গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার কুঁদঘাটে ম্যানহোল পরিস্কার করতে গিয়ে মৃত্যু হয় চারজন ঠিকা শ্রমিকের। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এদেশে নিষিদ্ধ। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ম্যানহোল ও নিকাশী ব্যবস্থা পরিস্কারের ব্যবস্থাটি যন্ত্রচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু কলকাতা পৌর সংস্থা সেই বিধির তোয়াক্কা না করে অনভিজ্ঞ ঠিকা শ্রমিকদের দিয়ে এবং কোনওরকম সুরক্ষা বিধির পরোয়া না করে তাদের ম্যানহোল পরিস্কারের কাজে নিয়োগ করে এবং চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে তাদের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর দায় কার? লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
উনিশ বছরের সাবির হোসেন, ২০ বছরের লিয়াকত আলি, ২২ বছরের জাহাঙ্গীর আলম, ৩৫ বছরের মহম্মদ আলমগীর – চার জনেই ঠিকা শ্রমিক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার দরিদ্র দলিত মুসলমান পরিবারের মানুষ। অধিকাংশের পরিবারই আর্থ-সামাজিকভাবে এতটাই সুবিধাবঞ্চিত যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও রোজগারের পথে নামতে হয় সাবির, লিয়াকত, জাহাঙ্গীর, মহম্মদদের। কারণ তাঁদের উপার্জিত টাকাতেই দু’বেলা দু’মুঠো ভাত উঠবে তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকা পরিবারের মুখে আর নিজেদের প্রাণটাও বাঁচবে। তার জন্য শহরের বর্জ্য নিজে হাতে ম্যানহোলে নেমে পরিষ্কার করতে হয় এই মানুষগুলিকে। আর সেই কাজ সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও, তাদের জন্য কোনওরকম সুরক্ষাবিধি না থাকায় শহর কলকাতায় তারা স্রেফ মারা যান ম্যানহোলে দম আটকে।
ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার নামে পরিচিত এই মানুষেরা দেশের চূড়ান্ত বর্ণবাদী সামাজিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক শোষনের নিরিখে প্রান্তিক, দলিত, নিম্নবর্ণ, আর্থ-সামাজিকভাবে সম্পূর্ণভাবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরাই। তারাই আইনের ফাঁক এড়িয়ে এই কাজে নিয়োগ হচ্ছেন ও সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর মুখে পড়ছেন। অথচ দেশের আইন অনুযায়ী ম্যানহোল ও নিকাশী ব্যবস্থা পরিষ্কারের এই কাজে ব্যক্তি মানুষের নিয়োগ বর্তমানে আইনত নিষিদ্ধ। সবটাই যন্ত্রচালিত হওয়ার কথা এবং যে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে মানুষ এই কাজ করবেন তাদের সব রকম সুরক্ষা বিধি মেনে কাজ করানোর কথাও বলা রয়েছে। যদিও ১৯৯৪ থেকে সাফাই কর্মচারী আন্দোলন (এসকেএ) শুরু হওয়ার ফলে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বিষয়টির বিরুদ্ধে জনমত দানা বাঁধতে শুরু করেছে এবং এ ধরনের ঘটনাগুলি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। যদিও মূলস্রোতের গণমাধ্যম এখনও এই বেআইনি কাজ বা শ্রমিক মৃত্যুকে শিরোনামযোগ্য মনে করে না।
ম্যানহোল ও নিকাশী ব্যবস্থা পরিস্কারের মতো একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর পেশায় দশকের পর দশক ধরে যুক্ত হয়ে রয়েছেন সমাজের দরিদ্র ও তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষেরা। এদিকে ‘প্রহিবিশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন রুলস্, ২০১৩’-এর রুল ৩-এ স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে – “No person shall be permitted to clean sewers manually, with protective gear and safety devices, except under four circumstances” অর্থাৎ চারটি ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া কোনও ব্যক্তি হাতে করে বা প্রতিরোধক পোশাক ও সুরক্ষামূলক যন্ত্রপাতিসহও নিকাশী ব্যবস্থা পরিস্কার করবেন না। এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে কোনও ব্যক্তিমানুষের বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া নিকাশী, ম্যানহোল ইত্যাদি পরিস্কার আইনত নিষিদ্ধ। তাছাড়া এই যে চারটি ব্যতিক্রমী পরিস্থতির কথা বলা হয়েছে সেগুলির ক্ষেত্রেও স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের লিখিত অনুমতি থাকতে হবে, যেখানে তিনি এই কাজের উপযুক্ত কারণ দর্শাবেন। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বা ব্যক্তি মানুষের দ্বারা নিকাশী পরিস্কার আইনত নিষিদ্ধ করার জন্য দেশজুড়ে বহু বছর ধরেই নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চলছে। কারণ এটি শুধু অত্যন্ত অমানবিকই নয়, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় একজন নাগরিকের সম্মানের সঙ্গে জীবনধারনের যে অধিকার তাও এর দ্বারা কার্যত লঙ্ঘিত হচ্ছে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হল গত বছর চালু হওয়া সাফাইমিত্র সুরক্ষা চ্যালেঞ্জ প্রকল্পের অধীনে সারা দেশের ২৪৩টি শহরে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সমস্ত সেপটিক ও নিকাশী ট্যাঙ্ক পরিস্কার সম্পূর্ণভাবে যন্ত্রচালিত করার লক্ষ্য ধার্য করা হয়েছিল।
বিধানসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত উত্তেজনার মাঝে এ রাজ্যে চারজন মানুষের মৃত্যু প্রায় হারিয়ে যায়। আইন, সরকারি প্রকল্পের গালভরা আশ্বাস, মানবিকতা সবটাই নিছক কথার কথা হয়ে রয়ে যায়। উনিশ বছরের কিছুই না জানা একটি ছেলে যে শহরে এসেছিল সামান্য রোজগারের আশায় গ্রামের বাড়িতে লাশ হয়ে ফেরে। যে চারজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তারা আদপে কেউই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার নন। শহরে এসে ঠিকাদারের অধীনে ঠিকা শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত হন। বর্জ্য ও নিকাষী পরিস্কারের কোনও রকম অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ঠিকা শ্রমিকদের কীভাবে পৌর প্রশাসন ম্যানহোল পরিস্কারের কাজে নিয়োগ করেন সে প্রশ্নই তোলা সবচেয়ে আগে জরুরি। জানা যাচ্ছে প্রথম ম্যানহোলে নামেন সাবির। কোনওরকম দড়ি বা অক্সিজেন মাস্ক এদের কারওরই ছিল না। তিনি নামার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকি তিন জন নামেন এবং বিষাক্ত গ্যাস ও গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। চারজন তরতাজা মানুষের এরকম অবস্থার পরেও বাকি আরও তিন জন ২৪ বছরের সইফুল ইসলাম, ৩৫ বছরের মহম্মদ সলোমন, ২২ বছরের মাহাবুল হককেও ম্যানহোলে নামানো হয়। তারা কিছুটা নামার পর পরিস্থিতি বিপজ্জনক বুঝে উঠে আসেন, যদিও তারাও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মৃত শ্রমিকদের দেহ তৎক্ষণাৎ তোলারও কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বেশ কয়েক ঘন্টা পরে দমকল বাহিনী এসে দেহ উদ্ধার করে।
নির্বাচনী প্রচারের বাকযুদ্ধে সরকার, বিরোধী কারওর ভাষন, বক্তব্য কোনও কিছুতেই জায়গা করে নেয়নি এই চার জন মানুষের মৃত্যু, জায়গা পায়নি প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের অবহেলার কথা, জায়গা হয়নি আইন ভাঙার বিষয়টিরও। তবু এখনও পর্যন্ত দু’তিনটি জায়গায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। পুর প্রশাসন ও যাদের প্রকল্পটি সেই কলকাতা এনভায়রনমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট (কেইআইআইপি)-এর সামনে বিক্ষোভ দেখানো, প্রকল্প অধিকর্তার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি আদপে এশিয়ান ব্যাঙ্কের। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এফআইআর করা হয়েছে, কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে তা কিছুই তারা জানায়নি। পরবর্তী সময়ে এই মৃত্যুর তদন্তে পিআইএল করার কথাও ভাবা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদীদের দাবির তালিকায় ছিল (১) মৃত শ্রমিক পরিবারগুলিকে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে অবিলম্বে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, (২) সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টারের লাইসেন্স বাতিল ও গ্রেপ্তার করতে হবে (এই দাবি পরে তুলে নেওয়া হয়), (৩) কায়িক শ্রমের মাধ্যমে নয়, নর্দমা সাফাইয়ের কাজ আধুনিক যন্ত্র দিয়ে করতে হবে, (৪) সমস্ত অস্থায়ী সাফাই কর্মীদের অবিলম্বে স্থায়ীকরণ করতে হবে। চাপের মুখে কলকাতা পৌর সংস্থা মৃতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষনা করা হয়েছে। সরকারি দায়িত্ব সেরে ফেললেও এরকম বেআইনি ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের ফলস্বরূপ বেঘোরে প্রাণ হারানোর ক্ষতিপূরণ সত্যিই হয় কি না সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর পক্ষ থেকে আলতাফ আহমেদ বলছিলেন, “এই মানুষগুলিকে তো মানুষ বলেই মনে করে না। এদের জন্য যেটুকু অধিকার পাওয়া গেছে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে বা আরও নানাভাবে সরকার, প্রশাসন, প্রকল্প মালিক কেউই কিছু দিতে চায় না। এটা ভারত বলেই সম্ভব। মানুষ মরলে ৫০ জন হয়তো বিক্ষোভ দেখাবে, ডেপুটেশন দেবে, তারপর হয়তো প্রশাসন কোনও সামান্য ব্যবস্থা নেবে। ইতিমধ্যে এই প্রথা বিলুপ্ত, আইনিভাবে সেই প্রথাই ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা খবর পেয়েছি কয়েক কোটি টাকার মেশিনও এসেছে। অথচ সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে এখন এমনকি এ ধরনের ঠিকা শ্রমিকদেরও নিয়োগ করা হচ্ছে। ঠিকা শ্রমিক – যাদের জন্য কেউ বলবে না, ওরা জেনেও গেছে এদের জন্য কালো পতাকা নিয়ে কেউ বিক্ষোভ দেখাবে না, এই ধরনের শ্রমজীবী মানুষকে এরা টার্গেট করছে। আমরা নিয়মিত মৃতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি।”
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সমীক্ষা দাবি করছে ২০০৮-এ যেখানে দেশে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারের সংখ্যা ছিল ৭৭০,৩৩৮ তা না কি ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪২,৩০৩। কেন্দ্রের দাবি এর মূলে রয়েছে স্বচ্ছ ভারত অভিযান ও কঠোরভাবে ‘প্রহিবিশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট, ২০১৩’ মেনে চলা। মনে রাখতে হবে এই সমীক্ষাটি সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল সাফাই কর্মচারী ফিনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন করেছিল। এই সমীক্ষাটি করা হয়েছিল দেশের মাত্র ১৪টি রাজ্যে। সুতরাং এই সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর প্রশ্ন রয়ে যায়।
অপর দিকে এসকেএ-এর তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ম্যানহোলেই প্রতি বছর ২০০০ শ্রমিক বিষাক্ত গ্যাসে প্রাণ হারান। এসকেএ-এর বেজওয়াদা উইলসন-এর সঙ্গে এই প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানালেন, “সমস্যা হল ভারতে সরকারের কোনও পলিসি নেই নিকাশী ও সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিস্কারের কাজে নিযুক্ত কর্মীদের সুরক্ষার জন্য। যদিও ২০১৩-এর আইনের আওতায় পড়েন এই কর্মীরা, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। এবং বর্তমানে কেন্দ্র সরকার এই আইনটিও নতুন করে পুর্নবিবেচনা/রিভিউ করতে চায়, কারণ তারা চায় না এই কর্মীরা আইনটির আওতার মধ্যে থাকেন। কারণ তারা মনে করছেন নর্দমা, ম্যানহোল – নিকাশী ব্যবস্থা পরিস্কারের জন্য এই যে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার নিয়োগ তা এখন আর নিষিদ্ধ করে রাখা যাবে না, সেপটিক ট্যাঙ্ক ও নিকাশী পরিস্কারের জন্য স্যানিটেশন কর্মীদেরই প্রয়োজন হবে। কিন্তু সরকারের আসলে উচিত কাজের একটা সঠিক পরিকল্পনা করা এবং যন্ত্র ব্যবহার করা এই কাজগুলির জন্য, যা ঘোষণা হলেও এখনও পর্যন্ত ভারতে কার্যকর হয়নি। সরকার এই যন্ত্রপাতি নিজে তৈরিও করছে না, তারা প্রাইভেট কোম্পানিগুলিকে বলছে তৈরি করতে। কোন কোম্পানি এই যন্ত্র তৈরি করবে তা এখনও ঠিকই হয়নি। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে এই কাজে যেন ব্যক্তি নিয়োগ বন্ধ হয়। কোনও ব্যক্তি এই কাজে মারা গেলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্য সরকারই তা দিতে টালবাহানা করে, পরিবারগুলির তিন, চার বছরও চলে যায় এই ক্ষতিপূরণ পেতে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেরই এক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব রয়ে যায়। অন্য দিকে কেন্দ্র সরকার প্রকাশ্যে মলত্যাগ বন্ধ করার প্রকল্পের জন্য ২ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেছে। অথচ বর্জ্য ও নিকাশী পরিস্কার করতে গিয়ে মৃতদের জন্য কোনও অর্থবরাদ্দ ঘোষণা হয় না। আমাদের কাছে তথ্য আছে কতজন প্রতি বছর মারা যান, যখনই এরকম ঘটনা ঘটে আমরা প্রধানমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে চিঠি পাঠাই অথচ সংসদে মন্ত্রী তার থেকে অনেক কম সংখ্যা বলে দিতে পারেন। আমরা বলছি অন্তত মৃতের সংখ্যাটা স্বীকার করুন। কেন সরকার পুরো ব্যবস্থাটিকে যন্ত্রচালিত করছেন না? দেশের নাগরিক হিসাবে সকলের জীবনের অধিকার রয়েছে। যেকোনও ঘটনা ঘটলে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা মন্তব্য করেন। শুধু এই মানুষগুলির ক্ষেত্রেই তারা নিশ্চুপ। কেন? তারা দলিত, প্রান্তিক বলে, তাদের কোনও রাজনৈতিক ক্ষমরা নেই বলে? যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের নিজেদের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়েই ভাবতে হবে। যদি এই সুরক্ষাটুকু নাগরিকদের জন্য সাংবিধানিক পরিকাঠামোর মধ্যে নিশ্চিত করতে না পারা যায় তাহলে আর দেশকে রক্ষা করা যাবে কীভাবে। আর এটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই কাজ সম্পূর্ণ যন্ত্রচালিত করানোর জন্য চাপ তৈরি করতেই হবে। প্রতিবার কেন্দ্র, রাজ্য সরকার দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু তাদের উপর নিরবচ্ছিন্নভাবে চাপ তৈরি করে রাখতেই হবে।
আসলে প্রতিটি শ্রমিক মৃত্যু, রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসনের গাফিলতিতে মৃত্যুতে শুধু একজন মানুষ নন, তার পরিবারটিও প্রায় ধ্বংসের সামনে এসে দাঁড়ায়। যে আর্থিক, সামাজিক, মানসিক চাপ ও ট্রমার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয় তা সম্ভবত একটি গোটা জীবনে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। মালদার এই চার শ্রমিকের মধ্যে আলমগীরের স্ত্রী জোসনারা বিবির সঙ্গে কিছু সময় কথা বলার সুযোগ হয়েছিল, স্তিমিত গলায় জানালেন, “বাড়িতে শ্বশুর, শাশুড়ি, আমার দুই ছেলেমেয়ে, আমি আর আমার এক ননদ আছি। ছেলে দশ বছরের, মেয়ে পাঁচ বছরের। সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ করে বলেছে, পাশে আছি, ব্যবস্থা করছি কিছু। আরও কেউ কেউ যোগাযোগ করেছে।” নিজের বয়স বললেন ২০, ২২, বিয়ে হয়েছিল ১৫, ১৬ বছর। নিজে আর সন্তানেরা সুস্থ আছেন কি না জানতে চাওয়ায় মৃদু কন্ঠে শুধু বলেন, “আছি আল্লার রহমতে।” একটা সংসার একটা মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় এভাবেই। জোসনারা জানালেন, তার স্বামী শহরে এসেছিলেন, ‘পাইপলাইনের কাজ’ করতে হবে জেনে, তা যে মৃত্যু পরোয়ানা হয়ে যাবে জানা ছিল না চার জন মৃত মানুষের।
Feature Image courtesy : Indian Express