন্য থেকে আজকের দানবিক চেহারায় বিজেপিকে প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তৃণমূলের। এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের জন্যই তৃণমূল এবং মমতা সর্বতোভাবে পরিত্যজ্য। প্রশ্ন হলো এই আরোপণ কি সত্য? না, তথ্য এই আরোপণকে সমর্থন করে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক হাজার একটা দোষ থাকতে পারে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে এই অভিযাগ সর্বৈব মিথ্যা। কারণ প্রথমত যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভানেত্রী মমতা নিজের দল কংগ্রেসকে সিপিএমের বি-টিম বলে অভিযুক্ত করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে তারা বামফ্রন্টের বিগ ব্রাদার সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিরিয়াস নয়। এর অবধারিত পরিণতি তাঁকে ২২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরই মমতা তাঁর নিজস্ব দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইলেকশন কমিশনের দ্বারা স্বীকৃত হয় ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে। তার আগে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব বা বিজেপির সঙ্গে মমতার সম্পর্ক, কোনওটারই বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল না।
অথচ ভারতীয় জনতা পার্টি প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। সেবার ৫২টি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং রাজ্যে মাত্র ১২৯, ৯৯৪ ভোট পেয়েছিল। ১৯৮৪র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং ১০১১৬৫ (০.৪%) ভোট পায়। ১৯৮৭ সালে বিজেপি ৫৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং সামান্য (১৩৪.৮৬৭) ভোট বাড়ে। এরই মধ্যে কংগ্রেস ছেড়ে আসা বোফর্স ডিল ফাঁসের নায়ক ভি পি সিং বামেদের তাঁর স্বাভাবিক মিত্র বলে অভিহিত করেন। বিজেপি কিন্তু তাঁর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্কই রক্ষা করছিল, যাতে ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোতে একটি ছাতার নীচে থাকা যায়। ২ জুলাই ১৯৮৮ সালে কলকাতার ব্রিগেডে একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে সর্বভারতীয় কংগ্রেস বিরোধী নেতৃত্বের সঙ্গে জ্যোতি বসুও উপস্থিত ছিলেন। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একক দল হিসেবে বৃহত্তম হওয়া সত্বেও রাজীব গান্ধীকে আটকাতে বামফ্রন্ট আর বিজেপি একযোগে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে ভি পি সিং- এর জনতা দলকে শাসকদল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। পশ্চিমবঙ্গের ১৯৮৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৯ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং ৫২৯৬১৮ (১.৬৭%) ভোট পায়। লক্ষ্য করুন, বিজেপি বাংলার নির্বাচনী মানচিত্রে অতি তুচ্ছ গণ্য হলেও, তাদের ভোট কিন্তু বাড়ছিল।
এরপর ১৯৯১ এর ভোট। ভারতীয় জনতা পার্টি ১৯৯১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য জুড়ে ২৯১ জন প্রার্থী দেয়, এবং ৩,৫১৩,১২১ (১১.৩৪%) ভোট পায়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রথমবারের মতো এত বিশাল সংখ্যক প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৯১ সালে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন পাশাপাশি একযোগে অনুষ্ঠিত হয়। বিজেপি সেই নির্বাচনে ৩৬২৪৯৭৪ (১১.৬৬%) ভোট পেয়েছিল। তার আগেই সারা ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দীর্ঘস্থায়ী বাতাবরণ সৃষ্টি করে আদবাণীর রথ যখন বামরাজত্বে পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে অবাধে অতিক্রম করে যায়, তখন বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব কিন্তু আদবাণীকে গ্রেপ্তার করে সেই যাত্রার ইতি টেনে দেয়। সারা ভারতে বিজেপি মূলত অযোধ্যা ইস্যুতে মনোনিবেশ করলেও, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মূল ইস্যু ছিল অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন। চেষ্টা করেছিল দেশভাগের যন্ত্রণা উস্কে দিয়ে ভোটে জিততে। বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির পক্ষে সমর্থন সামান্য বৃদ্ধি পেলেও, অবাঙালি জনগোষ্ঠীই তখনও (মারোয়ারি এবং গুজরাতি) কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে তাদের মূল শক্তি। প্রশ্ন হচ্ছে ১৯৯১ সালে তো মমতাও নেই, তৃণমূলও জন্মায়নি। তাহলে পূর্ণ বামরাজত্বে এত ভোট কী ভাবে পেলো বিজেপি? আর পেলেও সে দোষ মমতার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে কেন? উল্টে বাম এবং বিজেপি মিলে (অথবা না মিলে) ভিপি-কে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিল। এখন অবশ্য চোখ পাল্টিয়ে বলে দেবে ওরা ওদের মতো সাপোর্ট দিয়েছে, আমরা আমাদের মতো। ১৯৯৬ সালেও, বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন একই সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিজেপির ভোট বিধানসভায় কিছুটা কমে দাঁড়ায় ২,৩৭২২,৪৮০ ভোট। এবং লোকসভায় এবং ২৫২৫৮৬৪ (৬.৮৮%) ভোট পেয়েছিল বিজেপি। আসন পায়নি কোথাও, কিন্তু তখনই বিজেপি এ রাজ্যে সমীহ করার মত শক্তি।
এর পরেই সেই ঘটনা, যার কথা সিপিএম প্রচার করে। যখন ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে আসা তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে জোট নয়, সিট অ্যাডজাস্টমেন্টে যায় এবং মমতা ৭টি আসনে জেতে। বিজেপি ১৪ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং ১ টি আসন জিতেছিল দমদম লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথমবারের মতো পশ্চিমবঙ্গে থেকে। তপন শিকদার পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বিজেপি সাংসদ হিসেবে মন্ত্রীও হন। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ১০.২%। ১৯৯১ থেকে অনেকটা কম। পরের বছরেই ১৯৯৯ সালে আবারও লোকসভা ভোট। বিজেপির সঙ্গে জোটে গিয়ে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস ৮টি আসনে জেতে। ১৩ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২টি লোকসভা আসনে জেতে বিজেপি। প্রাপ্ত ভোট ৩,৯২২,৪৪৪ ভোট পেয়েছে (১১.১৩%), ১৯৯১ থেকে কম। এ বছরই অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বে মমতা ববন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হন।
তৃণমূল ও বিজেপির এই সখ্যতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০০১ সালের প্রথমদিকেই তেহেলকার স্টিং অপারেশনে বিজেপির দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসা মাত্র তিনি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন, এমনকি এনডিএও ছেড়ে দেন। এতে এটা প্রমাণিত হয় না যে মমতা কখনও দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করেননি। কিন্তু এটা প্রমাণিত হয় যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তে তাঁর ভূমিকা নেই বললেই চলে। এর ফলে যা হয় তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেন, বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ২০০১ সালে কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস ২২৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৬০টি আসন পায়। বাজপেয়ীর সঙ্গ ত্যাগের জন্য এই বিপর্যয়কে মেনে নিতে পারেননি মমতার দলের বহু স্টলওয়ার্ট। তাঁরা মমতাকে ছেড়ে যেতে শুরু করেন। উপায়ান্তর না দেখে মমতা বাধ্য হন ডিসেম্বর ২০০৩ সালে কংগ্রেসের সঙ্গ ছেড়ে পুনরায় এনডিএ-তে ফিরতে। কিন্তু সে প্রক্রিয়াও মসৃণ হয়নি। জর্জ ফার্নান্ডেজ সহ এনডিএ-র সব মহারথীরাই মমতাকে ফিরিয়ে নেবার বিপক্ষে রায় দেন। বাজপেয়ী নিরুপায় হয়ে প্রমোদ মহাজনকে দায়িত্ব দেন শরিকদের মান ভাঙ্গানোর। তিনি নিজেও শরিকদের রাজী হওয়ার আহ্বান জানান। অবশেষে বরফ গলে। মমতা পুনরায় এনডিএ ভুক্ত হন। কিন্তু কতদিনের জন্য? ২০০৪ সালে পরাজয়ের পর বাজপেয়ী রাজনীতি থেকে অবসর নেন। বাজপেয়ীর অনুপস্থিতিতে এনডিএ-তে থাকা মমতার পক্ষে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। সব ধরণের রাজনৈতিক ভবিষ্যবক্তাই মমতার রাজনৈতিক কেরিয়ারের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেন যখন ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা এনডিএ থেকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তৃণমূলের সবাই হেরে যায়, শুধু মমতা একা তার সিটটি কোনক্রমে বাঁচাতে পারেন।
বাজপেয়ী সেবার প্রথম পুরো মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রথম সুযোগেই তিনি ২০০৩ সালে এই আইনটির খোলনলচে এমনভাবে সংশোধন করেছিলেন, যেখানে তিনি দেশের ভূখণ্ডে জন্মের অধিকারে নাগরিকত্ব থেকে রক্তের অধিকারে নাগরিকত্বে সংশোধনী আনেন। আজ সারা ভারত সিএএ-র বিরুদ্ধে সোচ্চার। সিএএ, ২০০৩ যেখানে যুক্ত হয়েছে এনআরসি প্রসঙ্গ। সংশোধনীতে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্যতামূলকভাবে একটি এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ) তৈরি এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এবং নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে। ২০০৩-এর এই সংশোধনীর উপর ভর করেই ২০১৯-এর সিএএ সংসদে এসেছে। প্রশ্ন হলো মমতা না হয় বিজেপি সঙ্গী (যদিও সে সময়ে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন) কিন্তু বামেরা কেন এই ভয়ংকর ভবিতব্য সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতন করেননি? কেন এর বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলেননি?
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর ফল আরও খারাপ হয়, এবং এনডিএ-তে থেকে মাত্র ২৯ টি আসনে জয়লাভ করে তাঁর দল। বিজেপি সেবারও কোনও সিট পায়নি। এর পরই ভারতীয় এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপ্রসঙ্গিক হয়ে পড়া মমতা ফাইনালি এনডিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এখান থেকেই বাংলার রাজনীতি আবার পাশ ফেরে। পূর্বসূরী জ্যোতি বসুকে ছাপিয়ে যাবার অত্যুৎসাহে এবং বিধানরায়ের চেয়েও উচ্চস্তরের নয়া বাংলার রূপকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মোহে, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পবিধ্বস্ত বঙ্গদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজিকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন। এসইজেড-এর মতো বাজার অর্থনীতির খোলাখুলি সমর্থন করে, সরাসরি সর্বহারার একনায়কত্বের বদলে পুঁজিপতিদের একনায়কত্বের রূপকার হয়ে দাঁড়ান। তাঁর ভরসাস্থল ছিল সিপিএমের সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ (নিরুপম সেন সহ) এবং বিধানসভায় বিপুল সংখ্যাধিক্য। কমিউনিজমের নামে এই পুঁজিবাদের বিস্তারকে স্বাগত জানিয়েছিল দেশীয় ও বিদেশি কর্পোরেট হাউসগুলি। সিঙ্গুর সুন্দরবন নয়াচর নন্দীগ্রাম সেই অবিমৃশ্যকারীতার প্রকাশ্য বিষ্ফোরণ। এবং বাংলার রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া মমতা ববন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক পুনর্বাসন দিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব।
এদিকে দিল্লিতে তখন অন্য নাটক চলছে। মনমোহন সিং-এর ইউপিএ সরকার চলছিল বামেদের সমর্থনে। কিন্তু প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বাধীন সিপিএম এবং বাম দলগুলি আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক নিউক্লিয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করার বিরোধিতায় হঠাৎ করেই কমন মিনিমাম ইস্যু মানা হলো না এই যুক্তিতে কংগ্রেস সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। কারাট এর হিসেব ছিল এর ফলে মনমোহন সরকারের পতন সম্ভাবনা তীব্র হবে এবং শেষ মুহূর্তে সরকার বাঁচানোর জন্য কংগ্রেস চুক্তিতে সই না করে আরও বেশি বামনির্ভর হয়ে পড়বে। কিন্তু ব্ল্যাকমেইলের খেলায় সবসময় অঙ্ক মেলে না। মনমোহন চুক্তিতেও সই করলেন এবং সরকার ও পড়ল না। মাঝখান থেকে কংগ্রেস হাইকমান্ড রাজ্য কংগ্রেসকে মমতার সঙ্গে জোট করার সবুজসংকেত দিয়েই দিলেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট বদ্ধ হয়ে লড়ে এবং বিজেপি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে নিয়ে লড়ে দুটি মাত্র আসন পায়। ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে লড়ে তৃণমূল কংগ্রেস ৩৪ বছরের একটানা বামরাজত্বের অবসান ঘটায়। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি নিজের শক্তিতে লড়ে ১৭.২% ভােট পায়। এই প্রথম আসন পায় তিনটি। কিন্তু ২০১৪-তে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে বাংলায় বিজেপির এটাই সর্বাধিক ভোট (১৯৯১ সালের পর)। ২০১৬ সালে ও তৃণমূলকে ছাড়াই বিধানসভা ভোটে লড়ে বিজেপি। তিনটি আসন পায় কিন্তু প্রাপ্ত ভােট নেমে আসে ১০.১৬%। তারপর আসে ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। সবাইকে চমকিত করে বিজেপি ১৮ টি আসনে জেতে এবং প্রাপ্ত ভোট ৪০.২৫%। এখন একথা সর্বজনবিদিত যে হিন্দু বাম ভোটের একটা বিরাট অংশ বিজেপির দিকে ঢলে পড়াতেই তাদের শক্তি বেড়েছে।
এত বেশি তথ্য দেওয়ার কারণ এটা দেখানো যে, যখনই বিজেপি তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন লড়েছে, তখনই তাদের ভোট শতাংশ কমে গেছে। একা লড়েই তাদের আসন বেড়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ এই সময়ে মমতা এ রাজ্য বিজেপির সঙ্গে ছিল (মাঝখানে দু’বছর কংগ্রেসের সঙ্গে) এবং তখন বিজেপি নেহাতই অকিঞ্চিৎকর একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এ রাজ্যে বিদ্যমান ছিল। মমতা নিজের স্বার্থেই তাদের মাথা তুলতে দেয়নি। একক শক্তিতে লড়ে বাম আমলেই বাংলায় বিজেপি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে মমতার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তৃণমূল বিজেপিকে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছে, এই প্রচার ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাম রাজত্বেই বিজেপি শনৈঃশনৈঃ এগিয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত হিন্দু বামভোট শিফ্টের ফলেই বিজেপির বাড়বাড়ন্ত। সেই অর্থে বাংলায় বিজেপি উত্থানের জন্য কারও যদি প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে তবে তা সব দলের। বামেরা মমতার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পার পেতে পারে না। সত্যি বলতে কি বিজেপির উত্থানের পর থেকে বাম ডান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের কোনও দলই বিজেপির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলেনি। সম্ভবত হিন্দু ভোট হারানোর আশঙ্কা কাজ করেছে। আজ তৃণমূল নিজের অস্তিত্ব টেকানোর স্বার্থে বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। যেহেতু বামেদের এই মুহূর্তে সে দায় নেই তাই তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিরোধিতার অভিমুখ বিজেপি থেকে তৃণমূলের দিকে ঘুরিয়ে দিতে। আর কংগ্রেস? বিজেপি সরকার গড়লে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সাইনবোর্ডও থাকে কি না দেখুন।
- লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক। মতামত লেখকের নিজস্ব।
একদম সঠিক মূল্যায়ন।