নির্বাচন, বাম ইশতেহার ও রামধনু অধিকার


  • April 1, 2021
  • (0 Comments)
  • 1596 Views

গত ৩০ মার্চ বাম জনপ্রতিনিধিরা ও আট’টি কেন্দ্রের মনোনীত প্রার্থীরা কলকাতা ও জেলার প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের সঙ্গে এক আলোচনায় যোগ দেন কলকাতার শ্রমিক ভবনে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।

 

পশ্চিমবঙ্গে সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য প্রচার কর্মসূচী নিচ্ছেন নানাবিধ, চলছে মিছিল-মিটিং, বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রার্থীরা ভোটারদের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব চালাচ্ছেন জোরদার। তারই মাঝে অনেক রাজনৈতিক দল নিজেদের দলীয় অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী কিছু বিশেষ কর্মসূচীও নিয়েছেন। গত লোকসভা নির্বাচন মানে ২০১৯-এ দেখা গেছিল এ রাজ্যে বাম দলগুলি প্রতিবন্ধী, যৌনকর্মী, প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের সঙ্গে আলাদাভাবে মিটিং করে, তাদের দাবি-দাওয়া বোঝার চেষ্টা করেছিলেন এবং কীভাবে রাজনৈতিক দল হিসাবে তাদের প্রার্থীরা জিতলে তারা সেগুলি পূরণের চেষ্টা করবেন সে বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। বাম দলগুলির নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিবারই প্রান্তিক মানুষদের উল্লেখ থাকে, নাগরিক হিসাবে তাদের মৌলিক অধিকার, জীবন-জীবিকার অধিকার কীভাবে সুনিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

 

এ বছরেও ‘বামফ্রন্টের ইশতেহার’-এর শেষ অংশে ‘বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প’ বিভাগের ১৯ নম্বর পয়েন্ট-এর তিন নম্বর লাইনে বলা হয়েছে “তৃতীয় লিঙ্গ ও অন্যান্য প্রান্তিক যৌন এবং লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের (LGBTQIA+) জন্য প্রয়োজনীয় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে।” এই একটি লাইনের মধ্যে দিয়ে যদিও স্পষ্ট হয়নি যে পশ্চিমবঙ্গে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের যারা এখনও সামাজিকভাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, কীভাবে তাদের প্রয়োজন নিরূপন করা হবে ও কী ধরনের ব্যবস্থা করা হবে। কিছুটা ধোঁয়াশার মাঝেই সামনে আসে ‘লেফট ফর রেনবো রাইটস’ নামের একটি স্বতন্ত্র প্রচার। এই প্রচারে শুধুমাত্র প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের জন্য কী কী ক্ষেত্রে বাম সরকার গঠিত হলে কাজ করা হবে এবং তাদের মৌলিক সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও দাবিগুলি বাস্তবায়িত করা হবে তা বিশদে আলোচনার মাধ্যমে একটি খসড়া দাবিপ্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। রাজ্যের ভোটাধিকার প্রয়োগকারী এক বড় সংখ্যক নাগরিকের প্রান্তিক অবস্থানজনিত চাহিদার কথা মাথায় রেখে এ ধরনের দাবিপ্রস্তাব তৈরির প্রচেষ্টা অবশ্যই আলাদা করে চোখে পড়ে। এই দাবিপ্রস্তাবকে সামনে রেখেই গত ৩০ মার্চ বাম জনপ্রতিনিধিরা ও আট’টি কেন্দ্রের মনোনীত প্রার্থীরা কলকাতা ও জেলার প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের সঙ্গে এক আলোচনায় যোগ দেন কলকাতার শ্রমিক ভবনে।

 

সরকার ও প্রধান বিরোধী দলগুলির কারওর তরফ থেকেই এ ধরনের প্রয়াস চোখে না পড়লেও বামফ্রন্টের এই উদ্যোগ সাড়া ফেলেছে। তবে বিতর্ক পিছু ছাড়ল না জনপ্রতিনিধি, প্রার্থী এবং প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির মানুষদের এই আলোচনাসভার। সভার উদ্দেশ্য, আলোচনার বিষয়বস্তু ও সভায় উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য বেশ প্রবল হয়ে ওঠে। যদিও উদ্যোক্তা রাজনৈতিক দল ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বারেবারে এই কথাও উঠে আসে যে হয়তো এই কথাবার্তা ও মত বিনিময় প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে চেষ্টা তা প্রতিরোধ করা সম্ভব, বিশেষত যখন ধর্ম-জাতি-বর্ণের নামে ফ্যাসিবাদী শক্তির আগ্রাসন এদেশে প্রকট হয়ে উঠেছে।

 

যে আটজন প্রার্থী এদিন উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন – বালী কেন্দ্রের দীপ্সিতা ধর, বেহালা পূর্ব কেন্দ্রের শমিতা হর চৌধুরি, বেলেঘাটা কেন্দ্রের রাজীব বিশ্বাস, কাশীপুর বেলগাছিয়া কেন্দ্রের প্রতীপ দাশগুপ্ত, বালিগঞ্জ কেন্দ্রের ফুয়াদ হালিম, মানিকতলা কেন্দ্রের রূপা বাগচি, দমদম কেন্দ্রের পলাশ দাস, যাদবপুর কেন্দ্রের সুজন চক্রবর্তী। ছিলেন বাম গণ আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও সদস্যরা যেমন কনীনিকা বোস, ইশিতা মুখোপাধ্যায়, প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত। প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অনেকগুলি সংগঠনের প্রতিনিধিরা, পুরনো-নতুন সদস্যরা। তাঁদের মধ্যে থেকেই মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়েছিল কয়েক জনকে, যাঁরা নিজেদের বক্তব্য সম্প্রদায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরেন। এর মাঝেমাঝেই বক্তব্য রাখতে থাকেন উপস্থিত প্রার্থীরা। সভা নির্ধারিত সময়ের পরেও গড়িয়ে যায় কারণ উপস্থিত শ্রোতা ও অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের মত ও বক্তব্য প্রকাশের জন্য আগ্রহ দেখাতে থাকেন। ভোট রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যা যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। বামফ্রন্টের প্রার্থী ও গণ আন্দোলনের নেতৃত্বরা বারেবারেই বলতে থাকেন এই আলোচনাসভা আদপেই ভোট প্রচারের কৌশল নয়, বরং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাককালে যে কথোপকথনের পরিসর তৈরি হয়েছিল তাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে চলা ও নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়েও সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অংশ। অন্যদিকে সভায় উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও এখানে আলোচিত দাবিপ্রস্তাবের বাস্তবায়নের সম্ভাবনা বা উদ্যোক্তাদের সঠিক উদ্দেশ্যকে বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের দীর্ঘদিনের অধিকার আদায়ের লড়াই এবং বিভিন্ন স্তরে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা, তার প্রতিরোধে জোটবদ্ধ আন্দোলন এবং রাজনৈতিক দলগুলির অনুপস্থিতি তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কারণ, নিঃসন্দেহে। তাই এহেন উদ্যোগকে ভোট টানার কৌশল বলে প্রশ্ন তুলতেও তারা পিছ পা হননি। পাশাপাশি এ ধরনের আলাপচারিতা যে চালিয়ে যাওয়া উচিত তাও স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন।

 

এই দাবিপ্রস্তাবে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, মৌলিক অধিকার ও দাবিগুলি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি পরিশেষে বলা হয়েছে “এলজিবিটিকিউআইএ+ কমিউনিটির সমস্ত মানুষেরা যাতে সম্মানের সাথে, মর্যাদার সাথে বসবাস করার সুযোগ পায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কোনওরকম বিভেদ বিভাজনকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। জেলায়, জেলায়, ব্লকে ব্লকে প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের সাথে কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই নির্দিষ্ট পরিসর থেকে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার পরিচয়ের মানুষদের উপর যেকোনো ধরনের আক্রমন ও অধিকারের বিষয়গুলি নিয়ে বামপন্থীরা লড়াই, সংগ্রাম ও সংগঠনের ক্ষেত্র তৈরি করবে।”

 

অপ্রতিম রায় যেমন শুরুতেই বললেন প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির মানুষদের নিয়ে একটি রাজ্যব্যাপী সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মনে করিয়ে দিলেন লকডাউনের সময়ে বামপন্থী সংগঠনের তরফ থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন জেলায় এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষদের খাদ্যাভাব ও অনাহারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। দেখা দরকার সেই দাবি জানানোর পর সরকার কী করল। দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য প্রয়োজনে রাজভবন ঘেরাও বা দিল্লির বুকে আন্দোলন শুরুর ডাকও দেন তিনি।

 

১৯৯৯ সালে কলকাতার প্রথম গে প্রাইড ওয়াকে অংশগ্রহণকারী রফিকুল ইসলাম বলেন শুধুমাত্র পলিসি তৈরির স্তরেই বিষয়টি আটকে রাখলে চলবে না, প্রয়োজন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ভোট চাইবার যদি দরকার থাকে তাহলে উদ্যোগ নিয়ে এই সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার একটি ডাটাবেস তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজন স্কুল স্তরে সচেতনতা তৈরি করা। সুস্থ, অর্ন্তভুক্তিমূলক সার্বিক সমাজ তৈরির পরিকল্পনা করতে হবে। প্রান্তকথা সংগঠনের বাপ্পাদিত্য মুখার্জি বলেন ‘রামধনু’ জনগোষ্ঠীর গণসংগঠন তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা। কোন্ রাজনৈতিক দল সেই দায়িত্ব নিচ্ছে তা দেখা প্রয়োজন। তিনি জানান, মনে রাখা দরকার এই সম্প্রদায়ের মানুষ একমাত্রিক নন, তাদের বক্তব্য, ‘ভয়েস’ এক হবে না।

 

প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্টের অনিন্দ্য হাজরা স্পষ্টই জানান এইভাবে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি শোনা ও তাতে আস্থা রাখা ট্রাপিজের খেলায় লিপ অফ ফেইথ-এর মতোই। রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের মানুষেরা একটু একটু করে এই বিশ্বাস তৈরি করছেন, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন, এটিও তেমন। তবে এভাবে আলাদা করে এই সম্প্রদায়ের জন্য দাবিপ্রস্তাব তৈরি হওয়ায় যে তিনি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছেন, বিশেষত ‘এলজিবিটিকিউআইএ+’ শব্দবন্ধ আদৌ এই সম্প্রদায়ের অধিকার আন্দোলনে কোনও নতুন মাত্রা যোগ করছে কি না, না কি কেবলই ‘অক্ষরের খিচুড়ি’ তৈরি করে পরিচিতির আন্দোলনকে জটিল করে তুলছে সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। তিনি বলেন বামফ্রন্টের শরিক সংগঠন ও গণ সংগঠনগুলিকে এই সম্প্রদায়ের ইস্যুগুলিকে গভীরভাবে বুঝতে হবে, নিজেদের বোঝাপড়া ও চিন্তাভাবনার জায়গাগুলি ফিরে দেখতে হবে। সংগঠন হিসাবে, ব্যক্তি হিসাবে নিজেদের মধ্যে থাকে ‘সেক্সিজম’, ‘হোমোফোবিয়া’ চিহ্নিত করাও সেক্ষেত্রে জরুরি। এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ‘বিশেষ’ বলে ‘অপর’ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। আলাদা করে দাবিপ্রস্তাব নয় ইস্তেহারের প্রতিটি খোপেই একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির মানুষদের স্বাভাবিক মৌলিক অধিকার যাতে নিশ্চিত করা হয় সেই দাবি তোলেন তিনি। তিনি প্রশ্ন তোলেন বামফ্রন্টের শরিক দলের প্রচারে ব্যবহৃত একটি নির্দিষ্ট গানে নারীবিদ্বেষের প্রসঙ্গ এনে, মনে করিয়ে দেন অনেক জেলাতেই বাম মনোভাবাসম্পন্ন ছাত্র সংগঠন দ্বারা এই সম্প্রদায়ের মানুষদের হেনস্থার কথা। যাতে সূচকগুলিকে সংগঠনের তরফে প্রশ্ন করা হয়, ‘টোকেনিজম’-এর রাজনীতি না হয়ে ওঠে সে দাবিও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলি যাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতেও সোচ্চার হন ও এখনও যে তা নেই তা মনে করিয়ে দেন তিনি। রূপান্তরকামী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী অপর্ণা ব্যানার্জী বলেন দাবিপ্রস্তাবটি যথেষ্ঠ ‘হোমওয়ার্ক’ করে করা ও উদ্যোগটি সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু এখনও যে নির্বাচনের সময়ে তাঁদের কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। তিনি বিশেষ করে বলেন কলেজে পাঠরত রূপান্তরকামী পড়ুয়াদের কথা যাদের ছাত্র সংগঠনের দ্বারা হেনস্থা হতে হয়, যেখানে বহু সময় হয়তো বাম মনোভাবাসম্পন্ন সংগঠনও থাকে। ফলত এই সচেতনতা তৈরির প্রক্রিয়াটি যে লাগাতার ও বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতিকভাবে চালিয়ে যাওয়া জরুরি, তা মনে করিয়ে দেন তিনি।

 

রূপান্তরকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী রঞ্জিতা সিনহা জানান যে রাজনৈতিক দল সম্প্রদায়ের উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করবে তিনি বিনা দ্বিধায় তাদের পাশে থাকবেন। বামফ্রন্টের এই উদ্যোগকে তিনি অন্তত কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার, মত আদান-প্রদানের একটি মঞ্চ হিসাবে এগিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান। রূপান্তরকামী সিন্টু বাগুই তাঁর বক্তব্যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যার বিভিন্ন স্তর তুলে ধরেন যেখানে শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষদের পাশে থাকার দাবি করা বামফ্রন্টের কাজ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। সিন্টু রূপান্তরকামী হওয়ার পাশাপাশি যৌন কর্মীর সন্তান ও একজন দলিত। অবস্থার প্রেক্ষিতে একজন স্কুল ড্রপ আউট। শ্রমিক হয়ে কাজ করতে গিয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু পাশে পাননি কোনও রাজনৈতিক দলকে। তিনি প্রশ্ন তোলেন শুধু নির্বাচনের আগেই কেন তৈরি হবে মত আদান-প্রদানের পরিসর? সদিচ্ছা যখন রয়েছে তখন যাতে এই প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে তার দাবি রাখেন তিনি। আরেক জন রূপান্তরকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী তিস্তা দাস সরাসরি অভিযোগ করেন যে এই পরিসরটি তৈরি করা নিছকই ভোটের রাজনীতি। তিনি জানান তাঁর এলাকার বামপ্রার্থী গত লোকসভা নির্বাচনে এ জাতীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করে ও পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরবর্তী সময়ে আর এই ইস্যুতে পাশে থাকেননি। আসলে লিঙ্গ রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে আরও সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন। বিশেষ প্রয়োজনে তারা যেন পাশে দাঁড়ায় তা তাদের বোঝাতে হবে।

 

কোচবিহার থেকে এসেছিলেন রূপান্তরকামী ডলি রায়। তাঁর কথায় ফুটে উঠছিল জমে থাকা ক্ষোভ ও অপ্রাপ্তি। ছোট শহরে প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষদের সামাজিক অবস্থান যে কতটা প্রান্তিক হতে পারে তা বোঝা যাচ্ছিল তাঁর বক্তব্যে। তিনি অভিযোগ করেন,  “যখন নারীদেরই সুরক্ষা নেই, তখন রূপান্তরকামী মানুষদের গোটা জীবনটাই শুধু নিজেদের গোছাতে গোছাতে কেটে যায়। আমরা যেন বহিরাগত। আমরাও তো পরিযায়ী কর্মী। কই আমাদের কথা তো কেউ বলে না। কোথায় আমাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা? আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যই যেখানে ঠিক থাকে না, সেখানে স্বাস্থ্যের কথা আর কীই বলব!” সম্পূর্ণ অন্য একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রূপান্তরকামী নারী দিয়াশা। মঞ্চে উপস্থিত জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, “সিএএ, এনআরসি ও ট্রান্স বিল নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন? আমরা কি আদৌ নাগরিক? ফ্যাসিস্ট শক্তি যখন এই বিলগুলির জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে আমরা কোথায় দাঁড়াব? এই যে আপনাদের এতজন প্রার্থী তাদের মধ্যে একজন কী প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার হতে পারতেন না? আমাদের কথাটা আমাদেরই কারওর মাধ্যমে উঠে আসাটাও খুব জরুরি। পরিবর্তন আসলে প্রতিটি ধাপেই প্রয়োজন।”

 

বামফ্রন্টের উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ও প্রার্থীরা বারেবারেই বলেন যে নিশ্চিতভাবেই এই লড়াইতে তাদেরও অনেকটাই শেখার রয়েছে ও এ এক দীর্ঘমেয়াদী লড়াইও। তবে বামপন্থী রাজনীতির ধারা মেনেই বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এই অধিকারের লড়াই-ই মূলধারার রাজনীতি। তরুণ বাম প্রার্থী দীপ্সিতা ধর যেমন বলেন, এই ‘অপর’ করে রাখার যে চেনা ছক তা ভাঙার প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই ভাবনাচিন্তা, কাজ শুরু করেছেন। সরকারের যে কার্যব্যবস্থা, সেক্ষেত্রে সরকার গড়তে পারলে তাঁরা নির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করে কাজ করবেন। ‘লার্নিং’ ও ‘আনলার্নিং’ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে তাঁরা প্রস্তুত। উল্লেখ করা যেতে পারে দীপ্সিতার নিজের প্রচারেই সাথী হয়েছেন রূপান্তরকামী শিল্পী। রাজনৈতিক প্রচারে এই অর্ন্তভুক্তিকরণে তরুণ বামকর্মী নতুন পথে হেঁটেছেন।

 

তবে এদিনের সভায় যে বিষয়গুলি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল, বক্তা হিসাবে সমকামী নারীদের ও রূপান্তরকামী পুরুষদের তথা প্রচলিত লিঙ্গ পরিচিতির বাইরে থাকা ব্যক্তিদের অনুপস্থিতি। রূপান্তরকামী পুরুষ রাহুল মিত্র বলেন, “ট্রান্সম্যান-রা সব সময়েই পেছনে। এতজনকে বলতে ডাকলেন একজন ট্রান্সম্যানকেও নয় কেন? এ রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড এত বছরে কী কাজ করেছে তার খতিয়ান কে চাইবে? আমাদের কথা মুখ্যমন্ত্রী কোথাও বলেন না। আপনারা ক্ষমতায় এলে যে তা করবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়? আমরা শারীরিকভাবে নারী বলেই কী এই অবজ্ঞা?” তাঁর পরে রূপান্তরকামী পুরুষ দীপন চক্রবর্তী, অঙ্কন বিশ্বাসরাও তাঁদের বলার সুযোগ দেওয়ার কথা না ভাবার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

 

এদিনের আলোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট – নির্বাচন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আসবে। শাসক, বিরোধী অবস্থান বদলাবে। কিন্তু তথাকথিত প্রান্তিক মানুষদের অধিকারের লড়াই ছিল, আছে ও থাকবে। যে রাজনৈতিক দল ভোটের স্বার্থ দেখে নয় – মানুষের, নাগরিকের অধিকারের গুরুত্ব ও তার নানাবিধ স্তর সঠিকভাবে বুঝে সেই লড়াইয়ের শরিক হতে পারবেন তারাই আস্থা অর্জন করবেন। বামফ্রন্টের ইশতেহারে অন্তত অর্ন্তভুক্তির ইতিবাচক দিকটুকু দেখা গেছে। বাকিটা সময় বলবে।

 

Share this
Leave a Comment