মানুষের কাছে তখন রেশনের চাল-ডাল-আলু-সোয়াবিন আর ইঁদুরকল! অলরেডি ৬০-এর ওপর শো হয়ে গেছে …জনগণমন দলের ইঁদুরকল নাটক নিয়ে লিখলেন নাট্যকর্মী অঙ্কুর।
ইঁদুর চলে যাচ্ছে। চাষির গোলা থেকে, চাষির ঘর থেকে।
পোড়াকপালি ইঁদুর চলে যাচ্ছে। বস্তি থেকে, কলোনি থেকে, ফুটপাত থেকে, প্লাস্টিকের ছাউনি থেকে।
ধরিত্রী আর ‘প্ল্যানেট অফ্ স্লাম্স’ থাকছে না, ধরিত্রী পরিষ্কার, ঝকঝকে হয়ে উঠছে। বস্তি-কুচ্ছিত ধরিত্রী হয়ে উঠছে বস্তি-হীন, হাইরাজ-সুন্দর, স্কাইস্ক্র্যাপার-সেক্সি। ইঁদুরদের ভাগিয়ে দাও, গরিবদের ফুটিয়ে দাও – সিস্টেম্যাটিক ক্লিনজিং! সবকটা ভোট-মারানি পার্টি এই গণ-উদবাস্তুকরণের, বা আরো সহজ করে বললে গণ-গায়েবের খুলে-আম দালাল! ভোটের ছোট্ঠাকুর বা বট্ঠাকুর, এই শয়তানির শরিক প্রত্যেকে। সিটি-প্ল্যানিং-এর হাড়েমজ্জায়, শহর-স্থাপত্যের ডি এন এ-তে এই আমরা-ওরা – ফর্সা-কালো, খুশবু-বদ্বু, খানদানি-চাকরানি, আমির-গরিব, মিঠে পান-পানপরাগ, শপিং মল-হকার দল, ডোভার লেন-টুম্পা সোনা! সেদিন আর দূরে নেই যখন দেশের সব শহরেই – সে শহর শিল্পোন্নতই হোক বা শিল্প-কাঙাল – ইঁদুরের দল ওয়ার্ক পারমিট হাতে সকালে শহরের গেটেড্ কমিউনিটিগুলোতে ঢুকবে, সারাদিন উঁচু খোপের কবুতর-মুরগি-পাঁঠাদের খিদমত খাটবে, আর সন্ধে নামার আগেই শহর ছাড়বে। তাদের শহর ছাড়া সুনিশ্চিত করবে এক বিশেষ বাহিনী, যাদের আবার রিক্রুট করা হবে এই ইঁদুরদের মধ্যে থেকেই, চুক্তিভিত্তিক।
ছড়া-খেউরে রাঙা ইঁদুরকল নাটকে আছে দুটো গান – ‘লুঙ্গি-ডান্সের’ সুরে ‘আমরা বোকার দল’, আর সন্ধ্যা রায়-অনুপকুমারের ‘পলাতক’ ছবির ‘আহা রে বিধি গো তোর লীলা বোঝা দায়’-র সুরে আরেকটা গান। প্রথমটা স্ট্রেটকাট প্যারডি, পরেরটায় মূল গানের মুখ্রা-মেজাজ বজায় রেখে আরেকটা গান বানানো হয়েছে। সিনেমায় মুকুল দত্তর কথায়-হেমন্তর সুরে-পঙ্কজ মিত্রর গলায় গানটা গাইছে ডোম-বাগদিরা, আর তাদের সঙ্গে ভিড়েছে আংটি চাটুজ্যের ভাই অনুপকুমার। ডি-ক্লাস্ড, কাস্টলেস্ হওয়ার সচেতন বাসনা তার আছে কি না জানা নেই, তবে কালো-বদ্বু-দের আস্মানেই সে উড়ে বেড়াতে চায়! পল্লি-নাটক ইঁদুরকল দর্শককে ইয়াদ করায় সেই তাল, সেই ঢোল, সেই খতরনাক এনার্জি! সার্থক দৃশ্যকাব্যের কাজই তো এই – সে তোমাকে পৌঁছে দেবে গান থেকে গানে, নাটক থেকে সিনেমায়, ডাফলি থেকে ঢোলে, ঘর থেকে বাইরে, স্বার্থ থেকে পরার্থে, সুরান্তরে, ভাষান্তরে, তেপান্তরে … ডোম-বাগদির তেপান্তরে।
ইঁদুরকল নিয়ে ডোম-বাগদির পাড়ায় তো যাচ্ছে পৌঁছে এই ছুট-পলাতকের দল…গান-নাটকের দল জনগণমন। লকডাউন-কাল থেকেই, অফ্লাইনে! জিজ্ঞেস করলেন না, ‘অফ্লাইন’ নাটক আবার কি? করোনা-যুগে এক নতুন বকচ্ছপের আমদানি হয়েছে, অনলাইন থিয়েটার! তাই বলে না দিলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না! ছুট-পলাতক জনগণমন মাস্ক পরে না পরে, করুনা-জল মেখে না মেখে মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে নাটক নিয়ে। মানুষের কাছে তখন রেশনের চাল-ডাল-আলু-সোয়াবিন আর ইঁদুরকল! অফ্লাইন, জ্যান্ত বিনোদন…টাটকা তাজা, খেতে মজা! শুধু পেট না, মন-ও ভরে। জনগণমন – “ইঁদুরকল লেখা হয়েছিল কসবায় বস্তির কচিকাঁচাদের নিয়ে কাজ করানোর জন্য। লকডাউন পরিস্থিতিতে ছোটদের নিয়ে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় কাজটা এই টিম করে এবং স্ক্রিপ্টটা সামান্য অদলবদল করে লকডাউনের মধ্যেই কাজটা শুরু হয়। লকডাউনে জনগণমন একদিনের জন্যেও থমকে থাকেনি। আমরা তো নতুন দল, তাই আমাদের এনার্জি একটু বেশি, সাথে পলিটিকাল কমিটমেন্ট মিশে আছে। তাই আমরা আলো নিবিয়ে ঘরে বসে না থেকে আমাদের কথাগুলো বলার জন্য ছটফট করছিলাম। আমাদের বলতে চাওয়া কথাগুলোকে ধার করল ইঁদুরকল। সো-কল্ড থিয়েটারের বোদ্ধা দর্শক নয়, আমাদের দর্শকের কাছে থিয়েটার একটা অভিজ্ঞতা, নতুন কিছু কথা শোনা এবং বলার জায়গা।”
নাটকের কুশীলব একদল মফস্বলের নাট্যকর্মী …কাঁকিনাড়া-নৈহাটি-শ্যামনগর-ইছাপুর অঞ্চলের বছর ২৫-৩৫-র ছেলেমেয়ে। একই এলাকার বলে একসাথে রিহার্সাল সম্ভব হয়েছে, আসলে সম্ভব করেছেন ওরা। সব বাধা পেরিয়ে বাংলার গ্রাম-মফস্বলে হাজির হয়েছেন ওরা। কলকাত্তাইয়া না, হাজির হয়েছে জেলার নাটক! কেন্দ্রীয় না, বাধা পেরিয়েছে লোকাল থিয়েটার!
চাষির ঘর ছেড়ে চলে যাবার সময় বাঁশির সুর ভেসে আসছে…ইঁদুর কাঁদছে। ইনশাল্লাহ দর্শকও কাঁদছে! সে কান্না ইঁদুরের কান্না, সে কান্না পথনাট্যকর্মীর কান্না, সে কান্না মফস্বল পথনাট্যকর্মীর কান্না, সে কান্না মফস্বল মহিলা পথনাট্যকর্মীর কান্না। যাদবপুর এইটবি মোড়ের ভরবিকেলের কাঁই-কিচিড়ের মাঝেই দর্শকের নাকের ডগায় কেঁদে, কাঁদিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিলকুল…গ্লিসারিন লাগছে না।
হ্যাঁ, ইঁদুরকল অ্যাজিট-প্রপ! তবে স্লোগান-সর্বস্ব অ্যাজিট-প্রপ না। কালো কস্টিউম-লাল দোপাট্টার ধ্যাদ্দেরে অ্যাজিট-প্রপ না। রঙিন অ্যাজিট-প্রপ! সস্তার সব প্রপ – হাতে-বানানো পাখি-পশুর হেডগিয়ার, আস্ত ভাজা মাছ, তালপাতার হাতপাখা। কিন্তু রং তৈরিতে আর কিচ্ছু লাগছে না, ইলিউশান তৈরিতে একটুও খামতি হচ্ছে না। ফিমেল অ্যাক্টর থাকতেও ঢ্যাঙা, দেড়েল মেল অ্যাক্টরই সাজল চাষি-বৌ … দিব্যি! বাংলার ‘অশিক্ষিত’ দর্শক নিচ্ছে এই ডিজাইন, খিল্লি ওড়াচ্ছে না কিন্তু, একদম না। দেখতে সহজ, করতে না। প্রসেনিয়াম মঞ্চেও আকছার দেখা যেত এসব ডিজাইন। যবে থেকে গ্রান্ট ঢুকেছে, চলে গেছে এসব আটপৌরে ডিজাইন, পিপল্স ডিজাইন। নাটক ছেড়ে চলে গেছে। ইঁদুরের মতো, সাধারণের মতো।
“শহরের বোদ্ধা দর্শক অনেক বেশি জাজমেন্টাল! অথচ গ্রামে নাটকটা অনেক বেশি সমাদৃত – গ্রামের মানুষ সরাসরি ভালো বা খারাপ বোঝে। তাই গ্রামেগঞ্জে পথচলতি মানুষ বায়না দিয়েছেন…কবে যাবেন আমাদের গ্রামে …আসুন, আমরা খুব ভালো খাওয়াব! সে বুঝেছে, নাটক দূরের জিনিস না, তাদের কাছের জিনিস। মানুষের ভালো লাগা-কে গুরুত্ব দিয়ে, প্রয়োজনে স্থুল হাস্যরস তৈরি করে সরল চলনে পপুলার ফর্মে নাটক মানুষের হয়ে উঠছে। আশ্রয়হীন, পথবাসি, ভুমিহারা কৃষক, গরিবের কথা বলে এই নাটকটা। আসলে গরিবের ঘরের জিনিষ খুব যত্ন পায়। মানুষ যত্ন করে ডাকে, যত্ন করে দেখে…”
“ইঁদুরকল-কে আমরা প্রযোজনা হিসেবে দেখিনি! সাধারণভাবে থিয়েটার দলগুলো যেভাবে টাকা হেঁকে বসে, মানুষ পেরে ওঠে না। অথচ মানুষ নাটককে নিজেদের গ্রামে নিয়ে আসতে চায়, মহল্লায় নিয়ে আসতে চায়, নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে চায়। তারা দেখছে প্রায় বিনা আয়োজনে এই নাটকটা করানো যাচ্ছে। শুধু আন্তরিকতায়, ভালবাসায়। মানুষ নিজেদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় …ইঁদুরকল মানুষের ভাষা হয়ে উঠল।”
কোথাও পাঁঠাকে মারার পর চাষি ‘মেরে দিলাম’ বললে সাথে সাথে এক দর্শকের ফিক্ – ‘বলি হয়ে গেল!’ আবার কোথাও নাটকের পর কচিকাঁচারা মুরগিকে ‘কঁকর কঁ’ বা কবুতরকে ‘বকম বকম’ করে ভেংচি কাটে। বিশুদ্ধতার ধার না ধেরে ডায়লগ-থ্রোয়িঙে রোজকার চেনা কথা-বলার, আড্ডা মারার, ঝগড়ার সুর লাগিয়েছেন অভিনেতারা! আর সেই সুরের সরগমেই নাটকে আটকাচ্ছেন পথচলতি মানুষ, গুড়ে-পড়া মাছির মতোই … নাটকের মধ্যের সওয়াল-জবাবে অংশ নিচ্ছেন …শো-চলাকালীন ডায়লগ রিপিট করছেন, মন্তব্য করছেন … নাটক সাধারণের হয়ে উঠছে!
“লকডাউন পরিস্থিতিতে আমাদের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে হচ্ছিল, কারণ গাড়ি তেমন চলছিল না …যতটা সস্তায় সম্ভব। ট্রেন চালু হয়ে যাওয়ার পর যাতায়াত ভাড়া নিই, বাকিটা গামছা পেতে। জনতার থিয়েটার জনতা যদি বাঁচিয়ে রাখে, তবেই বাঁচবে।”
“অলরেডি ৬০-এর ওপর শো হয়ে গেছে …সব কটাই কল্ শো, একটাও নিজেদেরকে অর্গানাইজ করতে হয়নি। ১৫ই অগস্ট হালিশহরে প্রথম শো। তারপর বিভিন্ন গণসংগঠন, বিজ্ঞান সংগঠন, অধিকার সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনের ডাক। ভোটবাজ পার্টির ব্যানারে করিনি, প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনি। এ-নাটক রাজনৈতিক মঞ্চের শেষ পাতে চাটনি হয়নি, নাটকটা গুরুত্ব পেয়েছে, সে নিজের গুরুত্ব অর্জন করে নিতে পেরেছে।”
“জনগণমন-তে বড় দলের মত অসম বন্টন নেই। বড় দলে কিছু বক্স আর্টিস্ট মোটা টাকা পান, আর টাকা পান নির্দেশক-দলপতির কিছু কাছের অভিনেতা, বাকিরা স্রেফ বেগার খাটেন। এই বাকিরা সাম্মানিক তো দূর, ট্রেনির সম্মানটুকুও পান না। এই ব্যাপারগুলো দলগুলি খেয়াল করে না, বা ইচ্ছে করে ভুলে থাকে। আমাদের নাটকের পর ঝোলায় যে টাকা ওঠে, সেটার তিন ভাগের দুভাগ অভিনেতাদের মধ্যে ভাগ হয়, আর বাকি এক ভাগ যায় দলের তহবিলে। দলের তহবিল খরচ হয় যাতায়াত, খাওয়াদাওয়া, বাদ্যযন্ত্র কেনা … এইসবে। মাসে ১০-১২টা শো, তা থেকে একেকজনের ২০০০ টাকা মত হয়। আমরা যে কথাগুলো বলতে চাইছি, সেটা কমফর্ট জোনের মধ্যে থেকে বলা যাবে না। যারা কমফর্ট জোনের বাইরে বেরোচ্ছেন, তাদের খোরাকের দায়িত্ব সংগঠনকেই নিতে হবে। আমরা উদ্যোগী, কিন্তু সমাধান করা যায়নি … গোটাটা একটা প্রসেসের মধ্যে আছে।”
কিন্তু জনগণমন-র সাথে একটা ঝগড়া আছে। সদ্যপ্রয়াত রাজা বিশ্বাসের বড় হাত আছে এই নাটক নির্মাণে…ঝগড়াটা রাজার সাথে করা গেলেই সবচেয়ে ভালো হত …তবে সেটা যখন যাচ্ছে না, তখন পয়েন্ট-টা অন্তত রাখা যাক। নাটকে একটা উত্তরকথন রয়েছে, যেখানে রূপক ভেঙে আকাঁড়া প্রোপাগান্ডার লাইন নেয় নাটক। যেন দর্শক-কে কান ধরে নাটকের মেসেজ বোঝানোর দায় নেন অভিনেতারা। কেন? জনের মন কি এতই ঠুনকো? গনের মাথা কি এতই নিরেট? জনগণের মন পেতে কি অধিনায়ক হয়ে উঠতেই হয়? এনলাইটনার হয়ে উঠতেই হয়? অথচ জনগণমন-র নিজের কথায়, ‘বিনোদন এবং মনোরঞ্জন-কে সাথী করে রাজনৈতিক কথাগুলো বলতে চাই। বিনোদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের ভালো লাগার বিষয়, তারা আকৃষ্ট বোধ করেন। তারপর আসছে বোধ। আমরা খুব মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য করছি না, আমরা আসলে নিজেদের রাজনৈতিক কথাগুলো বলার জন্য নাটকটা করি। আমাদের এই কথাগুলো মানুষের কথার সঙ্গে মিলে যায়’।
আশা রাখি, জনগণমন বামপার্টি-শাসিত হবে না, সে হবে রাজনীতি-তাড়িত। নাটক, গান হয়ে উঠবে তাদের স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মসূচী। কোথায় কালচারাল ফ্রন্টের শেষ, আর কোথায় পলিটিক্যাল ফ্রন্টের শুরু – এ সিদ্ধান্ত নেবে কে? একবগগা পার্টিলাইনের প্রচার-যন্ত্র হতে গিয়ে হামেশাই কালচারাল ফ্রন্টের স্বকীয়তার বলিদান হয়েছে। পরিণাম, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া – মানুষের চিন্তা-চলনের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন রাজনীতি নির্মাণের ডাক নিয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়ার বদলে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, সবশেষে কালচারাল ফ্রন্টের অকালমৃত্যু! রাজনৈতিক কার্যকলাপ তো দূর, ক্ষমতার রোষ এড়িয়ে কর্মীদের তখন টিকে থাকাটাই বড় ব্যাপার…রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে ‘টম অ্যান্ড জেরি’ খেলতে খেলতেই দম ফুরোনোর জোগাড়। সময়ের গান বাঁধা, সমকালের নাটক তৈরি তখন মায়ের ভোগে! নিজেদের রাজনৈতিক লাইন নিজেরাই বানাক, নিজেরাই নামাক – এ চ্যালেঞ্জ রইল তাদের কাছে!
চ্যালেঞ্জ রইল, কারণ অলরেডি তারা নানান চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন। বাম-কুসংস্কারের তোয়াক্কা না করে তারা শো করেছেন কাঁকিনাড়া, মেমারির কালীপুজো মন্ডপে:
“আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কথাবার্তার মাধ্যমে আমরা এটা ঠিক করতে পেরেছি যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় কুসংস্কার-মৌলবাদ সমার্থক নয়। আমরা আমাদের কথাগুলো বলতে পারব, ওই জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কাছে। আমরা কোনো ধর্মীয় আচার পালন করতে সেখানে যাচ্ছি না। এমন তো হয়েছে যে, মন্দিরের চাতালে, নাটমন্দিরের ভিতরে কীর্তন হচ্ছে, আর বাইরে আমরা অভিনয় করছি … তখন তো ধর্মীয় ভেদাভেদ থাকে না! থিয়েটার তার নিজস্ব ধর্মে অবিচল থাকে – মানুষের কথা মানুষের মধ্যে গিয়ে সোচ্চারে বলতে পারা। যদি পৌঁছতে না পারি তাহলে যা হওয়ার তাই হবে। আগে তারকেশ্বরে জল ঢালতে যেত যারা, তারা ‘ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম’ বলতে বলতে যেত … এখন ‘জয় শ্রী রাম’-‘ভারতমাতা কি জয়’ বলতে বলতে যায়! এরা কিন্তু মৌলবাদী রাজনীতির হোতা নয়, শিকার। এই মানুষগুলো আমাদের মানুষ। এদের আমরা শোনাতে চাই, মোটিভেট করতে চাই। তাই জন্য কোনো ছুঁতমার্গ রাখার প্রয়োজন বোধ করি না।”
মার্চ মাসে হয়ত পরের নাটক নামবে, যার কনটেন্টে থাকবে রাষ্ট্রীয় সংস্থার বেসরকারিকরণ, জল-জঙ্গল-জমিনের লড়াই। “সেভাবে থিয়েটারের দর্শক নন এমন মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। এই যে দর্শক যারা আমাদের থিয়েটারকে ডাকছেন, আমাদের লালন করছেন, তারা যাতে শুধুমাত্র আমাদের দর্শক হয়ে না থাকেন, আমাদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন, আমরা যা কিছু করতে চাইছি তার সঙ্গী হন।”
“বেশ কিছু কেওটিক জায়গায় নাটকটা হয়েছে। প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও গাড়ির আওয়াজের সঙ্গে অভিনেতারা আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছেন।” গাড়িবহুল রাস্তায় খালি গলায় নাটক করার যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক থাকবেই। তবে রাস্তায় করতে এনার্জি লাগে যেমন, রাস্তা উল্টে এনার্জি দেয়ও তেমন … কলজের দম বাড়ায়, বাড়ায় বুকের খাঁচাটা। জনগণমন-র খাঁচাটা বাড়ছে … সেই বেড়েওঠা খাঁচার বাড়তি দম নিয়ে তারা তুলে যাক সং-নাচের তাল, ছাড়ুক খেউরের সুর আর সে-রসে মজতে থাকুক দ্বীন-দুনিয়ার যত্ত ছোটলোক!
“ইঁদুর-কলে কি শুধুই ইঁদুর ধরা পড়ে? ইঁদুরের বিপদে পড়শিরা কেউ সাহায্য করল না। তারা ভাবল, এটা তো ইঁদুরের বিপদ, তাদের আর কি? তারা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমোতে গেল।”
এ উপকথা, এ জনকথা শুধু বাংলাদেশের না! এ পল্লি-কথা ছড়িয়ে আছে আরো আরো দেশে, আরো আরো জাতিগোষ্ঠীর উচ্চারণে। ছুট-পলাতক জনগণমন-র এ নাটক ষোলআনা মাটির নাটক, দেশকালের নাটক।
কিন্তু গরম গরম মুরগির ঝোলভাত-মাখা এ নাটক বাঁচবে কি?
ছোটলোক, মোছলমান ইঁদুর চাষির ঘর ছেড়ে বেঘোরে চলে যাওয়া আটকানো যাবে কি?
পরিকল্পিত গণ-গায়েব ঠেকানো যাবে কি?
আসছে দিনে এর জবাব বাংলা, তথা দেশের গরীব-মধ্যবিত্ত দেবেন।
সার্বজনীন মানব প্রগতি তো দুর কি বাত্, বদলে দেখা দিয়েছে এক সর্বব্যাপী সামাজিক উৎকণ্ঠা, যা ছোবল মারছে সরকারি-অসংগঠিত সব্বাইকে – তত্ত্ব-কপচানো শিক্ষিত পাঁঠা থেকে সুইগি-উবেরে লালিত ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ কবুতরকেও। কর্পোরেটের ছানা, সরকারি বেলের পানা বা মনিবের দানা খেয়ে নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া যাচ্ছে কি? সে গুছনোতে, সে বাঁচায় ফয়েল-শোভিত হাপ্ঠান্ডা ওরিয়েন্টাল খানা ঠিক ডেলিভারি হচ্ছে, কিন্তু বস্তির ঝোল-ভাতের গন্ধ মিলছে না, মাথা খুঁড়লেও না। ইঁদুরকলে আলটিমেটলি কে ধরা পড়বে আর কে পড়বে না, সে খবর ইনশাল্লাহ খোদাও জানেন না!
মানুষকে ওরা বোকা বানাচ্ছে
একা থাকার কায়দা শেখাচ্ছে
জাতি–ধর্মে দাঙ্গা লাগাচ্ছে
প্রতিবাদীদের জেলে ঢোকাচ্ছে
আমরা বোকার দল
বুঝব এবার ফল
ইঁদুর-কল ইঁদুর-কল ইঁদুর-কল ইঁদুর-কল
ফন্দি-ফিকির তো মানা যাবে না
একা একা তো বাঁচা যাবে না
কেউ লুটে খাবে আর কেউ খাবে না
হবে না না না তা তো হবে না
মানুষ বাঁধবে দল
এইবার
গদি টলমল
এইবার
ইঁদুর-কল ইঁদুর-কল ইঁদুর-কল ইঁদুর-কল
ভাঙ্গবি চল ভাঙ্গবি চল ভাঙ্গবি চল ভাঙ্গবি চল
অঙ্কুর নাট্যকর্মী ও ‘ডাকঘর পড়ছি’ বইয়ের লেখক।
পড়ে দেখুন: ল্য মিজারেবল – ড্রাগনের দেশে যাত্রা
এই প্রচেষ্টা আরো সাফল্যমণ্ডিত হোক।জনগণকে নিশ্চই পাশে পাবেন, এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।সুস্থ থাকুক শরীর এবং মন,আরো ভালোবাসাই হবে আপনাদের কাজের অনুপ্রেরণা। আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার ঠিকানা দেবেন। আপনাদের কোন ফোন নম্বর বা,ফেসবুক আই ডি,হোয়াটস এপ নম্বর থাকলে জানাবেন।শুভেচ্ছা রইল।