‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ভ্যাকসিন  


  • January 14, 2021
  • (0 Comments)
  • 1482 Views

ভ্যাকসিন এখন সোনার খনি, অতএব সমাজে থাকতে গেলে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে পরোক্ষভাবে আমাকে বাধ্য করা হতে পারে একটি ভ্যাকসিন কিনতে এবং সেই ভ্যাকসিন আমার শরীরে প্রয়োগ করতে যার সম্পর্কে আমার কোনো আস্থা নেই, আতঙ্ক রয়েছে। লিখেছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র

 

 

আমরা অসংখ্য প্রাণঘাতী বীজাণু দিয়ে ঘেরা। যখন একজন মানুষ এই ধরনের কোনো ক্ষতিকর অর্গানিজমের সংস্পর্শে আসে অথবা সংর্ঘষে আসে, সে অসুস্থ হয়। সে অসুস্থতায় তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এইসব প্রাণঘাতী অর্গানিজমকে বলা হয় প্যাথোজেন। তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রকৃতি মানুষের শরীরে কতগুলি সুরক্ষা প্রক্রিয়া তৈরি করেছে। মানুষের ত্বক, মিউকাস জাতীয় ফিজিক্যাল বাধা প্যাথোজেনগুলিকে শরীরে প্রবেশ করতে দেয় না। তবুও যদি কোন প্যাথোজেন শরীরে প্রবেশ করে এবং শরীরকে সংক্রামিত করে, তখনি আমাদের শরীরের সুরক্ষা প্রক্রিয়া (যাকে বলি ইমিউন সিস্টেম) সেটি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সে প্যাথোজেনকে আক্রমণ করে, ধ্বংস করে, অথবা ওভারকাম করে। প্যাথোজেন হচ্ছে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইট, ফাঙ্গাস জাতীয় অর্গানিজম। প্রত্যেক প্যাথোজেনের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, যে কারণে তারা আলাদা আলাদা রোগ সৃষ্টি করে।

 

প্যাথোজেন-এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় অ্যান্টিজেন, যা কিনা ঘাতক। আবার শরীরে অ্যান্টিজেন তৈরি  হলেই শরীর সৃষ্টি করে  অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি। যা আমাদের ইমিউন সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যখন মানুষের শরীর প্রথমবার কোনো অ্যান্টিজেনের মুখোমুখি হয়, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাড়া দিতে সময় নেয় এবং অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে। এই সময়েই আক্রান্ত মানুষের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা। একবার অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি প্রস্তুত হয়ে গেলে তারা বাকি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে একযোগে সেই প্যাথোজেনকে ধ্বংস করতে এবং অসুস্থতার সংক্রমণ রোধ করতে চেষ্টা করে। কোনও একটি স্পেসিফিক প্যাথোজেনের জন্য প্রস্তুত অ্যান্টিবডি সাধারণত অন্য প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে শরীরকে রক্ষা করতে পারে না, যদি না এই দুটি প্যাথোজেন একে অন্যের খুব কাছাকাছি হয়। বংশগতভাবে এক ও আকৃতিগতভাবে কাছাকাছি। একবার যদি শরীর অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে, কোনও একটি অ্যান্টিজেনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, তখন সেই অ্যান্টিবডি মেমোরি সেল তৈরি করে, যা সেই প্যাথোজেন ধ্বংস হওয়ার পরেও বেঁচে থাকে।

 

ভ্যাকসিন হচ্ছে দুর্বল অথবা নিষ্ক্রিয় প্যাথোজেনের অতি ক্ষুদ্র অংশ, একটি পার্টিকুলার অ্যান্টিজেন অথবা তার ব্লুপ্রিন্ট। যাতে শরীরে এই দুর্বলতর ভার্সন কোনো অসুস্থতা সৃষ্টি না করেই শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেমকে সক্রিয় করে, মেমোরি সেলগুলিকে প্ররোচিত করে অ্যান্টিবডি তৈরি  করতে, প্যাথোজেনকে ধ্বংস করতে। ভ্যাকসিন স্বাভাবিক প্রত্যাশা অনুযায়ী সেই নির্দিষ্ট অসুখকে হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করবে। কিন্তু সবার পক্ষে ভ্যাকসিন নেওয়া সম্ভব নয়। যে সব মানুষের স্বাস্থ্য দুর্বল, তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল (যেমন ক্যান্সার অথবা এইচআইভি রোগীর ক্ষেত্রে) অথবা যাদের সাংঘাতিক এলার্জি আছে ভ্যাকসিনের কোনও কোনও উপাদানে, তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এই মানুষগুলি তবুও সুরক্ষিত থাকবে যদি তারা অন্যদের মধ্যে বাস করে, যারা ভ্যাকসিন নিয়েছে। আক্রান্ত মানুষের শরীরের ভাইরাস যেভাবে ক্রিয়াশীল, ভ্যাকসিনও ঠিক সেভাবেই কাজ করে, আরেকটু নিরাপদ পদ্ধতিতে। যখন একটা কমিউনিটির প্রচুর সংখ্যক মানুষের শরীরে আক্রান্ত হয়ে বা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে, অ্যান্টিজেন তৈরি হয়, তার প্রতিরোধে জন্মানো অ্যান্টিবডি আর মেমোরি সেল সেই কমিউনিটিতে সুরক্ষা বলয় তৈরি  করে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ, যাদের সঙ্গে প্যাথোজেনের সংঘাত হবে, তারা প্রতিরোধ সক্ষম। একে বলে হার্ড ইমিউনিটি। হার্ড ইমিউনিটিই মানুষকে প্যাথোজেনের বিরুদ্ধ প্রকৃত সুরক্ষা দিতে পারে। এই হলো মোদ্দা কথায় ভ্যাকসিনের বিজ্ঞান।

 

কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়া কোভিড-কালে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানও বড় বেশি মাত্রায় ক্রিয়াশীল। আপাতত বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে মিলিত ভাবে সিরাম কোম্পানি ভারতে তাদের কারখানায় এই ভ্যাকসিনের উৎপাদন করছে ব’লে তাকে ভারতীয় ভ্যাকসিন বলার কোনও কারণ নেই, যেটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী করছেন। ভারত বায়োটেকের থার্ড ফেজ ট্রায়ালের রিপোর্ট কোনও সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত হয়নি তবুও তারা অনুমোদন পাচ্ছে তাদের ভারতীয়ত্বের জন্য। অর্থাৎ মোদির “মেক ইন ইন্ডিয়া” স্লোগানের যথার্থতা প্রমাণ করার খেসারত দিতে হতে পারে ভারতবর্ষের মানুষকে। সারা পৃথিবীতেই বহু চিকিৎসক এই ধরনের প্রচেষ্টায় যথেষ্ট আস্থাশীল নয়, সন্দেহমুক্ত নয়। অতীতে বহু ড্রাগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, যেগুলি অনুমোদিত হয়েছিল সেগুলোকে পরে রেগুলেটরি অথরিটি তুলে নিচ্ছেন, তার কারণ তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনেক পরে দেখা গিয়েছে। মনে রাখতে হবে পরবর্তী সময়ে যদি দেখা যায় যে ভ্যাকসিন বা ওষুধের কোনও কুফল দেখা যাচ্ছে, তাহলে সেই ভ্যাকসিন বা ঔষধ ফিরিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু তার যে কুফল ঘটে গেছে তা আর ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে দাবি উঠতে শুরু করেছে, প্রথম, সরকার ডাক্তার অথবা রোগীকে কোনোভাবেই বাধ্য করবে না ভ্যাকসিন নিতে, যদি তারা নিজেরা কনভিন্সড না হয়। এক্ষেত্রে নাগরিক অধিকারকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি অনুমোদিত ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয় তখন ফ্রি ইন্সুরেন্স স্কিম চালু করা উচিত, যাতে পরবর্তী সময়ে কোনও কুফল নজরে এলে, আক্রান্ত মানুষ তাদের অন্তত আর্থিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারে। তৃতীয়ত সমাজের এলিট ক্লাসকে আগে প্রকাশ্যে একই ভ্যাকসিন নিয়ে প্রমাণ করতে হবে এই ভ্যাকসিন নিরাপদ। ভারত বায়োটেক, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এদের প্রত্যেকর ট্রায়াল ফেজে মানব শরীরে ভ্যাকসিনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। যার ফলে সাময়িকভাবে তাদের ট্রায়াল বন্ধও রাখতে হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছে যে গভীর অনুসন্ধানের পর তারা বুঝতে পেরেছেন যে এই ঘটনাগুলির জন্য ভ্যাকসিন দায়ী নয়। এই ব্যাখ্যাও প্রত্যাশিত। এর আগে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি দশ লক্ষে একজনের শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ধরা হতো। এক্ষেত্রে একলাখে একজন ধরা হচ্ছে। কিন্তু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ট্রায়ালে চব্বিশ হাজারে তিনজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রিটেন সাময়িকভাবে বাধ্য হয় ফাইজার-বায়োএনটেক-এর ভ্যকসিনকে ই.ইউ.এ দিতে।

 

আরেকটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য ওষুধ নেই, আবিষ্কৃত হয়নি, বারবার প্রচার করা হলেও, চিকিৎসা তো হয়েছে, হচ্ছে। তাহলে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কোভিডের চিকিৎসায় ই.ইউ.এ প্রাপ্ত যে সমস্ত ড্রাগ কোভিডের সিরিয়াস রোগীদের ক্ষেত্রে, হাসপাতালের রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে, হু জানিয়ে দিয়েছে যে সেগুলি কোনোটি প্রমাণিত ভাবে কোভিদের চিকিৎসার ওষুধ নয়। অথচ এমার্জেন্সি ইউজের জন্য সেই ওষুধ (যা আসলে অন্য রোগের ওষুধ) কোভিডের রোগীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। একটা সময়ে মানুষ বলতে শুরু করেছিল যে হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে বাড়িতে থাকা অনেক কম বিপজ্জনক। যিনি কোভিড আক্রান্ত, তিনি হাসপাতাল বেশি করে আক্রান্ত হবেন এরকম তো কোনো সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে এই ভীতি সঞ্চারিত হয়েছিল কেন? ওষুধ নির্বাচন সংক্রান্ত নির্দেশনামা আসে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে, কোম্পানির নিজস্ব গবেষকদের কাছ থেকে, বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছ থেকে। সিদ্ধান্ত নেয় রাজনৈতিক নেতারা। ফলে কোভিড রোগীর ওপর পরীক্ষামূলক ওষুধ প্রয়োগের জন্য কত জনের মৃত্যু হয়েছে সেই হিসেব জানা যাবে না কোনোদিনও। শেষ কথা হলো এই যে, ভ্যাকসিন নেব কি নেব না এই অধিকার জনগণের থাকবে কি থাকবে না, সেটা শুধুমাত্র আইনের উপর নির্ভর করে না। সমাজে বাস করতে গেলে ভ্যাকসিন না নিলে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী  আমাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে প্ররোচিত করতে পারে অন্যদের। ভ্যাকসিন এখন সোনার খনি, অতএব সমাজে থাকতে গেলে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে পরোক্ষভাবে আমাকে বাধ্য করা হতে পারে একটি ভ্যাকসিন কিনতে এবং সেই ভ্যাকসিন আমার শরীরে প্রয়োগ করতে যার সম্পর্কে আমার কোনো আস্থা নেই, আতঙ্ক রয়েছে।

 

  • লেখক কবি প্রাবন্ধিক।মতামত লেখকের নিজস্ব।

 

Share this
Leave a Comment