২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘ভিশন ডকুমেন্ট’-এ লেখা হয়েছিল ১০৩২৩ জন শিক্ষকের স্থায়ী সমাধানের কথা। আসামের হিমন্ত বিশ্ব শর্মা থেকে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ বহু কেন্দ্রীয় নেতার মুখে তখন শোনা গেছে পরিত্রাণের কথা, স্থায়ী সমাধানের কথা। কিন্তু বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের ৩ বছর পূর্ণ হতে হতে সেই ১০৩২৩ জন শিক্ষককে ২৭ জানুয়ারি রাস্তায় ফেলে লাঠি দিয়ে নির্মম মারের রাস্তা বেছে নিল মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পুলিশ। সৌরব চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
সরকারপক্ষ থেকে কোন-ও সদর্থক বার্তা না পেয়ে ‘জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটি ১০৩২৩’ প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন ২৬ জানুয়ারি শহর আগরতলার বুকে দীর্ঘ মশাল মিছিল সংগঠিত করে। মিছিলকে সমর্থন জানিয়ে সারা রাজ্যের নানা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন বিপুলভাবে সমর্থন জানায়। এই সমর্থন জানানোকেই হয়তো ভালোভাবে নেয়নি জোট সরকার। যার প্রতিক্রিয়ায় ২৭ জানুয়ারি ভোরবেলা সূর্যের আলো ফোটার আগেই সিটি সেন্টার সংলগ্ন এলাকায় বিপুল পরিমানে পুলিশের জমায়েত শুরু হয়। আচমকাই শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে বিপ্লব দেবের সরকার। পরপর আন্দোলনকারীদের টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হয়। প্রসঙ্গত, মহিলাদের জন্য কোনও মহিলা পুলিশ কর্মীকে আনা হয়নি! পরিস্থিতি বেগতিক হতে শিক্ষকেরাও রুখে দাঁড়িয়ে রাস্তাতেই বসে পড়েন। সকাল সাড়ে দশটা’র দিকে পুলিশ আন্দোলন ভাঙতে জল কামান, রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস নিয়ে রাস্তায় নামে – যেন শিক্ষক নয়, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই!
চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটি’র ডাকা ধর্নামঞ্চ ২৬ জানুয়ারি ৫২তম দিনে পা দিয়েছিল, সরকারের প্রতি আশাবাদী ছিলেন শিক্ষকেরা, কিন্তু তার বদলে মিলেছে টিয়ার গ্যাস শেল। তবে রাস্তা ছাড়েননি শিক্ষকেরাও, টিয়ার গ্যাসের শেল হাতে তুলে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশের দিকেই। প্রতিবন্ধী একজন শিক্ষক একাই আটকে দিয়েছিলেন জলকামানের গাড়ি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, লড়াইয়ের মাঠ খালি হচ্ছে না। এরপর যা শুরু হয়েছিল তা ত্রিপুরাবাসী দীর্ঘদিন মনে রাখবে, সিআরপিএফ ও টিএসআর একযোগে শিক্ষকদের উপর লাঠি চালায়, যাতে বহু শিক্ষক গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কয়েকজনের অবস্থা শোচনীয়।
২০২০ সালের মার্চ মাসে চাকরি চলে যাওয়ার পর দফায় দফায় মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা অধিকর্তার কাছে এই শিক্ষকেরা ডেপুটেশন দিলে, সাক্ষাৎ করলেও বাস্তবে বিজেপি সরকার একবিন্দুও নিজেদের অবস্থান পালটায়নি ৷ শেষে ৫ই ডিসেম্বর থেকে আগরতলা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিটি সেন্টারের সামনে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরী করে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণধর্নায় বসে শিক্ষকদের মোট তিনটি সংগঠন – ‘আমরা ১০৩২৩’, ‘জাস্টিস ফর ১০৩২৩’, ‘অল ত্রিপুরা এডহকটিচারস এসোসিয়েশন’ – একযোগে ‘জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটি ১০৩২৩’ নামে। অভিযোগ, “প্রথম থেকেই ১০৩২৩ জন শিক্ষকদের আন্দোলনকে ভণ্ডুল করে দেওয়ার জন্য জোর কদমে প্রয়াস নিয়েছে বিজেপি সরকার, না করতে পেরে আন্দোলনরত শিক্ষকদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালানো শুরু হয়, পরে ধর্ণামঞ্চে উপস্থিত মহিলা শিক্ষকদের কটুক্তি করতেও পিছুপা হয়নি তাঁরা।”- বলছিলেন আন্দোলনের নেত্রী ডালিয়া দাশ।
এই চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনার নিন্দা করেছে রাজ্যের নানা সংগঠন। পাশাপাশি সিপিআই (এম), কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন সংগঠন — ‘ত্রিপুরা রাজ্য উপজাতি গণমুক্তি পরিষদ’, ‘ত্রিপুরা সরকারি শিক্ষক সমিতি’, ‘এসএফআই’, ডিওয়াইএসআই’, ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন’, ‘বিপ্লবী যুব ফ্রন্ট’ সরকারের অমানবিক নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক গৌতম দাশ বলেছেন, “আন্দোলন করা শিক্ষকদের উপর এইভাবে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে বিজেপি সরকার আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা কেন ফ্যাসিস্ট সরকার।” ত্রিপুরা হিউম্যান রাইটস্ অর্গানাইজেশনের সম্পাদক পুরুষোত্তম রায়বর্মন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, “সরকারের নগ্ন চোখ-মুখ খুলে এসেছে জনগণের সামনে। এই সন্ত্রাস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই না।”
ঘটনার পর কয়েক দিন কেটে গেলেও শহর আগরতলার মানুষ এই ঘটনার নির্মমতার ট্রমা থেকে বের হতে পারছেন না, সরকার যেন প্রত্যক্ষভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে – আওয়াজ তোলা বারণ, আওয়াজ তুললেই তোমার দিকে লেলিয়ে দেওয়া হবে পুলিশ। ত্রিপুরার বুকে গণ আন্দোলনকে দমাবার নানান নিদর্শন থাকলেও এইভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শিক্ষকদের আন্দোলনকে প্রতিহত করার যে কায়দা বর্তমান সরকার নিয়েছে তা বোধহয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে রাজ্যবাসীর কাছে। তিন বছর হয়ে যাওয়ার পরেও প্রতিশ্রুতি পালন করতে না পেরে এইভাবে মুখোশ খুলে নগ্ন চেহারা দেখাতে শুরু করাকে রাজ্যের মানুষ ভালো চোখে নিচ্ছে না তা ২৭ই জানুয়ারির স্যোশাল মিডিয়া দেখলেই আন্দাজ করা যায়। অবশ্য এই ঘটনার কথা ত্রিপুরার বাইরের মূলস্রোতের সংবাদপত্রে একেবারেই উঠে আসেনি, কোনটা ‘খবর’ হবে তা নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমের বৈষম্যমূলক আচরণে থেকে তা স্পষ্ট।
Related news
ত্রিপুরায় বিজেপি’র ভুয়া প্রতিশ্রুতি, ১০৩২৩ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়ে গণধর্ণায়