রাজ্যে রাজ্যে কোঅর্ডিনেটরদের ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার বা এনপিআর-এর কাজ শুরু করার নির্দেশ জারি করেছে রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া। এনপিআর জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসির প্রথম ধাপ। আসামে ২০১৯ সালের ৩১ অগাস্ট এনআরসির ‘চূড়ান্ত’ তালিকা প্রকাশিত হয়। কিন্ত, সে তালিকা আজও চূড়ান্ত হয়নি বলেই দাবি বর্তমান কোঅর্ডিনেটর হিতেশ শর্মা। মুখে কুলুপ এঁটে আছে রেজিস্টার জেনারেলও। লিখেছেন কমল চক্রবর্তী।
আসামে ১৯ লক্ষ এনআরসি ছুটদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। আসামে ৩১ অগাস্ট, ২০১৯ সালে চূড়ান্ত এনআরসির তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এর সঙ্গে সঙ্গে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন চূড়ান্ত তালিকা থেকে ছিটকে পড়েন। সেই সময় এনআরসি কোর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা মহাশয় বলেছিলেন যে সেপ্টেম্বর মাস, ২০১৯ সালেই এনআরসি ছুটদের “নাম না আসার কারণ” জানানো হবে। এর পর এনআরসি ছুটদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবার থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিক, জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এমনকি বিজেপির এমপি – এমএলএ – পরিবারের সদস্যদের কারোর কারোর নাম বাদ পড়েছে। এখন তাঁদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে। গরিব মধ্যবিত্তের কথা ছেড়েই দিলাম, এঁরা যাবেন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে? তাঁরা তো সরকারের কাছে সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ। এখন চলছে ২০২১ সালের মার্চ মাস। এই কুড়ি মাসের মধ্যে কেন এনআরসি থেকে নাম বাদ দেওয়া হলো, এনআরসি অথরিটি এখন পর্যন্ত জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর পেছনে এই কারণটিও আছে।
উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দল ও তাদের দোসররা সারা ভারতবর্ষে প্রচার করেছিলেন যে আসামে এক কোটি বিদেশি রয়েছেন! এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারও নড়েচড়ে বসল। আসামের মতো একটি ছোট্ট রাজ্যে এক কোটি বিদেশি! আসামের অসমিয়ারা ভাবতে শুরু করল যে, এই এককোটি বিদেশি থাকায় আসামের নিজস্ব অর্থনীতি সমাজ ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত বিশ্বাস করল যে, আসামে সত্যিই এক কোটি বাংলাদেশি ঘুরে বেড়াচ্ছে! বামপন্থী দলগুলো কোনোরকম গভীর অনুসন্ধান ছাড়াই জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিদেশি সমস্যা নিয়ে তৎপর হলো। পরবর্তীতে আসামে এই এনআরসির মাধ্যমে এক কোটি সংখ্যাটি যে একটা মিথ্যে সেটা স্পষ্ট হলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। আসামে এনআরসি চলাকালীন জেপিসির (জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি) এক প্রতিনিধি দল আসামে এসেছিল, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের মতামত নেওয়ার জন্য। সেই সময় প্রতিটি সংগঠনকে জেপিসি একটা ‘কমন’ প্রশ্ন করেছিলেন যে আপনাদের অঞ্চলে কতজন ১৯৭১ সালের পরে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আছেন। এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি। কিছু কিছু সংগঠন উত্তর দিলেও সেই উত্তরের কোনো ভিত্তি ছিল না। জেপিসির সদস্যরা তাদের কথায় বিশ্বাসও করেনি। আজ জেপিসির কাছে পরিষ্কার সম্ভাব্য সংখ্যাটা কত দাঁড়াতে পারে। ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে অনেকের নাম না আসার কারণ এলআরসিআর (লোকাল রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেন রেজিস্ট্রেশন), ডিআরসিআর (ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেন রেজিষ্ট্রেশন), সিআরসিআর (সার্কেল রেজিস্ট্রার অফ সিটিজেন রেজিষ্ট্রেশন) ইত্যাদিরাও জানে না। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল সমস্ত ব্যক্তিদের নথিপত্র দেখার, বিভিন্ন স্তরে নথির সত্যতা যাচাই করার। এনআরসির নিয়মানুযায়ী জনসাধারণের কাছ থেকে যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল সেসব ঠিক আছে কিনা। তারা নথিপত্র দেখে বিভিন্ন ব্যক্তির নামের পাশে বাতিল লিখে তার কারণও লিখে দিয়েছিলেন, “কী কারণে বাতিল” করা হয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা, যাদের নামের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য লিখেছিলেন, অর্থাৎ যাদের জমা দেওয়া নথিপত্র সবকিছু ঠিক আছে, তাদের নামের পাশে হঠাৎ দেখা যাচ্ছে ‘বাতিল’ লেখা আছে! অর্থাৎ আসাম এনআরসির স্টেট কোঅর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা সেখানে বাতিল করে দিয়েছেন। এবার সেই বাদ পড়া ব্যক্তিদের কী কারণে নাম আসেনি, সেটা লিখবে কী করে? সবার জমা দেওয়ার নথিপত্রের তো ডাটাবেস তৈরি করে রাখা হয়েছে এবং প্রত্যেক দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা (এলআরসিআর, ডিআরসিআর) তাদের মতামত জানিয়ে দিয়েছেন। এইক্ষেত্রে ম্যানুয়াললি কারেকশন করার কোনো রাস্তা নেই। এই সমস্যা নিয়ে আসামে এনআরসির নতুন স্টেট কোঅর্ডিনেটর হিতেশ দেব শর্মা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েও ছিলেন এর সমাধানের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর এখনও আসেনি। ৩ ডিসেম্বর হিতেশ দেবশর্মা গুয়াহাটি হাইকোর্টকে জানান, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এনআরসি তালিকা খতিয়ে দেখে যা যা সমস্যা ছিল তার তালিকা আকারে রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়া বা আরজিআইকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু, আরজিআই-এর তরফ থেকে কোনও জবাব আসেনি। ফলে ‘চূড়ান্ত’ তালিকা প্রকাশ করা যায়নি। হলফনামায় তিনি এও বলেছেন, ৩১ অগাস্ট প্রকাশিত তালিকাটি ‘সাপ্লিমেন্টারি’ বা ‘অনুপূরক’। অথচ, এই তালিকাটিকেই পূর্ববর্তী কোঅর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা ‘চূড়ান্ত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
১৯ লক্ষ এনআরসি ছুট হওয়ার আগে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম আসেনি। সেই সময় যাদের নাম বাদ পড়েছিল, তাদের প্রত্যেককে বলা হয়েছিল পুনরায় আবেদন করতে। এর মধ্যে ৩ লক্ষ মানুষ আবেদনই করেনি। কেন করেননি? সরকারের তরফ থেকে সেইভাবে প্রচার না হওয়ায়, এই তিন লক্ষ মানুষ পুনরায় আবেদন করতে পারেননি বলেই অভিযোগ। অর্থাৎ এই ১৯ লক্ষ যারা বাদ পড়লেন, তাদের মধ্যে তিন লক্ষ বাদ দিলে সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৬ লক্ষ। আবার এই তিন লক্ষ মানুষ পুনরায় আবেদন না করায়, তাদের ক্ষেত্রে কী করা হবে, তাদেরকে কি আবার সুযোগ দেওয়া হবে আবেদন করার? যদি না দেওয়া হয়, তাহলে তো আসামে এনআরসির পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ, একটা সময়ে হিসেব কষে কেন্দ্রীয় সরকার বা আরজিআইকে তো বলতে হবে, এনআরসি করার পর কতজন ভারতীয় এবং কতজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে উঠতে পারেনি। তাই, রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয় আসামের এই ফাইনাল এনআরসির অনুমোদন দিচ্ছে না। আর অনুমোদন না দিলে, এনআরসি ছুটদের ‘রিজেকশন স্লিপ’ দেওয়া সম্ভব না।
আমাদের আলোচনায় লক্ষণীয় যে এক কোটি থেকে কিন্তু সংখ্যাটা আপাতত ১৬ লক্ষ! এই ১৬ লক্ষের বাদ পড়ার মধ্যে রয়েছে গোর্খারা, চা শ্রমিক পরিবার, হরিজন সম্প্রদায়, অসমিয়া, বড়ো, মিসিং, কোচ সহ আদিবাসীরা। বাদ পড়েছে ১৪ বছরের নীচে শিশুরা, যাদের কোনো কাগজপত্র দেওয়ার দরকার ছিল না, এনআরসির নিয়মানুযায়ী। তাহলে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটা কতোতে গিয়ে দাঁড়াবে, তার একটা অনুমান কি সরকার গোপনে করে রাখেনি? ৩১ অগাস্ট, ২০১৯ সালে এনআরসির তালিকা বের হওয়ার পর, বিভিন্ন খবরের কাগজের মাধ্যমে জানা গেল, ১২ লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ পড়েছে, যদিও এর কোনো ভিত্তি ছিল না। তার কারণ, এনআরসি কোর্ডিনেটর “বন্ধ খাম”- এ রিপোর্ট পেশ করেছেন। তবুও এই সংখ্যা যদি সত্যি হয়, তাহলে তাদের বাঁচার রক্ষাকবচ হওয়ার জন্য নাগরিকত্ব আইন। এই আইনের রুলস এখনও তৈরি হয়নি। তবুও ধরে নিলাম, বাঙালি হিন্দুরা যদি নাগরিকত্ব পেয়েও থাকে, উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দল সেটা মানবে না। যে সরকারই রাজসিংহাসনে থাকুক না কেন, দশদিনের মধ্যে সেই সরকারকে ফেলে দেবে। এই অসমিয়ারা বাঙালিদের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য কোনদিনও নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করতে দেবে না আসামে। কেন্দ্রীয় সরকার সেটা খুব ভালো করেই জানে এবং সেইজন্যই বিজেপি এবার সিএএ-কে নির্বাচনী ইস্তেহারে যুক্ত করেনি। কাজেই আসামের এনআরসি শেষ পর্যন্ত ডাস্টবিনেই নিক্ষেপিত হলো বলা যায়। কেননা ১৯ লক্ষ মানুষের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার পর, যে চিত্রটা আসবে তার আইনি সমাধান করতে সময় নেবে কম করেও পঞ্চাশ বছর!!
‘আসামে নাগরিকত্ব হরণের দিনলিপি’ গ্রন্থের লেখক ও সমাজকর্মী কমল চক্রবর্তী আসামের শিলচরের বাসিন্দা।