এই যে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন নিয়ে, তার বাজারি কলহের ফলে কোভিড আতঙ্কের চেয়েও বেশি হয়ে উঠছে ভ্যাকসিনের আতঙ্ক। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে কোভিড ভ্যাকসিনের বাণিজ্য বিস্তার। একটিমাত্র ভ্যাকসিন নির্মাণের কথা কেউ ভাবছে না। প্রত্যেকেই ভাবছে যে, কোটি কোটি টাকা এই দ্রুত উৎপাদনের কাজে ব্যয় করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ তিনগুণ চতুর্গুণ টাকা দ্রুত তুলে নিতে হবে। লিখেছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র।
ভারতে আপাতত দুটি ভ্যাকসিনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের জন্য। সেই দুটি ভ্যাকসিন বাছাই এবং সুপারিশ করেছে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি, যে কমিটির বিশেষজ্ঞ তালিকা কিছুতেই আমাদের হাতে এসে পৌঁছচ্ছে না। জানি না এই বিশেষজ্ঞ কারা ( অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদী হবেন এই বিশেষজ্ঞ কমিটিরও প্রধান। রাডার, প্লাস্টিক সার্জারি, মঙ্গল অভিযানে তাঁর ‘সুচিন্তিত’ মতপ্রকাশ এই ধারণাকে পুষ্ট করেছিল। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেই ‘রণবাদ্য বাজিয়ে’ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা ‘নয়’ এর আলোয় করোনা সংহার, হেলিকপ্টার থেকে ‘পুষ্পবৃষ্টির’ পর, তিনি ‘লকডাউন-আনলক’ এবং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ভ্যাকসিন ছাড়া অন্য বিষয়গুলিতে তিনি একধরণের নিস্পৃহতাই প্রদর্শন করছেন)। এদেশে অনুমোদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন প্রথমে কিন্তু খোদ ব্রিটেনে সরকারের অনুমোদন পায়নি। পেয়েছিল ফাইজার-বায়োএনটেক-এর ভ্যাকসিন, যা আমাদের দেশে তালিকার তৃতীয় স্থানে চলে গেছে। মাঝখানে ঢুকে পড়েছে কোভ্যাক্সিন, যারা সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের ভাইরোলজিস্টদের ভুরু কুঁচকে দিয়েছে। কারণ ভারত বায়োটেক-এর ভ্যাকসিনের তৃতীয় ট্রায়ালের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি কোনও সায়েন্টিফিক জার্নালে। তবুও তারা অনুমোদন পাচ্ছে তাদের ভারতীয়ত্বের জন্য। অর্থাৎ মোদীর “মেক ইন ইন্ডিয়া” স্লোগানের যথার্থতা প্রমাণ করার খেসারত দিতে হতে পারে ভারতবর্ষের ১৩০-৪০ কোটি মানুষকে। এবং এই যে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন নিয়ে, তার বাজারি কলহের ফলে কোভিড আতঙ্কের চেয়েও বেশি হয়ে উঠছে ভ্যাকসিনের আতঙ্ক। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে কোভিড ভ্যাকসিনের বাণিজ্য বিস্তার। একটিমাত্র ভ্যাকসিন নির্মাণের কথা কেউ ভাবছে না। প্রত্যেকেই ভাবছে যে, কোটি কোটি টাকা এই দ্রুত উৎপাদনের কাজে ব্যয় করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ তিনগুণ চতুর্গুণ টাকা দ্রুত তুলে নিতে হবে। কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে বিজনেস রাইভ্যালরি কোথায় পৌঁছতে পারে তার প্রমাণ কোভ্যাক্সিনের অন্যতম প্রতিযোগী অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড যাদের সঙ্গে কোলাবরেশনে উৎপাদনের কাজটা করছে, সেই সিরাম-এর সিইও অদার পুনাওয়ালা নিজেদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনকে নিরাপদ বলে শংসাপত্র দেওয়ার পাশাপাশি অন্য ভ্যাকসিনগুলিকে, বিশেষত কোভ্যাক্সিনকে বলছেন জলের মতো নিরাপদ। যার অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায় কোভিশিল্ড বাদে যে সব ভ্যাকসিন অনুমোদন পাচ্ছে, তা আসলে পরিশ্রুত জলের বেশি কিছু নয়। অনুমোদিত ভ্যাকসিনের তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রয়া থাকতে পারে, দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রতিক্রয়া ঘটতে পারে, এবং যার প্রকাশ এই মুহূর্তে না-ই হতে পারে। হয়তো আরো বেশ কয়েক বছর বাদে তা প্রকাশ পাবে। অথবা এও হতে পারে, যে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, তার ভালো করা বা খারাপ করার কোনও ক্ষমতাই নেই। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরেও কোভিড প্রতিহত না হলে বলার সুযোগ রইল যে ‘১০০% কার্যকর হবে তো বলা হয়নি’। যেমন কোভিশিল্ডের কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে ৬২-৯০ শতাংশ, এক বিস্তৃত রেঞ্জ। বোঝো ঠ্যালা।
ভ্যাকসিন বললে অবশ্য কিছুই বোঝা যায় না। কোনটা কী ধরণের ভ্যাকসিন এটা বোঝাও জরুরি। এখানে ভুল বোঝার কোনও অবকাশ নেই যে আমি অনধিকার চর্চা করছি। যে কোনও জনস্বার্থে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে (“হু”-এর প্রচার সহ) যা বলা আছে, আমি তারই নির্যাস বলছি মাত্র। ভ্যাকসিন সংক্রান্ত ল্যান্ডস্কেপ ডকুমেন্টে “হু” দেখিয়েছে কমপক্ষে দশ ধরনের পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে ভ্যাকসিন। যেমন বেইজিংয়ের বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সিনোভ্যাক একটি ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিনের নির্মাতা যার নাম করোনাভ্যাক। এতে নিষ্ক্রিয় বা মৃত ভাইরাস পার্টিকল ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে এই ভাইরাসের সামনে উন্মোচিত করে, যদিও সেখানে সিরিয়াস অসুখের রেসপন্সের ঝুঁকি থাকে না। এর সঙ্গে তুলনা করতে হবে মডার্না বা ফাইজার ভ্যাকসিনের, অর্থাৎ পাশ্চাত্যে নির্মিত (সাধারণতঃ এম.আর.এন.এ) ভ্যাকসিনের, যেখানে জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাল ভেক্টর বা করোনা ভাইরাসের জেনেটিক কোডের একটি অংশ শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, যা শরীরে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করতে সাহায্য করে। প্রথমটি একটি ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি যা কিনা সাকসেসফুলি ব্যবহার করা হয়েছে বহু পরিচিত ভ্যাকসিন এর ক্ষেত্রে (যেমন রাবিস ভ্যাকসিন)। দ্বিতীয়টি একটি নতুন পদ্ধতির ভ্যাকসিন (বলা হচ্ছে বেশি আধুনিক ও বেশি কার্যকরী) এবং মানুষের মধ্যে কোনো সফল প্রয়োগের উদাহরণ নেই। সিনোভ্যাকের বড় সুবিধা হচ্ছে যে এটিকে সাধারণ রেফ্রিজারেটরে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে স্টোর করা সম্ভব, যেমন অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সম্ভব বলে দাবি করা হচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আবার জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়র্ড ভাইরাস (যা শিম্পাঞ্জির মধ্যে কমন-কোল্ড সৃষ্টি করে, সেই ভাইরাস) ব্যবহার করে। মডার্নার ভ্যাকসিন মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্টোর করতে হয়, যেখানে ফাইজারের ভ্যাকসিন স্টোরেজের জন্য প্রয়োজন মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর অর্থ উন্নয়নশীল দেশ, যারা বিপুলসংখ্যক ভ্যাকসিন এত কম টেম্পারেচারে সংরক্ষণ করতে অক্ষম, সেখানে সিনোভ্যাক বা অক্সফোর্ড কার্যকরী হতে পারে। দামের দিক থেকে দেখতে গেলে এখনও বোঝা যাচ্ছ না কোনটির দাম কত হবে। তবে বলা হচ্ছে যে স্থানীয়ভাবে সিনোভ্যাকের দাম পড়বে দুই ডোজে প্রায় দুই হাজার টাকা, যেখানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের দাম দুই ডোজে চার-পাঁচশো টাকার মতো। কিন্তু বেসরকারি দাম পড়বে প্রতি ডোজ হাজার টাকা। অর্থাৎ হরেদরে প্রায় একই দাঁড়াল। মডার্নার ভ্যাকসিনের দাম দুই হাজার চারশো বাইশ, আর ফাইজারের দাম পড়বে প্রতি ডোজ চোদ্দশো আটষট্টি আর রাশিয়ার গামালেয়া (স্পুটনিক-৫) এর দাম প্রতিটি এগারোশো টাকা করে। এরই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির দৌড়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চিনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং আফ্রিকা মহাদেশের জন্য দুই বিলিয়ন ডলার এবং লাতিন আমেরিকা আর ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জন্য জন্য এক বিলিয়ন ডলার সফ্টলোন ধার্য করেছেন, ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য। কিন্তু ভ্যাকসিনের দাম নিয়ে দরাদরি এবং অন্যান্য টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন এখনও পরিষ্কার নয়।
অতএব শুধুমাত্র ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এখানে বিবেচ্য নয়। জনগণের সুরক্ষাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। কোভিড অর্থনীতি, ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির মতো অনেক কিছুই এখানে বিবেচ্য। এমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশন (ইইউএ) অর্থাৎ জরুরি প্রয়োগের জন্য অনুমোদনের ক্ষেত্রে দামের প্রশ্নটি কোভিশিল্ডের পক্ষে গেছে এমন বলা হচ্ছে। হাজার টাকা করেও যদি হিসেব করা হয়, তাহলে দুই ডোজের জন্য প্রত্যেকের খরচ পড়বে দুই হাজার টাকা। ভারতের ১৩০-৪০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র তিন কোটি ফ্রি ভ্যাকসিন পাবে বলে আপাতত স্থির হয়েছে। দেশে সব মানুষকে ভ্যাকসিন দিলে শুধু ভারতে ভ্যাকসিন বাণিজ্য হবে সরকার কিনলে প্রায় পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর হাজার কোটি টাকা আর বেসরকারি ভাবে কিনতে হলে দুই লক্ষ ষাট থেকে দুই লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকা। প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়ানো অর্থনীতির দেশে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আসবে কোত্থেকে? মনে রাখতে হবে সরকার এই ভ্যাকসিন মুফতে দেবে নাকি জনগণকে পয়সা খরচ করে কিনতে হবে সেই বিতর্ক অর্থহীন। তার কারণ সরকার যে টাকা ভ্যাকসিন কেনার জন্য খরচ করবেন সেটাও আসলে জনগণেরই ট্যাক্সের টাকা। অর্থাৎ জনগণ তার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ট্যাক্স দিচ্ছেন, আবার তাঁরাই আত্মরক্ষার জন্য হয়তো আরো টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন কিনবেন। এই গোটা প্রক্রিয়ায় যে বিপুল টাকার এদিক-ওদিক হবে, সেই কাটমানির ভাগ কোথায় কোথায় যাবে, সেটা এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি।
“হু” জানিয়ে দিয়েছে যে তারা এই ল্যান্ডস্কেপ ডকুমেন্টগুলি শুধুমাত্র নভেল করোনভাইরাস সম্পর্কিত তথ্যের জন্য তৈরি করেছে। এই ল্যান্ডস্কেপ নথিগুলির মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট পণ্য “হু” দ্বারা অনুমোদিত হিসাবে বিবেচিত হবে না। ল্যান্ডস্কেপ ডকুমেন্টগুলিতে সরবরাহিত কোনও তথ্য এবং/অথবা এতে উল্লিখিত পণ্যগুলির সংগ্রহ, বিতরণ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বা এর সাথে সংযুক্ত হতে পারে এমন কোনওরকম মৃত্যু, প্রতিবন্ধী হওয়া, আঘাত, যন্ত্রণা, ক্ষতি, বা অন্য যে কোনও দায় এবং দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে এই ল্যান্ডস্কেপ নথি। “হু” তো হাত তুলে নিল, এবার সরকার বা অনুমোদনকারী সংস্থা কী করে সেটাই দেখার।
- লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক। মতামত লেখকের নিজস্ব।