নিজেদের অধিকার এবং সুরক্ষার দাবি নিয়ে ২৭ই মার্চ কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মোট ২১টি সংগঠন। মূলত তাঁদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, নানারকমের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান ইত্যাদি বিষয় রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই এই সাংবাদিক সম্মেলন। গ্রাউন্ডজিরো-র প্রতিবেদক সৌরব চক্রবর্ত্তী-র রিপোর্ট।
লিঙ্গ রাজনীতি ও লিঙ্গ সচেতনতায় ভারতবর্ষ এখন-ও পিছিয়ে এই বিষয়টি নতুন ভাবে আর বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোতে আমাদের এখন-ও এই শিক্ষাই দেয়া হয় যে, সমাজে মাত্র দুই লিঙ্গের মানুষ বাস করে। পরিকল্পিত ভাবেই ভুলিয়ে দেয়া হয় হিজড়েদের প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরেও এই সংকীর্ণতা থেকে বের হতে পারেনি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজনৈতিক দলগুলি-ও এই বিষয়ে রা-হীন। নিজেদের অধিকার এবং সুরক্ষার দাবি নিয়ে ২৭ই মার্চ কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মোট ২১টি সংগঠন। মূলত তাঁদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, নানারকমের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান ইত্যাদি বিষয় রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই এই সাংবাদিক সম্মেলন।
এদিনের অনুষ্ঠানের একেবারে প্রথমে আলোচনা করেন অভিনব, তিনি বলেন, “জানুয়ারি মাস থেকে আমরা এই উদ্যোগটি নেয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আলাদা আলাদা মোট ২১টি সংগঠনের প্রায় ১৫০ জন মানুষ আমাদের এই উদ্যোগে সামিল হয়ে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন। ‘Bengal Trans and Queer Charter of Demands’ এই নামে আজকের সাংবাদিক সম্মেলনটি আয়োজন করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া আছে যা আমরা তুলে ধরতে চাইছি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির কাছে। কারণ বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর এক বা একাধিক দল মিলে যখন সরকার গঠন করবে তখন যেন আমাদের এই দাবি সনদ নিয়ে তাঁরা ভাবতে বাধ্য হয়।”
সামাজিক কর্মী তিস্তা তাঁদের দাবিসনদে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “শিক্ষা যে-কোনো জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষার মধ্য দিয়েই একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে উন্নত করে তোলা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই পরিকাঠামো অন্যান্য লিঙ্গের মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে থাকলেও আমাদের জন্য সেই বরাদ্দ প্রায় শূন্য। শিক্ষার অধিকার আইনে আমাদের জন্য বিশেষ কিছুই নেই। একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন আলাদা হোস্টেলের সুবিধা পাবো না, এই প্রশ্ন করার সময় এসেছে এখন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিকলাঙ্গ, মহিলা ও পুরুষেরা নানান কোটা ও সুবিধা ভোগ করে থাকলেও সরকার আমাদের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সেক্ষেত্রে শিক্ষা না থাকায় আমাদের রাস্তাতেই নেমে আসতে হয়েছে। যা একজন মানুষ হিসেবে আমাদের মানাতে পারে না।”
স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য আলাদা করে কোনো সুবিধা না থাকার কারণে নানান সময়ে বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়, এই অভিযোগ তুলে আয়োজকদের একজন রাহুল বলেন, “হাসপাতালগুলিতে আমাদের জন্য কোনো সুবিধা নেই। আমাদের দাবি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে আমাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রাখতে হবে এবং তৃতীয় লিঙ্গের ডাক্তার ও নার্সকে সেখানে নিযুক্ত করতে হবে। করোনাকালে আমাদের বাকিদের মতোই ভ্যাকসিন নেয়ার সুবিধা করে দিতে হবে। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে আমাদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফর্ম থাকতে হবে।”
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনেই প্রথম বার নিজেদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভোট দিতে পেরেছিলেন এ দেশের রূপান্তরকামীরা। পাঁচ বছরে তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সারা দেশে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে তৃতীয় লিঙ্গের মোট ভোটার ছিলেন ২৮,৫২৭ জন, যা ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এসে দাঁড়িয়েছিল ৩৮,৩২৫। এই সংখ্যার নিরিখে শীর্ষ স্থানে ছিল উত্তরপ্রদেশ। তার পরেই কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ। প্রবাসীদের মধ্যেও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে। যদিও অরুণাচলপ্রদেশ, গোয়া, হরিয়ানা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, দাদরা ও নগর হাভেলি এবং লক্ষদ্বীপ থেকে এক জন ভোটারও নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গ বলে চিহ্নিত করেননি।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব বলছে, ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ছিলেন মাত্র ৪৯৯ জন। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে সেই সংখ্যাটা ছিল ৭৫৭। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৪২৬। ২০২১ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়েছে তা বলাই যায়। তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে রূপান্তরকামীদের সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ ৮৮ হাজার। এ রাজ্যে ৩০ হাজার ৩৪৯ জন। অর্থাৎ, রাজ্যে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত মানুষের সংখ্যার তুলনায় ভোটার তালিকার পরিসংখ্যান নেহাতই নগণ্য।
আলোচনা করেন দীর্ঘদিনের সমাজকর্মী অপর্ণা, তিনি বলেন “তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার হিসেবে নথিভুক্ত হতে হলে প্রথমে চিকিৎসক এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সার্টিফিকেট নিয়ে নাম পরিবর্তন করতে হবে কোনও হিজড়ে, রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিতকে। তার পরেই মিলবে ভোটার তালিকায় তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি, যা যথেষ্ট সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। আমরা কেন বাকিদের মতো করে বাঁচতে পারবো না! ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন ৯ জন রূপান্তরকামী, যাঁদের কেউ উত্তরপ্রদেশ, আবার কেউ তামিলনাড়ু বা কর্নাটকের বাসিন্দা। কিন্তু এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত কোনও রূপান্তরকামীকে প্রার্থী করেনি প্রথম সারির কোনও রাজনৈতিক দল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির ভোটের আগে শুধুমাত্র মনে হয়, তার আগে এতোগুলি মানুষ যে সমাজে বাস করে তার কোনো হিসেব রাখে না তাঁরা। আমাদের উপর প্রতিনিয়ত সামাজিক চাপ থাকে, সামাজিক ছুতমার্গ কাটাতে পারছেন না অনেকেই। পারিবারিক চাপও থাকে অনেক ক্ষেত্রে। এ ছাড়া, সরকার-পক্ষ আমাদের বিষয়ে কতটা সংবেদনশীল, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। রূপান্তরকামীদের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার সে ভাবে উদ্যোগী হয়নি। ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডও এ বিষয়ে সে ভাবে কিছু করেনি। রূপান্তরকামীদের উপরে হেনস্থার ঘটনা বন্ধ না হলে এই পরিস্থিতি বদলাবে না। আমরা তো সরকারের ভিক্ষা চাইছি না, আমরা শুধু সমাজের বাকি মানুষদের মতো আমাদের অধিকারটুকু চাইছি। এই ভোটের সময়ে আমাদের দাবি, যে দল ক্ষমতায় আসবে তাঁরা যেন আমাদের এইসব দাবিগুলির প্রতি গভীরভাবে নজর দেয় এবং সমস্যাগুলির নিরসন করে।”
মোট ২১টি সংগঠন একই মঞ্চের নীচে এসেছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের, তার মধ্যে শিলিগুড়ি উত্তর ফাল্গুনী সোসাইটি, বর্ধমান স্বপ্নিল, বারুইপুর আশ্রয়, মালদা পরিচয় সোসাইটি, কলকাতা আনন্দম, বীরভূম সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য। তাঁদের দাবি-দাওয়া গুলির মধ্যে উলেখ্য – সামাজিক সুরক্ষা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নিশ্চয়তা, প্রশাসনিক পদে নিযুক্তি, আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান, ভোটে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়। এই মঞ্চ NRC, CAA, NPR এর প্রবল বিরোধিতা করে। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পবন।
দেরিতে হলেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা তাঁদের দাবি-দাওয়া রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এবং তাঁদের নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলছে রাজনীতি ও সমাজনীতিতে, এই মুহূর্তে যা খুবই প্রাসঙ্গিক।