১০ মার্চ ফ্যাসিস্ট বিজেপি আরএসএস বিরোধী নাগরিক অভিযান: কলকাতা চলো


  • March 9, 2021
  • (0 Comments)
  • 1265 Views

পাহাড় থেকে সাগরে ছড়িয়ে পড়েছেবিজেপিকে একটিও ভোট নয়ধ্বনিপ্রতিধ্বনি। যে আহ্বানে সাড়া মিলেছে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের থেকেও। ১০ মার্চ মঞ্চের ডাকেকলকাতা চলোঅভিযান। যা স্বাধীন নাগরিক সমাজের আন্দোলনের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করতে চলেছে। লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

“বিজেপিকে একটিও ভোট নয়” — এ এক স্পষ্ট উচ্চারণ। কোথাও কোনও অস্বচ্ছতা নেই। যেমন, আজ আর এ বিষয়ে কোনও বিতর্ক থাকতে পারে না যে, পশ্চিমবঙ্গ কেন, ভারতের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপদ হচ্ছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার।

 

কেন বলা হলো সবচেয়ে বড় বিপদ?

(এক) বিগত প্রায় সাত বছর ধরে আমরা দেখছি ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক আক্রমণ। দুর্গাপূজায় বাঙালিদের আমিষ খাবারের স্টল বাতিল করা (দিল্লি, আমেদাবাদ)। দুর্গাপুজোর সময় নবরাত্রির বাহানা দেখিয়ে দিল্লির কোনো কোনো বাজারে একমাস ব্যাপী মাছ-মাংস বিক্রির উপর সঙ্ঘী নিষেধাজ্ঞা। দুর্গাপুজোর বিজ্ঞাপন নিয়ে মামলা ( হাবিব সেলুন, উত্তরপ্রদেশ)। পুজোর দিনে বাঙালির আমিষ খাওয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসী প্রচার (কলকাতা)। আমিষ বিরোধী প্রচার (সারা দেশে)।

 

(দুই) পয়লা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষের বিরোধিতা করে বিক্রম সংবৎ চালু করা ও পালন করার পক্ষে প্রচার। রাস্তার শনি-কালী-শেতলা মন্দিরগুলোতে সংস্কারের নামে পয়সা ঢেলে স্থানীয় পুরোহিতদের হাত করে বজরঙ্গবলী থেকে রামের মূর্তি স্থাপন (কলকাতা-সহ অন্যত্র)। শিক্ষিত, পেশাজীবী বাঙালিদের মধ্যে গরু পুজো ও  ভজনার সংস্কৃতি ছড়ানো (কলকাতা)। কলকাতা, হাওড়া, ব্যারাকপুরের ঘাটে ঘাটে উত্তর ভারতীয় পুরোহিতদের এনে নিয়মিত আরতি শুরু করা। আদিবাসী থানগুলোতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিস্থাপন।

 

(তিন) বিগত পাঁচ বছর ধরেই এ রাজ্যে গোবলয়ের এই ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রামের নামে  অস্ত্র-আস্ফালন ও দাঙ্গা বাঁধানো বাদ যায়নি। এই উত্তর ভারতীয়, নাগপুরী, বর্গি হানা থেকে বাদ পড়েননি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলার বর্তমান মেধাজীবীরা। তাঁদের ‘জুতো পেটা করা উচিত’ বলে মনে করেন বিজেপির ‘জননেতা’। গুলি করে মারার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

 

(চার) এনআরসি, সিএএর এই পর্বে বাঙালি জাতি হিসেবে সারা দেশে আক্রান্ত (উত্তরপূর্ব, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, মহারাষ্ট্রের পুণে-মুম্বাই, কর্নাটকের বেঙ্গালুরু)। বেঙ্গালুরুতে শুধু পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী বাঙালিদের ঘেটো ভেঙে দেওয়া হয়নি, নিমহানসের লাগোয়া বাঙালি হোটেলগুলির বাংলা সাইনবোর্ড মুছে দেওয়া হয়েছে। গোয়েবলীয় প্রচারে সারা দেশে এবং এ রাজ্যের হিন্দিভাষী হিন্দুদের কাছেও বাঙালি মানেই সন্দেহজনক অনুপ্রবেশকারী ও বাংলাদেশি।

 

(পাঁচ) এই আগ্রাসী, বাংলা ও বাঙালি বিরোধিতার মূলে রয়েছে সঙ্ঘ পরিবার অর্থাৎ আরএসএস, বিজেপি, এবিভিপি, বজরঙ্গী দল-সহ নানা কিসিমের গণসংগঠন। আজ বাংলার ও বাঙালির আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রশ্নের মুখে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে এই বিজাতীয়দের, বর্গিদের হারিয়ে দেওয়া এবং এনপিআর, সিএএ বয়কট করাই হবে বাঙালির অস্মিতা বাংলার অস্মিতা প্রকাশের প্রকৃষ্ট সময়। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব তৈরি করে, মতুয়া, রাজবংশী, গোর্খা, আদিবাসীদের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে এরা বাংলাকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে দখল করতে চায়। বাঙালির স্বার্থে, বাংলার স্বার্থে পুঁজি ও হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপির এই চক্রান্তকে পরাস্ত করতেই হবে।

 

বিজেপিকে ভোট নয়, এই শ্লোগানের জন্মদাতা “ফ্যাসিস্ট আরএসএস বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা” নামক একটি নাগরিক মঞ্চ। এমন একটি সঙ্ঘ, এমন একটি নাগরিক উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি ছিল। বেশ কিছু সময় জুড়েই পদে পদেই অনুভূত হচ্ছিল যার অভাব। এই মুহুর্তের ন্যায়-নীতিহীন ঘোড়া কেনাবেচার ভোট রাজনীতির সময়ে যা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। দলিল দস্তাবেজ খুলে বসলে দেখা যাবে ২০১৪ সাল থেকেই বিজেপি-আরএসএস ক্রমে সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে তাদের উপস্থিতি প্রবল ভাবে জানান দিতে শুরু করে। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের পতন হয়েছে। এবং তিন বছরের মধ্যেই একটি প্রবল প্রতিপত্তিশালী দল ক্রমে গুটিয়ে যেতে থাকল। এই ফাঁকটাকেই ভরে তুলতে সাংগঠনিক ভাবে মরিয়া হয়ে ওঠে সঙ্ঘ পরিবার, অর্থাৎ আরএসএস পরিচালিত ৩১টি গণসংগঠন। তাদের সামনে তখন এক ও একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস। একমেবাদ্বিতীয়ম নেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিসংবাদিত জনপ্রিয়তাই দলটির একমাত্র পুঁজি। এবং অবশ্যই এমনই এক সাধারণ কর্মীবাহিনী, যারা বাহুবলে যতটা দক্ষ সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শগত রাজনীতির মোকাবিলায় ঠিক ততটাই অসহায়।  অতঃপর একদা নির্বাচনী জোটসঙ্গী বিজেপির বাংলা দখলের আগ্রাসী রাজনীতির অভিযান রুখতে গিয়ে, পাল্টা মতাদর্শগত রাজনীতি নয়, বাহুবলই হাতিয়ার হয়ে উঠল তৃণমূলের। ২০০৯ থেকে সিপিএমের দুর্বলতার সুযোগে এক পা এক পা এগোলেও ২০১১ থেকেই আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠনগুলি সীমান্ত থেকে সম্প্রদায়গত ভাবে মিশ্র এলাকা, আদিবাসী এলাকায়, ছাত্র-যুব-মহিলাদের মধ্যে নয়া উদ্যমে বিভাজনের রাজনীতির চাষ শুরু করে। নিচু মাত্রায় হলেও শুরু হয় সংঘর্ষ। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। ২০১৪ সালের ৮ জুন বারুইপুরে আরএসএস-এর এক সভায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার তিন তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখ, আরাবুল ইসলাম, কাইজার আহমেদদের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, “আমরাও পাল্টা আঘাত করতে জানি। তোমাদের উপর থেকে ছ’ইঞ্চি ছোট করে দেওয়া হবে কিংবা মাটির ছ’ফুট নীচে পুঁতে দেব।”  সাংবাদিকদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ওই ব্যক্তি ছিলেন বিজেপির বর্তমান রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। মঞ্চে আরএসএস-এর রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের সামনে সেদিন তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’ -এর অর্গানাইজেশন সেক্রেটারি হিসেবে। যে সংগঠনের নাম তখনও এ রাজ্যে প্রায় অজানা। আসলে তিনি ছিলেন আরএসএস-এর প্রচারক। (মিশন  বেঙ্গল, এ স্যাফরণ এক্সিপেরিমেন্ট, স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য, ২০২০)। স্নিগ্ধেন্দু জানাচ্ছেন, ২০০১ সালের ১৩ বছর পর আরএসএস এরকম একটি সভা করল। এবং পূর্ববর্তী সেই সভা ছিল সোনাখালির চার আরএসএস কর্মীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। অভিযোগ, আরএসপির সদস্যদের হাতে ওই চারজন খুন হয়েছিলেন। বলা যায়, আর সলতে পাকানো নয় সঙ্ঘ পরিবার রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার সমসময় থেকে।

 

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৪৫ শতাংশ ভোট ও ২১১টি আসনে পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি ১০ শতাংশ ভোট এবং তিনটি আসন পেয়েছিল। বামেরা ৩২টি এবং কংগ্রেস পেয়েছিল  ৪৪টি আসন। বাম ও কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশ ভোট। ২০১৮ সালে ‘বিরোধী শূন্য’ পঞ্চায়েতের ডাক দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কথা রেখেছিল দলীয় বাহিনী এবং অবশ্যই পুলিশ ও প্রশাসন। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩৫ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের মোট ৫৮,৬৯২টি আসনের মধ্যে ৩৪,৫০৭টি আসনে, অর্থাৎ বিরোধী দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিল বিজেপি। পঞ্চায়েত সমিতির দুই-তৃতীয়াংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, তৃণমূল জেলা পরিষদের ৮২৪টি আসনেরর মধ্যে ৭৯৩টি; ৯,২১৪টি পঞ্চায়েত সমিতি আসনের ৮,৫০২টি এবং ৪৮,৬৩৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনের মধ্যে ৩৮,৩৩৮টি আসনে জয়ী হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই বিপুল জয়কে যেন চরম পরিহাস করে ১৮টি আসন জিতে নিয়েছিল বিজেপি। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল এক প্রকাণ্ড প্রহসন। ১৯৭২ সালের নির্বাচনকে যা লজ্জায় ফেলেছিল। আমরা অনেকেই যদিও লজ্জা পাইনি।  বরং একথা বললে হয়তো খুব একটা ভুল হবে না যে, অনেকেই এই ভেবে নিশ্চিত হয়েছিলেন  — গণতন্ত্র চুলোয় যাক — বিজেপি তো হারল। কিংবা, একটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে ঠিক, তবে, বিজেপিকে তো…। মানুষ বোধহয় এভাবে ভাবেন না। ভোট দেওয়ার অধিকার একজন সাধারণ নাগরিকের কাছে বড্ড বেশি দামী। পঞ্চায়েত ভোট একজন গ্রামবাসীর কাছে গাঁয়ের নিজের ভোট। এবং অনেক বেশি আপন। বোতামে প্রতিটি আঙুলের ছোঁয়ার মধ্যে আসলে একজন ভোটারের সমর্থন ও প্রত্যাখ্যান, আনন্দ কিংবা রাগ, ভালবাসা কিংবা ঘৃণা, পাওয়া বা না-পাওয়া লুকিয়ে থাকে। প্রতিটি ভোটদাতাই জিততে চান, যেমন জিততে চান প্রতিজন প্রার্থী বা প্রতিটি দল।

 

২০১৯ -এ বিজেপির চোখ ধাঁধানো সাফল্যের একটি অন্যতম কারণ কি ‘বিরোধী শূন্য’ পঞ্চায়েতের আত্মঘাতী আকাঙ্খা এবং তার সাফল্য? হাতের কাছে এমন কোনও গবেষণালব্ধ ফল কিংবা সমীক্ষা নেই যে বলা যেতে পারে ‘হ্যাঁ’। তবে, নানা মুনির বিশ্লেষণের মধ্যে বার বার উঠে এসেছে ‘দুষ্টু’ ছেলেদের, দলীয় নেতৃত্বের লাগামহীন জুলুমবাজির কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে মাসাধিকালব্যাপী যা চূড়ান্ত আকার নিয়েছিল। গড়পড়তা দেশচিন্তা, গড়পড়তা গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক অধিকার বোধ, গড়পড়তা রাজনীতির মাঝারিয়ানার সাম্রাজ্য সে কথা স্বীকার করতে চায়নি। এ রাজ্যে এই ‘মধ্যমেধার সাম্রাজ্যবিস্তারে’ বামশাসকদের ‘সুউচ্চ’ ও ‘সুগভীর’ অবদান রয়েছে। আজও এ রাজ্যে তার প্রভাব অবিসংবাদিত । (সৌজন্য: মধ্যমেধার মহাযজ্ঞ,  অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, দেশ, ১৮ নভেম্বর ২০০২)। যদি একটু তলিয়ে ভাবা যেত, তবে দেখা যেত, মোদী-শাহ জুটির এনআরসি-সিএএ সহ  সংখ্যালঘু বিরোধী প্রবল আগ্রাসী প্রচার; গোর্খা-মতুয়া-আদিবাসী সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভেদ-বিভেদ ঘটিয়ে তোলা; তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার অন্তর্দন্দ্ব এবং সিবিআই-ইডিকে ব্যবহার করে দলভাঙা (যা এখনও অব্যাহত); প্রবল আর্থিক আধিপত্য এবং যা তখনও কেউ কেউ বলেছেন আজ যা অনেকটাই প্রমাণিত তা হলো — পুলিশ, আমলা এবং তৃণমূল নেতৃত্বের একটি অংশের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া। এবং অবশ্যই দলীয় স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতি।

 

ট্রোলপ্রিয় অলস মাঝারিয়ানা এত কিছুর মধ্যে বিজেপির উত্থানের পিছনে কারণ হিসেবে যা খুঁজে পেল তা হলো বাম সমর্থকদের ‘ভোট বদল’। অর্থাৎ, ২০১৪ লোকসভার তুলনায় বামভোটের ২২.৩ শতাংশ ভোট হারিয়ে ২০১৯-এ ৭.৪ শতাংশে নেমে আসার মধ্যে। অঙ্কটা সহজ ছিল। কেননা বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা থেকে ২৩.২ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছেছিল ৪০.২৫ শতাংশে। আবার তৃণমূল কিন্তু এই সময়েও ৪.২৫ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। কংগ্রেস হারিয়েছিল ৪ শতাংশ ভোট।কেন এত ভোট হারাল বামেরা? পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ২০১১ সাল থেকেই স্থানীয়, পঞ্চায়েত, পুরসভা থেকে উপনির্বাচন সহ সব নির্বাচনেই বামদের ভোটক্ষয় ধারাবাহিক ভাবে অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ ক্ষমতার মেদ ও আন্দোলনহীনতা এবং স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি  ঘুরে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিটুকুকে ক্ষইয়ে দিয়েছিল। তাই দেখা যাবে, বিগত ১০ বছরে কোনও একটিও সদর্থক আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেনি। মারের বদলে পাল্টা মার দূরে থাক চোখও রাঙানোর মতো মনোবল জোটাতে পারেনি এককালের হাতে মাথা কাটা নেতৃত্ব। তৃণমূল বিরোধী সেই ফাঁকটি বিজেপি ভরিয়ে গিয়েছে। শুধু ভরিয়ে দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সক্রিয় সহযোগিতায় রাজনৈতিক জমিও দখল করেছে। ২০১৪ সাল থেকেই বিজেপির জমি দখলের চেষ্টা ক্রমে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়িয়ে তোলে, দাঙ্গা বৃদ্ধি পায়, ২০১৭ সালের রামনবমীর অস্ত্রমিছিল থেকে যা তীব্র আকার ধারণ করে। এই হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্রত নিয়ে পথে নামা উচিত ছিল বামফ্রন্ট নেতৃত্বের। দুর্ভাগ্য সেই কাজটুকুও তারা করেননি। যতটুকু করেছেন তা নিছকই ঠোঁটনাড়া আনুষ্ঠানিকতা। এই কাজটি মনপ্রাণ দিয়ে করলে — যার যোগ্যতা ছিল বাম নেতৃত্বের — আজ হয়তো পিরজাদার শরণাপন্ন হতে হতো না। কিংবা রাজনৈতিক জোট না করেও মিলত পিরজাদাদের দোয়া। আম-বামভোট হারানোর সেওতো একটি কারণ। এই আমজনতার ‘ভোট বদল’-কে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখা করা যেতেই পারে। তাঁদের কাছে পৌঁছতে পারলে আমরা তাঁদের  বয়ানটুকু জানতে পারতাম। যেমন, ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ ডুয়ার্স-তরাই-পাহাড়ে প্রায় একমাস ব্যাপী ‘শ্রমজীবী অধিকার যাত্রা’ ট্রেড ইউনিয়ন, বনাধিকার, সমাজকর্মীদের নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছে এই জনপদের মানুষকে গ্রাস করে নিয়েছে রুজিরোজগারের সমস্যা। বিজেপি না তাদের পথ আটকেছে, না এই চা-বাগিচা, অরণ্য, কৃষিজীবী মানুষকে হতবুদ্ধি করতে পেরেছে বিভাজনের রাজনীতি। এই দীর্ঘ যাত্রায় কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম ও কৃষি আইন, বনাধিকার আইন বাতিলের চক্রান্তই ছিল মুখোমুখি বসার বিষয়। শিলিগুড়িতে উত্তরের নাগরিক সমাজও গঠন করেছে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক মঞ্চ’। ১০ মার্চ শিলিগুড়িতে ডাক দেওয়া হয়েছে আর এক মহামিছিলের।

 

দুঃসময় আরও গাঢ় হয়েছে। আর তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বাঁধ বাঁধতে প্রাথমিক ভাবে এগিয়ে এসেছিল নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ। ‘প্রতিবেশীকে জানুন’, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী নাগরিক উদ্যোগ’, ‘ওপেন আ ডোর’, ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’, ‘আমরা’, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উদ্যোগ’ সহ আরও বহু সংগঠন। ২০১৭ সালের নববর্ষে গো-বলয়ের বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য উদযাপন দেখেছিল কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর, বাংলা আকাদেমি চত্বর। সেই শুরু, ২০১৮-‘১৯ স্বাধীন নাগরিক আন্দোলনের বর্শামুখ ছিল এনআরসি বিরোধিতা। সংসদে সিএএ বিল পাশ হওয়ার পর দেশের নানা প্রান্ত — শাহিনবাগ থেকে পার্কসার্কাস —  নাগরিক আন্দোলন ফেটে পড়ে। করোনা ও লকডাউনের প্রকোপ ও আমপান-কাল দেখেছে  নাগরিক আন্দোলনের আর এক মানবিক রূপ। অতিমারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কর্মহীন ঘরে ফেরা শ্রমিক, বস্তিবাসী, আমপান বিধ্বস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-ছাত্রী, যুব ও নাগরিক সমাজ। এই ধারাবাহিকতায় অন্যতম বৃহৎ নাগরিক উদ্যোগ ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস বিরোধী বাংলা’ মঞ্চ। এ কথা বোধহয় বলা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই পাহাড় থেকে সাগরে ছড়িয়ে পড়েছে ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। শিলিগুড়িতে উত্তরের নাগরিক সমাজও গঠন করেছে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক মঞ্চ’। ১০ মার্চ শিলিগুড়িতে ডাক দেওয়া হয়েছে আর এক মহামিছিলের। যে আহ্বানে সাড়া মিলেছে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের থেকেও। ১০ মার্চ মঞ্চের ডাকে ‘কলকাতা চলো’ অভিযান। যেখানে উপস্থিত থাকছেন কৃষক আন্দোলনের পাঁচ নেতা। এই ‘কলকাতা চলো’ ডাক স্বাধীন নাগরিক সমাজের আন্দোলনের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করতে চলেছে।

 

Share this
Leave a Comment