২০১৯ ও ২০২১ এক নয়; অতিমারি পর্বের অভিঘাত বদলে দেবে জয়-পরাজয়ের বহু হিসাব-নিকাশ


  • March 22, 2021
  • (2 Comments)
  • 1138 Views

বিজেপি এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসছে এমন কোনও সাধারণ বোধ এখনও তৈরি হয়নি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনী ইস্যুতেও বদল ঘটেছে। জ্বলন্ত জাতীয় ইস্যু যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে স্থানীয় ইস্যুও। আবার জাতীয় ইস্যুগুলির, কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক নীতির অভিঘাতও নানা মাত্রায় এ রাজ্যের শ্রমিক-কৃষক-চাকুরিজীবীদের উপর পড়েছে। যার জেরে তা বিধানসভা ভোটেরও বিষয় হয়ে উঠেছে। ২৭ মার্চ প্রথম দফা নির্বাচনের প্রাকপর্বে তারই বিশ্লেষণ করলেন দেবাশিস আইচ

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নির্বাচন আসলে এক জাতীয় উপলব্ধির খেলা। সাধারণ ভোটার তাঁদের উপলব্ধি, তাঁদের সহজাত বোধ থেকে কাকে ভোট দেবেন তা মনে মনে স্থির করে নেন। বহুসময় দেখা যায় এই ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এই উপলব্ধি কানাকানি হতে হতে একটি সমষ্টিগত উপলব্ধি নির্মিত হচ্ছে। কান পাতলে শোনা যাবে, ভোটার বলছেন, “এবার অমুক আসছে বা তমুক এবার পারবে না।” ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে কি — পাহাড় থেকে সাগর — কোনও একপক্ষের জন্য এমন কোনও সাধারণ উপলব্ধির সুবাতাস বইছে। এককথায় বলা যায় — না।

 

২০১৯ এর লোকসভার নির্বাচনে বিজেপির প্রবল উত্থান হতচকিত করে ছেড়েছিল নির্বাচন-পণ্ডিতদের। প্রায় কোনও সংবাদমাধ্যমই এই ফলাফলের আভাস দেয়নি। তবে, বিজেপি যে ‘ভাল’ ফল করবে এ বিষয়ে অনেকেই একমত ছিলেন। কতটা ভাল হয়েছে? ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৮টি আসন। উত্তরবঙ্গের ৮টি আসনের মধ্যে ৭টি এবং দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে তিনটি আসনের মধ্যে তিনটিই। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়্গ্রাম। লোকসভার নিরিখে বিধানসভাওয়ারি ফলাফল অনুযায়ী ১৬৪টি বিধানসভায় এগিয়েছিল তৃণমূল, ১২১টিতে বিজেপি। ৯টিতে কংগ্রেস। বামফ্রন্ট একটিতেও নয়। উত্তরবঙ্গে ২০১৯-এ আটটি লোকসভার ৫৬টি বিধানসভা আসনের ৩৬টিতে বিজেপি এগিয়েছিল, তৃণমূল এগিয়েছিল ১৪টি এবং কংগ্রেস ৬টিতে এবং দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে ১৪টির বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২টিতে এগিয়েছিল বিজেপি, দু’টিতে তৃণমূল কংগ্রেস।

 

২০১৯-এর এই ফল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হতবাক করে দিয়েছিল। প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় ২৪ ঘণ্টা। তৃণমূল দলটির মধ্যেও যে তোলপাড় উঠেছিল ব্যাপক, এবং সম্ভবত ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ‘নৌকাডুবি’র আশঙ্কাও করেছিলেন অনেকেই। নাহলে বিগত দু’বছরে অন্তত ৩৪ জন তৃণমূল মন্ত্রী, বিধায়ক, জেলাস্তরের নেতা দল ছাড়বেন কেন? শুধু তো তৃণমূল নয় সিপিএম (৬) কংগ্রেস (৪), ফরোয়ার্ড ব্লক (১) নেতা, বিধায়কদেরও দেখা গিয়েছে দলবদলুতে পরিণত হতে। এই দলবদলের পিছনে কতটা ক্ষমতা হারানোর ভয়, কতটা আর্থিক লোভ, কতটা দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং সিবিআই-ইডির কোপ থেকে বাঁচার চেষ্টা, কতটাই-বা ‘দাম পেলাম না’ সিন্ড্রোম বা দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল — তার হিসেব কষা দুরুহ। কিন্তু, একটি কথা বুঝতে অসুবিধা নেই যে, এই দলবদলের পিছনে কোথাও কোনও নীতি-আদর্শের স্থান নেই। কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূলে আশ্রয় নেওয়া বিধায়ক, নেতাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

 

এখন প্রশ্ন হলো, দলে দলে দলছাড়াও তো ভোটারদের মনে একটা পারসেপশেনের জন্ম দেয় যে — এরা যখন দল ছাড়ছে তাহলে বিজেপির বিধানসভায় জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। আবার বিজেপি যখন দল ভাঙানোর জন্য এত মরিয়া তখন এই উপলব্ধি থেকেই তো তারা এ কাজটি করছে যে, তৃণমূল কংগ্রেসকে দলগত ভাবে দুর্বল করে দিতে পারলে রাজ্যজয় সহজ হবে। এ তো শুধু সংখ্যার খেলা নয়, প্রতিপক্ষের সেনাপতিদের কিনে নিয়ে মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে তোলার খেলাও বটে। এই খেলায় তৃণমূল দুর্বল হয়েছে বটে, রাজ্য বিজেপিও কি লাভবান হলো? এ প্রশ্নে আসব তার আগে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

 

প্রথম প্রশ্ন এই যে, লোকসভা নির্বাচনে একটি রাজ্যের মানুষ যে ভাবনাচিন্তা থেকে ভোট দেন নিজ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেও কি সেই একই ভাবনাচিন্তা, একই নির্বাচনী ইস্যু কাজ করে? এর কোনও সহজ উত্তর নেই। নানা উদাহরণই দেওয়া যাবে। যেমন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস যেমন ব্যাপক জয় পেয়েছিল, ২০১৬ সালে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে তারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু, ২০১৯-এ তেমনটি পুরোপুরি হলো না। আসনের হিসেবে বিজেপি জিতল না বটে কিন্তু তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রায় টালমাটাল করে দিল। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় এনডিএ সরকার প্রতিষ্ঠার পিছনে মোদীর ক্যারিশমাকেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সবচেয়ে বেশি মূল্য দেন। এর পর বিরোধী ইউপিএ-র বিশেষ করে কংগ্রেসের নেতৃত্বহীনতাকে দায়ী করা হয়। এ কথা সত্য। কিন্তু, শুধু তো ইউপিএ-র দুর্বলতা নয়। ইউপিএ বা এনডিএ বিরোধী দলগুলিও, কংগ্রেসবিহীন আরেক ফ্রন্ট খুলে — তৃণমূল কংগ্রেস যার অন্যতম উদ্যোক্তা — এনডিএর জয় সুনিশ্চিত করে তুলেছিল। এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসই ছিল প্রধান। কিন্তু, তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্টের কোনও অস্তিত্বই ছিল না।

 

এবারও এই বিধানসভা নির্বাচনে সংবাদমাধ্যম তো বটেই বার বার মমতা বনাম মোদী লড়াইয়ের কথাটাই উঠে আসছে। নানা জনমত সমীক্ষায় (এবিপি-সি ফোর, টাইমস অব ইন্ডিয়া, টিভি নাইন) যেমন রাজ্যের নাগরিকদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এখনও তুঙ্গে তেমনই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে ঢালাও নম্বর দিতে সমীক্ষাকৃত ব্যক্তিরা পিছপা হচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই ২০ মার্চ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রথম দফা ভোটের সাতদিন আগে পর্যন্ত, অন্তত চারবার পশ্চিমবঙ্গ সফর করে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিটি জনসভায় তাঁর আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্যই হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী এলেই মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা আক্রমণ শানাচ্ছেন। এবং প্রতিটি জনসভাতেই নরেন্দ্র মোদী যে কথা বার বার বলে চলেছেন, তা হলো ক্ষমতায় ‘দিদি’ আসছেন না। অর্থাৎ, ভোটারদের মধ্যে একটি পারসেপশন বা উপলব্ধি নির্মাণ করা যে — ক্ষমতায় আসবে বিজেপি। এই সমীক্ষাগুলি যদি আমরা ২০১৯-এর বিধানসভাওয়ারি ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তবে দেখতে পাব — তৃণমূলের সর্বোচ্চ আসন সেই ১৬৪-র ধারেকাছেই রয়েছে। কিন্তু, বিজেপি ১২১-এ পৌঁছচ্ছে না। এবং বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-এর সংযুক্ত মোর্চা প্রতিটি সমীক্ষার পরই তাঁদের আসন বাড়িয়ে চলেছে। এই সমীক্ষাগুলিকে শেষকথা বলে মেনে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে চলেছে এমন কোনও সাধারণ মতামত তৈরি হয়নি। বিগত লোকসভায় উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে বিজেপির প্রায় সব আসন ঝেঁটিয়ে জেতার পিছনে সিপিএমের প্রায় ৭ শতাংশ ভোটে নেমে আসাকে অন্যতম কারণ বলে ধরা হয়। আলোচ্য সমীক্ষাগুলিকে সাধারণ নমুনা হিসেবে ধরলে বলা যায়, এত ভোট আর বিজেপির ঝুলিতে যাচ্ছে না। সমীক্ষা বাদ দিলেও বলা যায়, প্রথমত, সিপিএম-কংগ্রেসের মধ্যে এবারের সমঝোতা অনেকবেশি দৃঢ়। আইএসএফ নিয়ে কংগ্রেসের যথেষ্ট আপত্তি থাকলেও সিপিএম আসন সমঝোতায় একরকম ‘আত্মত্যাগী’ ভূমিকা পালন করায় কংগ্রেসও মানিয়ে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্রিগেড হোক কিংবা সমাজমাধ্যম — সিপিএম-এর সোচ্চার ও আক্রমণাত্মক উপস্থিতি লক্ষণীয়। তৃতীয়ত, একঝাঁক বলিয়ে-কইয়ে, প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণ-তরুণীকে ভোটযুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে মনোনীত করা সিপিএমকে ডিভিডেন্ড দেবে বলেই পণ্ডিতদের মত। যা তাদের বামভোট ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর ফলে তৃণমূল কংগ্রেস লাভবান হবে বলে একটি সাধারণ ধারণাও তৈরি হয়েছে। আবার বামেদের ক্ষেত্রে ২০১৯-এর বিধানসভাওয়ারি ফলও এবার হবে না।

 

অন্যদিকে, আদি ও নব্য বিজেপি বিশেষ করে তৃণমূল বা অন্যদল থেকে আসা বিরোধীদের ভাষায় ‘তৎকাল’ বিজেপির বিরুদ্ধে যে তুমুল ও হিংসাত্মক ক্ষোভ-বিক্ষোভ সারা রাজ্যজুড়ে দেখা গিয়েছে তা বিজেপি জাতীয় একটি দলের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এই মর্মে, ২১ মার্চ ২০২০, ‘ইন বিজেপি বেঙ্গল লিস্ট, ৩৬ জয়েন্ড দ্য পার্টি ওভার লাস্ট সিক্স মান্থস’ শীর্ষক এক অত্যন্ত তথ্যবহুল প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, তালিকা প্রকাশের পর ২০টি বিধানসভা কেন্দ্রে দলবদলুদের বিরুদ্ধে এবং ২৫টি কেন্দ্রে নিজের দলেরই অপছন্দের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বিজেপি ও আরএসএস সদস্য-সমর্থকদের একটি বড় অংশ। বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা নেতৃত্ব ঘোষণা করেই দল কিংবা রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়েছেন। কোনও কোনও জেলায় ক্ষুব্ধ নেতৃত্ব নির্দল প্রার্থী হয়ে প্রতিযোগিতা করবেন বলে স্থির করে ফেলেছেন। এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ রাজ্য নেতৃত্ব কতটা সামাল দিতে পারেন তার উপর নির্ভর করছে সে দলের আসন-ভবিষৎ। তবে, আট দফার ভোটে দফায় দফায় বিজেপি এই সমস্যা মোকবিলায় যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই তারা বাংলার সাংসদ এবং ভোটে লড়তে অনিচ্ছুক শীর্ষ নেতাদেরও ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে।

 

২০১৯ ও ২০২১ আরও এক গুরুত্বপূর্ণ কারণে এক নয়। কারণটি হলো, কোভিড-১৯ অতিমারি ও লকডাউন। অতিমারি ও লকডাউনের প্রকোপে সারা দেশের মতোই এ রাজ্যও ভয়াবহ কর্মহীনতার শিকার। যার একটি প্রধান অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। এ রাজ্য যেহেতু পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্যতম প্রধান জোগানদার সেহেতু, এই শ্রমিকদের কল্যাণের প্রশ্নটি বহু কেন্দ্রেই একটি ইস্যু। নানা টালবাহানার পর মোট ফিরে আসা ১২-১৪ লক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শ্রমিককে ট্রেনে-বাসে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা, ১০০ দিনের কাজ ও বিকল্প কর্মসংস্থান, বিনা পয়সায় রেশন — রাজ্য সরকার যা এখনও অব্যাহত রেখেছে — অন্যান্য সামাজিক প্রকল্পের জের, বিশেষভাবে ভোটের মুখে স্বাস্থ্যসাথী ও দুয়ারে সরকার প্রকল্প — গ্রামীণ ভোটদাতাদের কতটা ‘অনুপ্রেরণা’ জোগায় তা অবশ্যই এই ভোটে লক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়াও রাজ্যের মহিলাদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বড় রকমের প্রভাব রয়েছে। এর একটি বড় কারণ ২ টাকা কেজি চাল (বর্তমানে বিনা পয়সায়) এবং কন্যাশ্রী, সবুজসাথী-সহ ছাত্রীদের জন্য অন্যান্য সর্বজনীন প্রকল্প। চাল তো মেয়েরাই ফোটান। ছেলে-মেয়েদের মুখেও ভাত তুলে দেন তাঁরাই। স্বাভাবিকভাবেই একটা কৃতজ্ঞতা থেকে যায়ই। সে চালের কত পয়সা কে দিচ্ছে — তা নিয়ে ভাবিত নন তাঁরা। একে ‘ডোলের রাজনীতি’ বললে ‘ডোলের রাজনীতি’ আবার বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার  ‘রাজনৈতিক-সামাজিক-মানবিক’ দায় বললে তাই। মানুষ এ নিয়ে চিন্তিত নন। মুখ্যমন্ত্রীর জোরের জায়গাও এটা। একথা যে দিনের আলোর মতো সত্যি তা প্রমাণ করছে, বিজেপির মতো রেশন ব্যবস্থা অর্থাৎ ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী যারা এমনকি মিড ডে মিল-সহ একাধিক এ জাতীয় প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ যারা কমিয়ে দিয়েছে — তারাও এ রাজ্যে ক্ষমতায় এলে পাঁচ টাকায় তিনবেলা খাওয়া, রেশনে ১ টাকা কেজি গম দেওয়ার মতো সামাজিক প্রকল্পের কথা ইস্তেহারে ছেপেছে। অথচ, ডাবল ইঞ্জিনের সরকার অর্থাৎ দেশের প্রধান প্রধান দরিদ্রতম রাজ্য বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি শাসিত কিংবা এই সেদিনও ক্ষমতায় থাকা ঝাড়খণ্ডে এমন কোনও প্রকল্পের কথা কেন্দ্র ভাবেনি। শুধু কি তাই? নানা সমীক্ষা যখন বলছে কাজ হারিয়ে বা ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দায় কিংবা ঋণগ্রস্ত হয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ গরিব হয়ে পড়েছেন — তাদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কি এমন কোনও প্রকল্প চালু করতে পারে না। যখন পশ্চিমবঙ্গে বসে — লক্ষণীয় রাজ্য বিজেপির কোনও নেতা নন — এই প্রকল্পগুলি ঘোষণা করছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই অমিত শাহের গুজরাতেও হতদরিদ্র প্রান্তবর্তী গ্রামীণ কিংবা শহরের মানুষদের জন্যও নেই এমন কোনও সামাজিক প্রকল্প।

 

কাটমানি-সিন্ডিকেট-টেট কেলেঙ্কারি, সামাজিক প্রকল্পে দলীয় ও পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর ভাতে ও হাতে মেরে ধ্বংস করে দেওয়া — ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ — ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী দল ভাঙানো, জেলা পরিষদ থেকে পুরসভা দখল করার খেসারত ২০১৯ নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে দিতে হয়েছে। অর্থাৎ, গত লোকসভা নির্বাচনে শুধুমাত্র জাতীয় ইস্যুর দিকে তাকিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা ভোট দেননি। বিগত দু’বছরে তার কতটুকু সামলানো গিয়েছে, বিশেষভাবে দলের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ভয়ঙ্কর ‘ভৈরববাহিনী’-কে সামলে উঠতে পারা গিয়েছে তার উপর এবারও নির্ভর করবে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল।

 

কৃষক আন্দোলন, ব্যাঙ্ক ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা বেচে দেওয়া বা বিলগ্নিকরণ, অর্থনৈতিক মন্দার জেরে দোকান-পাট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের আর্থিক সঙ্কট, শ্রমিক ও চাকুরিজীবীদের বাধ্যতামূলক পে-কাট, দেশজোড়া বাড়াবাড়ি রকমের বেকারত্ব, গ্যাস-পেট্রল-ডিজেল থেকে নিত্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, পেনসন ভোগীদেরও ডিএ এক বছরের উপর হাতে না পাওয়া — দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ থেকে সাধারণ মধ্যবিত্তকে চরমসীমায় ঠেলে দিয়েছে। এর প্রতিফলনও ভোটে পড়তে বাধ্য। যা বিজেপির পক্ষে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে এগুলি কোনও বিষয় হয়ে ওঠেনি। আবার ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি, এনআরসি, ৫৬ ইঞ্চির প্রতি অচল ভক্তিও, যা ২০১৯-কে সর্বত্র সমানভাবে না হলেও প্রভাবিত করেছে, এবারও ভোটারদের তা প্রভাবিত করবে। এই নির্বাচনে আরও একটি নাগরিক শক্তি অনুঘটকের কাজ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক আন্দোলন থেকে প্রায় গণআন্দোলনের রূপ নিতে চলা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্রমে মোদী-শাহদের পথে বড় কাঁটা হয়ে উঠেছে। যদিও, বিজেপি বিরোধী দলগুলির কাছে তাদের সমান গ্রহণযোগ্যতা নেই। সিপিএম-এর কাছে তো একেবারেই নেই। এর সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি বিষয় যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা হলো — বাঙালিয়ানা বনাম বিজেপিয়ানা। শিক্ষিত মহলে এই বিজেপিয়ানা বা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহলে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। এ রাজনীতির সমর্থক হিন্দুত্ববাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরও অবশ্য অভাব নেই। কিন্তু, তাঁদের তুলনায় বাংলায় সংস্কৃতিগত ভাবে বিজেপিয়ানা বিরোধী মেধাজীবীরা  অনেকবেশি মুখর। সম্প্রতি বিজেপির বিরোধিতা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন বিজেপির সংস্কৃতিকে বহিরাগতের সংস্কৃতি বলে সমালোচনা করেছেন। ৩ মার্চ ২০২১ আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজেপির বিপদ প্রসঙ্গে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “বিজেপির সংস্কৃতি বাঙালির আত্মপরিচিতির বিরোধী বলেই তা বহিরাগত। এই যে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের ধারণাটা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, এটা বাংলার সংস্কৃতি বিরোধী।” অর্থাৎ, জ্বলন্ত জাতীয় ইস্যু যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে স্থানীয় ইস্যুও। আবার জাতীয় ইস্যুগুলির, কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক নীতির অভিঘাতও নানা মাত্রায় এ রাজ্যের শ্রমিক-কৃষক-চাকুরিজীবীদের উপর পড়েছে। যার জেরে তা বিধানসভা ভোটেরও বিষয় হয়ে উঠেছে।

 

পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন। দক্ষিণের পুদুচেরি, তামিলনাড়ু, কেরালা, পূর্বের পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপূর্বের আসাম — একমাত্র আসাম ছাড়া কোথাও কোনও সমীক্ষাতেই বিজেপি জিতছে, এমন কোনও আশ্বাসবাণী নেই। আসামেও প্রবল অস্বস্তি রয়েছে। আগামী ২ মে জনগণের রায় শেষ কথা হয়ে প্রকাশ পাবে। তবে, ২০২১-এর নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে যে একটি জল-বিভাজিকা হয়ে দেখা দেবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তার রেশ রয়ে যাবে আগামী বহুদিন।

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: রজত রায় on March 23, 2021

    লেখাটায় বেশ‌ বিস্তারিতভাবে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। খুবই ভালো লাগলো। বিশ্লেষণের মান রীতিমত ভালো।

  • ধন্যবাদ রজতদা।

Leave a Comment