দুর্নীতিকে মান্যতা দিতে গিয়েই এই নির্বাচনী বন্ড আনা হয়েছিল এবং এখনও তা সুপ্রিম কোর্টের বদান্যতায় চলেছে বহাল তবিয়তে। লিখেছেন সুমন সেনগুপ্ত।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ২০১৭ সালের বাজেট পেশ করার সময়ে বলেছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর টাকা তোলার প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ না করা যায় তাহলে কোনোদিন ভারতবর্ষে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সংগঠিত করা সম্ভব নয়। এর পাশাপাশি তিনি আরও একটি কথা বলেছিলেন যে ৭০ বছরের রাজত্বে কংগ্রেস এই বিষয়ে কোনও স্বচ্ছতা আনতে পারেনি তাই এই রাজনৈতিক মতঐক্যে পৌঁছনো জরুরি যাতে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকে যে টাকা নির্বাচনে দেয় সেই প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ হয়। অনেকেই আশা করেছিলেন তাহলে এমন কিছু একটা পদ্ধতি আনতে চলেছেন এই মোদী সরকার যাতে রাজনৈতিক আঙিনা যেন কলুষ মুক্ত হয়। কিন্তু যে পদ্ধতির উনি প্রস্তাব দিলেন তাতে ঘটলো যেটা, সেটা উল্টো। তিনি বললেন এরপর থেকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে কোনও ব্যক্তি তাঁর পছন্দের রাজনৈতিক দলের জন্য যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারবেন। তাঁকে শুধু স্টেট ব্যাঙ্কের থেকে বন্ড কিনতে হবে।
আগে কী হতো? যদি কোনও ব্যক্তি কোনও দলকে আগে টাকা দিতে চাইতেন, তখন হয় চেক অথবা ক্যাশে দিতেন। তখন কোন ব্যক্তি কাকে কত টাকা দিচ্ছেন সেটা দু’পক্ষের ব্যাঙ্কের বই দেখলেই বোঝা যেত। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহলে নতুন কী প্রস্তাব দিলেন যা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠল ? বললেন, বহু কালো টাকা লোকজন এই নির্বাচন প্রক্রিয়াতে দিয়ে সেগুলোকে সাদা করিয়ে নেন। এবার থেকে স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সেই ব্যক্তিদের নির্বাচনী বন্ড কিনতে হবে। ওই নির্বাচনী বন্ডগুলোর আয়ু মাত্র ১৫ দিনের। ধরা যাক কোনও ব্যক্তি স্টেট ব্যাঙ্কের থেকে ১ লক্ষ টাকার বন্ড কিনবেন। তিনি ব্যাঙ্ককে ওই ১ লক্ষ টাকা দেবেন আর বলে দেবেন উনি কোন দলকে টাকাটা দিতে চাইছেন। ব্যস, সেই ব্যক্তির দ্বায়িত্ব শেষ। এবার স্টেট ব্যাঙ্কের দায়িত্ব ওই দলকে ওই বন্ডটি দেওয়ার। বন্ডে যেহেতু কারুর নাম লেখা নেই, সুতরাং যুক্তি অনুযায়ী কারুর পক্ষে জানা সম্ভব নয় কে ওই টাকাটা দিলেন? দেখা গেছে যে ৬ হাজার কোটি টাকা উঠেছে নির্বাচনী বন্ডে তার ৯৫ শতাংশ অর্থ পেয়েছে বিজেপি বাকিতা অন্যান্যরা।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, নির্বাচন কমিশন, অর্থ মন্ত্রকের আপত্তি সত্ত্বেও খোদ প্রধানমন্ত্রী নিয়ম ভেঙে এর মাধ্যমে দলের টাকা পাওয়ার পথ করে দিয়েছেন। অভিযোগ যখন উঠেছে তখন তা নিয়ে উত্তর দেওয়ার দায়িত্বও তো সরকারের বর্তায়। কিন্তু সরকারের তরফে মন্ত্রীরা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন যে, গত ৭০ বছর ধরে কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবার এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, আগে ২০০০০ টাকা ক্যাশে দেওয়া যেত চাঁদা, এই নির্বাচনী বন্ড আসার পরে সেটা তাঁরা ২০০০ টাকায় নামিয়ে এনেছেন। আগে দেখা গেছিল যে কোনও রাজনৈতিক দলকে কোনও ব্যক্তি, চেক, নগদ অথবা ব্যাঙ্ক ড্রাফটের মাধ্যমে টাকা দিতেন, এই নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পরে দেখা গেল যে চেক, নগদ ছাড়াও বেশীরভাগ অনুদান এসেছে এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে।
স্টেট ব্যাঙ্ক সাধারণত নিয়ন্ত্রণ করে কারা? যারা সরকারে ক্ষমতাসীন থাকেন। যেহেতু স্টেট ব্যাঙ্কের কাছে “কেওয়াইসি” দেওয়া আছে প্রতিটি গ্রাহকের, সুতরাং তাঁরাই একমাত্র জানতে পারবেন কে কত টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছেন। অন্য কোনও বিরোধী দল যদি টাকা পেয়েও থাকে স্টেট ব্যাঙ্ক কি কাউকে জানাবে তাঁর পরিচয়? সরকারকে যদি স্টেট ব্যাঙ্ক জানায় যে কে বা কারা তাঁদের দলকে বন্ড কিনে অর্থ সাহায্য করেছেন, দল ক্ষমতায় আসার পর এটা কি নিশ্চিত করে বলা যায় তাঁরা সরকারের থেকে বাড়তি সুবিধা নেবেন না? জনগণ যদি এই প্রশ্নটা করে যে তাঁরা যেহেতু ভোট দিয়ে সাংসদ বা বিধায়ক নির্বাচন করেন তাঁদের পূর্ণ অধিকার আছে জানার কারা কারা এই সাংসদদের বা বিধায়কদের পার্টির জন্য কত টাকা দান করেছেন। তাঁরা কেন এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন না? তাহলে কি এই সরকারের দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল সেটা সম্পূর্ণ ভাঁওতা? নাকি দুর্নীতিকে মান্যতা দিতে গিয়েই এই নির্বাচনী বন্ড আনা হয়েছিল এবং এখনও তা সুপ্রিম কোর্টের বদান্যতায় চলেছে বহাল তবিয়তে।
একদিকে নির্বাচনী বন্ডের জন্ম হল, আর অন্যদিকে যে স্বচ্ছতার কথা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, তার মৃত্যু হল। আগে যদি কোনও ব্যক্তি ২০ হাজার টাকা বা তার থেকে বেশি মূল্যের অর্থ কোনও রাজনৈতিক দলকে দিতেন, তাহলে তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হতো, কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে কেউ যদি ২ কোটি বা ২০০ কোটি টাকাও দেন, রাজনৈতিক দল তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে বাধ্য নয়। যুক্তি, যা দেওয়া হলো, তাও অদ্ভুত। যারা টাকা দিচ্ছেন তাঁদেরও তো একটা গোপনীয়তা দরকার! অথচ কেউ কিন্তু প্রশ্ন করলেন না, আচ্ছা কেন একজন ব্যক্তি বা সংস্থা এই টাকা দেওয়ার বিষয়টি গোপন করতে চাইবে? তাহলে কি তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে? সে কি সরকারের কাছ থেকে কোনও সুবিধা পায় বা পাবে, যেটা সে জানতে দিতে চায় না? সে কি ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে পালিয়ে যাবে? বা সে কি সরকারি কোনও কন্ট্রাক্ট বা কোনও কিছুর লাইসেন্স পাবে সেই আশায় রাজনৈতিক দলকে টাকা দিল? ৭০ বছরে তো এরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি, আগেও তো বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা বিভিন্ন যুযুধান দলকে টাকা দিয়েছে, একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে কি সেই সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে? তাঁকে কি প্রশ্ন করেছে, যে কেন সে অন্য রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিয়েছে? তাহলে?
যখন প্রথম নির্বাচনী বন্ড আনা হয়েছিল নির্বাচন কমিশন এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু সাম্প্রতিককালে সর্বোচ্চ আদালতে যখন এই বন্ড নিয়ে শুনানি চলছিল তখন নির্বাচন কমিশন সেই বন্ডকে সমর্থন করে বলেছে যে এই মুহুর্তে আর পিছনো সম্ভব নয়। তাঁরা কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে কোনও উত্তর দেননি। আসলে তাঁরা বুঝেই গেছেন যে নরেন্দ্র মোদীর জমানায় আইনানুগ দুর্নীতি হবে, এবং কিছু পছন্দের শিল্পপতিরা সুবিধা পাবেন এটাই দস্তুর। আরও একটি তথ্য জানিয়ে রাখা জরুরি। নির্বাচনী বন্ডকে চালু করার জন্য আরও বেশ কিছু নিয়মকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বদল করেছে। কোম্পানি আইন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইন, ইনকাম ট্যাক্স আইন সহ বেশ কিছু আইনে বদল আনা হয়েছে। আগে নিয়ম ছিল লভ্যাংশের ৭.৫ শতাংশ অবধি কোনও সংস্থা দান করতে পারে, এই নির্বাচনী বন্ড চালু করতে গিয়ে বলা হল, যে কোনও সংস্থা যদি তাঁদের ব্যবসায় ক্ষতিও হয়, তাহলেও তাঁরা যে কোনও পরিমাণের টাকা দান করতে পারে। এটাই আসলে একটি ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া সংস্থাকে ধীরে ধীরে সরকারের প্রিয় পাত্র করে তোলে, এটাই ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। এই ভাবেই আদানি থেকে আম্বানিরা ধীরে ধীরে সরকারকেই পরিচালনা করেন পিছন থেকে।
গণতন্ত্রে একজন নির্বাচক যখন তাঁর অধিকার প্রয়োগ করেন তখন তাঁর জানার সম্পুর্ণ অধিকার আছে, যে কে বা কারা এই নির্বাচনী দল কিংবা প্রার্থীকে আর্থিকভাবে সহায়তা করছেন, তবেই গণতন্ত্র সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়। অথচ নির্বাচনী বন্ড এমনই একটি অসচ্ছ প্রক্রিয়া তাতে কোনও মানুষই জানতে পারবেন না, যে রাজনৈতিক দলগুলোকে কে বা কারা আর্থিক মদত দিচ্ছে? কোনও মানুষই জানবেন না, তিনি যাকে বা যে দলকে ভোট দিচ্ছেন, তার সমস্ত নীতিগুলোকে কোন কোন শিল্পপতি বা ব্যক্তি সমর্থন করছেন এবং তার পিছনে উদ্দেশ্যই বা কী? আমরা একদিকে যখন অঞ্চল স্তরের নেতা মন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবো, তখন কি এই নির্বাচনী বন্ডের মতো আইন সম্মত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও কথা বলবো না? আমরা যখন বলবো ‘এবার আসল পরিবর্তন’ আর নরেন্দ্র মোদীর জোড়হাত করা ছবি সারা বাংলায় প্রদর্শন করবো, তখন কি এই নির্বাচনী বন্ডের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চুপ করে থাকব? যখন বলবো ‘আর নয় কাটমানি’ তখন এই আইনানুগ তোলাবাজি চলতেই থাকবে? দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন এই বিষয়ে চুপ করেই থাকবে তখন কি নাগরিকদের দায়িত্ব নয় এর বিরুদ্ধে কথা বলার? ২০১৪ সালের আগে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে হাওয়া তৈরি করা গেছিল, এখন বাংলায় অঞ্চল স্তরের নেতাদের দুর্নীতিকেই একমাত্র বড় করে দেখিয়ে আসলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বড় দুর্নীতি থেকে চোখ সরিয়ে নজর ঘোরানোর প্রক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু আমরা কি সেটা বুঝতে পারছি, বা বলা ভালো বুঝতে চাইছি?
(লেখক গণআন্দোলনের কর্মী। )