তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লিতে ধরনা অব্যাহত। উত্তরভারতে বিজেপির রাজনৈতিক ও সামাজিক ধস ক্রমে বেড়েই চলেছে। হাজার অপপ্রচার, মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক বয়ান, দমনপীড়নের পরও কৃষকশক্তিকে টলাতে না পেরে ক্রুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন, কর্পোরেটরাজই দেশের অর্থনীতি-শিল্প শাসন করবে। সরকার নয়। তাঁবেদার দুই গুজরাতি শিল্পপতি আম্বানি-আদানির উদ্দেশ্যে কৃষকদের সমালোচনা সহ্য হয়নি একদা গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর।
এই কৃষি আইন বিষয়ে এটি একটি দীর্ঘ নিবন্ধ। যা ‘আপডেট স্টাডি গ্রুপ’ (updatestudygroup.org) রচনা করেছে। তাদের অনুমতি নিয়েই গ্রাউন্ডজিরো নিবন্ধটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা শুরু করল। তিন পর্বে নিবন্ধটি প্রকাশিত হবে। সম্পাদকমণ্ডলী।
কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি বিল অর্ডিন্যান্স জারি করে ২০২০ সালের জুন মাসে। অর্ডিন্যান্স জারির পর প্রায় গায়ের জোরে গত সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি বিল সংসদে পাশ করানো হয়। কৃষি অর্ডিন্যান্স ও কৃষি বিল জারির প্রথম থেকেই সরকার গলা ফুলিয়ে বলে আসছে, এই অর্ডিন্যান্স বা বিল কৃষকদের ‘স্বাধীনতা’ দিয়েছে বাজারে লাভজনক দামে ফসল বিক্রি করার, বিশ্ব বাজারে কৃষিপণ্য রপ্তানি করার। সরকারের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। কিন্তু কৃষি বিল কি প্রকৃতই কৃষকদের ‘স্বাধীন’ করেছে? এই বিল কি প্রকৃতই কৃষক স্বার্থে রচিত? দেখা যাক।
অর্ডিন্যান্স জারির এক মাসের মধ্যে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেজ কাউন্সিল আয়োজিত ‘ইন্ডিয়া আইডিয়াজ সামিট’ সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন,
ভারত সম্প্রতি কৃষি ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক সংস্কার করেছে। (এর ফলে) কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি, কৃষি সরবরাহ শৃঙ্খল পরিচালনা, প্রস্তুত করা খাদ্য, মৎস্য ক্ষেত্র এবং জৈব উৎপাদনে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুলে গেছে। ২০২৫ সালে ভারতের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রের আয়তন দাঁড়াবে ৫০,০০০ কোটি ডলার। আরও বেশি লাভ করতে হলে ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সুযোগের সদ্ব্যবহার করার এটাই হল ব্রাহ্ম মুহূর্ত।১
প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত পরিষ্কার করে দিয়েছেন, কৃষি বিলের ফলে আসলে মার্কিন বিনিয়োগকারী তথা বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কাছে মুনাফা অর্জনের এক ‘‘ঐতিহাসিক’’ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেছে। ভারত প্রকৃতই ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে উঠছে। বস্তুত, কৃষি বিল পাশ হওয়ার পর সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারনৈতিক সংস্থা থেকে শুরু করে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা তাকে উদ্বাহু সমর্থন দিয়েছে। কৃষক আন্দোলনের দেড় মাস পরে আইএমএফ জানিয়েছে এই বিল হল ভারতে কৃষি সংস্কারের লক্ষ্যে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ।২ ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরাম (ইউএসআইএসপিএফ)-এর সভাপতি মুকেশ আঘি সানন্দে ঘোষণা করেছেন, এই সংস্কারের ফলে ভারতের কৃষকরা সরাসরি অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের কাছে পৌছে যাবে এবং বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।৩ ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের নয়া কৃষি বিল সমর্থন করেছে এবং বলেছে এর ফলে ভারতীয় বাজারের ‘‘দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে’’।৪ অর্থাৎ, ভারতের বাজারের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমেরিকার স্বার্থ খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত।
১৯৯১: কৃষি সংস্কারের সলতে পাকানোর সূত্রপাত
ভারতে ১৯৯১ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অর্থনৈতিক সংস্কার ও কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস চালু হয়েছিল। বস্তুত, তখনই বিশ্ব ব্যাঙ্ক সহ সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলি ভারতের শাসকবর্গকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল, কৃষিতে সংস্কার চালু করতে হবে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে বাজেট পেশ করার আগে বিশ্ব ব্যাঙ্কের যে মেমোরান্ডাম (খণ্ড ১) প্রকাশিত হয় তাতে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল,
সুতরাং ভারতকে তার অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যাস করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকৃত বিকল্প হল, ভারত বৈদেশিক আর্থিক সাহায্য নিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ, বৃদ্ধি-অভিমুখী পুনর্বিন্যাস কর্মসূচী গ্রহণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেবে না কি বহু বছরের জন্য আন্তর্জাতিক পুঁজির বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেশকে এক বিশৃঙ্খল ও যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দেবে এবং বৃদ্ধির পরিমাণ ব্যাপক মাত্রায় সংকুচিত করবে।৫
তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ও ভারতের পুঁজিপতিবর্গ সাগ্রহে বিশ্ব ব্যাঙ্কের পাঁচন গিলে উদারনীতি তথা আর্থিক সংস্কার চালু করেছিল। কৃষি সংস্কারের জন্য উপরোক্ত মেমোরান্ডামে বিশ্ব ব্যাঙ্ক যে নির্দেশিকা জারি করে তার মধ্যে ছিল:
- ১) চার বছরের মধ্যে সারের উপর থেকে ভরতুকি তুলে নিতে হবে।
- ২) কৃষি ক্ষেত্রে সরকার উদার হস্তে যে ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় তা বন্ধ করে দিতে হবে।
- ৩) কৃষি পণ্য আমদানি ও রপ্তানির উপর সমস্ত বাধা-নিষেধ তুলে নিতে হবে এবং তৈলবীজের আমদানি অবাধ করে দিতে হবে।
- ৪) বীজের উপর গবেষণায় বেসরকারি উদ্যোগ, বেসরকারি বিনিয়োগের রাস্তা করে দিতে হবে। বীজের উপর ভরতুকি তুলে দিতে হবে।
- ৫) কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুতে সরবরাহে ভরতুকি তুলে নিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে।
- ৬) ফসল ক্রয়, পরিবহণ ও গুদামে সঞ্চয়ের উপর ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণ ধাপে ধাপে তুলে দিয়ে সে দায়িত্ব লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্ট, পাইকারি বিক্রেতা ও মজুতদারের হাতে তুলে দিতে হবে।
- ৭) ফসলের আপৎকালীন মজুত ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে, খাদ্যফসলে ঘাটতি দেখা গেলে বিশ্ব ফসল বাজারের উপর নির্ভর করতে হবে।
- ৮) কৃষকদের থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কিনে নেওয়ার নীতি প্রত্যাহার করতে হবে।
- ৯) খাদ্যে ভরতুকি কমিয়ে দিয়ে প্রকৃত গরিবদের জন্য গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু রেখে বাকিদের বণ্টন ব্যবস্থা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে।৬
গত তিরিশ বছরে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই নির্দেশিকা বহুলাংশে প্রযুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী তাই ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে এক কৃষি মহাসম্মেলনে ঘোষণা করেন:
আমরা যে কাজ করেছি তা ২৫-৩০ বছর আগে করা উচিত ছিল।…এই কৃষি সংস্কার রাতারাতি হয়নি। এই দেশের প্রতিটি সরকার গত ২০-২২ বছর ধরে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে এ ব্যাপারে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চালিয়েছে।৭
প্রকৃতপক্ষে, গত ২৫-৩০ বছর ধরে বিভিন্ন রঙের কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কার ধাপে ধাপে চালু করেছে। সারের উপর ভরতুকি ব্যাপক মাত্রায় কমানো হয়েছে। ফলে সারের দাম বেড়েছে আকাশছোঁয়া। কৃষিতে ব্যাঙ্ক ঋণ খর্বিত হয়েছে বড় মাত্রায়। ফলে চাষিরা মহাজনের কাছে আরও বেশি মাত্রায় বাঁধা পড়েছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লক্ষ চাষি আত্মহত্যা করেছে। মধ্য-১৯৯০ পর্ব থেকে কৃষিতে সরকারি সাহায্য ও বিনিয়োগ ক্রমে ক্রমে সংকুচিত হয়েছে। কৃষি-ফসল আমদানির উপর বাধা-নিষেধ কিছুটা হলেও তুলে নেওয়া হয়েছে। ভোজ্য তেলের অর্ধেক এখন বিদেশ থেকে আমদানি হয়। বীজের বাজার থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ক্রমশ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তার স্থান নিয়েছে বেসরকারি পুঁজি। সাম্প্রতিক কালে নতুন বিদ্যুৎ বিল এনে কৃষিতে ভরতুকি ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে। গণবণ্টন ব্যবস্থা সংকুচিত করে বিপিএল ও এপিএল ব্যবস্থা চালু হয়েছে, ইত্যাদি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ভুল কিছু বলেননি। অন্যান্য সরকার যে কাজটা ধীরে ধীরে ও রেখে ঢেকে করছিল, বর্তমান সরকার তা এক ধাক্কায় করেছে। কৃষি সংস্কার রাতারাতি ঘটেনি।
গত শতকের নব্বই-এর দশক থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নানা ভাবে ভারতের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলির উপর লাগাতার চাপ দিয়ে বলেছে, খাদ্য নিরাপত্তার নামে ভারতের মতো দেশগুলি ফসলের যে মজুত ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে এবং গরিবদের জন্য সস্তা দরে চাল-গম সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তার ফলে ভারত গর্হিত কাজ করছে, কেননা এর ফলে ভারতে ফসলের দাম নিম্নমুখী থাকছে, ফসল রপ্তানিকারক দেশ ও কোম্পানিগুলি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হচ্ছে। এছাড়া, চাল-গম উৎপাদনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থা বজায় থাকার ফলে এই দেশে রপ্তানিকারক ফসল কোম্পানিগুলি ঢুকতে পারছে না, ফসলের দামও বাড়ছে না। সুতরাং এই ব্যবস্থাগুলিকে সত্বর তুলে দিতে হবে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কৃষকরা চাল-গমের পরিবর্তে অন্যান্য বাণিজ্যিক ফসলের দিকে ঝোঁকে এবং তা রপ্তানি করে। ২০০১ সালের ৬ মার্চ প্রথম এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী কৃষকদের প্রতি আহ্বান রাখেন, ‘‘ধান ও গমের উপর থেকে নজর সরাও।… ফল, ফুল, তৈলবীজ ও সব্জি উৎপাদনে মন দাও কেননা এগুলির রপ্তানির উত্তম সম্ভাবনা আছে।’’৮ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার এখন কৃষি সংস্কারের জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা যেমন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দাবিপত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, অতীতে তাকে প্রযুক্ত করার প্রচেষ্টাও কম ছিল না।
ভারত-মার্কিন প্রস্তাবিত কৃষি চুক্তি
২০২০ সালের গোড়ার দিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারতে আসেন, তখন কথা ছিল ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (Free Trade Agreement বা, FTA) সম্পাদিত হবে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন কৃষি পণ্যদ্রব্য যাতে ভারতে অবাধে ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা করা। বস্তুত, ভারতের কৃষিপণ্য বাজারে ঢোকার জন্য মার্কিন বহুজাতিকরা খুবই ব্যগ্র। পাঁচজন মার্কিন সেনেটর তার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি একটি চিঠিও লিখে ফেলেছিলেন। তাতে লেখা হয়েছিল, ‘‘গত দশ বছর ধরে গ্রামীণ আমেরিকার অর্থনৈতিক কার্যকলাপে রপ্তানির জন্য অতিরিক্ত ১২৫ কোটি ডলার ঢালা হয়েছে। ভারতের বাণিজ্য বাধাগুলি কমিয়ে আনলে গ্রামীণ আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার সুযোগ পাওয়া যাবে।’’৯ বার্তাটি ছিল স্পষ্ট। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে রয়টার জানিয়েছিল, আসন্ন ভারত-মার্কিন কৃষি চুক্তির ফলে ভারতে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলারের মার্কিন কৃষিপণ্য ঢুকতে পারে।১০
ঐতিহাসিক ভাবে ভারতের বাজারে মার্কিন কৃষিপণ্য ঢেলে দেবার দৃষ্টান্ত অনেক। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের খাদ্য সংকট সামলানোর নামে পিএল-৪৮০ গম রপ্তানি, কিংবা ১৯৯৮ সালে ভারতে প্রতি টন ২০০ ডলার দরে সয়া রপ্তানি, যার ফলে বহু সয়া চাষি ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মৃ্ত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। অথবা ২০০৫ সালে দুই দেশের মধ্যে কৃষি চুক্তির ফলে প্রতি মেট্রিক টন ৪০০ ডলার দরে মার্কিন (বস্তুত কারগিল কোম্পানির) গম আমদানি, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন পিছু ১৫২ ডলার।১১ যাই হোক, ২০২০ সালে ভারতে ট্রাম্প সাহেবের সফরের সময়ে অন্যান্য কিছু ব্যাপারে ঐকমত্য না হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত এফটিএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। কিন্তু পরবর্তী কালে সেই চুক্তি হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা বিরাজ করছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা গেছে, বাইডেন প্রশাসনের অধীনে এফটিএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর (USDA) জানিয়েছে, ভারতে আমেরিকা থেকে দুগ্ধজাত দ্রব্য, ভোজ্য তেল, ডাল, বাদাম ও ফল রপ্তানির যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনই ভারত থেকে চাল, তুলো ও মোষের মাংস রপ্তানিরও সুযোগ আছে।১২ ভারত-মার্কিন প্রস্তাবিত কৃষি চুক্তির সঙ্গে ভারতের তিনটি কৃষি বিলের যথেষ্ট সম্পর্ক রয়েছে এমন অনুমান করা অসঙ্গত হবে না।
ভারত-মার্কিন এহেন কৃষি চুক্তির সম্ভাবনা যে প্রবল তা অন্যান্য সংবাদ থেকেও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত তিন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, মেক্সিকো, এমনকি চিনের সঙ্গেও কৃষি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত করেছে। এর ফলে সেই দেশগুলি সাধারণ শস্য তো বটেই, এমনকি জিনগত ভাবে পরিবর্তিত (জিএম) ফসল প্রবেশেরও চুক্তি করেছে। কিন্তু, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রবল চাপ থাকলেও এতদিন ভারতের বাজারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য ধনী দেশ ও কোম্পানিগুলি খুব একটা ঢুকতে পারেনি। কিছুদিন আগে ভারত এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বাণিজ্য চুক্তি (RCEP) থেকে বেরিয়ে এসে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। এর ফল হতে পারে আরও সর্বনাশা। GRAIN জানাচ্ছে, ভারতের কৃষকদের হাতে যেখানে গড়ে ১ হেক্টর করে জমি আছে, সেখানে মার্কিন চাষিদের (বা কোম্পানির) হাতে আছে গড়ে ১৭৬ হেক্টর বা ১৭৬ গুণ জমি। আমেরিকার কৃষিতে যেখানে মাত্র ২ শতাংশ বা ২১ লক্ষ কৃষক (কৃষি-শ্রমিক সমেত) যুক্ত, সেখানে ভারতের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বা ৬৫-৭০ কোটি মানুষ কৃষি ক্ষেত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। আমেরিকার কৃষিক্ষেত্র থেকে কৃষকদের পরিবার পিছু বার্ষিক গড় আয় হল ১৮,৬৩৭ ডলার। ভারতে তা ১০০০ ডলারও নয়।১৩ অন্যান্য ধনী দেশগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে ঐ সব দেশগুলি থেকে ঢালাও ভাবে কৃষিপণ্য ভারতে আমদানি হতে শুরু করলে ভারতের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় কী ধরনের সর্বনাশ হবে তা অনুমান করা খুব কঠিন নয়।
‘নিউ ভিশন ফর এগ্রিকালচার’ না কি লুণ্ঠনের নয়া ছক?
সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের নিউ ভিশন ফর এগ্রিকালচার (NVA) এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইউএন ২০৩০ অ্যাজেন্ডা’ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিতে কৃষিক্ষেত্রে উদারীকরণ ও কৃষির উপর কর্পোরেট আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্যে যে মডেল উপস্থিত করেছে তার সঙ্গে মোদী সরকারের কৃষি বিল আশ্চর্য রকম সঙ্গতিপূর্ণ। গত বারো বছর ধরে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম, রকফেলার ও বিল গেটস ফাউন্ডেশন আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়াতে তাদের কৃষি কর্মসূচী ব্যাপকভাবে প্রবিষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ, কৃষকদের অসম প্রতিযোগিতার সামনে ফেলে দিয়ে তাদের জমি দখল, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে যে সব আইন-কবচ আছে তার ব্যাপক সংস্কার, ইত্যাদির জন্য তারা ‘এনভিএ ইন্ডিয়া বিজনেজ কাউন্সিল’ নামক একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী গঠন করেছে। এই গোষ্ঠীর ঘোষিত উদ্দেশ্য হল, ‘‘এনভিএ ইন্ডিয়া বিজনেজ কাউন্সিল হল একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা যারা ভারতে টেকসই কৃষিগত বৃদ্ধির জন্য বেসরকারি উদ্যোগ ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে।’’১৪ অর্থাৎ এই বিজনেজ কাউন্সিলের ঘোষিত লক্ষ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কীভাবে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট ও বহুজাতিক কব্জাকে দৃঢ় করা যায়, তারা সেই উদ্দেশ্যেই কাজ করে চলেছে।
এই বিজনেস কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে আছে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ কীটনাশক ও জিএম বীজ-উৎপাদক মনস্যান্টো, বৃহৎ মার্কিন শস্য কোম্পানি কারগিল, দাউ অ্যাগ্রোসায়েন্স, জিএম বীজ উৎপাদক দ্যুপঁ, শস্য ব্যবসায়ী লুইস দ্রেইফাস কোম্পানি, ওয়ালমার্ট, মাহীন্দ্রা অ্যান্ড মাহীন্দ্রা (বিশ্বের সর্ববৃহৎ ট্রাক্টর কোম্পানি), নেসলে, পেপসিকো, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুতকারী ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, আদানি গ্রুপ, ইত্যাদি। এমনকি মুকেশ আমবানিও ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের বোর্ড অব ডিরেক্টর্স-এর অন্যতম সদস্য।১৫ জানি না, কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি সংস্কার ও উপরোক্ত বিজনেস কাউন্সিলের উদ্দেশ্যর মধ্যে কেউ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক খুঁজে পেলে তাকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করা হবে কি না।
বস্তুত, গত ৩০ বছরে সরকারগুলি নানাভাবে সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলির চাপের কাছে মাথা নত করতে চেয়েছে। কিন্তু মূলত ভারতে কৃষক আন্দোলনের চাপে এবং অন্যান্য কিছু দেশও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশনামাকে বিরোধিতা করায় উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলি চালু থেকেছে। এখন দেশ জুড়ে করোনা অতিমারির ফলে যখন দেশের শ্রমিক ও কৃষকরা গভীর সংকটগ্রস্ত, তখন সুযোগ বুঝে ঘাড়ে কোপ মারছে কেন্দ্রীয় সরকার। কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলির নিদানগুলি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিয়ে বর্তমান কৃষি সংস্কার চালু করেছে তা নিয়ে আলোচনা করব এর পরের অংশে।
(ক্রমশ)
সূত্র:
১। https://www.republicworld.com/…/pm-modi-plays-up...; ২২.০৭.২০২০, সংগৃহীত ২৫.০৯.২০২০।
২। https://www.thehindu.com/ ১৫.০১.২০২১, সংগৃহীত ০৫.০২.২০২১।
৩। https://theprint.in/…/new-farm-bills-will-allow…/575086/; ২৯.১২.২০২০, সংগৃহীত ৩১.১২.২০২০।
৪। https://www.business-standard.com/…/us-backs-india-s…; ০৪.০২.২০২১, সংগৃহীত ০৫.০২.২০২১।
৫। https://rupeindia.wordpress.com/; ০৫.০১.২০২১-এ উদ্ধৃত, সংগৃহীত ০৬.০১.২০২১।
৬। পূর্বোক্ত।
৭। https://pib.gov.in/PressReleaseIframePage; ১৮.১২.২০২০, সংগৃহীত ০৬.০১.২০২১।
৮। সূত্র ৫ দেখুন।
৯। https://thewire.in/…/the-pandoras-box-of-agri-reform…; ২১.১২.২০২০, সংগৃহীত ২১.১২.২০২০।
১০। https://www.reuters.com/…/exclusive-u-s-pushing-india…; ২৪.০১.২০২০, সংগৃহীত ৩১.১২.২০২০।
১১। সূত্র ৯ দেখুন।
১২। https://www.ndtv.com/…/india-us-negotiating-on-tariff…; ১১.০১.২০২১, সংগৃহীত ১৫.০১.২০২১।
১৩। https://www.grain.org/…/6472-perils-of-the-us-india…; ২৬.০৫.২০২০, সংগৃহীত ৩১.১২.২০২০।
১৪। https://countercurrents.org/…/the-wef-agenda-behind…/; ১৭.০২.২০২১, সংগৃহীত ১৭.০২.২০২১।
১৫। পূর্বোক্ত।
Also visit: updatestudygroup.org
বস্তূনিষ্ঠ ওদ
দ্বর্থহীন।