পার্শ্বশিক্ষকদের আন্দোলন সরকারের উপেক্ষা ও পুলিসি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবার অনশনের পথে


  • February 11, 2021
  • (0 Comments)
  • 930 Views

গত ৫৩ দিন ধরে কলকাতার বুকে এ রাজ্যের পার্শ্ব শিক্ষকদের লাগাতার অবস্থান চলছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তাদের নবান্ন অভিযান আটকে দেয় পুলিস ও তারপর চলে লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তারী। বহু চিঠি, অনুরোধের পরেও মুখ্যমন্ত্রী দেখা করেননি। কোনও সরকারি ঘোষণাও শোনা যায়নি। আন্দোলনকারীদের দাবি একটাই ন্যূনতম বেতন কাঠামো চালু করা। এখন শুরু হয়েছে লাগাতার অনশন অবস্থান। যদিও মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে এই অবস্থান, অনশন ও শিক্ষকদের দাবি রাজ্য সরকারের উপেক্ষা করা ও পুলিসি সন্ত্রাসের খবর উঠে আসেনি। প্যারাটিচার ঐক্য মঞ্চের যুগ্ম আহ্বায়ক ভাগীরথ ঘোষ, নদীয়ার বাসিন্দা, বয়স ৩৬, গত ২০০৭ সাল থেকে পার্শ্ব শিক্ষক হিসাবে পেশাদার জীবন শুরু করেছেন কলকাতায় পার্শ্ব শিক্ষকদের অবস্থান ও অনশন মঞ্চ থেকে গ্রাউন্ডজিরো-র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানালেন পার্শ্ব শিক্ষকদের ক্ষেত্রে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিশ্বাসভঙ্গের জায়গাটি কীভাবে তৈরি হল ও এখন সরকারের প্রতি তাদের মনোভাব কী ও আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় কী হতে চলেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী। 

 

প্র: আপনাদের অবস্থান কর্মসূচী ৫২ দিন পেরোলো। আপনাদের নবান্ন অভিযান আটকে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী দেখা করেননি। পুলিশি আক্রমণ ঘটেছে। এর পরে আপনাদের কর্মসূচী কী?

উঃ আমরা গত ৬ জানুয়ারি থেকে অনশন কর্মসূচী শুরু করে দিয়েছি। এই লাগাতার অনশনই এখন চলবে। এরপরে আলাদা করে আরও কোনও কর্মসূচী নেব কি না তা সময় বলবে। এই মুহূর্তে আপাতত আমরা চার জন অনশনে বসেছি, যাঁর মধ্যে একজন মহিলা।

 

প্র: ৫০ দিন পেরিয়ে গেছে আপনাদের অবস্থানের, কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এই যে কোনওরকম পদক্ষেপ না নেওয়া, কোনও রকম ঘোষণা শুনতে না পাওয়া, মুখ্যমন্ত্রীর দেখা না করা – কেন এরকমটা হচ্ছে বলে মনে করছেন?

উঃ রাজ্য সরকারের আমাদের প্রতি রয়েছে একটা অনমনীয় মনোভাব। তাছা আর কী! তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় ঘোষণা করেছিলেন যে পার্শ্বশিক্ষকদের তিনি স্থায়ী করবেন এবং সেটা তাঁর প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি এখনও পর্যন্ত সেটা পূরণ করেননি।

 

প্র: প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার নানা কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, কর্মসূচী ঘোষণা করছেন। কিন্তু তবুও পার্শ্বশিক্ষকদের বিষয়টিকে তাঁরা উপেক্ষা করছেন কেন?

উঃ কেন সেটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বলতে পারবেন।

 

প্র: আপনাদের কাছে কী অন্য কোনও রাজনৈতিক দল কোনও বার্তা নিয়ে পৌঁছেছেন?

উঃ এটি একটি অরাজনৈতিক মঞ্চ ছিল ৫০ দিন পর্যন্ত। তারপর আমরা যখন ওখানে মার খাই, অ্যারেস্ট হই, তারপর থেকে আমরা সমস্ত রাজনৈতিক দলের জন্য মঞ্চ খুলে রেখেছি।

 

প্র: আচ্ছা। কারা কারা এখনও পর্যন্ত পৌঁছেছেন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে?

উঃ এখনও পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব এসে পৌঁছননি। অর্জুন সিংয়ের আসার কথা রয়েছে। জানি না আসবেন কি না।

 

প্র: এখন আপনাদের অবস্থান ও অনশন মঞ্চে কতজন পার্শ্বশিক্ষক উপস্থিত রয়েছেন?

উঃ এখানে আমাদের ৭০০ জনের জমায়েতের অনুমতি রয়েছে। মোটামুটি দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ জন শিক্ষক উপস্থিত থাকছেন। তাছাড়া বাইরে আমাদের যে প্রোগ্রামগুলি হচ্ছে সেখানে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ মানুষ উপস্থিত থাকছেন।

 

প্র: প্রচুর সংখ্যক মহিলা রয়েছেন আপনাদের সঙ্গে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে শৌচালয় ইত্যাদিতে বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। কীভাবে সামলাচ্ছেন? তাছাড়া এখন কোভিড পরিস্থিতিতে স্যানিটাইজেশন-ও একটা বড় বিষয়। কীভাবে সামলাচ্ছেন আপনারা?

উঃ মহিলাদের জন্য আমরা ৩০/৩৫ দিন হল একটি বায়ো-টয়লেটের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। পুরুষদের জন্য কিছু করে উঠতে পারিনি। পানীয় জলও একটা বড় সমস্যা। এখানে একটা টাইম কলের মানে সরকারি জলের ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে সারাদিনই জল আসে, আমরা সেই জল-ই ব্যবহার করি। স্যানিটাইজেশন-এর ব্যবস্থা সরকার থেকে কিছুই করেনি। আমরা নিজেরাই করছি। এক জায়গা থেকে একটা স্প্রে জোগাড় করেছি। সেটি দিয়েই স্যানিটাইজার স্প্রে করছি নিয়মিত।

 

প্র: শুরু করছিলেন যে দাবি-দাওয়া নিয়ে তাতে কি গত ৫০/৫২ দিনে কোনও পরিবর্তন হয়েছে? নতুন কোনও দাবি কি যোগ হয়েছে?

উঃ না, তেমন কিছু হয়নি।

 

প্র: পরবর্তী সময়ে ধরুন রাজ্যপালের কাছে যাওয়া বা অন্য কাওকে চিঠি লেখা – এগুলো কি আপনাদের অ্যাজেন্ডার মধ্যে আছে?

উঃ চিঠি বলতে আমরা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে দু’দিন গিয়ে দু’টো চিঠি দিয়ে এসেছি। এছাড়া মেইল-এ কিছু চিঠি পাঠিয়েছি। আমরা রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছি, নবান্নের উদ্দেশ্যে। নবান্ন প্রথমবার সেটা রিজেক্ট করেছে, দ্বিতীয় বার তা গ্রহণ করেছে।

 

প্র: এই রক্ত দিয়ে চিঠি লেখার বিষয়টি কেন?

উঃ এখনও পর্যন্ত আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনেক চিঠি পাঠিয়েছি, তাঁর বাড়িতে গিয়েও দিয়ে এসেছি, কোনও চিঠির কোনও রিপ্লাই আসেনি, কোনও অ্যাকশন-ও নেওয়া হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছি।

 

প্র: আপনাদের মূল দাবিটি যদি আরও একবার স্পষ্ট করে দেন…

উঃ আমাদের একটিই মূল দাবি – ভাতা প্রথার অবসান ঘটিয়ে বেতন কাঠামো চালু।

 

প্র: আর এই যে স্থায়ী করার বক্তব্যটা প্রথম থেকেই ছিল সেটা?

উঃ স্থায়ী বলতে আমরা অ্যাকচুয়াল স্থায়ীই রয়েছি। কারণ সিক্সথ ইয়ার এনগেজমেন্ট লেটার আমাদের হাতে রয়েছে। ষাট বছর বয়স পর্যন্ত আমরা চাকরি করতে পারব। যেটা আমাদের নেই সেটা হচ্ছে পে স্কেল। সেই পে স্কেলটার জন্য আমরা লড়াইটা চালাচ্ছি। আমরা ফুল পে স্কেল চাইছি না। ন্যূনতম একটা বেতন কাঠামো সরকার আমাদের দিক।

 

প্র: সেই ন্যূনতম বেতন কাঠামোটা আপনারা কী কিছু ঠিক করেছেন?

উঃ হ্যাঁ, একটা কাঠামো আমরা নির্দ্ধারণ করেছি। কিন্তু এখনই সেটা আমরা বলতে চাইছি না। যদি কিছু সংশোধন ইত্যাদি করতে হয় সেজন্য। পরে নিশ্চয়ই আমরা সবাইকে সেটা জানাতে পারব।

 

প্র: সারা রাজ্যের সমস্ত পার্শ্ব শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব আপনারা কর‍ছেন এই মুহূর্তে। কতজন শিক্ষক রয়েছেন আপনাদের সঙ্গে?

উঃ রাজ্যের সমস্ত পার্শ্ব শিক্ষকেরাই এখন প্যারা টিচার ঐক্যমঞ্চের সঙ্গে রয়েছে। রাজ্য জুড়ে ৪৮,০০০ পার্শ্ব শিক্ষক রয়েছেন। তার মধ্যে বলা যেতে পারে ৪৫,০০০-ই আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।

 

প্র: মূলত কোন বয়সের শিক্ষক-শিক্ষিকারা আপনাদের অবস্থানে যোগ দেওয়ার জন্য আসছেন বলে দেখতে পারছেন? যদি কোনও নির্দিষ্ট বয়স হয়, তার কোনও নির্দিষ্ট কারণ আছে কি?

উঃ সব বয়সের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই আসছেন। তবে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যোগদানই বেশি। এর কারণ হল, আমাদের সবারই অন্যান্য সরাকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার টাইম শেষ হতে চলেছে। তার মধ্যে অনেকেই রিটায়ারমেন্ট-এর (অবসরের) মুখোমুখিও পৌঁছে গেছেন। ফলে অন্য চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে সীমিত। অতএব এখান থেকেই আমাদের লড়াই করে জিততে হবে। এবং এই সরকার যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল এবং এই সরকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাদের দাবি পূরণ করবেন, অতএব সেই সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া-চাহিদা অনেকটাই বেশি।

 

প্র: আসন্ন নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে আপনাদের মধ্যে কী ধরনের ভাবনা রয়েছে। এ রাজ্যে ৩৪ বছর বাম জমানা দেখেছেন, দীর্ঘ কয়েক বছর তৃণমূলের শাসন দেখছেন। এই নির্বাচনে কী ধরনের ফলাফল ও তারপর আপনাদের অবস্থা নিয়ে কী ভাবনা আপনাদের?

উঃ গত পাঁচ তারিখে আমাদের অন্য কোনও দাবি ছিল না। একটাই দাবি ছিল দু’মিনিটের জন্য মাননীয়া আমাদের সঙ্গে দেখা করুন। তার বিনিময়ে যেটা পেলাম, তারপর থেকে আমাদের মানসিক পরিস্থিতিটা এমনই হয়েছে আপাতত অর্থ নয়, বাঁচাটা প্রয়োজন। আর এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে আমাদের বাঁচতে দেবে না। অতএব আগে এর পরিবর্তন হওয়াটা জরুরি।

 

প্র: সেই পরিবর্তনের অভিমুখটা কোন দিকে?

উঃ যেখানে যেখানে বিরোধী দল হিসাবে যে শক্তিশালী বেশি। যে বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএম শক্তিশালী মানে সিপিএম টক্কর দিতে পারে তৃণমূলের সাথে সেখানে আমরা অবশ্যই সিপিএম-কে সাপোর্ট করব, যেখানে কংগ্রেস সেখানে কংগ্রেস, যেখানে বিজেপি সেখানে বিজেপি।

 

প্র: সেক্ষেত্রে বিজেপিকে সমর্থন করতেও আপনাদের কোনও অসুবিধা নেই!

উঃ না, কোনও অসুবিধা নেই। আমরা তাদের বিরোধী দল হিসাবেই দেখছি। আর আমাদের ভূমিকাটাও আস্তে আস্তে আমাদের সেরকম জায়গাতেই যেতে হবে এবং এদের সঙ্গে আমরা এখন ভোটের টক্করই দেব।

 

প্র: এতদিন পর্যন্ত আপনারা এই মঞ্চটিকে অরাজনৈতিক রেখেছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ তারিখের পর থেকে আপনারা রাজনৈতিক দলের জন্য এই মঞ্চ খুলে দিয়েছেন। আপনাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে মনে করছেন কি এটা বাধা হতে পারে আরও বেশি করে?

উঃ এই সরকারের হাতে সময় আছে পাঁচ থেকে সাত দিন। পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে তারা যদি কিছু করে এই সরকারকে দু’হাত ভরে আর্শিবাদ করতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। যদি না করে তাহলে লড়াই যেমন চলছে চলবে, ভোটের ময়দানে লড়াইটা হবে এবার। মানে ভোটদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ যেখানে যে শক্তিশালী বিরোধী আছে আমরা তাদের হয়ে হাতে-কলমে খাটব। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কাছেও আমাদের একটা প্রস্তাব থাকবে যেন তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে পার্শ্বশিক্ষক সমস্য সমাধানের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। সেটা আমরা তাদের কাছে চাইব।

 

প্র: কিন্তু ধরুন আপনি এই যে বললেন প্রায় ৪৫,০০০ পার্শ্ব শিক্ষক আপনাদের সঙ্গে রয়েছেন বা যারা আপনাদের অবস্থান মঞ্চে আসছেন তাদের মধ্যেও অনেকেই নিশ্চয়ই তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক রয়েছেন। তাদের কী মনোভাব বুঝতে পারছেন?

উঃ তাদের মনোভাবও একই যে, আগে একে তাড়াও। আমি আগেই বললাম যে আমাদের এখন অর্থনৈতিক উন্নতির থেকেও বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হল। ইতিমধ্যেই আমরা ১৯৪ জন পার্শ্বশিক্ষককে অকালে হারিয়েছি। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন, অর্থাভাবে মারা গেছেন, অনেকে সুইসাইড করতে বাধ্য হয়েছেন অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে।

 

প্র: এই যে যারা মারা গেছেন, সুইসাইড করেছেন তাদের কি কোনও নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে রাখা সম্ভব?

উঃ হুমম, তাদের বয়সটাও ঐ চল্লিশের আশেপাশেই। অর্থনৈতিক দিক থেকে হয়তো অনেক দেনা, অনেক ধার হয়ে গেছে, অসুস্থ চিকিৎসা করাতে পারছে না। আমরা তাও সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু কিছু জায়গায় হেল্প করেছি। চিকিৎসার জন্য বা যারা মারা গেছে তাদের পরিবারের জন্য, যারা মারা গেছে তাদের পরিবারকে তো একটা টাকাও দেয়নি সরকার। যে রাজ্যে মদ খেয়ে মানুষ মারা গেলে দু’লক্ষ টাকা দেওয়া হয় যেখানে একজন শিক্ষক মারা গেলে সরকারের সময় নেই তাকানোর।

 

প্র: পাঁচ তারিখ আপনাদের উপর যে আক্রমণ নেমে এসেছিল আপনারা কি ভেবেছিলেন যে এরকমটা আদৌ হতে পারে?

উঃ হ্যাঁ, ভেবেছিলাম।

 

প্র: ভেবেছিলেন! কেন?

উঃ কারণ এই সরকারের থেকে আমাদের আগেও একইরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৬ আগষ্ট ২০১৮ আমাদের বিকাশ ভবন অভিযানের কর্মসূচী ছিল। আমরা স্টেশনে নামার পরেই আমাদের ধরপাকড় শুরু হয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে জায়গা পরিবর্তন করে কর্মসূচী নিয়েছিলাম। সেদিন আমাদের প্রায় ৩৫ হাজারের রেকর্ড পরিমাণ জমায়েত ছিল। সন্ধ্যার আগে পুলিস আমাদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে। তখনই শুরু হয় অঝোরে বৃষ্টি আর সেই সুযোগে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। রাত্রিবেলা ভিজতে ভিজতে আমরা শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছালে, আমাদের পুলিশি অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়। সবাই বাড়ি পৌঁছে সেদিন রাতেই আমরা কর্মসূচী ঘোষণা করি কল্যাণী বাস টার্মিনালে আমরা অবস্থান শুরু করি ১৭ আগষ্ট বেলা ১২টা থেকে ও অনশন কর্মসূচীর ডাক দিই বেলা ৩টে থেকে। সন্ধ্যা ৬টা-সাড়ে ছটা থেকে শুরু হয় পুলিসের বেধড়ক লাঠিচার্জ, মার। ঐ জায়গাটা চারিদিক ঘেরা, দুটো মাত্র গেট। প্রচুর মহিলা ছিলেন। মহিলা পুলিস না রেখেই তাদের উপর বেধড়ক অত্যাচার চলে। আমাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। সেই জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে দেয় পুলিস। সেখানে আমাদের পাঁচ জন সাথীকে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ দিন জেলের মধ্যে বন্দী রাখে ও সেখানেও অকথ্য অত্যাচার করে। সেইসব অভিজ্ঞতা থেকেই এই পুলিসকে আমরা কোনওরকম বিশ্বাস করি না। এখানে সেদিন পারমিশান থাকা সত্ত্বেও আমাদের র‍্যালি করতে দেয়নি। পুলিসের কাছ থেকে সেটাও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। আমরা তাদের বলি, ‘আপনারা বলছেন যখন আমরা র‍্যালি করব না, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দেখা করিয়ে দিতে হবে দু’মিনিটের জন্য। পুলিস তিন বার সময় নিয়েও দেখা করাতে ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে আমরা ওখানে অবস্থানে বসে যাই। সেই সময়ে সামনের দিক থেকে পুলিস লাঠিচার্জ করে। আমরা পিছন দিক থেকে বেরোনোর চেষ্টা করি। পিছনেও একটা ব্যরিকেড ছিল। সেই ব্যরিকেড ভেঙে আমরা বেরোনোর চেষ্টা করি। তখনই পুলিস আমাদের গ্রেপ্তার করে।

 

প্র: সেদিন কি মহিলা পুলিস ছিলেন?

উঃ মহিলা পুলিস ছিলেন, কিন্তু মারেননি। মহিলা পুলিসদের হাতে কিন্তু লাঠি ছিল না। লাঠি যা ছিল সব পুরুষ পুলিসের হাতে। আর আমাদের যে কোনও কর্মসূচীতে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি থাকে।

 

প্র: গোটা একটা বছর কোভিড পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। গত ৫৩ দিন ধরে আপনারা অবস্থানে বসেছেন। ইতিমধ্যে তো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তো খারাপ হয়েছে নিশ্চয়ই…সেক্ষেত্রেও কোনওরকম সরকারি আশ্বাস বা কিছু আপনারা কেউই পাননি?

উঃ না, না। বরং মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে আমরা টাকা অনুদান হিসাবে দিয়েছি। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে একটা ফান্ড তৈরি করেছিলাম মৃত পার্শ্বশিক্ষকদের পরিবারগুলিকে সাহায্য করার জন্য। সেই তহবিলের টাকা থেকেই দিয়েছিলাম।

 

প্র: প্যারা টিচার ঐক্য মঞ্চে এই মুহূর্তে কতজন সদস্য রয়েছেন?

উঃ দেখুন, আমাদের নির্দিষ্টভাবে কোনও সদস্য নেই। সবাই-ই আমাদের সদস্য। রাজ্যে ৪৮,০০০ প্যারা টিচার। লিখিত বলুন, অলিখিত বলুন, তারা সবাই আমাদের সদস্য।

 

প্র: বাম জমানার সঙ্গে তৃণমূলের সরকারের কোনও তফাৎ আপনাদের ক্ষেত্রে বলতে পারবেন?

উঃ অনেকটাই তফাৎ রয়েছে। বাম জমানায় প্রতি বছরই কম বেশি একটা ইনক্রিমেন্ট তারা আমাদের জন্য করত। ৫০০, ১০০০, ২০০০ – যাই হোক, ইনক্রিমেন্ট একটা হত। যখন স্থায়ী শিক্ষকদের বেতন বাড়ত, পে কমিশন যখন আসত, সেসব সময়গুলোয় আমাদেরও বেতন বাড়ত। বাজেটেও অনেক সময় বেড়েছে।

 

প্র: তাহলে যতক্ষণ না সরকারের কাছ থেকে কোনও আশ্বাস পাচ্ছেন আপনাদের অবস্থান ও অনশন কর্মসূচী চলবে?

উঃ হ্যাঁ, একদম। আশ্বাস নয়। আশ্বাসে কাজ হবে না। এখন কার্যকরী করতে হবে। এতদিন ধরে এই সরকারের আশ্বাস শুনেছি।

 

প্র: তৃণমূল আমলে আপনাদের কি কোনওরকম ইনক্রিমেন্ট-ই হয়নি?

উঃ বাম আমলে আমাদের একটা ইনক্রিমেন্ট ছিল ৩ বছর অন্তর ৫%। সেটা এই সরকার একবার দিয়েছে আর ২০১৮ সালে একবার ৪০০০ টাকা ভাতা বৃদ্ধি করেছে।

 

প্র: লকডাউন ও করোনার জন্য স্কুল বন্ধ থাকলেও অনলাইন ক্লাস ও আরও নানা কাজ চলেছে। আপনাদেরও কি তা করতে হয়েছে?

উঃ লকডাউনে আমাদের মিড ডে মিল দেওয়া ও আরও নানা কাজ করতে হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করতে হয়েছে। অনলাইন ক্লাসও করাতে হয়েছে। সেটা একেক স্কুলে একেক রকম ছিল। হয়তো কোনও স্কুল একেবারেই করায়নি।

 

প্র: আপনারা যে বেতন কাঠামোর কথা বলছেন সেটার কোনও নির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে পারবেন?

উঃ আমাদের এখানে যে স্কেলটা ওরা দিতে পারে সেটা হল ৫২০০ থেকে ৯৫০০ একটা স্কেল রয়েছে সেটা দিতে পারে। এখানে সকলে আপাতত একই স্কেল-এ বেতন পায়। সুতরাং ন্যূনতম কাঠামোর এই দাবিটা আমরা তুলছি।

 

প্র: ত্রিপুরাতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে আপনারা কোনও রকম যোগাযোগ করেছেন?

উঃ ত্রিপুরাতে যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁরা কেউ কন্ট্র্যাক্টচুয়াল শিক্ষক নন। সবাই সহকারী শিক্ষক। না, আমাদের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগাযোগ হয়নি। ওখানে আদালতের রায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গেছে কারণ তাঁদের নিয়োগ পদ্ধতিতে সমস্যা ছিল। সুতরাং ওখানকার শিক্ষকদের নিয়ে আমাদের এখানে যোগাযোগের কোনও কারণ দেখছি না।

 

পড়ুন:

 

ত্রিপুরায় বিজেপি’র ভুয়া প্রতিশ্রুতি, ১০৩২৩ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়ে গণধর্ণায়

 

আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপরে নির্মম আঘাত ত্রিপুরা সরকারের

 

Share this
Leave a Comment