নির্ভীক সাংবাদিকতার প্রতিচ্ছবি ছিলেন বিপ্লবী গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী


  • March 25, 2021
  • (0 Comments)
  • 1506 Views

আজ থেকে ঠিক নব্বই বছর আগে কানপুরের দাঙ্গায় সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হন সৎ, নির্ভীক, বিপ্লবী সাংবাদিক গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী। স্বাধীনতা আন্দোলন, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেওয়া এই লেখকের রাজনৈতিক বিচরণক্ষেত্র ছিল ভগৎ সিং থেকে গান্ধী অবধি। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।

 

“কিছু লোক হিন্দু রাষ্ট্র হিন্দু রাষ্ট্র বলে চেঁচামেচি করেন। ক্ষমা করবেন, আমি তাঁদের সাথে একমত নই। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তাঁরা খুব বড় ভুল করছেন, তাঁরা রাষ্ট্র শব্দটির মানেই বুঝে উঠতে পারেননি। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না ঠিকই, কিন্তু চারদিকের অবস্থাই আমায় বলে দিচ্ছে যে হিন্দু রাষ্ট্র এ সমাজে আর তৈরি হতে পারবে না।”

 

একথা লিখেছিলেন বিপ্লবী সাংবাদিক গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী, সাম্রাজ্যবাদী-সামন্তবাদী-সাম্প্রদায়িক শোষকদের বিরুদ্ধে অক্লান্ত আন্দোলন জারি রেখে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে নিহত হন যিনি। আজকের ভারতে জন্মালে তাঁর নামে যে ‘আন্দোলনজীবী’ ছাপ্পা পড়তই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ মূল ধারার বহু সংবাদপত্র ভয়ে এবং লোভে যেকোনো সরকারবিরোধী প্রতিবাদকে আতঙ্কবাদ বলে দাগিয়ে দেবার চেষ্টা করে চলেছে। এসময় গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর মতো সৎ, সাহসী রাজনৈতিক সাংবাদিকদের কথা বারবার মনে করতেই হবে।

 

ঠিক নব্বই বছর আগে, আজ যে দিনটি শহীদ দিবস বলে পরিচিত তার দু’দিন পরে, ২৫ মার্চ ১৯৩১ গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী শহীদ হন। ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ – এঁদের কাছের মানুষ বলে বেশি পরিচিত হলেও গান্ধী ও নেহেরু সমেত উত্তর ও মধ্য ভারতের বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর সাথেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল বিদ্যার্থীর। তাঁর প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ‘প্রতাপ’ ছিল হিন্দিভাষী কৃষক ও শ্রমিকদের বহু লড়াইয়ের সাথী। পাঁচবার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে – তিনবার ‘প্রতাপ’-এ প্রকাশিত লেখার কারণে, আর দু’বার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেবার কারণে। এছাড়া বহুবার তাঁর নামে মোটা অঙ্কের ফাইন জারি হয়, কিন্তু একবারের জন্যও তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বা মুচলেকা দিতে রাজি হননি।

 

ধর্মীয় গোঁড়ামি ও হিংসার বিরুদ্ধে আজীবন বক্তব্য রেখে যাওয়া বিদ্যার্থীকে হত্যা করা হয় ১৯৩১-এ কানপুরের ভয়াবহ দাঙ্গা চলাকালীন, যাতে ব্রিটিশ হিসাব মতো প্রায় চারশ হিন্দু-মুসলমান নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক বিবরণ নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে।

 

২৬ অক্টোবর ১৮৯০ এলাহাবাদে বিদ্যার্থীর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। টাকার অভাবে, স্কুলের পড়া শেষ করলেও তাঁর কলেজের পড়ায় বাধা পড়ে এবং তাঁকে কানপুরে নানান চাকরি নিয়ে চালাতে হয়। পরে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. করেন।

 

লেখালেখি ও সাংবাদিকতা: বিপ্লবীদের আস্তানা হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রেস

 

“আজ সেই সময় এসে গেছে, যখন রাজনৈতিক মতবাদ এবং আন্দোলনগুলিকে শুধুমাত্র ইংরিজি শিক্ষিতদের সীমানায় বেঁধে রাখলে চলবে না, সাধারণ মানুষের [সামান্য জনতা] মধ্যে তাকে ছড়িয়ে পড়তে হবে। শুধু কিছু শিক্ষিত ব্যক্তির মতামত নয়, জনমতের আয়নায় দেশের সমস্ত শ্রেণীর মানুষের চিন্তাকে দেখতে হবে […] গণতান্ত্রিক শাসনের মানে আসলে জনমতের শাসন।”

 

বিদ্যার্থীর লেখালেখি শুরু হয় ১৯১১ সালে, আচার্য মহাবীর প্রসাদ দ্বিবেদী সম্পাদিত ‘সরস্বতী’ সাহিত্য পত্রিকায়। দ্বিবেদী, বিদ্যার্থীর প্রতিভা দেখে তাঁকে সহ-সম্পাদকের কাজে যোগ দিতে বলেন, কিন্তু বিদ্যার্থীর প্রাণের টান ছিল সাংবাদিকতায়। ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় উর্দুতে এবং গদরপন্থী পণ্ডিত সুন্দরলাল ‘কর্মযোগী’ পত্রিকায় কিছুদিন হিন্দিতে লেখালেখি করে তিনি পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য সম্পাদিত ‘অভ্যুদয়’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। এইভাবে, লেখায়-সম্পাদনায় তাঁর হাত পেকেছিল সেইসময়কার কিছু বিখ্যাত লেখক-সম্পাদকদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে।

 

‘অভ্যুদয়ে’ লিখতে শুরু করার কিছু পরেই, ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে কানপুর চলে আসেন। এখানেই, মাত্র ২৩ বছর বয়সে, শিব নারায়ণ মিশ্র, নারায়ণ প্রসাদ অরোরা, করোনেশন প্রেসের মালিক যশোদা নন্দন ইত্যাদি বন্ধু-সহযোগীদের সাথে মিলে তিনি বার করেন ‘প্রতাপ’ পত্রিকা, যা শুরুতে সাপ্তাহিক হলেও পরে রোজ প্রকাশিত হতে থাকে এবং হিন্দিভাষী অঞ্চলে তথা গোটা দেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও শ্রমজীবী আন্দোলন বিষয়ে একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা হয়ে ওঠে।

 

 

বিদ্যার্থীর প্রেস ছিল বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার আস্তানাও, আবার লেখালেখি চর্চার কেন্দ্রও। তিনি তাঁর প্রেস থেকে রাম প্রসাদ বিসমিলের আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। ভগত সিং, বিসমিল, আশফাকউল্লা, আজাদ, বটুকেশ্বররা তাঁর প্রেসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তিনি এই বিপ্লবীদের আর্থিক সাহায্যও করতেন। কাকোরি কেসে জেলে যাওয়া রোশন সিং-এর মেয়ের বিয়েতে তিনি সম্প্রদান করেন। আশফাকউল্লার সাথে তিনি শুধু তাঁর ফাঁসির আগে জেলে দেখা করেছিলেন, তাই নয়, তাঁর সমাধির উপর তিনি একটি মাজার প্রতিষ্ঠায় সাহায্যও করেন। এঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল শুধু বিপ্লবের সূত্রে নয়, বন্ধুত্বের সূত্রেও।

 

বিদ্যার্থীর সাংবাদিকতা রাজনৈতিক দলীয় ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করত। তাঁর প্রকাশিত লেখায় বৈপ্লবিক সুর থাকলেও অনেক লেখা আবার কংগ্রেস নীতির পক্ষেও ছিল। ১৯১৬ সালে গান্ধীর সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়। গান্ধীর সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও ব্রিটিশ সরকারের হিংস্র শোষণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি গান্ধীর অহিংস নীতিকে মেনে নিতে রাজি হননি।

 

রাজনীতি: কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান

 

শুধু লেখার ভিতর দিয়ে নয়, বিদ্যার্থী নিজে নানা আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেন। তাই গান্ধী তাঁর মৃত্যুকে “শানদার” বলেছিলেন; বলেছিলেন, এমন মৃত্যু তাঁরও কাম্য। বিদ্যার্থী ছিলেন কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং কংগ্রেস অফ ইউনাইটেড প্রভিন্সেস(আজকের উত্তর প্রদেশ)-এর রাজ্য সভাপতিও।

 

১৯২০-র আশেপাশে ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে বেশ কিছু কৃষক আন্দোলন ঘটে। শুধু ব্রিটিশের শোষণ নয়, এই আন্দোলনগুলিতে স্থানীয় তালুকদারদের অত্যাচারের ছবিও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৯২১-এর ৬ ও ৭ জানুয়ারী রায়বেরিলির মুনশিগঞ্জে কৃষক মিছিলের উপর পুলিশের গুলি চলে, তেরজন কৃষক মারা যান। ১৩ জানুয়ারী ‘প্রতাপ’ পত্রিকায় বিদ্যার্থী তীব্র ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করে, একে জালিয়নওয়ালাবাগ গণহত্যার সাথে তুলনা করে ‘ডায়ারশাহী, ও ডায়ারশাহী’ (জালিয়নওয়ালাবাগ কাণ্ড-কুখ্যাত সার মাইকেল ও’ডায়ার-এর নামে) নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর ফলে, কৃষকদের উপর গুলি চালাবার হুকুম দেন যে তালুকদার বীরপাল সিংহ, তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে ‘প্রতাপ’ পত্রিকার নামে মানহানির মামলা আনেন। বিদ্যার্থীর পক্ষে মতিলাল ও জওহরলাল নেহেরু, কৃষ্ণ মেহতা প্রমুখ নেতারা সাক্ষ্য দিলেও শেষ অবধি তাঁর প্রথম কারাবাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই মামলা।

 

কানপুরের শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি অংশ নেন। কানপুর সেসময় থেকেই শিল্পকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল – বিদ্যার্থী বহু শ্রমিক মিছিল ও অবরোধে অংশ নিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জের মুখোমুখি হন। ১৯১৭-১৮ সালে ‘হোম রুল’ আন্দোলনেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। ১৯১৯-এর ডিসেম্বরে কানপুরে কাপড়ের মিলের ২৫,০০০ শ্রমিকের ঐতিহাসিক ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। কংগ্রেস নেতা হিসাবে ১৯২৭ থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কানপুর মজদুর সভার সভাপতি ছিলেন।

 

১৯১৯ সালে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত শ্রমিক সম্মেলনে ভারতের শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গে ওই বছর ১৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যার্থী একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন – ‘দেশের শ্রমিকদের অবস্থা’ নামে। তাতে তিনি লেখেন –

 

“‘শ্রমিক’ বলতে আমরা মিল ও কারখানার কর্মীদের কথা বলছি। বম্বে, কলকাতা, আহমেদাবাদ, নাগপুর, কানপুর, দেহলী ইত্যাদি শহরে ছোটবড় মিল মিলিয়ে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। লোকে ভাবে, শ্রমিকদের অবস্থা ভালো, বাঁধা মাইনে, সকালে কাজে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে, মাস গেলে মাইনে পায়। কিন্তু একথা ভুল। এই শ্রমিকদের অবস্থা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের তুলনায় খারাপ।”

 

দিনে ১২ ঘণ্টা শ্রম ও থাকাখাওয়ার চূড়ান্ত অব্যবস্থার বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন –

 

“ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে কোনোক্রমে কিছু মুখে তুলে তাঁদের আর কিছু নিয়ে ভাববার মতো অবস্থা থাকে না। […] বহু কারখানায় তাঁদের সাথে অসভ্য ব্যবহার করা হয়, ছোটখাটো ছুতোয় অপমান করা হয়, গায়ে হাত তোলা হয়। […] কারখানার মালিক আর তাদের বড়মাপের চাকরদের এমন নির্মম, নীরস, নীচুমানের ব্যবহারে শ্রমিকদের আত্মার মৃত্যু ঘটে, তাঁদের স্বাধীনতার বোধ চলে যায়, তাঁদের ভিতর ভয় জন্ম নেয়। মালিকপক্ষের অসভ্যতা ও নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে তাঁদের অন্তর দূষিত হয়ে পড়ে। […] লাখ লাখ নারী-পুরুষের আচার-ব্যবহার এইভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মিলে-কারখানায় শরীর-আত্মা বলিদান দিয়ে লাখ লাখ ভাইবোন যেভাবে পেট চালাচ্ছেন, তা থেকে ভালো কিছু হতে পারে না।”

 

আফ্রিকা-ফিজি-জাপান-ইউরোপের শ্রমিকদের সাথে তুলনা করে এরপর বিদ্যার্থী শ্রমিকদের ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রচারের প্রয়োজনের কথা বলেছেন, কাজের সময় কমানোর কথা বলেছেন। সেসব কথা আজ প্রায় এক শতাব্দী পরেও একইভাবে প্রযোজ্য থেকে গেছে – এই দুর্ভাগ্য।

 

ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মৃত্যু

 

“আজান দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, নাক টিপে আর নামাজ পড়ে ধর্ম হয় না। শুদ্ধ আচরণ আর সৎ ব্যবহারই ধর্মের আসল চিহ্ন। দু’ঘণ্টা পুজো করে বা পাঁচবার নামাজ পড়ে বাকি সময়টা যদি আপনি নিজেকে বেইমানি করার আর লোককে নির্যাতন করে বেড়াবার স্বাধীনতা দেন, তাহলে আগামী দিন আপনার সে ধর্মকে টিকে থাকতে দেবে না।”

 

আশাবাদী বিদ্যার্থী নিজের জীবন দিয়ে প্রশ্ন রেখে গেছেন, তাঁর দেশকে সাম্প্রদায়িকতা গিলে খেতে পারবে কি না। যদিও তাঁর মৃত্যু ঘিরে যেমন একদিকে রয়েছে মুসলমান দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়ার গল্প, তেমনই রয়েছে দাঙ্গার ছলে ব্রিটিশ শাসকের তরফে তাঁর বিরুদ্ধে গুন্ডা লাগিয়ে খুন করাবার গল্প, কারণ তাঁর মতো শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা এবং সংবাদ ও রাজনীতি মাধ্যমকে একইসাথে ব্যবহার করে দেশের নানান প্রতিবাদী শক্তিকে মিলিয়ে দেবার ক্ষমতা খুব বেশি লোকের হয়তো ছিল না।

 

তবে এ নিয়ে দ্বিমত নেই যে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি কানপুরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান সাধারণ মানুষকে বাঁচাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ৫ মার্চ গান্ধী-আরউইন চুক্তি ও ২৩ মার্চ ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি উপলক্ষ্য করে এমনিতেই জনতার ভিতর উষ্মা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ব্রিটিশ সরকারও একে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে নানা চেষ্টা করে চলেছিল। কানপুরের দাঙ্গা আপাত ভাবে শুরু হয় হিন্দু কংগ্রেসি নেতাদের ডাকা ধর্মঘটে স্থানীয় মুসলমান দোকানদারদের যোগ না দিতে চাওয়া নিয়ে। ২৩ মার্চের পরে দাঙ্গার তীব্রতা বাড়তে থাকে। বিদ্যার্থী এইসময় এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছেন, কীভাবে পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাধে হিংসার ঘটনা ঘটে যেতে দিচ্ছিল। বেশ কিছু মানুষকে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা মিলে বাঁচাতে পারলেও ২৫ মার্চ তাঁরা আক্রান্ত হন এবং দু’দিন পরে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহটি খুঁজে পাওয়া যায়।

 

 

গান্ধী এই নির্ভীক সাংবাদিকের অকালমৃত্যু নিয়ে বলেন, তাঁর মৃত্যু হল সেই সিমেন্ট, যা এই দুই সম্প্রদায়কে মিলিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বিদ্যার্থীর নিজের লেখাতেই পাওয়া যায় এবিষয়ে আরো মোক্ষম এক উক্তি, যা আজকের রাজনীতিকরাও চমৎকার বোঝেন এবং দলের স্বার্থে ব্যবহার করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান –

 

“এইসময় দেশে ধর্মের নামে মহাধুম চলছে। নির্যাতন করা হয় – সেও ধর্ম আর বিশ্বাসের নামে, জেদাজেদি করা হয় – সেও ধর্ম আর বিশ্বাসের নামে। রামুয়া পাসি আর বুদ্ধিমিয়াঁ ধর্ম আর বিশ্বাস কী তা জানুন বা না-ই জানুন, ধর্ম আর বিশ্বাসের নাম শুনলেই তাঁরা হামলে পড়ে মরতে ও মারতে প্রস্তুত। দেশের সব শহরেই একই অবস্থা। হামলে পড়া মানুষটির ত্রুটি খালি এই যে, তিনি কিছুই বুঝতে পারেন না আর অন্য লোকে তাঁকে যেখানে জুতে দেয়, তিনি সেখানেই লেগে পড়েন।”

 

গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী ছিলেন খুব সম্ভবত ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারানো প্রথম সাংবাদিক। আজ দেশের সাংবাদিকদের এক অংশ দাঙ্গা থামানো দূরের কথা, দাঙ্গা বাধাতেই বেশি উৎসাহী। তবু আশা থাকে, বিদ্যার্থীদের দমিয়ে রাখা যায় না।

 

ছবি – গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর ছবি ও লাবনী জঙ্গির আঁকা ২০১৯ দিল্লি দাঙ্গার একটি ছবি

Share this
Leave a Comment