কৃষকদের কাছে কি পৌঁছনো গেল? আগ্রহী করে তোলা গেল কৃষি আইন বিষয়ে? মঞ্চের তরুণ নেতৃত্বের অন্যতম, মহম্মদ রিপনের মতে, যতটা আশা করেছিলেন প্রাপ্তি তার থেকে বেশিই। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
ক্ষোভ আছে চাষির। তাঁর আঁচ পাওয়া গেল। কিন্তু, সে আঁচের দগ্ধানোর ক্ষমতা কতটুকু তার গভীরতার নাগাল পাওয়া গেল না। তিনটে দিন দুটো রাত হাওয়া মোরগের মতো ‘অন্নদাতা’দের কাছে ঘেঁষার সৌভাগ্য হল মাত্র। এক মঞ্চে। পাশাপাশি বিছানায়। ডাল-ভাত-সব্জি কিংবা রুটি-তরকার আস্বাদে। দফায় দফায় চায়ে। কিন্তু হাওয়া মোরগ কি ঝড়ের গতি, ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা, বিপদ-আপদ বোঝাতে পারে? তার ল্যাজে হাওয়া লাগলে দিক পরিবর্তন করে জানাতে পারে হাওয়ার গতিপথ। সেও কম কথা নয় যদিও। কিন্তু, কখনও সেই হাওয়া মোরগেরও যদি ইচ্ছে জাগে — ঝড়ের চোখে চোখ রাখবে, তার লেজের ঝাপটের হিসেব কষবে, মাপ নেবে গতির, প্রকৃতির? তখন?
তখন কীভাবেই-বা সে খুঁজে পাবে ঝড়ে পাওয়া মানুষগুলোকে? পূর্বাভাসের হিসেব কষবে? হিসেব যে কষবে তার কি জানা আছে বোনা ও রোয়ার হিসেব? বীজ-সার-বিষ-জলের মূল্য কিংবা কাটা-বাঁধা-মারার হিসেব? না হলে তো কত ধানে কত চাল তার হিসেব মেলাই দুষ্কর হবে। হলও তাই। হিসেব কষার জন্য সে দুয়ারে পৌঁছন গেল না, ধান ওঠা খেত পেরিয়ে সর্ষে, সব্জির মাঠ পেরনো হল না। কিন্তু, উত্তেজনার আঁচ পোহানো গেল। এ যেন মঞ্চে চড়ে দেশ দেখা। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে রামপুরহাট মহকুমা শহরের কেন্দ্রস্থল পাঁচমাথার মোড়ে ধরনা আন্দোলন, শহর জুড়ে ট্রাক্টর র্যালির উদ্যোগ নিয়েছিল সামাজিক সংগঠন বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ। তবু, নিজস্ব আন্দোলন-ট্যুরিজমের হতাশা কাটাতে ছ’দিনের আন্দোলন থেকে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবটা বুঝতে চাইছিলাম এই মঞ্চের কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃত্ব এবং অন্যান্য উপস্থিত কৃষিজীবী মানুষদের কাছ থেকেও।
জানতে চাইছিলাম আন্দোলনের লক্ষ্য কতটা পূর্ণ হল? নতুন মানুষ, নতুন মুখ ভিন্ন ভিন্ন সমাজের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা গেল কতটা? উঠে এল কি নতুন নেতৃত্ব? এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। উত্তর এই জন্য জরুরি যে, এই যে প্রশ্ন উঠছে দিল্লির উপান্তে লক্ষ লক্ষ পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের মাঝে বাংলার কৃষকরা কোথায়? শত শত ট্রাক্টরের অভিযান দেখে কেউ কেউ মন্তব্যও করে ফেলেছেন, এ পঞ্জাবের ধনী চাষিদের আন্দোলন, কেউ তাঁদের বলেছেন ‘কুলাক’। বাংলার চাষিদের অনুপস্থিতির ওজর খুঁজে পেতে চোখের পাতা ফেলার মতো সময়ও তাঁরা নষ্ট করেননি। তাঁদের মতে ওই ধনী চাষিদের সমস্যার সঙ্গে, দাবিদাওয়ার সঙ্গে বাংলার চাষিদের নাকি কোনও মিল নেই। অনেকাংশেই মিল নেই তা ঠিক কিন্তু কোনও মিল যে নেই তাও তো নয়। যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠেছে, তা আদায় হলে তো বাংলার চাষিরাও তো লাভবান হবেন। এই সামান্য কথা বুঝতে কৃষিবিদ হতে হয় না।
কিন্তু, কৃষি আইন বিষয়ে সাধারণ ধারনা যে চাষিদেরও নেই সে তথ্যটুকু অক্টোবর মাসে বীরভূম, মালদহে প্রতিবাদী মিছিল সংগঠিত করতে গিয়েই টের পেয়েছিল মঞ্চ। সেই উপলব্ধি থেকেই রামপুরহাটে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধরনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। মঞ্চের সভাপতি সামিরুল ইসলাম জানান, “এ রাজ্যে কৃষক আন্দোলন হচ্ছিল না। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার বলে যাচ্ছে এটা পঞ্জাবিদের আন্দোলন। কিন্তু, এই আইনে যে আমাদেরও ক্ষতি হবে তা বাংলার চাষিদের বোঝানোর কেউ নেই। আমরা দেখেছি গ্রামের লোক কৃষি আইন বিষয়ে কিছুই জানেন না।”
এই কৃষকদের কাছে কি পৌঁছনো গেল? আগ্রহী করে তোলা গেল কৃষি আইন বিষয়ে? মঞ্চের তরুণ নেতৃত্বের অন্যতম, মহম্মদ রিপনের মতে, যতটা আশা করেছিলেন প্রাপ্তি তার থেকে বেশিই। তিনি জানান, “রামপুরহাট একটা স্বাস্থ্যজেলা। এখানে বহু মানুষের নিত্য আনাগোনা। এখানে আন্দোলনে বসে শহরের মানুষ, ব্যবসায়ীদের একাংশের কাছে পৌঁছনো গিয়েছে। কিন্তু, গ্রামের মানুষদের কাছে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছে।” সামিরুলের ভাষায়, “মঞ্চে যাঁরা এসেছেন। তাঁরা এখন চাইছেন বড় বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে। আমরা সে পথে অন্য জেলাতেও আন্দোলন গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
ছ’দিনের ধরনায় চাষিদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ করার মতো। তাঁদের মধ্যে চাষবাসের সমস্যা নিয়ে, চাষের উপাদান আর বিদ্যুৎ, বোরোর সেচের জলের দামের বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভ রয়েছে নির্ধারিত মূল্যে সরকারের ধান কেনার পদ্ধতি নিয়েও। একে তো খুব কম চাষিই ধান বিক্রির টোকেন পান। সেই টোকেনও অনেক সময় হস্তগত করে ফেলেন নেতারা। আবার টোকেন পেলেও অপেক্ষা করতে হয় চার-পাঁচ মাস। ধান বিক্রি করে সে টাকা পরবর্তী ফসলের জন্য খাটানোর উপায় থাকে না। ফলত, সরকার কুইন্টাল প্রতি ১৮৬৫ টাকা দর দিলেও আড়তদারের কাছে ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা কুইন্টালে বিক্রি করে দিতে হয় সিংহভাগ চাষির।
মুরারইয়ের দাঁতুরা গ্রামের শের জাহান হোসেন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বীজ-সার-জল-ডিজেলের দাম বেড়েই যাচ্ছে। সেই তুলনায় ফসলের দাম বাড়ছে না।” তাঁর প্রশ্ন, “প্রত্যেক মালের দাম উৎপাদক ঠিক করে, আমি ফসল ফলাই আমি কেন দাম ঠিক করতে পারব না?” তাঁর দাবি, ফসলের ন্যায্য মূল্য। কৃষি সংস্কার, নয়া কৃষি আইন নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত শের জাহান বলেন, “আমি ছোট চাষি। দেড় একর জমি। ফসল কেনা, মজুত করা সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেলে আমাকে দাস হয়ে থাকতে হবে। ওদের ইচ্ছে মতো চলতে হবে।” ভয়ও দেখালেন তিনি। যখন বললেন, “আমরা তো তবু ফসল ফলিয়ে কিছু খেতে-পরতে পাব। কিন্তু, আপনারা? লকডাউনের সময় আলু-পেঁয়াজ, তেল-ডালের দাম কত বাড়ল। সরকার কিছু করতে পারল? এর পর আইন হলে মজুত এমন বাড়বে শহরের লোক তো কিনে খেতে পারবে না।”
মহকুমা শহরের ধরনা থেকে এবার ‘গ্রামে চলো’ কর্মসূচি নিতে চলেছে মঞ্চ। এর পিছনে রয়েছে গ্রাম থেকে আসা মানুষদের আগ্রহ। ট্র্যাক্টর র্যালির সাফল্য। রামপুরহাট, মুরারই, ময়ুরেশ্বর, মহম্মদবাজার, ধূলিগ্রাম থেকে ট্র্যাক্টর নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন চাষিরা। জেলার দলিত কিংবা আদিবাসী নেতৃত্বকে বড় সময় ধরেই দেখা গেছে মঞ্চে। সুদীপ দাস, রাজকুমার ফুলমালি কিংবা গৌতম মুদিরা তাঁদের অন্যতম। এবার স্বেচ্ছাসেবীদের, সদস্যদের গ্রামে পাঠাতে চাইছে মঞ্চ। প্রশ্ন হল, কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার চাষিদের যুক্ত করার পাশাপাশি এ রাজ্যের নিজস্ব সমস্যা, চাষিদের সরকারি ভর্তুকি, ঋণ, বাজারের সমস্যা সমাধানের পথ কি খুঁজবে মঞ্চ? দীর্ঘ উপেক্ষা আর ঔদাসীন্য পেরিয়ে চাষির কাছে পৌঁছলে তিনি তো তাঁর নিজের কথাই বেশি করে বলতে চাইবেন। সে কথা ধৈর্য ধরে শোনা, তা লিপিবদ্ধ করার কাজটাও শুরু করা জরুরি। মঞ্চের ব্রতীরা সকলেই গ্রামের ছেলে-মেয়ে। প্রায় সকলেই কৃষিজীবী পরিবারের মানুষ। এই গভীর সঙ্কটে তাঁদের কাছে আশাও তাই অনেক।
- লেখক সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।