দেশের কৃষকেরা বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকেরাও ওই অঞ্চলের যাবতীয় বড় ছোট মাঝারি কৃষি উদ্যোগীরা তাদের সর্বনাশের বার্তা পেয়ে এর বিরুদ্ধ যে বিপুল আন্দোলন সংগঠিত করেছেন সেটাই অভিপ্রেত। আপাতত এই আন্দোলনের পাশে অন্য রাজ্যের কৃষকেরাও এসে দাঁড়াচ্ছেন। কৃষকদের যাবতীয় দাবি গুলির প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন রেখেও এই কথাটাও বলা খুবই দরকার যে এটা হলো সেই অস্থির সময় যখন ফসলের দাম, ফসলের বিপণন, ফসলের মুক্ত মজুতদারির বিরোধিতা এসব নানান জরুরি বিষয়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এমন আরও দরকারি সেইসব বিষয়গুলি, যা এতদিন ধরে পরিবেশ গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। লিখেছেন অমিতাভ আইচ।
পৃথিবীর মানবসম্পদের ১৫ ভাগ ভারতে থাকেন আর এই দেশের জলসম্পদের (মিষ্টি জল যা খাওয়ার বা পানের যোগ্য ও কৃষিকাজে লাগে) পরিমাণ পৃথিবীর মোট জলসম্পদের মাত্র চার ভাগ। এই জলের মূল উৎস হলো হিমালয় থেকে সৃষ্ট নদীগুলি যা সমস্ত উত্তর ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছে, দক্ষিণের নদীগুলি মুলত বৃষ্টির জলে পুষ্ট। প্রায় সাড়ে চার হাজার বাঁধ স্বাধীনতার পর থেকে তৈরি করা হয়েছে বিগত ৭০ বছরে। শুধুমাত্র চাষের ক্ষেতে জল দিতে ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে। কিন্তু তাও, দেশের ৬৫ শতাংশ জমি আজও ইরিগেশন বা নদী সেচের আওতার বাইরে। এই ছোট ও মাঝারি বাঁধগুলি, ভারতের মাথা পিছু বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা বা সংরক্ষিত জলের পরিমাণ ২০০ কিউবিক মিটারে (এক কিউবিক মিটার মানে ১০০০ লিটার জল) নিয়ে গিয়েছে। তা চিন, রাশিয়া বা আমেরিকার তুলনায় বহুমাত্রায় কম। প্রধান নদীগুলিতে বাঁধ দেওয়া জায়গা আর প্রায় নেই, বাঁধের অভিঘাতে অধিকাংশ নদীর জলধারণ ক্ষমতা তীব্রভাবে কমে গেছে, দূষণ বেড়ে গেছে বহু গুণ। পরিণাম একটাই কৃষিতে বিপুল ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার। তথ্য বলছে, ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের নব্বই ভাগ কৃষিতে ব্যবহার হয় আর সেটা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ এবং এতটাই বেশি যে তা চিন ও আমেরিকার মোট উত্তোলনের থেকেও বেশি। আর এসবের মূল কারণ জলখেকো অধিক ফলদায়ী ধান, গম, আখ, তুলার মতো ফসলের চাষ। হিসেব বলছে এক কিলো তুলা তৈরি করতে ২০০০০ থেকে ২৫০০০ লিটার জল লাগে, আখে লাগে ৩০০০ লিটার, ধানে ২৫০০ থেকে ৫০০০ হাজার এবং গমে ৯০০-১০০০ লিটার।
ভ্রান্তনীতি ও মুনাফার লোভ: পরিবেশ গবেষকরা বহুদিন ধরেই ভারতের জলের আকালের জন্য দেশের ভ্রান্ত কৃষিনীতিকে দায়ী করেছেন। আমরা যদি তাকিয়ে দেখি যে তুলা ও আখচাষের যে বর্তমান ভরকেন্দ্র মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তা ভারতের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। অথচ সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সরকারি নীতি, এই ভয়ানক শুষ্ক অঞ্চলের প্রধানতম ফসল, যা শুষ্ক ও খরা প্রবল অঞ্চলে মানুষকে এতো বছর বাঁচিয়ে রেখেছিল — সেই জোয়ার, বাজরা, রাগির চাষ বন্ধ করে হেক্টরের পর হেক্টর আখ ও তুলা চাষ করিয়েছে, তৈরি হয়েছে চিনি কল ও সুতো কল। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। জলের হাহাকারে বহু অঞ্চলে (মারাঠাওয়ারা, বিদর্ভ এসব অঞ্চলে বিশেষ করে) চাষ বন্ধ হওয়া ও চাষির আত্মহত্যা একটা নিয়মিত বিষয়, আমরা সে কথা খবরে পড়ছি, দেখছি, রাজনৈতিক তর্জাও শুনছি। একই ভাবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা হয়ে উঠেছে ধান কেনার কেন্দ্র। ধান, যা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উত্তরপূর্ব ভারত, থাইল্যান্ড, চিন ও জাপানের জলসমৃদ্ধ অঞ্চলের ফসল, তা গত ৫০ বছরে ওই সব অঞ্চলের প্রধান উৎপাদিত ফসল হয়ে গেছে (ধান খরিফে, গম রবিতে)। আর এসবই ১০০ শতাংশ উচ্চ ফলনশীল ধান, খরিফ মরশুমে চাষ হয়, যা ফ্রি-তে পাওয়া বিদ্যুৎ, জল আর সরকারের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসে এই সব রাজ্য থেকে ১০০ শতাংশ ধান কেনার সাথে লাফিয়ে বেড়েছে, আর তার সাথে বেড়েছে জলের অপচয়। বস্তুত অবস্থা এমন যে পাঞ্জাব, হরিয়ানার এগ্রিকালচার প্রোডাকশন মার্কেটিং কমিটিগুলি (এপিএমসি)-তে উত্তরপ্রদেশ, বিহার আর এই রাজ্য থেকে কম পয়সায় অভাবী ধান কিনে ফড়েরা সরকারকে বেশি দামে বেচে। পরিণাম হলো পাঞ্জাবের কৃষক যার গড় জমির পরিমাণ মাথা পিছু ৩ হেক্টররেরও বেশি, তারা দেশের সবচেয়ে অর্থবান চাষি হলেও আজ ভুল কৃষিনীতির কারণে জল ও মাটির উৎপাদন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
“ওয়াটার প্রোডাক্টিভিটি অব ক্রপ” একটা নতুন পরিমাপ যা ফসল প্রতি কতটা জল সেচ দেওয়া হলো আর কতো ফসল উৎপাদন হলো তার হিসাব করে। আর সেই হিসেব দেখাচ্ছে যে, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা যেমন জমিপিছু ধানের উৎপাদনে সবার উপরে, তেমনি মিটার কিউব জল ব্যবহার হিসাবে এই রাজ্যগুলির উৎপাদন সবচেয়ে কম (০.২২কেজি/ ঘন মিটার, যদিও খরাক্রান্ত মহারাষ্ট্র, যেখানেও ধান চাষ হয়, সেখানে এইটা সবচাইতে কম ও ভয়াবহ — ০.১৭ কেজি/ ঘন মিটার)। একই রকম চিত্র আখের ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকে দেখা যাচ্ছে, মানে ফসলের নির্বাচনটাই ভুল। আপাতত জল মিলে গেলেও সর্বনাশের বেশি বাকি নেই (নীচে ছবিতে ভারতের ধানচাষের জল চিত্র)।
কিন্তু এমন পরিস্থিতি খালি অপেক্ষাকৃত কম জলের রাজ্যগুলিতে নয়, জলসমৃদ্ধ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বহু জেলায় ভূগর্ভস্থ জলের আধার শুকনো দিনে ১০০ ফুটের নীচে চলে যেতে শুরু করেছে (পাঞ্জাবে যা ৫০০ ফুট নীচে)। আসামে তো এমন হচ্ছে যে নিয়মিত বন্যা ও বন্যার জল সরে গেলে জলকষ্ট এক নিয়মিত বিষয়, বিশেষ করে দক্ষিণ ব্রহ্মপুত্রের জেলা গুলিতে। চাষের কাজে অতিরিক্ত জলের আহরণ আসামের এই সমস্ত অঞ্চলে ফ্লোরাইড দূষণের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে দিয়েছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের ধান চাষ আর আর্সেনিক প্রাদুর্ভাব তো একদম পরস্পর সমানুপাতিক হারে বেড়েছে। মনে রাখতে হবে এই দুটি রাজ্যেই ধানের উৎপাদন শুধু হেক্টর প্রতি কমই নয়, প্রতি মিটার কিউব জল পিছুও উৎপাদন খুবই কম। তবে এ রাজ্যের ধানের উৎপাদন খরিফ মরশুমে মূলত বৃষ্টি নির্ভর হলেও বোরো চাষের নলকূপের জল তাকে ধনে না হলেও মানে পাঞ্জাবের সমতুল করেছে। এখানে বলে রাখা ভাল, দেশের মোট ধান উৎপাদনে সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গ আছে। জমির পরিমাণ পাঞ্জাবের দ্বিগুণ, এবং এখানে মানুষ প্রধানত ভাত খায়। তবে এই রাজ্যের মোট উৎপাদিত চালের ১ শতাংশও কেন্দ্রীয় মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের (এমএসপি) কোনও সহায়তা পায় না। আর তাই রাজ্যের গরিব কৃষক, যার জমির পরিমাণ বাম আমলের অপারেশন বর্গার কারণে পাঞ্জাব হরিয়ানার তুলনায় প্রায় কিছুই নয়, তারও অধিকাংশই আবার ভাগচাষি, সে আরও গরিব হয়েছে।
পরিস্থিতি সত্যি জটিল। আন্তর্জাতিক সমস্ত সংস্থা ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের উৎপাদনকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ বলছে এবং এটা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা যে শুধু মাত্র জলের সঙ্কট ভারতের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কট হিসাবে দেখা দিতে চলেছে।
এটা অস্বীকার করার আজ কোনও জায়গা নেই যে সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সরকারি ভর্তুকি নির্ভর রাসায়নিক চাষ, মাটি, ফসলের বিভিন্নতা, চাষ ও চাষির সর্বনাশ করেছে। এবং দেশের চাষ ব্যবস্থা শুধু চাল-গম ও এফসিআই-এর গুদাম নির্ভর হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। এফসিআই-এর গুদামে ১৬ বছরের পুরনো চালও রয়েছে আর এই পুরো ব্যবস্থাটাতেই স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। আর এফসিআই তো সব রাজ্য থেকে কেনেও না। মূলত কেনে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে। বাকি রাজ্য, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য, যে কিনা সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করে, এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে এমএসপি কী হবে তা নিয়েও। হওয়া উচিত C2+ 50%, মানে চাষের সব রকম খরচ, মায় জমির খরচ, সুদ, নিজের বা পারিবারিক শ্রম সব মিলিয়ে খরচের উপর ৫০ শতাংশ, কিন্তু সরকার জমির খরচ সব বাদ দিয়ে হিসাব করছে, আর এর পরেও অধিকাংশ জায়গায় এর বহু নীচে ফসল কেনা বেচা হচ্ছে। নতুন কৃষি আইনগুলো এসব আলোচনা না করে, বরঞ্চ এর সুযোগ নিয়ে উলটে এমএসপি এবং সরকারের ফসল কেনার ব্যবস্থাকেই তুলে দেওয়ার পথ সুগম করে তুলতে চাইছে। চাইছে পুরো ক্ষেত্রটা থেকে সরকারি দায় পুরো ঝেড়ে ফেলে গুটিকয়েক অতিবৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের কৃষকেরা বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকেরাও ওই অঞ্চলের যাবতীয় বড় ছোট মাঝারি কৃষি উদ্যোগীরা তাদের সর্বনাশের বার্তা পেয়ে এর বিরুদ্ধ যে বিপুল আন্দোলন সংগঠিত করেছেন সেটাই অভিপ্রেত। আপাতত এই আন্দোলনের পাশে অন্য রাজ্যের কৃষকেরাও এসে দাঁড়াচ্ছেন। কৃষকদের যাবতীয় দাবিগুলির প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন রেখেও এই কথাটাও বলা খুবই দরকার যে এটা হল সেই অস্থির সময়, যখন ফসলের দাম, ফসলের বিপণন, ফসলের মুক্ত মজুতদারির বিরোধিতা এসব নানান জরুরি বিষয়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এমন আরও দরকারি সেইসব বিষয়গুলি, যা এতদিন ধরে পরিবেশ গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন। এখানে সেগুলোই আলোচনা করব।
কোনও রাস্তা কি আছে?: পরিবেশগত অধিকাংশ সমস্যার কোন সমাধানের পথ আসলে প্রকৃত সমস্যাকে স্বীকার করা, সঠিক নীতি রূপায়ণ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর দণ্ডায়মান। আমরা যতই পরিকল্পনা করি না কেন, এই তিনটি বিষয় না থাকলে (আর সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা) কোনওভাবেই এই সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়। তবে সমস্যার ধরন ও স্থান অনুযায়ী সমাধান পথের কিছু প্রকারভেদ থাকবে, ইংরাজিতে আমরা যাকে Place based solution বলি। পরিবেশগত অনেক সমস্যার মতো জল ও কৃষি উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে আমাদের বিজ্ঞানের সাথে, সময়ের সাথে পিছিয়ে যেতে হবে। যেতে হবে প্রকৃতির কাছে, জানতে হবে কীভাবে বহু শত বছর ধরে মানুষের সভ্যতা, বিশেষ করে আদিবাসী ও মূলনিবাসী জনসম্প্রদায় বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের রত্নসম বীজ ভাণ্ডার, তাদের দেশীয় কৃষিপদ্ধতি, যাকে বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন আইটিকে বা ইন্ডিজিনাস ট্র্যাডিশনাল নলেজ প্র্যাকটিস।
১) কোনও সন্দেহ নেই যে গুজরাটের খরা অঞ্চলে তুলা,মহারাষ্ট্রের আখ ও পাঞ্জাবের ধানের মডেল একটি ভুল কৃষিনীতির ফসল যা আমাদের দেশের জলসম্পদের সর্বনাশ করেছে। সমৃদ্ধ চাষিদের ভর্তুকি নির্ভর জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আমরা ভূগর্ভস্থ জলের মরুভূমি গড়েছি। প্রথম শর্ত হলো যে আখ ও তুলা চিনি কলে ও শিল্পে সাপ্লাই হয় তাতে সরকার দেশের মানুষের করের টাকায় ভর্তুকি দিতে পারে না। প্রান্তিক ও গরিব চাষিদের ক্ষেত্রে ভর্তুকি থাকতে পারে। একই ভাবে পাঞ্জাবের খরিফের ধান করতে লক্ষ লক্ষ নলকূপ তৈরির অনুমতি দিয়ে আমরা কি পাঞ্জাবের কৃষকদের ভাল করতে চাইছি? প্রতি ঘন মিটার জলে কত কেজি প্রোডাকশন হচ্ছে ও চাষিরা জমিতে জল ও মাটির উর্বরতা রক্ষার জন্য ঠিক কী কী পদক্ষেপ করছেন (এগুলো সহজে শেখানো যায় আর কৃষি আধিকারিকদের এটা বড় কাজ, আর কাজটা যে ঠিক মতো হয় না এটা এখন পরিষ্কার হয়েছে), সেটা বাধ্যতামূলক করা দরকার। মানে একটা “ফার্ম ল্যান্ড সয়েল অ্যান্ড ওয়াটার হেল্থ রিপোর্ট কার্ড” হবে। কৃষি সংক্রান্ত সব সুযোগসুবিধা এর সাথে জোড়া থাকবে। সরকারের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের সুবিধা শুধু একটি দুটি রাজ্য নয়, গোটা দেশ ও অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে হওয়া দরকার। সেটা বাড়লেই ফসলের বিভিন্নতা বাড়বে, আর এই বিভিন্নতা কৃষি বাস্তুতন্ত্র বা অ্যাগ্রো-ইকোলজির মাধ্যমে ঠিক করতে হবে, অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়।
২) একথা আজ নিশ্চিত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটিত সমস্যা থেকে আমাদের দেশের শুকনো জায়গাগুলোকে বাঁচাতে পারে মিলেট বা জোয়ার, বাজরা ও রাগি। ফুড সিকিউরিটি বা খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাদের ওই সব অঞ্চলের কৃষকদের দেশি প্রজাতির মিলেট চাষে ফেরাতেই হবে উপায় নেই। সরকার পাঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলি থেকে জলখেকো ধান না কিনে মিলেট ও গম কিনুক, আর পশ্চিমবঙ্গ, আসামের মতো রাজ্য থেকে কিনুক ধান, এটাই উচিত হবে। এতেই ফসলের পরিবর্তন হবে ও কৃষকের রোজগার বাড়বে। গম লাগানোর জন্য মেসিনে কাটা উঠে যাওয়া ধানের গোড়া পোড়ানও বন্ধ হবে।
৩) ফসল কেনার ও সরকারি সুবিধার ক্ষেত্রে দেশি বীজ ও জৈব পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটাই তো আসল আন্দোলনের বিষয়। সরকার রাসায়নিক চাষ ও উচ্চ ফলনশীল বীজের লবির জন্যে এই কাজটা সহজে করবে না। এই ব্যবস্থা্ গড়ে উঠলে, গড়ে উঠবে দেশীয় ফসলের বীজ ভাণ্ডার যা আমাদের বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থার আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে।
৪) বিটি কটন ও হাই ইয়েলডিং বীজ, সার, জল, কীটনাশকের মাত্রা বৃদ্ধি করে চাষির ও পরিবেশের সর্বনাশ হয়েছে। এর সাথে লড়াই করার রাস্তা রেইন ফেড অরগানিক কটন, কমিউনিটি ভিত্তিক চরকায় সুতো কাটা ও খদ্দরের আন্দোলনে নতুন করে আস্থা রাখা দরকার, আর এই কাজে বিপুল গ্রামীণ কর্মসংস্থান হওয়া সম্ভব সেটা প্রমাণিত। যেসব কৃষি সংগঠন ও কৃষকেরা আজকের এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তারা এই কাজটি করতে অস্বীকার করলে ভুল করবেন।
৫) কৃষি ক্ষেত্রে জল সংরক্ষণের একটা বড় উপায় ওয়াটার ব্যাঙ্কিং। এর মুখ্য বিষয় হলো অনেকগুলি কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায় একটি জলের আধার তৈরি করা। এই জলাধারে পার্শ্ববর্তী সমস্ত কৃষিক্ষেত্র থেকে এবং বৃষ্টির জল জমা হবে। শুখা মরশুমে চাষিরা এই জলাধার থেকে নিজের জমির মাপ অনুসারে জল পাবেন। আর সেই জল তাদের কাছে পৌঁছে যাবে সৌরচালিত মাইক্রো ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে। এই সিস্টেম জমিতে অতিরিক্ত জল সরবরাহ না করে সরাসরি গাছের রুটে জল পৌছে দেয় ও ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জল অপচয় বন্ধ করে। মোটকথা চাষের কাজে যেখানে সম্ভব বিন্দু সেচ ব্যবস্থা চালু করতেই হবে। এমনকি ধানের ক্ষেত্রেও নানান পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে যেখানে কম জলে ভাল ফসল হয়, যেমন শ্রী (SRI) পদ্ধতি।
৬) চাষের জমি থেকে জল উবে যাওয়া আটকানো জল বাঁচানোর বড় ধাপ। মাটিতে খড় চাপান দেওয়া ও জমির উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া আসা আটকানোর জন্য গাছ বসানো বা অ্যাগ্রো ফরেস্ট্রি ভালভাবে ফলদায়ী।
৭) আমরা নানাবিধ অরগানিক সার, কেঁচো সারের কথা বলি, এখন তো পালেকর সাহেব বেশ কিছু দিন ধরে জিরো বাজেট ফার্মিং-এর কথা বলে জনপ্রিয় হয়েছেন (যদিও তিনি কম্পোস্ট ও কেঁচো সারকে অযৌক্তিক আক্রমণ ও জিএম ফসলকে সমর্থন করেন এমনও শোনা যায়)। জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা কৃষি জমির উর্বরতা, জল ধারণ ক্ষমতা, বাতাস চলাচল এসব বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের কোনও জুড়ি নেই মনে করছেন। একটি হলো মূলত জাপানি কৃষি বিজ্ঞানী তেরিও হিগার আবিষ্কৃত জৈব পদার্থ কোহলিত করে তৈরি করা বোকাশি এবং আরেকটি হলো কৃষি জমি থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্য থেকে প্রস্তুত এক প্রকার চারকোলের গুড়ো বা বায়োচার। এই দুটিই সহজেই কৃষকেরা নিজের জমিতে তৈরি করে নিতে পারেন। বছর বছর বর্জ্য না পুড়িয়ে, ও বায়ুদূষন না করে, এই দুটি যদি তারা করেন তবে সব দিক থেকেই লাভবান হবেন। তবে বায়োচার মূলত অম্লত্ব কমায় কাজেই ক্ষার জমিতে ব্যবহার করা যাবে না। মাটির ক্ষারত্ব কমাতে বোকাসি ও খড় চাপানের জুড়ি নেই। আরেকটি জিনিস খুবই ফলদায়ী আর সেটি হলো গোবর গ্যাসের স্লারি। এই রাজ্যে,সরকারি উদ্যোগে হুগলি জেলার বলাগড়ে চাষিরা গোবর গ্যাসের স্লারি মারফত ধান ও সবজি ফলিয়ে সাবলম্বী হয়েছে। ফার্মইয়ার্ড ম্যানিওর ও উপকারী জীবাণু মিশ্রিত সার (জীবাণু এখন চাষিরাও যাতে তৈরি করতে পারেন সে ব্যবস্থা করা যায়); গোবর, গোমূত্র, বেসন, গুড় জলে মিশিয়ে অল্প পচিয়ে তৈরি করা তরল সার, চাষিকে ইউরিয়া, ডি এ পি-র মরণ আলিঙ্গন থেকে বাঁচাতে পারে। এতে মাটিতে উপকারী জীবাণুর পরিমাণ বৃৃদ্ধি পেয়ে, মাটির গঠন, জৈবিক পদার্থ, পিএইচ ও অনুখাদ্য সঠিক মানে থাকে আর ফসলের ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। একই ভাবে ভেষজ কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, নানান ইন্টিগ্রেটেড পেষ্ট ম্যানেজমেন্ট যেমন আঠা ফাঁদ ও ফেরোমোন ট্র্যাপ চাষিকে ল্যাদা পোকা, জাব পোকা, দয় পোকা, শোষক পোকা, নালি পোকা, ফল ফুুটোকারী পোকা ও নানান ছত্রাকের হাত থেকে ফসলকে যেমন বাাঁচায় তেমন চাষের খরচ কমায়, খাদ্য ও পরিবেশকে বিষমুক্ত রাখে। এখন তো দেশি ও প্রাকৃতিক ধান চাষে কোনও রকম সার ছাড়া শুধু অ্যাজোলা দিয়ে চাষ করে উচ্চফলন প্রমাণ করে দেখানো হয়েছ। রাজ্য সরকারের এগ্রিকালচার ট্রেনিং সেন্টার, ফুুুলিয়া এ বিষয়ে ব্যাপক কাজ করেছে, এখান থেকে এই রাজ্যর চাষিরা ৩০০ রকম দেশি ধানের বীজ পেতে পারেন।
৮) আমাদের দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের সংগে তাল মেলাতে পারে এমন কোনও ক্রপ অ্যাডভাইসারি সিস্টেম নেই। সেই এক মৌসম ভবন থেকে জারি হওয়া বর্ষার গতিপ্রকৃতি নির্ভর ও আঞ্চলিক কৃষি অধিকর্তার অফিস থেকে রেডিও ও টিভি মারফত প্রচারিত কৃষিকথার আসর। ‘মেঘদূত’ বলে একটি কৃষি ভিত্তিক অ্যাপ কৃষি ও আবহাওয়া দপ্তর মিলে করেছে, তবে সমস্যা আছে আর খুব কম ব্যবহার হয়, কারণ কেউ কৃষককে এসব বলেই না। এর ফল কী হয়েছে আমরা জানি, পরিবেশ জনিত সমস্যা তো আছেই, কখনও খরা ও কখনও অতিবৃষ্টি কোন কিছুর সাথেই কৃষি উপদেশ খাপ না খাওয়ার ফলে, হয় কৃষক ভাল ভাবে চাষ করতেই পারছে না, নয়তো এত উৎপাদন হচ্ছে যে দামও পাচ্ছে না। এর সমাধানে চাই এলাকা ভিত্তিক এমন এক ব্যবস্থা যা লোকেশন, লোকাল মাটির বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া, বাজার এসব বিচার করে ক্রপ ক্যালেন্ডার, ক্রপ সাজেশন, বেস্ট প্র্যাকটিস সাজেশন দেবে। আজকের উন্নত স্যাটেলাইট পরিসেবা আর আইটির যুগে মোবাইল ফোনের উপর নির্ভর করে এই টেকনোলজি তৈরি করা এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। চাইলে ওই ফোনগুলিও সরকার কৃষকদের কম পয়সায় বা ধারে দিতে পারে। এই ব্যবস্থা জল, পরিবেশ ও অর্থনীতি সবই রক্ষা করতে পারে।
৯) জলাভূমির ক্ষয় জলসঙ্কট ও বন্যা এই উভয়েরই বড় কারণ। জলাভূমি সংস্কার করে সেই জল ফিলট্রেশন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে সাব সয়েলে পাঠিয়ে ভূগর্ভস্থ জলস্তর বৃদ্ধি করা সম্ভব, এই প্রক্রিয়াকে ম্যানেজড অ্যাকুফায়ার রিচার্জিং বলা হয়। আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বহু অংশে এটা করা হয়েছে ও তা খুবই সফল। কোনও কারন নেই কেন এই প্রকল্পগুলি গ্রামীণ রোজগার পরিকল্পনায় এনে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা যাবে না এ দেশে। এমন কি মহারাষ্ট্রে মতো রাজ্যেও এই কাজ কিছু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই রাজ্যের ‘জল ভরো জল ধরো’ প্রকল্পের দিশাও এইদিকে যাওয়া দরকার
১০) আমরা যদি জলাভূমিকে ব্যবহার করে প্রচুর নতুন বিকল্প কর্মসংস্থান এর পরিকল্পনা করি তাতে জলভূমিও রক্ষা পাবে ও মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে। স্বাভাবিক ভাবে জলাভূমি মাছ, মাখনা, সিঙ্গারা বা পানিফল, পদ্ম, হোগলা এসব এমনিতেই দেয়। বিজ্ঞানকে আরেকটু কাজে লাগিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি ভাসমান সবজি বাগান যার তলায় থাকবে মাছের ঝোলানো খাঁচা (বা খাঁচা যেখানে করা যাবে না সেখানে জলাশয়েই বা পুকুরেই মাছ চাষ হবে)। নিচু জমির ক্ষেত্রে মাছ ও দেশি নিচু জমির ধান চাষ, পুকুরের আলে সবজি ও ফল চাষ ও পুকুরে মিশ্র পোনা মাছের চাষব্যবস্থা জলসম্পদে পরিপূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির ভোল বদলে দিতে পারে।
১১) আমরা যদি এমন কোনও সুস্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধি (আরটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) চাষিকে মাটি, এলাকা, বাজার ফলনকারি আর পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে বলে দেবে সে কী ফলাবে, আর তার সাথে তৈরি থাকে এমন কৃষি সমবায়ের বা চাষিদের জোট যারা সরাসরি ক্রেতার কাছে নিয়ে যাবে ফসল, দেশে ও বিদেশে, তবে চাষি অধিক মূল্য পাবেন।
পরিশেষে: উন্নয়ন তখনি সম্ভব যখন আমরা দু’পায়ে হাঁটতে শিখব। আর এই দু’পায়ে হাঁটার বিদ্যা কিন্তু আমাদের দিয়ে গেছেন একজন গুজরাটি উকিল যার ১৫০ তম জন্মদিন আমরা সবে ঢাকঢোল বাজিয়ে পালন করে উঠেছি। অথচ যে অহিংস উন্নয়নের কথা বলে গিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যা ভারতে“গ্রাম স্বরাজ” আনবে তা নাথুরামের বুলেটে শুধু নয় — টাটা, বিড়লা, আম্বানি, আদানির মোটর, সিমেন্ট, সুতো, চিনিকল আর অধুনা অ্যাগ্রো মার্টের চকচকে উন্নয়ন ও মুনাফার সিন্দুকের তলায় চাপা পড়েছে বা যেতে চলেছে। ভারত, তার প্রকৃতি, জল, জমিন ও সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে গেলে সেই গ্রামস্বরাজের চরকা আমাদের কাটতে হবে। অন্য কোনও বিকল্প নেই। আমরা বাঁচব, বাঁচাব নাকি বসে বসে ধ্বংস দেখব ও মৃত্যুর দিন গুনব তা শুধু এখন আমাদেরই হাতে।
লেখক একজন পরিবেশবিদ। মতামত নিজস্ব।
লেখাটি লেখকের গাংচিল পত্রিকার জল সংখ্যায় প্রকাশিত মূল লেখার পরিমার্জিত রূপ।
Important article. Raises crucial issues relevant in this time too. Needs to be shared widely. English version needed.