কলকাতায় সোচ্চারে উদযাপিত হল মহিলা কিষাণ দিবস


  • January 18, 2021
  • (0 Comments)
  • 1171 Views

মহিলা কিষাণ দিবস আরো একবার প্রমাণ করল মনুবাদি, পুরুষতান্ত্রিক শাসকদের হুমকিকে হেলায় উড়িয়ে, নিজেদের দাবি আদায় করতে পথে নেমেছেন পথে রয়েছেন দেশের কিষাণীরা। সেই লড়াইয়ের মশাল সহজে নেভার নয়। ১৮ জানুয়ারি, ২০২১, কলকাতায় মহিলা কিষাণ দিবস উদযাপন নিয়ে সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।

 

 

১৮ জানুয়ারি সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও উদ‌যাপিত হল মহিলা কিষাণ দিবস। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কৃষক বিরোধী তিনটি কৃষি আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে কলকাতার ধর্মতলায় ওয়াই চ্যানেলে ‘অন্নদাতাদের সংহতিতে বাংলা’ নামে চলছে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাঝেই ১৮ তারিখটি হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মাত্র কয়েক দিন আগে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছিলেন দিল্লির আন্দোলনে বয়স্ক, শিশু ও ‘মহিলাদের’, কেন ‘রাখা’ হচ্ছে। তাঁদের যেন অবস্থান থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই বক্তব্য প্রকাশের সময় এমন একটি ধারণা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে যেন তা মহিলাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার জন্য। কৃষক আন্দোলনের আইনজীবী যখন জানান বয়স্ক ও নারীদের অবস্থান ক্ষেত্রে আর ‘রাখা’ হবে না, তখন তা আরও বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক মহিলারা যে সাংবিধানিক অধিকার বলেই নিজের পছন্দ মতো যেকোনও জায়গায় যেতে, যেকোনও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলনে অংশ নিতে পারেন এবং তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের উপরে বর্তায় – সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির কথায় যেন এই বাস্তবটিকেই অস্বীকার করা হয়। রাষ্ট্র, সরকার, বিচারব্যবস্থা, সমাজ সব কিছুর গভীরে শিকড় ছড়ানো পুরুষতান্ত্রিকতা, তাকে দুর্বল প্রতিপন্ন করে যে কোনও জীবন-জীবিকার অধিকারের দাবি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া, নারীর অবস্থান ও অংশগ্রহণকে অস্বীকার ও নিয়ন্ত্রণ করার তার যে স্বাভাবিক প্রবণতা, বর্তমান কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠল।

 

আর এই রায়ের পরেই আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ১৮ জানুয়ারির পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী। দেশের কৃষক ও কৃষিমজুর মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, এদিন তাদের শক্তি ও পরস্পরের প্রতি সংহতি প্রদর্শন করা। দেশব্যাপী যে বিরাট সংখ্যক মহিলা এদিন পথে নেমেছেন, প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, তাতে স্পষ্ট ঘরে ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা, এধরনের মন্তব্যকে কোনওভাবেই তারা আমল দিতে তৈরি নন, প্রশ্নটা যখন এক চরম ফ্যাসিস্ত সরকারের দেশের নাগরিক বিরোধী কালা কানুনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের।

 

ধর্মতলায় এদিনের প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশ নিতে এসেছিলেন কলকাতাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার শয়ে শয়ে নানা বয়সের মহিলারা। মা, দিদিমার সঙ্গে যেমন এসেছিল বালিকারা, তেমনি শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে হাজির ছিলেন বহু তরুণী মা। সত্তর, আশি বছরের বহু বৃদ্ধাও এসেছিলেন নিজেদের দাবি নিয়ে। সুন্দরবন, বসিরহাট, ভাঙড় থেকে কৃষক পরিবারের সদস্য নারী, জমি-জীবিকা-পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত মহিলারা, কৃষিজীবি মহিলারা অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন। মুক্তমঞ্চে বা সাক্ষাৎকারে ভয়হীন, দৃপ্ত স্বরে বলে দিচ্ছিলেন, মোদি সরকারের কৃষি আইনগুলি তারা আদপেই মেনে নেবেন না। যতদিন পর্যন্ত তা প্রত্যাহার না হচ্ছে পুরুষ আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁদের লড়াই চলবে, শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত।

 

পতাকা কাঁধে হাজির ছিলেন সত্তর পেরিয়ে যাওয়া লক্ষ্মীবালা সাঁপুই। এসেছিলেন সুন্দরবন থেকে। “আমাদের, মা, নামেই সুন্দর, আর কিছুই সুন্দর নেই। আয়লা আর তারপর এই যে সব বড়বড় ঝড় এল আমাদের সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আর তেমন চাষও বা হয় কোথায়। আমরা বিধবারা ভাতা পর্যন্ত পাচ্ছি না। অথচ যখন কুমিরে বা বাঘে খেয়ে নেয় তখন তো তিন/চার লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় সরকার! তার মানে সরকারের কাছে টাকা আছে, লোকগুলি মরে গেলে টাকা দিয়ে কি লাভ? তারচেয়ে আমাদের চাষবাসে সরকার টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। শুনেছি, মোদি এমন সব আইন করেছে, তাতে আরওই না খেতে পেয়ে মরবে চাষীরা, মানে আমরাও। আমরা মীন ধরি, চাষের কাজ করি, টাকা পাই কোথায়? এগুলো সরকার শুনবে না তো কে শুনবে?” সহজ প্রশ্ন বৃদ্ধার। উত্তর পাওয়া অবশ্য কঠিন।

লক্ষ্মীবালা সাঁপুই

ভাঙড় থেকে এসেছিলেন সাফুরা বিবি। কৃষি আইন নিয়ে খুব স্পষ্ট করে যে সবটা জানেন, বোঝেন তা নয়। তবে আইন চালু হলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে এটুকু বুঝেছেন। “সবটা জানতে, বুঝতেই এসেছিলাম। কিছুটা হলেও অন্তত বুঝতে পারলাম। এমনিতেই দামের সমস্যায় জেরবার হয়ে যাচ্ছি। আগের মতো দামও পাই না আর ফলনও তেমন হচ্ছে না। তার উপরে যদি এই আইন চালু হয়, তাহলে তো পরিবারসুদ্ধ পথে বসতে হবে। অনেক আন্দোলন, লড়াই করে হকের জমি বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তাহলে চাষিদের দাবিদাওয়ার জন্যও লড়াই তো করে যেতেই হবে,” স্পষ্ট বক্তব্য সাফুরার।

 

উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট থেকে আসা খাদিজা বেগম বসেছিলেন তার সাথীদের সঙ্গে। সকলের মধ্যে কে কথা বলবেন, জানতে চাওয়াতে বাকিরা মধ্যবয়সের খাদিজাকেই দেখিয়ে দিলেন। কেন যোগ দিলেন জমায়েতে? উত্তরে বললেন, “আমরা মেয়েরাও তো চাষের জমিতে কাজ করি। অনেক কাজ করি। কিন্তু আমাদের কথা আলাদা করে কেউ বলে না। এসেছি যাতে দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হয়। যাতে মেয়েদের তাদের স্বামীর কাছে হাত পাততে না হয়। যাতে নিজেদের কাজের দাম পাই আমরা। বুঝেছি, এই আইন আসলে এর কোনোটাই হবে না, তাই এসেছি এখানে যোগ দিতে।”

খাদিজা বেগম

সালমা বিবি, সাফিয়া বিবি, সাবিনা বিবিরা এসেছিলেন ভাঙড় থেকে। সকলেরই হয় নিজেদের অল্পবিস্তর জমি রয়েছে বা অন্যের জমিতে কৃষিমজুরের কাজ করেন। পরিশ্রমের তুলনায় হাতে টাকা আসে না কিছুই। কি-ই বা জমাবেন, আর সংসারই বা চালাবেন কীভাবে? সালমা বিবি যেমন বললেন, “আমরা যদি না খেতে পাই, তাহলে কেউই পাবে না। ফসল না ফলালে কেউ কি খাবে? আমরা তো চাষির বাড়ির, কিন্তু আরও যারা আমাদের মতো গরীব মানুষ তাদের কথাও ভাবুন তো। তারাও বা এত বেশি দাম দিয়ে কীভাবে বাজার থেকে সব্জি, চাল কিনবে? আমরা যা ফসল ফলাই তা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হই, অথচ বাজারে তা-ই কত বেশি দামে বিক্রি হয়। আমাদের কিন্তু কিছুই লাভ থাকে না। এরকম করলে আমরা টিঁকব কী করে? আমাদের ক্ষতি বাড়িয়ে কার লাভ? সব কিছুর একটা ন্যায্য দাম ঠিক করে দিক সরকার এটাই চাই আমরা।”

সালমা বিবি, সাফিয়া বিবি ও সাবিনা বিবি

শিবানী মুদির বাড়ি সুন্দরবন। সামান্য জমি রয়েছে নিজেদের যেখানে ধান চাষ করেন। সেইসঙ্গে সংসার সামলাতে অন্যের জমিতে কৃষিমজুরের কাজও করেন মরশুমে দু’বার। গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে যখন বলেন, “আমরা ছেলেদের মতোই বা তার থেকেও বেশি কাজ করি চাষের জমিতে। অথচ আমাদের কাজ দেয় কম আর মজুরি দেয় আরও কম। ছেলেদের যেখানে ৩৫০/৪০০ টাকা দেয়, আমাদের সেখানে ১৫০/২০০ টাকা মজুরি দেয়। নিজেদের জমিতে যখন ধান ফলাই তারও দাম পাই খুব কম। ৫০০/৬০০ টাকা বস্তা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সংসার এসব কি এত কম টাকায় চলে? আমরা চাই আমাদের মেয়েদের কাজে মজুরি বাড়াক আর ফসল যা ফলাচ্ছি তার ঠিক দাম যেন আমরা চাষিরা পাই, বাজারে তো কত বেশি দামে সব বিক্রি হয়। অথচ আমরা যারা ফলাচ্ছি তারা লাভের মুখ দেখি না।”

শিবানী মুদি

আন্দোলনে থাকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানসিকতা যেমন মহিলা কিষাণ দিবসে বাংলার কৃষিজীবী মহিলাদের কন্ঠে স্পষ্ট, যেমন এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্রকর্তাদের কোনও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য তাদের লড়াইয়ের পথ থেকে সরাতে পারবে না, তেমনি দু’টি জিনিসও বোঝা প্রয়োজন। এক, এই কৃষি আন্দোলনের নেতৃত্বে আরও বেশি করে মহিলাদের উঠে আসা জরুরি, প্রয়োজন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর্মসূচী স্থির করায় তাঁদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ, কারণ মহিলাদের কৃষিক্ষেত্রে পরিশ্রম ও অংশগ্রহণের স্বীকৃতিতে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং দুই, কৃষিবিল কেন ক্ষতিকর ও কৃষক বিরোধী সে বিষয়ে আরও স্বচ্ছ ও স্পষ্ট বোঝাপড়া। এ দায়িত্ব আন্দোলনে যারা এখনও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরই নিতে হবে। মনুবাদি, পুরুষতান্ত্রিক শাসকদের হুমকিকে হেলায় উড়িয়ে পথে নেমেছেন, পথে রয়েছেন দেশের কিষাণীরা, সেই লড়াইয়ের মশাল সহজে নেভার নয়।

 

 

ছবি : সুদর্শনা চক্রবর্তী ও মৈনাক দত্ত।

 

Also read : আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ কোনো কোর্টের রায়ের মুখাপেক্ষী নয়

 

Share this
Leave a Comment