জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ ভারতে সবচেয়ে কম। কম করের হার, কর্পোরেট ট্যাক্সের নানান ধরণের ছাড়, বিশেষ বিশেষ শিল্পের জন্য দীর্ঘকালীন ট্যাক্স হলিডে — সরকারের আয় কমিয়ে দিচ্ছে। যেমন ২০১৯-২০ সালে কর্পোরেট কর ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তাই এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে আয় বাড়ানোর জন্য দেশের সম্পদ বিক্রি করার আত্মঘাতী পরিকল্পনা যা আত্মনির্ভরতার শ্লোগানের প্রতি এক নির্মম পরিহাস। লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক।
এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট প্রকৃতই ‘বৈপ্লবিক’। কোন রাখঢাক নেই, কোন মারপ্যাঁচ নেই, পরিষ্কার বলা হয়েছে দেশ চালানো হবে দেশের সম্পদ বিক্রি করে। জনগণের করের টাকা ও শ্রমে তৈরি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্পোরেটদের সস্তা দরে বেচে দিয়ে দেশ চালাবেন দেশপ্রেমের ঠিকেদাররা। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন এটা কি নতুন কিছু? অবশ্যই নয়, নব্বই-এর দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, আইএমএফ, আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির চাপে ভারতের শাসকশ্রেণি ‘উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন’ এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে, তখন থেকেই দেশের সম্পদ বেচার কাজটা শুরু হয়। এই বিক্রির কাজে সবচেয়ে বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বিলগ্নীকরণ নামে এক মন্ত্রক খুলে ফেলেছিলেন যার মন্ত্রী ছিলেন অরুণ শৌরি।
৯০’ পরবর্তী সময়ে বিলগ্নীকরণ, বেসরকারিকরণ বা বিক্রি করতে না পারলে স্রেফ বন্ধ করে দেওয়া কোন নতুন ঘটনা নয়। তবে এবারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর প্রশ্নে নির্মলা সীতারমন কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন যা জেনে নেওয়া দরকার — চারটি ক্ষেত্র (সরকারের ভাষায় স্ট্র্যাটেজিক এরিয়া) ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্বই থাকবেনা। এর অর্থ নন-স্ট্র্যাটেজিক এরিয়ার সংস্থাগুলিকে হয় বিক্রি করে দেওয়া হবে নতুবা বন্ধ। চারটি স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র হল
- আণবিক শক্তি, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা
- পরিবহন ও টেলিকম
- বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ
- ব্যাঙ্ক, বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এবারের বাজেটে বিক্রির তালিকাটা সুবিশাল—
- আই ডি বি আই ব্যাঙ্ক ছাড়া আরো দুটি পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক (সম্ভবত পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্ক অব বরোদা)
- একটি জেনারেল ইনসুরেন্স কোম্পানি
- এল আই সির শেয়ার বিলগ্নীকরণ (এরজন্যসংসদে আইন সংশোধন)
- এয়ার ইন্ডিয়া
- ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড
- শিপিং কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া
- কন্টেনার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া
- ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেড
- পবন হংস লিমিটেড (হেলিকপ্টার পরিষেবা)
- নীলাচল ইস্পাতনিগম লিমিটেড।
এই তালিকা আত্মনির্ভর ভারতের উপযুক্ত বিজ্ঞাপনই বটে। এই বিক্রিবাটার বিষয়ে আরো কিছু তথ্য যুক্ত করা প্রয়োজন। গত বারের বাজেটেই বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে মোটা টাকা সরকারি কোষাগারে ভরার লক্ষ্য জানিয়েছিল কেন্দ্র। ৬৭ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লাফে বিলগ্নির লক্ষ্য মাত্রা ২.১৪ লক্ষ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। লকডাউনে ও আন্তর্জাতিক পুঁজির সংকটের কারণে বণিকের হাটে পসরা সাজিয়ে নিয়ে বসলেও দেশ বিক্রি করে খুব একটা পয়সা ওঠাতে পারেনি সরকার,বাস্তবত আয় হয়েছে মাত্র ৩২,০০০ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক বর্ষে লক্ষ্য মাত্রা স্থির করা হয়েছে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা, তার মধ্যে ৭৫,০০০ কোটি টাকা আসবে বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে এবং ১ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ও বিমার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে তোলা হবে। এখানে দেখার মত বিষয় হল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের দুনিয়া জোড়া সংকটের কারণে বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের বেশি করে নজর পড়েছে ব্যাঙ্ক, বিমা সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর। আমাদের আশঙ্কাকে (পড়ে দেখুন : এল আই সিঃ নয়া উদারনীতির আগ্রাসন) সত্য প্রমাণ করে এলআইসি-র মত সমৃদ্ধশালী প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ করার কাজ আরো গতি পেয়েছে এবারের বাজেটে। বিমা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৯% থেকে ৭৪% করার উদ্দেশ্যই হল এই লাভজনক ক্ষেত্রটিকে পুরোপুরি বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া। সরকার তার নীতি মালায় বলেছে স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রগুলিতেও সরকারের উপস্থিতি হবে খুবই সামান্য। এর প্রভাব ব্যাঙ্কিং শিল্পে মারাত্মক হবে। ওয়াকিবহাল মহলের আশঙ্কা আগামী দিনে স্টেট ব্যাঙ্ক বাদে আর কোন সরকারি ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব থাকবে না। নন স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রগুলিতে এখনো যে সরকারি সংস্থাগুলির অস্তিত্ব আছে তাদের বিক্রি বা বন্ধ করে দেওয়ার রোডম্যাপ তৈরি করতে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নীতি আয়োগকে।
এই প্রসঙ্গে আমরা বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারিকরণের প্রশ্নটিকে দেশের আর্থিক ভালো মন্দের প্রেক্ষিতে বিচার করতে চাই। এই বিলগ্নীকরণের স্বপক্ষে যে যুক্তি খাড়া করা হয় তা হল কোম্পানির শেয়ার কিছু শতাংশ বিক্রি করলে বা বেসরকারি হাতে তার মালিকানা তুলে দিলে সরকারের ঘরে এক লপ্তে বেশ কিছু টাকা আসে যা জনগণের কল্যাণে কাজে আসে। এছাড়া অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে এই নয়া উদারবাদের জমানায় (minimal governance) কারখানা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালানো সরকারের কাজ নয়। এই যুক্তি কিন্তু অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে ধোপে টেকে না। কারণ এই শেয়ারগুলি হস্তান্তর করার ফলে সরকারের ধারাবাহিক ডিভিডেন্ড পাওয়ার পথ চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাশ। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থাগুলির বিলগ্নীকরণ সংক্রান্ত আলোচনায় একটা কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই যে, নিছক লাভ ক্ষতির অঙ্কে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলির কার্যকারিতার বিচার করা সম্ভব নয়। বরং খনিজ সম্পদ ও শিল্পে বেসরকারি পুঁজি যাতে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করতে না পারে তার জন্য ৫০’ এর দশক থেকে শুরু হয় সরকারি উদ্যোগে শিল্পস্থাপন। আবার আমজনতার কষ্টার্জিত টাকা নিরাপদে রাখা,সেই টাকা দেশের উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করা — এই সব বিষয়গুলি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করেছিল। অন্তত একটা মাত্রা পর্যন্ত জনকল্যাণমুখী সরকারের ধারণা সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করত। কিন্তু আজ সরকার শুধু মাত্র কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার কারণে দেশ বিক্রির নীতি গ্রহণ করছে।
একথা অনস্বীকার্য যে করোনা অতিমারী, অপরিকল্পিত লকডাউন, ১৫% বেশি জিডিপি সংকোচন দেশের আর্থিক অবস্থাকে আরো সঙ্গীন করেছে। কিন্তু একথাটাও ভুললে চলবে না যে আচ্ছে দিনের সওদাগর মসনদে বসার পর থেকে দেশের আর্থিক অবস্থা আরো অধোগতির দিকে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাস থেকে তার পরবর্তী প্রতিটি ত্রৈমাসিকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ কোভিড হানা দেওয়ার ঠিক আগে, আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.১ শতাংশ। এই কোভিড কালে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৯.৫% যা আগামীতে ৬.৮% করার কথা বলা হয়েছে। সরকার তার আয়ের লক্ষ্য মাত্রা স্থির করেছিল ১৫.৬ লক্ষ কোটি টাকা কিন্তু বাস্তবে আয় হয়েছে ১১ লক্ষ কোটি টাকা। চাহিদা কমার কারণে জিএসটি বাবদ ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা ও প্রত্যক্ষ কর বাবদ ৪ লক্ষ কোটি টাকা কম আয় হয়েছে। আবার এক্সাইজ বাবদ ৯৪,০০০ কোটি টাকা বেশি আয় হয়েছে পেট্রোল ও ডিজেলে সেস বসানোর কারণে। এই টাকা কিন্তু রাজ্য ও ইউনিয়ন টেরিটরির সঙ্গে ভাগ করতে হবে না। আবার পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার এবার ৪০,০০০ কোটি টাকা কম দেবে রাজ্য সরকারগুলোকে। এই অবস্থায় সরকার তার আয় বাড়ানোর জন্য কর্পোরেট করের মাত্রা বাড়াবে, অতিধনীদের উপর কোভিড ট্যাক্স বসাবে, চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সরকার আরো বেশি টাকা খরচ করবে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সরকার তার উল্টো পথে হেঁটেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের তথ্য অনুযায়ী ভারত সরকার সবচেয়ে কম টাকা খরচ করেছে। এর আগে বাজেট সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা দেখেছি, জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ ভারতে সবচেয়ে কম। কম করের হার, কর্পোরেট ট্যাক্সের নানান ধরণের ছাড়, বিশেষ বিশেষ শিল্পের জন্য দীর্ঘকালীন ট্যাক্স হলিডে — সরকারের আয় কমিয়ে দিচ্ছে। যেমন ২০১৯-২০ সালে কর্পোরেট কর ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই কোভিড কালেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। তাই আয় বাড়ানোর জন্য দেশের সম্পদ বিক্রি করার আত্মঘাতী পরিকল্পনা যা আত্মনির্ভরতার শ্লোগানের প্রতি এক নির্মম পরিহাস।
- লেখক স্কুল শিক্ষক ও অধিকার আন্দোলনের কর্মী।
- Also read : Union Budget: Disabled Cold Shouldered
গণ আন্দোলন ই একমাত্র রাস্তা। সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন গুলি কে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।